২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাত

ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাত - নয়া দিগন্ত

আগামী জানুয়ারির মধ্যে অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে বছর খানেক ধরে দেশে ঘটে চলেছে চাঞ্চল্যকর সব ঘটনা। এগুলো রাজনীতির মাঠে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। নির্বাচন নিয়ে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল পরস্পরবিরোধী অবস্থানে অনড়। রাজনীতির মাঠে প্রাধান্য ধরে রাখতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মধ্যে চলছে বাগযুদ্ধ। মাঝেমধ্যে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ। তবে এবার গেল দুই নির্বাচনের মতো বিষয়টি একপক্ষীয় নেই। এখন, ‘কেহ কারে নাহি জিনে সমানে সমান’ অবস্থায় এসে দাঁড়াচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা গণতান্ত্রিক বিশ্ব বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন যাতে অবাধ, নিরপেক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়; সেজন্য সরকারের ওপর অব্যাহতভাবে চাপ সৃষ্টি করছে। নির্বাচনকেন্দ্রিক মার্কিন পদক্ষেপ সাম্প্রতিক সময়ে দৃশ্যমান। এতে ক্ষমতাসীনরা কিছুটা বেকায়দায়, মানে ব্যাকফুটে। আর বিএনপির মনোবল চাঙ্গা। গত কয়েক দিনে গোটা ছয়েক ঘটনা তুমুল আলোচিত। সাধারণের মাঝে চর্চিত। এসব ঘটনা রাজনীতিবিদসহ আমজনতারও দৃষ্টি কেড়েছে।

১.
ঘটনার ঘনঘটায় সবচেয়ে কৌতূহল উদ্দীপক হলো, ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লিতে জি-২০ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সেলফি। দেশীয় গণমাধ্যমে সেলফিটি গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত-প্রচারিত হয়েছে। সাথে সাথে এটি রাজনৈতিক অঙ্গনে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝড় তোলে। আদর্শিকভাবে দুই শিবিরে বিভক্ত মানুষজন নিজের মতো করে সেলফির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করছেন। আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে এটি কী বার্তা দিলো তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।

প্রধানমন্ত্রীর সেলফির সারবত্তা কী সে ব্যাপারে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের এক সেলফিতে বিএনপি নেতাদের রাতের ঘুম হারাম। গত শনিবার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশে এই মন্তব্য করেন তিনি।

জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাইডেনের সাথে তোলা সেলফি গলায় ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াতে ওবায়দুল কাদেরকে পরামর্শ দিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘এই জাতির দুর্ভাগ্য কোথায়, জানেন? বেসিক জায়গায় আমরা কেউ যাই না; আমরা সেলফির মতো ইস্যুতে যাই!’ ডিআরইউতে গত রোববার সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে এক স্মরণসভায় এই মন্তব্য করেন তিনি।
সেলফির ঘটনায় আওয়ামী লীগের অতি উৎসাহে কিছু রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগ দেউলিয়া হয়ে গেছে। তাই সেলফির মতো একটি তুচ্ছ বিষয় দলটির নেতাদের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকের ভাষায়, আসলে সরকারি দল এখন ডুবন্ত জাহাজ। দলটির নেতারা খড়কুটো ধরে বাঁচার চেষ্টায় রত। এসব বিশ্লেষকের দৃষ্টিতে, দেশে ক্ষমতার পালাবদল আসন্ন।

২.
বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে এসে পরাশক্তিগুলোর লড়াইয়ের জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, এর বড় প্রমাণ- অতি সম্প্রতি রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোর ঢাকা সফর। তাদের সফর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আগামী দিনে ঢাকার অবস্থান নির্ণয়ে কিঞ্চিৎ হলেও ভূমিকা রাখবে। একই সাথে দেশের আগামী নির্বাচনে এই দুই বিশ্ব নেতার সফর কোনো প্রভাব ফেলে কী না তা কিছু দিনের মধ্যে স্পষ্ট হবে।

