০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`


মধ্যপন্থাই সেরা পন্থা

মধ্যপন্থাই সেরা পন্থা - নয়া দিগন্ত

ইংরেজিতে একটি কথা আছে- এক্সেস অব অ্যানিথিং ইস ব্যাড excess of anything is bad অর্থাৎ কোনো কিছুর বাড়াবাড়িই খারাপ। মাত্রা অতিক্রম করলে অনেক ভালো জিনিস মন্দ রূপ বা আকার ধারণ করতে পারে। যেমন মাত্রা অতিক্রম করলে সাহস হঠকারিতায়, আত্মোৎসর্গ আত্মহত্যায়, প্রতিযোগিতা হিংসায়, ধর্মভীরুতা ধর্মান্ধতায় পরিণত হতে পারে। অবস্থা বিশেষে সমালোচনা পরচর্চায়, প্রশংসা চাটুবাদে, তেজ ক্রোধে, দেশপ্রেম দেশদ্রোহিতার স্তরে নেমে আসতে পারে। নাতিশীতোষ্ণ তাপমাত্রা যেমন সবার পছন্দ তেমনি স্বরের মধ্যে পঞ্চম স্বরই মিষ্ট এবং শ্রেষ্ঠ। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বারবার বলেছেন, তোমরা কোনো কিছুতে সীমালঙ্ঘন করো না। আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীকে ভালোবাসেন না। লোকমান হাকিম তাঁর ছেলেকে উপদেশমূলকভাবে বলেছেন, মাটিতে হাঁটবে মধ্যম মেজাজে আর তোমার স্বর হওয়া উচিত মোলায়েম-স্বরের মধ্যে গাধার স্বরই নিকৃষ্ট।

প্রত্যেকের উচিত খাওয়া-দাওয়া, চাওয়া-পাওয়া, চিন্তা-চেতনা, আশা-প্রত্যাশা, আগ্রহ-আকাক্সক্ষার ক্ষেত্রে একটি পরিমিতি বোধ মেনে চলা। ক্যানভাসের রঙ ও তুলির সুষম সমন্বয়ে শিল্পের সার্থকতা ফুটে ওঠে। পারিপার্শ্বিক সব কিছুর পরিমিত অবস্থান ও শৃঙ্খলামণ্ডিত উপস্থাপনার মধ্যে সৌন্দর্যের যথার্থ বিকাশ। নিয়মনিষ্ঠা পালন ও সহনশীলতা প্রকাশ যেকোনো পরিবেশ পরিস্থিতিতে দান করে এক অনুপম মর্যাদা। অধিক ভোজনে অধিকাংশ রোগ বালাইয়ের কারণ। পরিমিত আহার শরীর ও মনের জন্য অপরিহার্য। মাত্রাতিরিক্ত চাহিদা সরবরাহে সমস্যা সৃষ্টি করে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। অধিক পরিশ্রমে মন ও শরীর ভেঙে পড়ে। অতি কথনে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হয়। অতিরিক্ত সব কিছু খারাপ। অতিভক্তি চোরের লক্ষণ নামে একটি প্রবাদ চালু আছে।

বাড়াবাড়ি কখনো সুখকর হয় না। অতি উত্তেজিত ব্যক্তির হার্টবিট ও রক্তের চাপ বাড়ে। অতি দ্রুত চলাচলকারী গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সমূহ বিপদের কারণ ঘটাতে পারে। চলনে বলনে আচার ব্যবহারে কর্মকাণ্ডে মধ্যমপন্থা অবলম্বন সেরা অভ্যাস বলে বিবেচিত।
আনন্দ-সর্বনাশের অধিক উচ্ছ্বাস কিংবা অতিশোকে কাতর হতে নেই। আনন্দের পরে বিষাদ আসছে আর বিষাদের পর আনন্দ আসবে এ বোধ ও বিশ্বাসে সব পর্যায়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা বা রাখার উপকারিতা অস্বীকার করা যায় না। ভগবদ গিতার (অধ্যায়-২ শ্লোক-১৫) যেমন বলা হয়েছে- ‘হে সর্বশ্রেষ্ঠ (অর্জুন), যে ব্যক্তি সুখ-দুঃখে বিচলিত হয় না এবং উভয় অবস্থায় স্থির থাকে; সে অবশ্যই মুক্তির যোগ্য’।

O best (Arjuna), the person who is not disturbed by happiness and distress and is steady in both is certainly eligible for liberation.

