০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১, ২২ শাওয়াল ১৪৪৫
`


সমকালীন প্রসঙ্গ

সামরিক শাসন ও সামরিক বাহিনীর ইতিকথা

সামরিক শাসন ও সামরিক বাহিনীর ইতিকথা - নয়া দিগন্ত

সামরিক শাসনের কার্যকারণ ও ইতিহাস বলার আগে চমৎকার একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে চাই। পৃথিবীর সর্বকালের সেরা মিলিটারি জিনিয়াস বলতে যাদেরকে গণ্য করা হয় তাদের মধ্যে পারস্য সম্র্রাট সাইরাস দি গ্রেট প্রধানতম। খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০ অব্দে তার জন্ম এবং রূপকথার গল্পের মতো বেড়ে ওঠা এই মহান বীর ৩৯ বছর বয়সে প্রাচীন দুনিয়ার মিডিয়া নামক রাজ্যের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। মাত্র ৩০ বছরের মধ্যে তিনি এশিয়া এবং ইউরোপজুড়ে যে বিশাল সাম্রাজ্য কায়েম করেন তার দ্বিতীয় নজির পৃথিবীতে নেই। ইতিহাসের জনক হিরোডোটাস তার অমর গ্রন্থে মহামতি সাইরাসকে যেভাবে তুলে ধরেছেন ওমনভাবে পৃথিবীর কোনো কালের কোনো শাসককে ইতিহাস অমরত্ব দিতে পারেনি।

সাইরাসের ক্ষুদ্র রাষ্ট্র মিডিয়া যেদিন তৎকালীন দুনিয়ার সবচেয়ে ধনশালী-শক্তিশালী এবং সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র লিডিয়া দখল করেছিল তখন সম্ভবত তামাম দুনিয়া কেঁপে উঠেছিল। আজকের বাংলাদেশ যদি আমেরিকা দখল করে তবে পৃথিবীতে যে কম্পন শুরু হবে ঠিক তেমনটি ঘটেছিল ৫৪৭ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দুনিয়ায়। পর পর তিনটি যুদ্ধে তিনি লিডিয়ার সম্রাট ক্রিসাসকে পরাজিত করে যে ইতিহাস রচনা করেছেন তা পৃথিবীর সব বিখ্যাত সামরিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। প্রিটেরিয়ার যুদ্ধ, থিমব্রার যুদ্ধ এবং সাদিশের যুদ্ধে জয়লাভের পর তিনি শুধু লিডিয়া সাম্রাজ্যই দখল করলেন না বরং সম্রাট ক্রিসাসকে যুদ্ধবন্দী হিসেবে পেয়ে গেলেন এবং একটি অবিস্মরণীয় নাটকীয় ঘটনার পর তিনি যুদ্ধবন্দী সম্রাট ক্রিসাসকে মুক্তি দেন এবং তাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়ে নিজের রাজধানী পাসারগাদে নিয়ে আসেন।

আজকের দুনিয়াতে আব্রাহাম লিংকন, থিওডর রুজভেল্ট, উইনস্টন চার্চিল, রোনাল্ড রিগ্যান অথবা বারাক ওবামা যেমন প্রসিদ্ধি তদ্রƒপ তৎকালীন দুনিয়ায় সম্রাট ক্রিসাসের প্রসিদ্ধি ছিল আরো বেশি। অধিকন্তু সম্রাট ক্রিসাসের যে পারিবারিক আভিজাত্য ছিল তা কেবল বর্তমানকালের জাপান সম্রাট অথবা ইংল্যান্ডের রাজার পারিবারিক ঐতিহ্যের সাথে তুলনীয়। কাজেই লিডিয়া জয়ের ফলে সম্রাট সাইরাসের অবস্থা কিরূপ হয়েছিল তা বোঝানোর জন্য আমি একটি কাল্পনিক রূপকল্প দাঁড় করাতে চাই। ধরুন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমাদের সেনাবাহিনী পুরো আমেরিকা দখল করে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে বন্দী করে ফেলল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন রাষ্ট্রের সম্রাজ্ঞী হলেন এবং দয়া করে বাইডেনকে মুক্তি দিয়ে তার মন্ত্রিপরিষদের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিলেন এবং বাইডেন সম্রাজ্ঞী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও আনুগত্যের সর্বোচ্চ পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে তার জ্ঞান-গরিমা-অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে নতুন সাম্রাজ্যের সেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে থাকলেন।

