২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


সরকারের সঙ্কট ও আনন্দবাজারি ইতরামি

সরকারের সঙ্কট ও আনন্দবাজারি ইতরামি - নয়া দিগন্ত

বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যে যে তৎপরতা চলছে তাতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ চিন্তিত। গত ১৫ বছরের ক্ষমতা কিভাবে ধরে রাখা যায় সেই নীলনকশা বাস্তবায়নে তারা ব্যস্ত। এ নিয়ে পর্দার অন্তরালে কাজ করছে সরকার। পুলিশ বাহিনীসহ সমগ্র প্রশাসনকে ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি প্রচার-প্রচারণারও নানামুখী কৌশল নিয়েছে। দেশে-বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করেছে। আওয়ামী জোটভুক্ত ১৪ দলকে চাঙ্গা করা এবং জাতীয় পার্টির আগের মতো ভাগে আনার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। রওশন এরশাদকে গণভববে ডেকে নেয়া এবং জাপা প্রধান জিএম কাদেরকে ভারতে পাঠানো এরই অংশ।

যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদলের ঢাকায় এসে তৎপরতা, মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের বিভিন্ন মহলের সঙ্গে মতবিনিময়, ইইউ প্রতিনিধি দলের তৎপরতার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ও সরকারি দলের লোকজনের মধ্যে হতাশা নেমে আসে। বিএনপির সভা-সমাবেশে অত্যধিক জনসমাগমও তাদের হতাশার অন্যতম কারণ। বিএনপির কর্মসূচির বিরুদ্ধে পাল্টা কর্মসূচি দিয়েও এই হতাশা দূর হচ্ছিল না। এরই মধ্যে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা সূত্রবিহীন একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করেছে। আনন্দবাজারের ইতরামি বহুল আলোচিত। পত্রিকাটি তার প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ের পর থেকেই এ ধরনের ইতরামি করে আসছে। এ পত্রিকার ইতরামি সম্পর্কে বলতে গিয়ে শেরেবাংলা একে ফজলুল হক একবার বলেছিলেন, ‘আনন্দবাজার যদি আমার প্রশংসা করে কোনো রিপোর্ট করে বুঝবেন আমি জাতীয় স্বার্থ এবং মুসলমানদের স্বার্থের বাইরে কাজ করছি। আর আনন্দবাজার যদি আমার বিরুদ্ধে লেখে তাহলে বুঝবেন আমি সঠিক পথে আছি।’ এই হলো আনন্দবাজার।

আনন্দবাজারের সাম্প্রতিক সূত্রবিহীন রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকার দুর্বল হলে তা নাকি ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র কারো জন্যই সুখকর হবে না। কূটনৈতিক নোটে নাকি ভারত যুক্তরাষ্ট্রকে এ বার্তা দিয়েছে। সূত্রবিহীন রিপোর্টটি বাংলাদেশেও ফলাও করে ছাপানো হয়েছে। অথচ আনন্দবাজার ছাড়া অন্য কোনো ভারতীয় পত্রিকায় এ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়নি। কয়েক দিন আগে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আনুষ্ঠানিক ব্রিফিংয়ে বলেছিলেন, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন কিভাবে হবে সেটা ঠিক করবে সে দেশের জনগণ। অথচ আনন্দবাজার তাদের রিপোর্টে বলেছে, ভারত নাকি যুক্তরাষ্ট্রকে বার্তা দিয়েছে। এটা যে এক ধরনের মতলবি রিপোর্ট তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায় ওই রিপোর্টটির ঢালাও প্রকাশ থেকেও মতলব বোঝা যায়। নির্বাচনের আগে এ ধরনের মতলবি রিপোর্ট ও ধাপ্পাবাজি যে চলতে থাকবে। কারণ ইতঃপূর্বেও একই ধরনের রিপোর্ট প্রকাশ হতে আমরা দেখেছি। তবে এসব ধাপ্পাবাজির মাধ্যমে ক্ষমতাসীনরা বর্তমান সঙ্কট কতটা কাটিয়ে উঠতে পারবে তা সময়ই বলে দেবে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, খবরটি সূত্রবিহীন। আমরা মনে করি না এটি সত্য। তবে খবরটি সত্যি হয়ে থাকলে এটা হবে দুর্ভাগ্যজনক। বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষার প্রতি ভারত মর্যাদা দেবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন। আনন্দবাজারের খবরটির পেছনে যে ক্ষমতাসীনদের হাত আছে তা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের অতি উৎসাহী মন্তব্যে প্রমাণিত। তিনি বলেন, ‘এ ভূখণ্ডে ভারত এবং যুক্তরষ্ট্রের অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে।’

খাদের কিনারায় আওয়ামী লীগ সরকার
সম্প্রতি কয়েকটি ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ আলোচিত হয়। এর অন্যতম হচ্ছে মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার সঙ্গে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি। এতে প্রধানমন্ত্রীকে বিমর্ষ দেখা যায়। এরপর মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয়ে বৈঠকের পর ওবায়দুল কাদের, আবদুর রাজ্জাকসহ দলটির নেতাদের বিষণœ বদনের ছবি সবার দৃষ্টি কাড়ে। একই চিত্র দেখা যায়, ভারত সফর শেষে সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ নেতাদের চেহারায়। নিষেধাজ্ঞা বিষয়ক মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের বৈশ্বিক দুর্নীতি দমন বিভাগের সমন্বয়ক রিচার্ড নেফিউর সঙ্গে বৈঠকের পর পররাষ্ট্র সচিবের মলিন মুখও সবার নজর কেড়েছে।
এসব বিমর্ষ ছবিই বলে দিচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার কতটা গভীর সংকটে পড়েছে। ছবিগুলো দেখে মনে পড়ে ইংরেজি প্রবাদবাক্য- Coming events cast their shadows before them (আসন্ন ঘটনাপ্রবাহ আগেই ছায়া ফেলে।)

আওয়ামী লীগ এবার যে সংকটে পড়েছে তা নজিরবিহীন। ভোটারবিহীন গত দুটি নির্বাচনে জয়ের পর সরকার তো সবচেয়ে সোনালি দিন কাটিয়েছে। সেসব এখন অতীত।
দেশে-বিদেশে চরম দুর্দিন দেখছে আওয়ামী লীগ সরকার। তবে সবচেয়ে বড় বিপদ নজিরবিহীন আন্তর্জাতিক চাপ। তারা স্পষ্টই বুঝতে পেরেছে, এবার আর রাতের ভোট সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তা মানবে না, আবার সে রকম ভোট করে ফেলার শক্তিও নেই তাদের। অন্যদিকে বিএনপির অভূতপূর্ব উত্থান, অর্থনীতির দেউলিয়া অবস্থা এবং সরকারবিরোধী প্রবল জনমত আওয়ামী লীগকে খাদের কিনারায় নিয়ে গেছে।

পশ্চিমা দুনিয়ার প্রচণ্ড চাপের মুখে আওয়ামী লীগের শেষ ভরসা ছিল ভারত। তবে আওয়ামী লীগ নেতাদের সাম্প্রতিক ভারত সফর দৃশ্যত তাদের হতাশ করেছে। বস্তুত, ভারত এবার নতুন বাস্তবতার মুখে পড়েছে। বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতের ওপর পশ্চিমা চাপ তো আছেই, তার ওপর মোদি সরকার বুঝতে পারছে, শেখ হাসিনা আবার ক্ষমতায় এলে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ভয়ঙ্কর হতে পারে। তাতে শেখ হাসিনার একমাত্র পথ থাকবে চীনের ছায়ায় আশ্রয় নেয়া। সেটা ভারতের জন্য হবে সর্বনাশা। অন্যদিকে বিএনপি ক্ষমতায় এলে ভারত বাংলাদেশ থেকে পাওয়া তার অবৈধ সুবিধার কিছুটা হলেও বহাল রাখতে পারবে দরকষাকষির মাধ্যমে। ভারতের এ মনোভাব এবার স্পষ্ট ধরা পড়েছে। তাই আওয়ামী লীগ সরকার পশ্চিমা চাপে জেরবার হলেও ভারত এবার শেখ হাসিনার নেই।

আওয়ামী লীগের জন্য আরেকটি বিপদ বিএনপির উত্থান। বিএনপি সারা দেশে এভাবে উজ্জীবিত, সংগঠিত হবে তা কদিন আগেও ছিল কল্পনাতীত। বস্তুত রাজনীতির মাঠ এখন বিএনপির দখলে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জনসভায় নেতাকর্মীদের উপস্থিতির তুলনামূলক বিচার করলেই তা স্পষ্ট হয়।

এর মধ্যে আওয়ামী লীগের বিপদ বাড়িয়েছে চরম অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং নিত্যপণ্যের আকাশছোঁয়া দাম। ডিমের ডজন ১৮০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। চিনির কেজি ১৪০ টাকা। এভাবে প্রতিটি পণ্যের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। সরকার ক্রমেই বিদেশি ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা হারাচ্ছে। ৪৫ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ ২৩ বিলিয়নে নেমেছে। আগামী কয়েক মাসে ১২ বিলিয়ন ডলার ঋণ শোধ করতে হবে, যেটা প্রায় অসম্ভব। এফবিসিসিআইর আওয়ামী সমর্থক সাবেক সভাপতি জসীম উদ্দিন বলেছেন, গত ৪০ বছরে এমন অর্থনৈতিক সঙ্কট তিনি দেখেননি। অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, সরকারের হাতে টাকাও নেই, ডলারও নেই। এক সময়ের এশিয়ার টাইগার খ্যাত বাংলাদেশকে এ অবস্থায় নিয়ে এসেছে সরকার।

আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে বিপর্যয়কর সরকারবিরোধী প্রবল জনমত। দেশে সম্প্রতি কোনো বিশ্বাসযোগ্য জনমত জরিপ হয়নি। বিভিন্ন গণমাধ্যমের অনলাইন জরিপ ও সোশ্যাল মিডিয়ায় এর কিছুটা আভাস মেলে। আওয়ামী লীগের অন্ধ সমর্থক গণমাধ্যমের প্রতিদিনকার জরিপেও দেখা, ৯০-৯৫ শতাংশ মানুষ সরকারবিরোধী মনোভাব প্রকাশ করেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষ ক্ষোভ উগরে দিচ্ছে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরো স্পষ্ট হবে। সরকারদলীয় একজন এমপির টিভি চ্যানেলে কথিত একজন বিজ্ঞানীর জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানিয়ে সচিত্র পোস্ট দেয়া হয়। তাতে দু হাজার লাইক পড়লেও হাহা রিঅ্যাক্ট পড়েছে আট হাজার।

এভাবে ঘরে বাইরে অসম যুদ্ধে রয়েছে সরকার। ফলে মনস্তাত্ত্বিক এবং নৈতিকভাবে তাদের পরাজয় ইতোমধ্যেই ঘটে গেছে। এর সর্বশেষ প্রমাণ শেখ হাসিনা এবং ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য।
সম্প্রতি জনপ্রশাসন পদক প্রদান অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘পুরস্কার পাওয়ার পর কারো মধ্যে হাসিখুশি দেখছি না। সবার মধ্যে মন মরা, মন মরা ভাব, কেন? সবাইকে হাসি খুশি থাকতে হবে।’

আর গণভবনে আওয়ামী লীগের এক সভায় ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমরা এখন এক সঙ্কটসঙ্কুল দুর্গম পথের যাত্রী।’
হতাশা কোন পর্যায়ে পৌঁছলে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এমন বক্তব্য আসে, বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব,
abdal62@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement