০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`


উৎসের উচ্চারণ

কম অধিকার, বেশি উন্নয়ন : তত্ত্ব ও বিচার

কম অধিকার, বেশি উন্নয়ন : তত্ত্ব ও বিচার - ফাইল ছবি

অধিকার এবং উন্নয়নের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে তর্ক দীর্ঘকালের। এই তর্ক পণ্ডিত, নীতিনির্ধারক ও অনুশীলনকারীদের মধ্যে চলমান। এই তর্ক থেকে বেরিয়ে এসেছে একটি তত্ত্ব, যার নাম কম অধিকার, বেশি উন্নয়ন। অনেকেই মনে করছেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক অগ্রগতি অর্জনের জন্য এ তত্ত্ব কার্যকর এক পদ্ধতি। এই তত্ত্বের পরামর্শ হলো- কিছু নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে গণ অধিকার প্রক্রিয়ার হ্রাস ঘটলে তা মেনে নাও, কর্তৃত্ববাদী শাসনের হাতে আরো সুবিধা দাও, তাকে আরো ধারাবাহিক ও কার্যকর করো। যেন সে দক্ষ উন্নয়ন- ফলাফলের দিকে দেশকে এগিয়ে নিতে পারে।

এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রান্তিকতা, চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতায় পরিপূর্ণ। এ তত্ত্ব নিজেই নিজেকে রদ করে। কারণ রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, মানবাধিকার ও টেকসই উন্নয়নের মধ্যে জটিল নৈকট্য এবং নির্ভরশীলতা রয়েছে। একটিকে বাদ দিলে আরেকটি পঙ্গু হয়ে যায়। এ তত্ত্বের অন্তর্নিহিত ত্রুটিগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অগ্রগতি বৃদ্ধির জন্য আরো ভারসাম্যপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতির কথা আমাদের ভাবতে হয় এবং এ ভাবনাকে সমালোচনামূলকভাবে পরীক্ষা করতে হবে।
অস্বীকারের তো উপায় নেই, অধিকার ও উন্নয়ন হচ্ছে আন্তঃসম্পর্কিত ধারণা। তত্ত্বগতভাবে একটি অপরটির সাথে যুক্ত, পারস্পরিকভাবে তাদের একে অপরকে শক্তিশালী করা উচিত। নাগরিক অধিকার জনগণকে একটি কণ্ঠস্বর প্রদান করে, সরকার গঠনে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াগুলোতে অংশগ্রহণ করতে তাদের সক্ষম করে। এটি উন্নয়ন নীতিগুলোকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। এর ফলে উন্নয়ন, বিশেষ করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নত জীবনযাত্রা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, নাগরিক স্বাধীনতা এবং আইনের শাসনের মাধ্যমে সত্যিকার অর্থে রাষ্ট্র, সরকার ও জনগণ শক্তিশালী প্রগতি লাভ করে।

কম অধিকার, বেশি উন্নয়ন তত্ত্বের প্রবক্তারা দাবি করেন, গণ-অংশীদারিত্বের যে প্রক্রিয়ার কথা বলে গণতন্ত্র, তা উন্নয়নের জন্য সব সময় ভালো নয়। জনগণের দাবি-দাওয়া সব সময় উন্নয়নের পক্ষে থাকে না। তাদের দাবিকে বিবেচনায় নেয়া উন্নয়নের জন্য সহায়ক হয় না অনেক সময়। জনপ্রিয় দাবিমাত্রই ভালো নয়। জনতাবাদের প্রতি সংবেদশীলতা কার্যকর নীতি বাস্তবায়নে বাধা তৈরি করে। দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ, ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক গতিশীলতা ও বড় আকারের প্রবৃদ্ধির পথে প্রায়ই গণদাবি বাধা হয়ে দাঁড়ায়। উন্নয়ন প্রকল্পগুলো ত্বরান্বিত করার জন্য টেকনোক্র্যাটিক কর্তৃত্বপূর্ণ শাসনব্যবস্থাকে ক্ষমতা দেয়া দরকার। যাতে তারা আরো দক্ষতার সাথে সম্পদ ব্যবহার করতে পারে।

