০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ভক্তরা তাকে কুরআনের পাখি বলতেন

মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী - ফাইল ছবি

গত ১৪ আগস্ট রাতে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ইন্তেকাল করেছেন। দীর্ঘ ১৩ বছর কারাগারে থাকাবস্থায় গত ১৪ আগস্ট হৃদরোগে আক্রান্ত হলে তাকে বিএসএমএমইউ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এই মৃত্যু নিয়ে দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি হয়। অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার উদ্ভব হয়।

মাওলানা সাঈদী একজন মন্ত্রমুগ্ধকর ধর্মপ্রচারক ছিলেন। সত্তরের দশক থেকে তিনি ধর্মীয় ওয়াজ-নসিহত শুরু করেন। ইসলামী বক্তা ও মোফাসসের বা কুরআনের তাফসিরকারক হিসেবে আশির দশকে তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, রাজশাহী, বগুড়া, ঢাকা ও কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাৎসরিক তিন থেকে পাঁচ দিনব্যাপী তাফসির মাহফিল করেছেন প্রায় ৩০ বছরের অধিক সময়। দিন দিন সেসব মাহফিলে মানুষের ভিড় বাড়ে আর ভিন্নধর্মের মানুষ তার বয়ান শুনে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে। এরই মধ্যে তার আন্তর্জাতিক পরিসরে কুরআনের তাফসির পরিবেশনার ডাক আসতে থাকে। তিনি বিশে^র বিভিন্ন প্রান্তে কুরআনের বাণী শোনানোর জন্য উড়ে যেতে থাকেন। এভাবেই তিনি তার ভক্তকুলের কাছে ‘কুরআনের পাখি’ উপাধি লাভ করেন। তার দরাজ কণ্ঠ, সুমধুর তিলাওয়াত, তেজোদীপ্ত ভঙ্গিমা, ছন্দময় ভাষণ, অসাধারণ শব্দচয়ন এবং দরদমাখা দ্বীনের দাওয়াতি প্রক্রিয়া তাফসির মাহফিলে উপস্থিত জনতাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো মোহাবিষ্ট করত। এমনকি সম্প্রতি ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী মাওলানা সাঈদীর ইন্তেকালে শোক জানিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন (প্রথম আলো : ১৯ আগস্ট ২০২৩)। মধ্যপ্রাচ্যে তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। কাবাঘরে প্রবেশের বিরল সৌভাগ্য তার হয়েছিল।

সম্ভবত ১৯৮৯ সালের দিকে তিনি জামায়াতে যোগ দেন। সে সময় এরশাদবিরোধী আন্দোলন চলছিল। ফলে তার ওপর এরশাদের খড়গ নেমে আসে। তখন যেখানেই তার তাফসির মাহফিলের আয়োজন করা হতো সেখানেই সরকারের পেটোয়া বাহিনী পাল্টা সমাবেশ ডেকে ১৪৪ ধারা জারির ব্যবস্থা করত। মাহফিল পণ্ড হয়ে যেত। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। হিন্দু ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা হলেও তিনি ব্যাপক জনপ্রিয় ছিলেন। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে তাকে ২০১০ সালের ২৯ জুন গ্রেফতার করা হয়। পরে মানবতাবিরোধী অপরাধে তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। ২০১৩ সালে আদালত তাকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ দিলে দেশব্যাপী ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে তার ভক্তদের সংঘর্ষে ১৬৭ জন মানুষ নিহত হয় (নয়া দিগন্ত : ২২ আগস্ট ২০২৩)। পরে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তার শাস্তি কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়। কারাভোগের সময় দু’বার তিনি পেরোলে মুক্তি পেয়ে একদিন মায়ের জানাজা, আরেকদিন নিজের বড় ছেলে রফিক সাঈদীর জানাজা পড়ান।

মাওলানা সাঈদীর মৃত্যুর পর ভক্তকুলের বাঁধভাঙা আবেগ শক্তি প্রয়োগে দমন করার প্রচেষ্টায় অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তার পরিবার ও ভক্তরা চিকিৎসা প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তার ছেলে মাসুদ সাঈদী বলেছেন, ‘আল্লামা সাঈদীর চিকিৎসার পুরো প্রক্রিয়া ছিল রহস্যজনক। তাকে পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখা করতে দেয়া হয়নি। তাকে লাইফ সাপোর্টে নেয়া হলেও আমাদের সাথে পরামর্শ করা বা অনুমতি নেয়া হয়নি’ (নয়া দিগন্ত : ১৯ আগস্ট ২০২৩)। এমনকি যে চিকিৎসক শাহবাগের গণজাগরণমঞ্চে সাঈদীর ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন করেছিলেন তাকেই চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয় : ১৭ আগস্ট ২০২৩)। মৃত্যুর পর জানাজা পড়া নিয়ে ঘটে লঙ্কাকাণ্ড। সাঈদীভক্তরা ও পরিবার ঢাকায় জানাজা পড়ার অনুমতি চাইলে নাকচ করা হয়। একপর্যায়ে ভক্তকুলকে লাঠিচার্জ করে ও সাউন্ড গ্রেনেড চার্জ করে ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে লাশ গ্রামের বাড়ি পিরোজপুর পাঠিয়ে দেয়া হয়। খবর পেয়ে পিরোজপুরের সাঈদী ফাউন্ডেশনে লাখো মানুষ জড়ো হয়। জনতার ঢল সামলাতে বেলা ২টায় সময় দেয়া হলেও তার আগেই জানাজা পড়ে ফেলতে হয়। ফলে তার প্রবাসী সন্তান শামিম সাঈদী মূল জানাজায় শরিক হতে পারেননি। তবে আগের রাতে হাসপাতাল ও শাহবাগ এলাকার ঘটনায় সাঈদীপুত্র মাসুদ সাঈদীসহ প্রায় ছয় হাজারের বেশি মানুষের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা করা হয় (প্রথম আলো : ১৭ আগস্ট ২০২৩)। পরদিন অর্থাৎ ১৫ আগস্ট বায়তুল মোকাররমে সাঈদীভক্তরা গায়েবানা জানাজার নামাজ পড়তে গেলে সেখানেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাধায় সংঘর্ষ ও মামলা হয়। দেশের অন্যান্য স্থানে গায়েবানা জানাজা নিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে অঘটন ঘটলেও ভয়াবহ ঘটনা ঘটে কক্সবাজারের চকরিয়ায়।

একটি ভিডিওতে দেখা যায়, সেখানে পুলিশের সাথে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার সময় স্থানীয় এমপির নেতৃত্বে অস্ত্রধারী চকরিয়া পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি বেলাল উদ্দিন গুলি চালায়। এতে জামায়াতের কর্মী ফোরকানুর রহমান (৫০) নিহত হন (প্রথম আলো : ১৭ আগস্ট ২০২৩ এবং ২০ আগস্ট ২০২৩)। পরে জানাজা পড়তে আসা ১৫১ জনের নাম উল্লেখ করে এবং দুই থেকে তিন হাজার অজ্ঞাত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা হয়। এমনকি বিভিন্ন পত্রিকার চারজন স্থানীয় সাংবাদিককেও ওই মামলায় আসামি করা হয় (প্রথম আলো : ১৮ আগস্ট ২০২৩)। এদিকে মাওলানা সাঈদীর চিকিৎসক এস এম মোস্তফা জামানকে মুঠোফানে হুমকি দেয়া হলে তিনি থানায় জিডি করেন এবং এ ব্যাপারে দুজনকে গ্রেফতারও করা হয়।

আরো কিছু ঘটনা ঘটে এই মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। নওগাঁয় ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে শহীদ মিনার চত্বরে নওগাঁ পৌর আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আয়োজিত দোয়ার অনুষ্ঠানে স্থানীয় মসজিদের ইমাম মোয়াজ্জেম হোসেন মাওলানা সাঈদীর জন্য দোয়া করলে সেই ইমাম এবং তাকে সাঈদীর জন্য দোয়া করার পরামর্শদাতা স্থানীয় ব্যবসায়ী হাফিজুর রহমানকে আটক করে পুলিশ (নয়া দিগন্ত : ১৭ আগস্ট ২০২৩)। অন্যদিকে ফেনীতে সদর উপজেলার ফকিরহাট মাদরাসা জামে মসজিদে সাঈদীর জন্য দোয়া চাওয়ায় স্থানীয় ছাত্রলীগ কর্মীরা খতিব মো: সলিমুল্লাহকে মারধর করে বের করে দেয় এবং তার মাথার পাগড়ি ও গায়ের আবা (পাঞ্জাবির উপর পরিধেয়) খুলে প্র্রাবখানায় ফেলে দেয় (নয়া দিগন্ত : ১৯ আগস্ট ২০২৩)।

সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে ছাত্রলীগে। সাঈদীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে ফেসবুকে ইন্নালিল্লাহ লিখে স্ট্যাটাস দেয়ায় ২০ জেলার ছাত্রলীগের মোট ১৮৫ জন নেতাকর্মীকে সংগঠন থেকে সাময়িক বহিষ্কার ও অব্যাহতি দেয়া হয় (প্রথম আলো : ২৩ আগস্ট ২০২৩)। আবার দু’-একটি স্থানে কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর সংগঠন থেকে পদত্যাগের ঘটনাও ঘটে। এদিকে গত বছর ৪ অক্টোবর সৌদি আরব চলে যাওয়া জনৈক আজিজুল হককে কক্সবাজারের পেকুয়ায় থানা পুলিশ আসামি করেছে। পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে ১৫১ জনের মধ্যে ১৩২ নম্বর আসামি এই সৌদি প্রবাসী আজিজুল হক। এ পর্যন্ত ঢাকা ও বিভিন্ন স্থানে জানাজা নিয়ে হাঙ্গামায় জামায়াত-শিবিরের শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

মৃত ব্যক্তির প্রতি কারো ঘৃণা থাকলেও তা আড়ালে রেখে স্বাভাবিকভাবে দাফন-কাফন করা সভ্যতার অংশ। মৃতের অধিকার হলো তার আত্মীয়-স্বজন ও ভক্তরা স্বাধীনভাবে সম্মানের সাথে জানাজা পড়বে ও দাফন করবে। আত্মীয়-স্বজনের ইচ্ছানুযায়ী ঢাকায় জানাজা হলে হয়তো কয়েক লাখ মানুষ হতো। তাতে কি ভয়ের কোনো কারণ ছিল? এই মৃত্যু তো হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু; আপাতদৃষ্টিতে কোনো অস্বাভাবিকতা ছিল না!

দাফনের জন্য প্রশাসনের তাড়াহুড়ো ও জোরজবরদস্তিও ছিল অস্বাভাবিক। এরপর বিভিন্ন স্থানে গায়েবানা জানাজার অনুমতি দিলে দেশ বা রাজনীতির কি খুব ক্ষতি হয়ে যেত? আসলে মানুষের আবেগ দমন করতে গেলে বিপত্তি ঘটবেই। সাঈদীর চিকিৎসক নিয়োগের বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের আরো সতর্কতা দরকার ছিল। তাহলে হয়তো কোনো প্রশ্নই উঠতো না।

পিরোজপুরে সাঈদীর জানাজার প্রাক্কালে আরো একটি সেনসেশনের উদ্ভব হয়। জনৈক সুখরঞ্জন বালি সেখানে একটি সাক্ষাৎকার দেন, যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। তিনি বলেন, সাঈদী রাজাকার নন। তার (সুখরঞ্জন বালি) ভাই হত্যার ব্যাপারে তিনি সাক্ষ্য দিতে গেলে তাকে কে বা কারা আদালত চত্বর থেকে অপহরণ করে ভারতে ফেলে আসে। ভারতের জেলে পাঁচ বছর কাটিয়ে তিনি মুক্ত হয়ে দেশে ফেরেন। সুখরঞ্জন বালি আরো বলেন, সাঈদী দু’বার তাদের এমপি ছিলেন। তখন তারা অর্থাৎ হিন্দু সম্প্রদায় যেন মায়ের কোলে ছিল। সুখরঞ্জন বালির ফেসবুকে দেয়া ওই বক্তব্য সাঈদীর ভক্তকুলের মধ্যে যথেষ্ট সেনসেশন সৃষ্টি করে। অন্যদিকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের একটি বড় সংখ্যা আওয়ামী লীগের রাজনীতি করলেও তারা সাঈদীকে সম্মান করত। কাজেই সাঈদীভক্তদের মধ্যে শুধু জামায়াত-শিবিরই নয়; বরং অন্যান্য দলের লোকও আছে। কাজেই বিশ্লেষকদের ধারণা, প্রশাসন আরো কৌশলী হলে মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুর পর হয়তো বা দেশে এত তোলপাড়, এতসব অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার অবতারণা হতো না।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক


আরো সংবাদ



premium cement