প্রত্যেকের চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে, আশা-আকাক্সক্ষা ও প্রয়াস প্রচেষ্টার মধ্যে পরিমিতি বোধ থাকা চাই। আমি বা আমরা যা পারি যা আমাদের প্রাপ্য তার বেশি করতে যাওয়া ও পাওয়ার আকাক্সক্ষা বা চেষ্টায় নানান বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। আহারের ক্ষেত্রে কথাটি আরো বেশি খাটে। অধিক আহার শরীরকে সবল করার পরিবর্তে শরীরে নানা সমস্যার জন্ম দেয়। আবার অতি অল্প আহার শরীরকে দুর্বল করে দেয়। যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু আহার করা উচিত। অতি শ্লথ গতির গাড়ি গন্তব্যে পৌঁছাতে যেমন বিলম্ব করে তেমনি অতি দ্রুতগতির গাড়ি গন্তব্যে হয়তো আদৌ না-ও পৌঁছাতে পারে। অতি দ্রুতগামী সে খরগোশের কাহিনী আমরা জানি। কচ্ছপের ধীর ও পরিমিত গতির কাছে তার পরাজয় ছিল নিশ্চিত। অতি বর্ষণে বন্যা হয়, অধিক শীতে কাতর হয়, অতি গরমে হাঁসফাঁস করে সবাই। সবার স্বপ্ন থাকে বসন্তের বাতাস, নাতিশীতোষ্ণ পরিবেশ, পরিমিত বর্ষা আর মধ্যম বা পঞ্চম সুরের গান।

মধ্যপন্থা অবলম্বনে ঝুঁকি কম। মধ্যমে অবস্থান থাকলে উঁচু মাত্রায় উঠতে যেমন সুবিধা হয়, নিচু মাত্রায় নামার ক্ষেত্রেও অসুবিধা হয় না। অথচ অতি নি¤œ মাত্রায় থাকলে তাকে মধ্যপন্থা পেরিয়ে উচ্চ পন্থায় যেতে বেশ বেগ পেতে হয়। আবার উচ্চপন্থা থেকে মধ্যপন্থা হয়ে নি¤œ পন্থায় নামতেও বেশ বিব্রতকর হতে হয়। বিশ্বাস ও বয়ানে মধ্যপন্থা নিরাপদ ও সুশ্রাব্য। কোকিলের স্বর পঞ্চম ও মধ্যমানের তাই এত মিষ্ট। পক্ষান্তরে কাকের স¦র সপ্তম, কর্কশ সুশ্রাব্য নয়। মধ্যপন্থার সুর বা স্বর সহজে অন্যের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। পক্ষান্তরে উচ্চ গ্রামের গান বা কথাবার্তা অশ্রাব্য ও ঝগড়া বাদানুবাদের ভাষা। চরম অবস্থান গ্রহণে সহজে সমঝোতা হয় না। সমাধান খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হয়। মিষ্টি সুরের গান বা কথা সব সময় মোলায়েম ও কোমল প্রশান্তির পরিচয় তুলে ধরে, আনন্দ ও উপভোগের সুযোগ সৃষ্টি করে।

জীবনযাত্রায় সব পর্যায়ে মধ্যপন্থা অবলম্বনের আবশ্যকতা রয়েছে। সম্পদ সসীম বা সীমিত অথচ চাহিদা অসীম বা অবারিত। সীমিত সম্পদ দিয়ে অসীম চাহিদা মেটাতে সবাইকে পরিমিতিবোধ মেনে চলতে হয় সময় সীমাবদ্ধ। করণীয় অনেক কিছু। স্বল্প সময়ের সদ্ব্যবহার করতে গিয়ে বিচক্ষণতার বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে অতি ধীরে কিংবা অতি দ্রুততার সাথে কোনো কিছু করতে চাওয়া বা করতে যাওয়া সমস্যা হয়ে থাকে।

যারা প্রকৃত বুদ্ধিমান তারা আজকের ঘটনা নিয়ে আজ ভাবেন না। এটি তারা ভেবেছিলেন বেশ কিছু দিন আগে এবং আজ যা ভাবছেন, তা আজকের জন্য নয়, ভাবছেন বেশ কিছু দিন পরের জন্য। যারা তাৎক্ষণিক ঘটনায় আপ্লুত, বিমোহিত, বিমর্ষ কিংবা উৎফুল্ল হন, তারা অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে খুব একটি স্বচ্ছ ধারণা পোষণ করতে সক্ষম বলে মনে হয় না। সময় যেহেতু দ্রুত পরিবর্তনশীল, সেহেতু তাৎক্ষণিক বলে কিছু নেই এবং তাৎক্ষণিকের ঘটনায় চূড়ান্ত সবকিছু ভাবাও সঠিক নয়। তবে তাৎক্ষণিকের ঘটনা কিন্তু তাৎক্ষণিক নয়, এটি সময়ের ধারাবাহিকতার একটি অংশ। সে কারণেও তাৎক্ষণিক চূড়ান্ত নয়। অভিজ্ঞতা বর্তমানের কার্যকারণকে এবং ভবিষ্যতের প্রতি দৃষ্টিক্ষেপে প্রভাব ফেলতে বাধ্য। সুতরাং বর্তমানের ঘটনাকে সতর্ক ও সংহত ও সংযমের সাথে গ্রহণ করা উচিত। পরে কী ঘটে তার জন্য। এটি করতে পারলে উত্তেজনা পরিহার করা সম্ভব।

ভোগবাদীরা অবশ্য বলেন, কাল কী হবে, সে চিন্তা পরে হবে আজকেরটি উদযাপন বা উপভোগ করে নাও। এটি তারা বলেন, উপভোগ বা আনন্দের জন্য। দুঃখ ভোগের বেলায় নয়। আনন্দ উপভোগের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতের উৎকণ্ঠার বাদ সাধা উচিত নয় কিন্তু সময়ের ধারাবাহিকতায় প্রশ্নে তা একটি বিভ্রান্তি বিশেষ, সংশয়বাদীরা তাই তাৎক্ষণিকতাকে উপভোগ করতে পারে না।
সংশয় আর সংযম-সুস্থিরতা এক কথা নয়। সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা হলো মধ্যপন্থা। সুতরাং সিদ্ধান্ত হলো, আনন্দের হোক আর দুঃখের হোক তাৎক্ষণিকতায় বিভোর ও বিমর্ষ কোনোটি কাম্য নয়। সংযত সংহত উপায়ে তা গ্রহণ এবং উদ্বেগ উৎকণ্ঠারহিত উপায়ে তা গ্রহণ করা উচিত। মধ্যপন্থা অবলম্বন শ্রেষ্ঠ উপায়।

প্রতিশোধ স্পৃহা থেকে বাড়াবাড়ি ব্যক্তি ও সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়াসকে অসম্ভব করে তুলতে পারে। কেউ অত্যাচারিত হলে প্রতিশোধ গ্রহণের প্রশ্ন আসে। কিন্তু এ প্রতিশোধ গ্রহণের ক্ষেত্রে সাম্যের সীমা লঙ্ঘিত হলে প্রতিশোধ গ্রহণও অত্যাচারে পর্যবসিত হতে পারে। প্রতিশোধ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সীমা লঙ্ঘিত হলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে বাধ্য এবং যা সামাজিক ভারসাম্য বিনষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আল-কুরআনে ৪২ সংখ্যক সূরা আশ শুরার ৪০ থেকে ৪৩ নং আয়াতে এ প্রসঙ্গে যা ইরশাদ হয়েছে তা বিশেষ প্রণিধানযোগ্য- ‘মন্দের প্রতিফল অনুরূপ মন্দ এবং যে ক্ষমা করে দেয় ও আপস-নিষ্পত্তি করে তার পুরস্কার আল্লাহর নিকট আছে। আল্লাহ জালিমদের পছন্দ করেন না। তবে অত্যাচারিত হওয়ার পর যারা প্রতিবিধান করে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না। কেবল তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা অবলম্বন করা হবে যারা মানুষের ওপর অত্যাচার করে এবং পৃথিবীতে অন্যায়ভাবে বিদ্রোহচারণ করে বেড়ায়, তাদের জন্য মর্মন্তুদ শাস্তি। অবশ্য, যে ধৈর্য ধারণ করে এবং ক্ষমা করে দেয়, তা হবে দৃঢ় সংকল্পের কাজ।’

প্রতিশোধ ততটুকু যতটুকু জুলুম করা হয়েছে সীমালঙ্ঘিত হলে তা আবার অত্যাচারে পর্যবসিত হতে পারে। প্রতিশোধের মাত্রা অতিশয় আপেক্ষিক, সীমালঙ্ঘনের আশঙ্কা ও সমস্যা থেকে যায় তাই ক্ষমা ও আপস মীমাংসার মাধ্যমে প্রতিশোধ এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা শ্রেয়। তবে যে ক্ষেত্রে ক্ষমা করার ফলে অত্যাচারীর ধৃষ্টতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, সে ক্ষেত্রে প্রতিশোধ-প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য হয়ে দাঁড়ায়। দোষীকে শাস্তি-উপযুক্ত শিক্ষা দেয়ার মানসিকতার মধ্যে ভারসাম্য রাখা কঠিন, এর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণও কঠিন। কিন্তু ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও প্রতিশোধের স্পৃহাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে সময় তার সুফল বয়ে আনে। গৌতম বুদ্ধের বাণীও তাই- ‘প্রতিশোধের স্পৃহা পুষে রাখতে নেই, ক্ষমা করে দেয়া বা বিলম্ব করাই প্রতিশোধের উত্তম উপায়। বিপদে, অত্যাচারের মুখে, অন্যায়ের সামনে ধৈর্য ধারণ কঠিন, প্রতিশোধ স্পৃহাকে সুনিয়ন্ত্রিতভাবে প্রয়োগও তেমন কঠিন। এর বিপরীতে অবস্থান নেয়া নিঃসন্দেহে তাই দৃঢ় সংকল্পের কাজ। ব্যক্তি সমাজ-দেশ ও দুনিয়ায় হানাহানির সর্বনাশা হতে পরিত্রাণ লাভার্থে এই the noblest form of courge and resolution (প্রয়োজন সাহস এবং প্রস্তাবনার মহৎ রূপ) -এর প্রয়োজন।

লেখক : উপকূলীয় উন্নয়ন অর্থনীতির বিশ্লেষক


আরো সংবাদ



premium cement