উল্লিখিত ঘটনা যদি পৃথিবীবাসী দেখে তবে শেখ হাসিনার নাম শুনলে অপরাপর পরাশক্তির যা হবে ঠিক তাই হয়েছিল ৫৫০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের দুনিয়ায়। ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনি ভারতের সিন্ধু নদ হয়ে আফগানিস্তান, মধ্য এশিয়ার পুরো অঞ্চল, মধ্যপ্রাচ্য, পুরো ইরান, উত্তর আফ্রিকা, বুলগেরিয়াসহ বলকান অঞ্চল, দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ তথা আলবেনিয়া, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, ক্রোয়েশিয়া, কসোভো, মন্টেনিগ্রো, রুমানিয়া, সার্বিয়া এবং আধুনিক তুরস্কের পুরো অঞ্চলসহ সাইপ্রাস দখল করে যে সাম্রাজ্য কায়েম করেছিলেন তাই আসেমীয় সাম্রাজ্যরূপে খ্যাতি লাভ করে।
এখন প্রশ্ন হলো, মাত্র ৩০ বছরের রাজত্বকালে মহামতি সাইরাস যে অসাধ্য সাধন করেছিলেন তা মানবজাতির ইতিহাসে কেন দ্বিতীয় কোনো সম্রাট পারলেন না। আলেকজান্ডার, চেঙ্গিস খান, নেপোলিয়ন বোনাপার্ট কিংবা জুলিয়াস সিজারের মতো সর্বকালের সেরা মিলিটারি জিনিয়াসরাও সম্রাট সাইরাসের অধিকৃত ভূখণ্ডের অর্ধেকটাও অধিকার করতে পারেননি। অধিকৃত রাজ্যে সুশাসন এবং একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে পুরো জাতিকে রাজার জাতিতে পরিণত করার মতো জাতীয়তাবোধ দেশের জনগোষ্ঠীর রক্তমাংসে ঢুকিয়ে দেয়ার যে দক্ষতা সাইরাস দেখিয়েছেন এমনটি পৃথিবীর আর কেউ দেখাতে পারেনি। ফলে পারস্য সাম্রাজ্য-ফারসি ভাষা, পারস্য জাতিসত্তার মতো তিন হাজার বছরের পুরনো ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা আজকের ইরান যেভাবে রক্ষা করে চলেছে তার ভিত্তিমূলটি তৈরি করে দিয়েছিলেন মহামতি সাইরাস।

সাইরাসের সফলতার বুনিয়াদ বর্ণনা করতে গিয়ে হিরোডোটাস যা লিখেছেন তার মর্মকথা হলো, তিনি অত্যন্ত শক্তিশালী একটি গেরিলা বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। পরে তার অনুকরণে হজরত ওমরের জমানার মুসলিম বাহিনী, চেঙ্গিস খান, তৈমুর লং এবং অটোম্যান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ওসমানের বাহিনী পৃথিবীতে ইতিহাস সৃষ্টিকারী নজির স্থাপন করলেও তারা কেউই সম্রাট সাইরাসের মতো করে একটি দুর্ধর্ষ-গেরিলা বাহিনীকে সুসংবদ্ধ এবং নিয়মিত বেতনভুক সামরিক বাহিনীতে পরিণত করতে পারেননি। একটি গেরিলা বাহিনীকে সাইরাস কিভাবে নিয়মিত বাহিনীতে পরিণত করেছিলেন তার ইঙ্গিত আমরা হিরোডোটাসের বইতে দেখতে পাই। হিরোডোটাসের মতে, লিডিয়া রাজ্য বিজিত হওয়ার পর সেই রাজ্যের সুসংবদ্ধ সেনাবাহিনী এবং সেনা কমান্ডারদেরকে কাজে লাগিয়ে সাইরাস মানবজাতির ইতিহাসের প্রথম বেতনভুক নিয়মিত সেনাবাহিনী তৈরি করেন এবং সেনা সদস্যদের বসবাসের জন্য ক্যান্টনমেন্ট তৈরি করেন। লিডিয়ার অভিজ্ঞ সম্রাট ক্রিসাসকে নিজের প্রধানমন্ত্রী নিয়োগের মাধ্যমে রাজকার্যে তিনি যেভাবে সফল হতে থাকেন তা রীতিমতো বিস্ময়কর। ফলে অসংখ্য যুদ্ধ পরিচালনার জন্য তার সুদক্ষ সেনাপতিরা রণাঙ্গনে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন এবং একের পর এক বিজয় হাসিল করে এমন একটা পরিবেশ তৈরি করেন যার ফলে পরবর্তীতে যুদ্ধ ছাড়াই তিনি একের পর এক রাজ্যের মালিক হতে থাকলেন। সম্রাট সাইরাসের দূতরা কোনো রাজদরবারে গিয়ে আনুগত্য ও কর প্রদানের বার্তা পৌঁছে দিলে সংশ্লিষ্ট রাজারা বিনাযুদ্ধে সম্রাট সাইরাসের বশ্যতা স্বীকার করে নিতেন। ফলে অতি অল্প সময়ের মধ্যে তিনি পৃথিবীর সর্বকালের বৃহত্তম ভূখণ্ডের অবিসংবাদিত শাহেন শাহ হতে পেরেছিলেন।

সামরিক বাহিনী গঠন এবং বাহিনীর সদস্যদেরকে দক্ষ, অভিজ্ঞ ও রণকৌশলী বানানোর যে দৃষ্টান্ত সাইরাস তৈরি করেছিলেন সেগুলো অনুসরণ করেই পরবর্তী দুনিয়ার মিলিটারি জিনিয়াসরা সামরিক বাহিনী গঠন করেছেন এবং শত শত বছর ধরে দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। চেঙ্গিস খানের পরবর্তী বংশধর কুবলাই খানের সেনাবাহিনী, অটোমানদের জেনিসারি বাহিনী, জাপানের সামুরাই বাহিনীর হাত ধরে আধুনিক দুনিয়ার দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনীর গঠন, কর্মকাণ্ড, পোশাক-হাঁটাচলা, খাবার দাবার ইত্যাদি সব কিছুর মধ্যেই সম্রাট সাইরাসের সেনাবাহিনীর আদি ও অকৃত্রিম নিয়মকানুন ধারাবাহিকভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে। একটি দক্ষ সেনাবাহিনীর জন্য প্রথম দরকার মেদহীন পরিশ্রমী শরীর। ভাত ও চর্বিযুক্ত খাবার এবং মদ্যপান তাদের জন্য নিষিদ্ধ। জনবহুল শহর বা গ্রাম থেকে তাদের আবাসভূমি ক্যান্টনমেন্ট হতে হবে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। যুদ্ধে নিষ্ঠুরতা প্রদর্শনসহ শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তিশালী মনোবল তৈরির জন্য গান-বাজনা, কবিতা, আরামদায়ক পোশাক, বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদি তাদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। শৃঙ্খলা-নিয়মানুবর্তিতা কঠোরভাবে পালিত হতো এবং শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য ক্ষমাহীন শাস্তির বিধান সংবলিত সামরিক আইন বলবৎ ছিল। সারা বছর তাদেরকে সীমিত খাবার, সীমিত পোশাক, সীমিত অর্থ, সীমিত বিশ্রাম ও কঠোর অনুশীলনের মধ্যে রাখা হতো এবং যুদ্ধের ময়দানে সীমাহীন স্বাধীনতা দেয়া হতো। ফলে প্রতিটি সৈন্য যুদ্ধ করার জন্য পাগলপারা হয়ে থাকত।

উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যের সৈন্যবাহিনী নিয়ে সম্রাট সাইরাস স্বয়ংযুদ্ধ ক্ষেত্রে গিয়ে একবার ভারি বিপদে পড়লেন। শত চেষ্টা করেও তিনি একটি দুর্ধর্ষ গেরিলা বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে সফল হতে পারলেন না। এ অবস্থায় তিনি প্রধানমন্ত্রী ক্রিসাসের পরামর্শ চাইলেন। ক্রিসাস বললেন, মহামান্য রাজাধিরাজ! এই দুর্ধর্ষ গেরিলা যোদ্ধাদেরকে লোভী-পেটুক ও বিলাসী না বানানো পর্যন্ত তাদের পরাজিত অসম্ভব। সুতরাং গেরিলারা যাতে সহজে পেতে পারে এ জন্য তাদের যাত্রাপথ, আবাসভূমি ও নিয়ন্ত্রিত এলাকায় হাজার হাজার বস্তা চাল-ডাল-গম রেখে দিন। মোলায়েম কাপড়, জুতো এবং বাদ্যযন্ত্রও রাখুন, তারপর মদ এবং বেশ্যাদেরকে তাদের জন্য সহজলভ্য করে দিন এবং মাত্র কয়েক মাস অপেক্ষা করুন। সম্রাট সাইরাস তার অভিজ্ঞ মন্ত্রীর পরামর্শ মতো প্রয়োজনীয় সব কিছু করলেন এবং নির্দিষ্ট সময় পর যখন আক্রমণ করলেন তখন সেই দুর্ধর্ষ গেরিলা বাহিনী যুদ্ধ করা তো দূরের কথা পালানোর শক্তি ও সাহসটুকুও হারিয়ে ফেলেছিল।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement