০৪ মে ২০২৪, ২১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`


সুশাসন

নির্বাচনকালে দলীয় সরকার কেন গ্রহণযোগ্য নয়?

নির্বাচনকালে দলীয় সরকার কেন গ্রহণযোগ্য নয়? - ফাইল ছবি

বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এখন পর্যন্ত দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল বিজয়ী হয়েছে। অন্যদিকে, অন্তর্বর্তী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রতিটি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের পরাজয় ঘটেছে। দেশের বর্তমান বড় দু’টি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির একের অন্যের ওপরে অনাস্থা ও অবিশ্বাস এত বেশি যে, মূলত এ কারণে এক দল অন্য দলকে নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়।
এ বিষয়ে কোনো বিতর্ক নেই যে, নির্দলীয়, অন্তর্বর্তী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা গণতন্ত্রের চিন্তাচেতনার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ওই নিরিখে এ সরকারব্যবস্থা সংবিধানের সাথে যে সাংঘর্ষিক হবে; সে বিষয়ে অনেকে দ্বিমত পোষণ করেন না। আমাদের দেশে ১৯৯৬ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যখন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়; তখন পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এ ধরনের ব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল না। এরপর দেখা গেছে, আমাদের এ উপমহাদেশের রাষ্ট্র নেপাল ও পাকিস্তান এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত উন্নত রাষ্ট্র গ্রিস ও ইতালিতে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

বাংলাদেশে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তনের সপক্ষে যে দলটি সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ছিল, ওই দলটি একতরফাভাবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করেছে। অন্য দিকে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন পূর্ববর্তী যে দলটির অবস্থান এর বিপক্ষে ছিল, বর্তমানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল পরবর্তী এর পুনঃপ্রবর্তনে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার।

সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রবর্তিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দু’টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। উভয় নির্বাচনে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান নিযুক্ত হয়েছিলেন। ত্রয়োদশ সংশোধনীতে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবেন সে বিষয়ে পর্যায়ক্রমিকভাবে একটির পরিবর্তে অপরটি এ ধরনের ছয়টি বিকল্প ছিল। প্রথম বিকল্পটিতে বলা ছিল- অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতিদের মধ্যে যিনি সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত হয়েছেন রাষ্ট্রপতি তাকে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ করবেন। দ্বিতীয় বিকল্পে বলা ছিল- তিনি অসম্মত হলে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির অব্যবহিত পূর্বে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিযুক্ত হবেন। তৃতীয় বিকল্পে বলা ছিল- এরূপ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি না পাওয়া গেলে আপিল বিভাগের বিচারকদের মধ্যে যিনি সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি প্রধান উপদেষ্টা পদে নিয়োগ লাভ করবেন। চতুর্থ বিকল্পে বলা ছিল- এরূপ অবসরপ্রাপ্ত বিচারক না পাওয়া গেলে আপিল বিভাগের সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত অনুরূপ বিচারকের অব্যবহিত পূর্বে অবসরপ্রাপ্ত বিচারক প্রধান উপদেষ্টা পদে নিয়োগ লাভ করবেন। পঞ্চম বিকল্প ছিল- আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত কোনো বিচারককে না পাওয়া গেলে রাষ্ট্রপতি প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনাক্রমে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এমন এক ব্যক্তিকে প্রধান উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দেবেন। আর ষষ্ঠ বিকল্পে বলা ছিল- উপরোক্তভাবে প্রধান উপদেষ্টা পদে নিয়োগ না দেয়া গেলে রাষ্ট্রপতি তার নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।

অষ্টম সংসদ নির্বাচন-পরবর্তী দেখা গেল, সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের কাছে গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় এবং এর পরবর্তী বিকল্পগুলোর ব্যক্তিরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলের কাছে সমভাবে গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ষষ্ঠ বিকল্পের পূর্ববর্তী সব বিকল্প নিঃশেষিত না করে নিজ দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানরূপে আবির্র্ভূত হয়েছিলেন। ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব শেষ করার আগেই অসাংবিধানিক সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধ্য হয়েছিল। এখানে উল্লেখ্য, সংবিধানে চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অবসরের বয়স নিজ মতাদর্শের ব্যক্তিকে প্রধান উপদেষ্টা করার প্রয়াসে ৬৫ থেকে ৬৭-তে উন্নীত করা হলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে যোগ্য বিবেচিত সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি দলীয় ব্যক্তির আবরণে আবৃত হন। মূলত সে কারণে অষ্টম সংসদের মেয়াদ অবসান পরবর্তী নবম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সাংবিধানিক পন্থায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা যায়নি।

কর্মরত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত পঞ্চম সংসদ নির্বাচন ও সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত সপ্তম এবং অষ্টম সংসদ নির্বাচনের ফল বিজিত অব্যবহিত পূর্ববর্তী ক্ষমতাসীন দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। এই তিনটি নির্বাচনে বিজিত দল নির্বাচনের নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনটিও বিজিত দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি।
অন্তর্বর্তী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন বিজিত দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না এবং এসব নির্বাচন সাংবিধানিক শাসনের অন্তরায়- এ অজুহাতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ স্বীয় দলের শীর্ষ নেতৃত্বের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়িত করতে গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার বিলোপ সাধন করে দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে। যদিও বাতিল বিষয়ে আদালতের সিদ্ধান্তকে উপলক্ষ হিসেবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু ওই সিদ্ধান্ত সংসদের ওপর বাধ্যকর কিনা সে প্রশ্নটির সুরাহা যেমন জরুরি, ঠিক তেমনি এ ধরনের সিদ্ধান্ত দয়ার ক্ষেত্রে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭৮(১), ১০২(৫) এবং একজন বিচারকের স্বপঠিত শপথের কোনো ধরনের ব্যত্যয় হয়েছে কিনা এসব প্রশ্নের নিরসনও জরুরি ছিল।

দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনটি প্রধান বিরোধী দলের বর্জনের মধ্য দিয়ে একতরফাভাবে অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনটিতে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের জন্য উন্মুক্ত সংসদের ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৪টি আসনের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় এবং অবশিষ্ট আসনে প্রকৃত ভোটার উপস্থিতি নগণ্য হওয়ায় দেশের সচেতন মানুষ ও আন্তর্জাতিক মহলে নির্বাচনটি গ্রহণযোগ্য হয়নি। বাস্তব ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন, প্রহসনমূলক ও একতরফা নির্বাচনের আয়োজন করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রধান বিরোধী দল বিএনপির দাবি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হবে না- এ সত্যটি প্রমাণ করে। তাই কোনো অবস্থায় এসব আসনের নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ বলার সুযোগ নেই। একাদশ সংসদ নির্বাচনে দিনের ভোট আনুষ্ঠানিক ভোটগ্রহণের নির্ধারিত তারিখের পূর্ববর্তী রাতে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও দলীয় নেতাকর্মীদের সহায়তায় সম্পন্ন করায় যেকোনো মানদণ্ডের বিচারে এটিকে কোনোভাবে সুষ্ঠু নির্বাচন বলার অবকাশ নেই।

ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও দলীয় সরকার- এ ধরনের সরকার নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে দেশের বড় দু’টি দলের কাছে সমভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। এমতাবস্থায় এমন একটি নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারব্যবস্থার উদ্ভাবন করতে হবে যা দু’টি দলের কাছে সমভাবে ও সর্বতোভাবে দেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়।

দশম সংসদ নির্বাচন-পূর্ববর্তী অন্তর্বর্তী সরকার বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তি পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থার সুপারিশ করা হয়েছিল। সুপারিশকৃত ব্যবস্থাগুলোতে প্রধান সমস্যা হিসেবে যে প্রশ্নটি আবির্ভূত হয় তা হলো- অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানরূপে কে দায়িত্ব পালন করবেন? ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কোনোভাবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানরূপে দলীয়প্রধান শেখ হাসিনা ছাড়া অপর কাউকে মেনে নিতে অপারগ। ঠিক এমনই অপারগ ছিল বিএনপি ১৯৯৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের পূর্ববর্তী এবং এই একটি কারণে অন্তর্বর্তী সরকারব্যবস্থা কার্যকর হতে পারেনি।

পৃথিবীর অন্যান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন সরকার স্বল্প পরিসরে অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবে কাজ করে। সে সময় এ অন্তর্বর্তী সরকার কোনো নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে না। এসব রাষ্ট্রে দেখা যায়, নির্বাচন কমিশন প্রকৃতপক্ষে আস্থাভাজন ব্যক্তিদের দিয়ে পরিচালিত হয়ে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিরপেক্ষভাবে কাজ করছে।

আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য এবং প্রকৃতপক্ষে অর্থবহ করতে হলে নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠন ব্যতীত যে অন্তর্বর্তী সরকারটি গঠিত হবে তার গঠন কাঠামো বিষয়ে অতীত অভিজ্ঞতা ধারণা দেয়, অন্তর্বর্তী সরকারটির প্রধান কে হবেন- এর সুরাহা হলে অবশিষ্ট বিষয়ে কোনো মতপার্থক্য থাকে না। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানরূপে উভয় দলের যেকোনো একজন উভয় দলের কাছে যিনি গ্রহণযোগ্য হবেন না অতীত অভিজ্ঞতা আমাদের এমন ধারণা দেয়। এ বাস্তবতায় দেশের সব শ্রেণী-পেশার মানুষের আস্থাভাজন ব্যক্তিদের মধ্য থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ও সদস্যদের বাছাই করে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ও সদস্যরা নিয়োগ পেতে পারেন।

এরূপ আস্থাভাজন ব্যক্তির সংখ্যা আমাদের দেশে সঙ্কটের গুরুত্ব বিবেচনায় অপর্যাপ্ত, এমন দাবি যথার্থ নয়। বাছাইপ্রক্রিয়া কী হবে তা উদ্ভাবনের দায়িত্ব বড় দু’টি রাজনৈতিক দল পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে সুরাহা করতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকারের কোন সদস্যকে কোন মন্ত্রণালয়, দফতর দেয়া হবে সেটি পরিস্থিতির আলোকে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারিত হতে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকার নিরপেক্ষভাবে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রত্যয়ে বর্ণিত ব্যবস্থায় গঠিত হলে সার্বিক বিবেচনায় সফল হবে। বাস্তবতার আলোকে উভয় দলের কাছে গ্রহণযোগ্য এর চেয়ে উত্তম ব্যবস্থা না থাকায় এটিকে গ্রহণ করে সম্মুখপানে এগিয়ে গেলে আশা করা যায় ভুল বুঝাবুঝির অবসানে সুখী ও সমৃদ্ধশালী ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন সফল হবে এবং দলীয় সরকার নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে কেন গ্রহণযোগ্য নয়, এ প্রশ্নের সুরাহা হবে।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail : iktederahmed@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement