২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দেশের চলমান বাস্তবতায় গণ-অভ্যুত্থানের ভাবনা

দেশের চলমান বাস্তবতায় গণ-অভ্যুত্থানের ভাবনা - নয়া দিগন্ত

বছর ঘুরতে চলল দেশের আর্থ-রাজনৈতিক অবস্থা ক্ষমতাসীনদের তেমন অনুকূল নয়। বলা চলে প্রতিকূলে। অর্থনীতি ও রাজনীতি উভয় ক্ষেত্রে দেশে অস্থিরতা বিরাজ করছে। গণ-অসন্তোষ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। কিছু দিনের মধ্যে চরম আকার ধারণ করলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
সঙ্কটের জট খোলার আপাতত কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এমন বাস্তবতায় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিপরীতমুখী অবস্থানে। বাকি দলগুলোও রাজনৈতিক দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে যার যার সুবিধামতো কর্মকাণ্ডে আবর্তিত হচ্ছে। নিক্তির নিরিখে সরকারবিরোধী শিবিরের পাল্লাটা একটু ভারী বলে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন।

দেশে রাজনৈতিক বিভাজন যেন অলঙ্ঘনীয়। রাজনৈতিক অস্থিরতার পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নেই। নাজুক। সরকারের অপ্রতিহত উন্নয়নের বয়ান আর ধোপে টিকছে না। অর্থনৈতিক সঙ্কট ঢেকে রাখা যাচ্ছে না। যদিও শাক দিয়ে মাছ ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টার কমতি নেই। এরপরও ব্যর্থতা জনসম্মুখে উদোম হয়ে ধরা দিচ্ছে। অর্থনীতির করুণ হাল স্পষ্ট। দৃশ্যমান। সাধারণ মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছেন।

গত বছরের মাঝামাঝি থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আকাশছোঁয়া। সব কিছু উচ্চমূল্যে স্থিতিশীল। মূল্যস্ফীতির কারণে হু হু করে বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম। ফলে সব জিনিস সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। কোনোভাবে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানা যাচ্ছে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম যে কতটা লাগাম ছাড়া, একটি তথ্যে তা স্পষ্ট হবে; গত ১১ বছর ৭ মাসের মধ্যে গেল আগস্টে দেশে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতির হার ছিল সর্বোচ্চ ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ।

পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না সরকার। বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারের অসহায়ত্ব উৎকটভাবে ধরা পড়ছে। সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে সরকার। পণ্যের দাম বেঁধে দিয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না। বাজারে ওই সব জিনিসও বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। মোদ্দা কথা, মুষ্টিমেয় মানুষ ছাড়া বাকি সবাই অর্থকষ্টে নিপতিত। সাধারণের আয় এক পয়সাও বাড়েনি। উল্টো পণ্যের উচ্চমূল্যে তাদের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। অবর্ণনীয় চাপে দিন কাটছে। যে কারণে অভূতপূর্ব উন্নয়নের বয়ান ফুটো হয়ে আকাশ থেকে মাটিতে আছড়ে পড়েছে। সরকারের কেউ এখন আর উন্নয়নের গল্পগাথা পারতপক্ষে বলেন না।

নাগরিক দুঃখ-কষ্ট নিয়ে জনবান্ধবহীন সরকারের মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। জবাবদিহিশূন্য একটি সরকারের কাছে বেশি কিছু আশা করা বাতুলতা মাত্র। এই বাস্তবতায় সাধারণত সাধারণ মানুষ ক্ষমতাসীনদের প্রতি চরম ক্ষুব্ধ হওয়ার কথা। সেটা হওয়াই স্বাভাবিক। তার পরও তারা সরকারের বিরুদ্ধে গণহারে রাস্তায় নামছেন না কেন? অথচ শ্রীলঙ্কায় রাস্তায় ক্ষুব্ধ মানুষের ঢল নামে। জনরোষে রাজাপাকসে সরকারের পতন হয়।

আমজনতার ক্ষোভের বিষয়টি টের পাওয়া যায় সোশ্যাল মিডিয়ায়, তাদের স্ট্যাটাসে, গণপরিবহনে যাত্রীদের আলাপচারিতায়। আঁচ করা যায় সরকারের প্রতি তারা কত ক্ষুব্ধ। সীমিত আয়ের মানুষ এখন সরকারের প্রতি চরম নাখোশ। তবে এসব যে সরকারি দল আমলে নিচ্ছে বা পাত্তা দিচ্ছে, তা-ও কিন্তু নয়। তাদের একমাত্র চিন্তা, ধ্যান-জ্ঞান কিভাবে আগামী নির্বাচনী বৈতরণী পার হবেন। পরবর্তী পাঁচ বছর ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে যারপরনাই পেরেশান। মসনদের তীব্র মোহে মোহাবিষ্ট। তবে মার্কিন ভিসানীতি কার্যকরের ঘোষণায় ক্ষমতাসীনরা একটু বেকায়দায়। দুশ্চিন্তায় কপালের বলিরেখা ফুটে উঠেছে। মুখে সেই ছাপ আর লুকাতে পারছেন না। যা তাদের সাম্প্রতিক বক্তব্য-বিবৃতিতে প্রতিফলিত হচ্ছে। আচার-আচরণ, চলনে-বলনে বিষয়টি আর ক্ষমতাসীনরা ঢেকে রাখতে পারছেন না।

অন্য দিকে মার্কিন পদক্ষেপ সরকারবিরোধীদের জন্য বাড়তি সুবিধা বয়ে এনেছে। তবু কেন দেশের আর্থ-রাজনৈতিক এমন বাস্তবতায় সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে কার্যকর গতি আসছে না? এ প্রশ্ন এখন রাজনীতিসচেতন জনমনে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। যেখানে আমজনতার ক্ষোভ শতভাগ কাজে লাগানোর কথা; সেখানে এর সদ্ব্যবহার করতে পারছে না সরকারবিরোধীরা।
আমাদের পর্যবেক্ষণ হলো, প্রথমত- বিরোধী নেতৃত্ব গণমানুষের ক্ষোভ যথাযথভাবে সরকারবিরোধী আন্দোলনে কিভাবে সংযুক্ত করবে, তার যুতসই উপায় এখনো বের করতে পারেনি। যে কারণে গণমানুষ সরকারবিরোধী আন্দোলনে যেভাবে সাড়া দেয়ার কথা; সেভাবে দিচ্ছে না। এ কথা সত্যি যে, আগের চেয়ে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলোর কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। কয়েক ঘণ্টার নোটিশে সরকারবিরোধী সমাবেশে বিপুল মানুষের উপস্থিতি তার প্রমাণ। সম্প্রতি সরকারবিরোধী আন্দোলনের পালে সাধারণের উপস্থিতি হাওয়া দিতে শুরু করেছে।

দ্বিতীয়ত, কিছু দিন আগেও বিরোধীরা ক্ষমতার পালবদলে যতটা না আগ্রহী, ওই তুলনায় জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যুতে রাস্তায় নামতে ততটা অনীহা দেখিয়েছেন। শুধু দলীয় এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠ গরমের চেষ্টা করেন। এতে জনগণের সাথে বিরোধীদের এক ধরনের দূরত্ব বা দেয়াল তৈরি হয়।

তৃতীয় কারণটি মনস্তাত্ত্বিক। বিরোধী নেতৃত্বের একটি অংশের মানসিকতা- আন্দোলনে অংশ নিলে যদি নিজের বা পরিবারের ক্ষতি হয়। ঝুঁকিতে পড়তে হয়? এ শঙ্কায় শীর্ষপর্যায়ের কিছু নেতা সরকার পতনের আন্দোলনে কতটা আন্তরিক তা প্রশ্নবিদ্ধ। মনে রাখা আবশ্যক, এ অংশটি রাজনীতিতে সিদ্ধান্তমূলক ভূমিকায় রয়েছে। তাদের মানসিকতা- তৃণমূলের নেতাকর্মী সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে সরকার পতনের আন্দোলন চূড়ান্ত পরিণতিতে আনুক। আর পরিবর্তনের সুফল ঘরে তুলবে আন্দোলনে অনুপস্থিত নেতৃত্ব। এখানে চলে আসে ভয়ের সংস্কৃতি। বিরোধী মত দমনে বর্তমান সরকার খড়গহস্ত। বেপরোয়া। এ লক্ষ্যে রাষ্ট্রযন্ত্রকে যথেচ্ছ ব্যবহার করা হয়েছে। এখনো হচ্ছে। পরিণামে বিরোধী নেতাকর্মীর মনে এতদিন ভয় জেঁকে বসেছিল। এটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যেও লক্ষণীয় মাত্রায় ছিল।

এখন বিএনপিসহ সব বিরোধী নেতাকর্মী বেরিয়ে আসতে শুরু করছেন। মূলত যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি ঘোষণার পর বিএনপি বাধানীহভাবে মাঠে সভা-সমাবেশের সুযোগ পাচ্ছে। দেশটির ভিসার বিধিনিষেধ কার্যকরের সিদ্ধান্তের পর বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো সরকার পদত্যাগের ‘একদফা’ দাবিতে কর্মসূচি দিয়ে এগোচ্ছে। এর একটা চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে চায়। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে আধিপত্য ধরে রাখার চেষ্টায় মরিয়া।
আন্দোলন চাঙ্গা করার ক্ষেত্রে বিএনপির কি অস্বস্তি ও উদ্বেগ নেই? দাবি আদায়ে সরকারের ওপর কার্যকর চাপ সৃষ্টির ব্যর্থতা দলটির নেতৃত্বের অস্বস্তির কারণ। বিএনপি নেতৃত্বকে মনে রাখতে হবে প্রকৃতি শূন্যতা মেনে নেয় না। কেউ কার্যকারিতা হারালে বা ব্যর্থ হলে অন্য কেউ এসে শূন্যতা পূরণ করে। অতএব ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক থাকতে হলে বিএনপিকে চলমান আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্যর্থতার অবকাশ নেই।

সম্প্রতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমরা রাজনৈতিক দল হিসেবে আমাদের দায়িত্ব পালন করছি। আমরা প্রায় এক বছর ধরে রাস্তায় নেমেছি, এর মধ্যে আমাদের ২২ জন তরুণ-যুবক নেতার প্রাণ গেছে রাস্তায় পুলিশের গুলিতে, অসংখ্য নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, অসংখ্য জেলে গেছেন। তারপর আমাদের কখনো দমিয়ে রাখতে পারছে না, পারবে না।’
বিএনপিসহ বিরোধীদের মনে রাখা আবশ্যক, সমাজের অধিকাংশ মানুষ দেশপ্রেমিক। সেখানে গণতান্ত্রিক চেতনার যে আকাল পড়েছে, তাও নয়। অতীতে তারা গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে; ভবিষ্যতে যে ঘটাতে পারবে না- তা মনে করার কারণ নেই। কিন্তু এই মানুষেরা বিচ্ছিন্ন ও বিপন্ন। তারা ঐক্যবদ্ধ হতে পারছেন না; তাদের ঐক্যবদ্ধ হতে দেয়া হচ্ছে না। জনগণের ভেতরকার ঐক্যের অভাবই সরকারের প্রধান ভরসা হয়ে আছে এখনো।

শেষ কথা হলো, বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী নেতাকর্মী যদি নিজেরা সব ভয়ভীতি উপেক্ষা করে মাঠে নামেন, জনগণও নিজস্ব তাগিদে শামিল হবে সরকারবিরোধী আন্দোলনে। কেবল তখনই বিরোধী আন্দোলনের সফল পরিণতি আসতে পারে। দেশের রাজনীতিতে এমন ঘটনার জন্ম দিতে হলে সরকারবিরোধী নেতৃত্বের রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়াই আসল কথা।


আরো সংবাদ



premium cement