৩.
নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূূসের বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি দিয়েছেন বিশ্বের বিশিষ্ট ১৮৩ ব্যক্তিত্ব। তাদের মধ্যে শতাধিক হলেন নোবেল বিজয়ী। এই চিঠিকে বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ আখ্যা দিয়ে এর তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন দেশীয় ৫০ সম্পাদক। দেখাদেখি প্রতিবাদ জানানোর প্রতিযোগিতা চলছে ড. ইউনূসের পক্ষে দেয়া চিঠির নিন্দাবাদ জানিয়ে। দেশের অন্যান্য পেশার বহু ব্যক্তি বিবৃতি দেয়ার কসরতে ব্যস্ত ছিলেন গত কয়েক দিন। আইনজীবীরাও এ থেকে পিছিয়ে নেই। তবে তাদের এই মহতী! উদ্যোগে কালিমা লেপন করেন রাষ্ট্রের এক আইন কর্মকর্তা। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরান আহমেদ ভূঁইয়া ড. ইউনূসের পক্ষে দেয়া বিশ্বের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের চিঠির প্রতিবাদ না করার সিদ্ধান্ত নেন। এটি বেশ তাৎপর্যপূণ। এমরানের মতে, ড. ইউনূস বিচারিক হয়রানির শিকার। পরিণতিতে তিনি বরখাস্ত হয়েছেন। হয়রানির ভয়ে স্ত্রী, দুই মেয়েসহ ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসে আশ্রয় প্রার্থনা করেন সাবেক এই ডিএজি। পরে দূতাবাসের কর্মকর্তারা তাকে হয়রানির শিকার হবেন না; এই বলে আশ্বস্ত করলে সপরিবারে বাসায় ফেরেন।


দেশে ঘটেছে রহস্যময় গায়েবি লেখক কাহিনী। এর জন্ম বছরখানেক আগে। বাংলাদেশে সাহসী চিন্তকের অভাব থাকলেও বুদ্ধিজীবীর আকাল পড়েনি কখনো। বুদ্ধিজীবিতার সহজ ফলনের দেশে আজব একটা খবর বেরিয়েছিল। বিদেশে সরকারের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারের জবাব দেয়ার মতো ‘দক্ষ’ বুদ্ধিজীবী ও কলাম লেখকের অভাব নাকি দেখা দিয়েছে। আর্থিক ‘সম্মানীর বিনিময়ে বাইরের কলাম লেখকদের দিয়ে ইতিবাচক নিবন্ধ লেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে’ (প্রথম আলো, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২২)।

সরকারের গুণগান গাওয়াও এখন বেশ লাভজনক খাত। এতেও নাকি অর্থকড়ি মিলছে দেদার। বিদেশী গণমাধ্যমে দেশীয় দরবারি বুদ্ধিজীবীদের অবশ্য তেমন ফায়দা নেয়ার সুযোগ হয়নি। ভাড়াটে নিবন্ধ লেখকের লেখা বেশির ভাগ প্রকাশিত হয়েছে বিদেশী গণমাধ্যমে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম ইউরোপে। এ থেকে প্রমাণিত হয়, দেশে জনমত গঠনের বিশেষ দরকার বর্তমান সরকারের নেই। জনমত, নাগরিকদের ভোট, জনপ্রিয়তা, সমর্থন ছাড়া বোধ হয় কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা ফলাতে পারছে সরকার।

ভুয়া, গায়েবি, ভুতুড়ে যাই বলি না কেন, এমন লেখক দিয়ে দেশী-বিদেশী সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন নীতির প্রশংসা করে ছাপা হওয়া প্রবন্ধ-নিবন্ধ বোদ্ধা মহলে রসের খোরাক জুটিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন নীতির প্রশংসা করে অনেক ‘নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞের’ শত শত নিবন্ধ নানা সময় জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। কিন্তু গোল বেধেছে লেখকদের অস্তিত্ব নিয়ে। সংবাদ সংস্থা এএফপির এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এসব বিশেষজ্ঞ লেখকের অনেকেরই বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই। এমনকি নিবন্ধে তাদের ভুয়া ছবি ব্যবহারের কথাও জানা গেছে।

অন্তত ৬০টি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নিউজ সাইটে প্রকাশিত ৭০০টিরও বেশি ভুয়া নিবন্ধে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরার গোপন প্রকল্প প্রকাশিত হয়ে পড়ায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সরকারের প্রচারণা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। এ নিয়ে গত রোববার এক বিবৃতিতে জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, প্রোপাগান্ডা ছড়াতে ভাড়া করা অস্তিত্বহীন বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ভুয়া অ্যাজেন্ডা কোনো আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন সরকারের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। শুধু ক্ষমতা ধরে রাখতে জাতীয় স্বার্থকে কুক্ষিগত করে ‘বিবেক’, ‘আত্মসম্মানবোধ’ এবং ‘লজ্জা’ বিসর্জন দেয়ার এহেন উদাহরণ বিশ্বে বিরল। এতে প্রমাণ হয়, সরকার কত আত্মবিশ্বাসহীন ও দেউলিয়া।
ঘটনাটি ফাঁসের পর অনেক রসিকজন বলছেন, নবাগতদের প্রশিক্ষণ দিতে আড়াই দশক আগে বাংলা একাডেমি তরুণ লেখক প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। তাতে যেসব তরুণ, লেখক হওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন তারা যারপরনাই উপকৃত হয়েছেন। এত বছর পর বর্তমান সরকারও ঠিক তেমনিভাবে গায়েবি লেখক প্রকল্প হাতে নেয়। যাতে দেশে-বিদেশে সরকারের ভাবমর্যাদা আরো উজ্জ্বল হয়।

৫.
চতুর্থ ঘটনাটি সেমসাইড। রীতিমতো আত্মঘাতী গোল। ব্যক্তিগত কারণে ছাত্রলীগের তিন নেতাকে শাহবাগ থানায় নিয়ে বেদম প্রহারের ঘটনায় আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশিদকে ঢাকা মহানগর পুলিশ থেকে (ডিএমপি) সরিয়ে দেয়া হয়েছে। ডিএমপির রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনারের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। শনিবার রাতে শাহবাগ থানায় নিয়ে ছাত্র লীগের দুই নেতাকে মারধরের কথা রোববার জানাজানির পর দুপুরে তাকে রমনা বিভাগ থেকে প্রত্যাহার করে ডিএমপির দাঙ্গা দমন বা পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট বিভাগে সংযুক্ত করা হয়েছিল। পরে ওই দিন সন্ধ্যায় পুলিশ সদর দফতরের এক প্রজ্ঞাপনে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে (এপিবিএন) বদলির কথা জানানো হয়। এ ঘটনা নিয়ে গত রোববার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের কাছে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এডিসি হারুন অর রশিদ ‘যতটুকু অন্যায় করেছেন, ততটুকু শাস্তি পাবেন’।
ঘটনাটি আপাতদৃষ্টিতে খুব সাধারণ মনে হলেও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ক্ষমতাকাঠামোর গভীরের চিত্রটি উন্মোচিত করেছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এ ঘটনায় দেখা যাচ্ছে, বিগত ১৫ বছরে আমাদের সমাজে আমূল পরিবর্তন হয়েছে। ‘জোর যার মুল্লুক তার’ অর্থাৎ ক্ষমতাবানদের দাপট অপ্রতিরোধ্য। এ রাষ্ট্রে দুর্বলের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে ৫২ বছরেও কোনো সিস্টেম দাঁড়ায়নি। তার আলামত এডিসি হারুন কাহিনী।

৬.
বিশ্ববিখ্যাত পত্রিকা নিউ ইয়র্ক টাইমসে কয়েক দিন আগে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। সেখানে দেখানো হয়েছে আমাদের দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কিভাবে ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। ভিন্নমত দমনে ফৌজদারি মামলা দিয়ে বিরোধী নেতাকর্মীদের জীবন বিপর্যস্ত এবং দুর্বিষহ করে তোলা হয়েছে। এই প্রতিবেদনের ধারাবাহিকতায় এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নামে দেয়া ময়লার গাড়ি ভাঙচুরের মতো হাস্যকর অভিযোগেও বিচার শুরু হয়েছে। আর জামায়াতে ইসলামীর কথা তো এক্ষেত্রে বাদই দিতে হয়। দলটির কেন্দ্রীয় আমির এবং সেক্রেটারি জেনারেল দীর্ঘ দিন ধরে জেলবন্দী। তাদেরও বিচারের আওতায় আনা হয়েছে।
উপরে উল্লিখিত সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া ছয়টি ঘটনার ঘাত-অভিঘাত আমাদের জাতীয় জীবনে কী প্রভাব ফেলে তাই এখন দেখার বিষয়।


আরো সংবাদ



premium cement