কিন্তু এই ব্যবস্থার সমস্যা হলো- এখানে থাকে জবাবদিহির নিদারুণ অভাব। জনতার কাছে দায়বদ্ধতাহীন সরকারের মধ্যে প্রতিনিয়ত জবাবদিহির ক্ষয় হতে থাকে। কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় প্রায়ই ভারসাম্যের অভাব থাকে, যার ফলে নেতারা জনসাধারণের যাচাই ও পছন্দ উপেক্ষা করে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। জবাবদিহির এই অনুপস্থিতি দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও সম্পদের অপব্যবহারের দিকে ধাবিত করে, যা শেষ পর্যন্ত উন্নয়নের লক্ষ্যকে ক্ষুণ্ণ করে।

এই তত্ত্বের ব্যবহার প্রায়ই টেকসই উন্নয়নে মানবাধিকারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে উপেক্ষা করে। স্বৈরাচারী সরকারগুলো, দ্রুত অর্থনৈতিক সংস্কার বাস্তবায়নে সক্ষম হয় বটে কিন্তু সাধারণত তারা সেটি করে ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মানবিক মর্যাদার বিনিময়ে। মানবাধিকার দমনের মাধ্যমে অর্জিত উন্নয়ন টেকসই হতে পারে না। উল্টো বরং তা দীর্ঘমেয়াদে সামাজিক অস্থিরতার কারণ হতে পারে।
এ ব্যবস্থায় সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রক্রিয়া থেকে নাগরিকদের ভূমিকা হ্রাস করা হয় কিংবা বাদ দেয়া হয়, যা উন্নয়ন উদ্যোগের ওপর জনগণের মালিকানার বোধ ‘নাই’ করতে চায়।

কিন্তু প্রকৃত অর্থে জনগণের অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ উন্নয়নের সঠিক চালক। উন্নয়নের নীতিকে অবশ্যই জনগণের চাহিদা ও আকাক্সক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। এই তত্ত্ব গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণকে সীমিত করার মধ্য দিয়ে উন্নয়নকে উৎসাহিত করে। ফলে এ উন্নয়ন সেই সব চ্যালেঞ্জের প্রতি উদাসীন থাকে, যার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে জনগণ। বাস্তব চ্যালেঞ্জগুলোর মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয় এ উন্নয়ন।

কর্তৃত্ববাদী শাসন দীর্ঘমেয়াদি, টেকসই উন্নয়নের চেয়ে স্বল্পমেয়াদি অর্থনৈতিক লাভকে অগ্রাধিকার দেয়। মেয়াদ শেষে মানুষের মতামতে সঠিক উপায়ে নির্বাচিত হওয়ার চাপ একটি সরকারকে জনবান্ধব হতে উদ্বুদ্ধ করে। এই চাপ না থাকলে এই সরকারগুলো মানব উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবেশ সুরক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে চায় না। তারা বরং দৃশ্যমান উন্নয়নের প্রতি নজর রাখে। তাৎক্ষণিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাধনায় থাকে সরকার। এর মধ্য দিয়ে আপাত উন্নয়ন হয় বটে, কিন্তু তা সামগ্রিক ও স্থায়ী উন্নয়নের বিনিময়ে।

এই তত্ত্বের অনুসারী সরকারগুলো দুর্নীতির প্রতি দুর্বল থাকে। অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব থাকে, যা প্রকল্পগুলোতে ব্যাপক দুর্নীতির মচ্ছব তৈরি করে। উন্নয়ন প্রকল্পগুলো প্রকৃত অগ্রগতির পরিবর্তে ব্যক্তিগত সমৃদ্ধির বাহন হয়ে উঠতে পারে। বড় প্রজেক্ট শুধু বড় উন্নয়ন নয়, হয়ে ওঠে বড় দুর্নীতিও। জনগণের সম্পদ লুটের মাল মনে করার সুযোগ বাড়ে। প্রভাবশালী গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানের জন্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি হতে থাকে। রাজনীতিকদের সাথে মিলে তারা জনগণের সম্পদের ওপর শ্রেণিস্বার্থের মনোপলি কায়েম করে বসে।

জনতার কাছে দায়বদ্ধ একটি জবাবদিহিতামূলক সরকারের আমলে মানুষের আয় ধীর গতিতে একটি বিশেষ মাত্রায় পৌঁছাতে পারে। কিন্তু তা হয় স্থায়ী, টেকসই। সরকার পরিবর্তনের শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়া এখানে বিদ্যমান থাকে। ফলে উন্নয়নের টেকসই ভবিষ্যৎ বিদ্যমান থাকে। কিন্তু কর্তৃত্ববাদী, জবাবদিহিশূন্য সরকারব্যবস্থায় জনগণের মাথাপিছু আয় অনেক উঁচুতে উঠে গেলেও এর পতনের ঝুঁকিও অনেক বেশি। কারণ জনগণকে নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য এবং শৃঙ্খলমুক্তির জন্য আজ হোক, কাল হোক- লড়াই করতে হবে। তখন নৈরাজ্য ও হানাহানি অর্থনীতির গতিরোধ করে এবং উন্নয়নের পতন ডেকে আনে। অধিকার হত্যা করে উন্নয়ন করা হলেও সেই উন্নয়ন অধিকারহীনতার প্রতিষেধক হতে পারে না।

উন্নয়ন হতে হবে মানুষের। আর মানুষের হাতে, মুখে, চোখে লাগাম লাগিয়ে তার উন্নয়ন হয় না। তার জন্য মুক্তি বাদ দিয়ে কোনো উন্নয়নই উন্নয়নের প্রকৃত শর্ত পূর্ণ করে না। উন্নয়ন তাই কেবল স্থাপনা ও অবকাঠামোর উন্নয়ন নয়। উন্নয়ন কেবলই অর্থনীতির ব্যাপার নয়। এতে রাজনৈতিক স্বাধীনতা থাকতে হবে, মানুষের ন্যায়সঙ্গত মতামত প্রকাশ ও প্রয়োগের স্বাধীনতা থাকতে হবে, সুযোগ-সুবিধা কোনো বিশেষ দল, শ্রেণী বা গোষ্ঠীর জন্য কেন্দ্রীভূত করা যাবে না, স্বচ্ছতার নিশ্চয়তা থাকতে হবে, আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা এবং জীবন ও জীবনমানের সুরক্ষার পরিবেশ থাকতে হবে। এসব বাদ দিয়ে চোখে পড়া উন্নয়নের প্রতিটি দৃশ্য আপনাকে আসল উন্নয়নের বদলে উন্নয়নের কৃত্রিম ছবি দেখাচ্ছে মাত্র।

এ প্রেক্ষাপটে অধিকার এবং উন্নয়নের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তির বদলে সমন্বয় তালাশ করতে হবে, যা হবে অধিক ভারসাম্যপূর্ণ, কম খরচে ও টেকসই। জনতার কর্তৃত্ব ও ভূমিকা সঠিক উপায়ে কাজ করলে টেকসই উন্নয়নের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি হতে পারে। অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াগুলো মানুষের মধ্যে অধিকার চেতনা জাগিয়ে তোলে এবং উন্নয়নের নীতিতে জনতার দৃষ্টিকোণ অঙ্গীভূত করে। এ প্রক্রিয়া স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও আইনের শাসন উৎসাহিত করে, যা উন্নয়ন প্রচেষ্টার ন্যায্যতা বজায় রাখার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রায়ই বহুমুখী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। সেখানে দুর্বল প্রতিষ্ঠান, জাতিগত উত্তেজনা এবং ঐতিহাসিক অবিচারের ধারা বজায় থাকে। এর মধ্যে যদি উন্নয়নের নামে কর্তৃত্ববাদের হাতে স্বেচ্ছাচারের স্বাধীনতা তুলে দেয়া হয়, তাহলে জনগণের মূল্য পদপিষ্ট হবে।
এখানে বরং জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ, মানবাধিকার সুরক্ষা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নকে উৎসাহিত করা জরুরি।

বুদ্ধিজীবীরা এ বিষয়টি উপেক্ষা করলে তারা অন্ধের ভূমিকা নেবেন। ক্ষমতার খেদমতগার হতে গিয়ে শুধু জনগণ নয়; বরং উন্নয়নেরও ক্ষতি করবেন। কারণ সরকার যদি হয় নাগরিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণমূলক, প্রকল্প যদি হয় জবাবদিহিমূলক, প্রশাসন যদি হয় মানুষের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তাহলে উন্নয়ন ও অধিকার হাত ধরাধরি করে এগোতে পারবে ভবিষ্যতের দিকে। উন্নয়ন কেবল দ্রুত নয়; বরং তা হবে টেকসই ও ন্যায়সঙ্গত।

লেখক : কবি, গবেষক
71.alhafij@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement