২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


‘মাগো আমি কি আর লেখাপড়ার সুযোগ পাবো না?’

- ছবি : নয়া দিগন্ত

‘মাগো, আমি কি আর লেখাপড়ার সুযোগ পাবো না?’ বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আর ক্লাস করতে পারবো না? মাকে এই প্রশ্নগুলো করেছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী খাদিজাতুল কুবরা। গত প্রায় এক বছর ধরে ছাত্রীটি জেলে বন্দী রয়েছেন। তার মা যতবারই জেলে তার সঙ্গে দেখা করতে গেছেন, ততোবারই মাকে তিনি এ প্রশ্নটি করেছেন। মা তার এই প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে পারেননি। কারণ আদালতের বারান্দায় বারান্দায় ঘুরেও মেয়ের জামিন তিনি করাতে পারেননি।

গত বছরের ২৮ আগস্ট পুলিশ মিরপুরের বাসা থেকে খাদিজাতুল কুবরাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। সেই থেকে কারাবন্দিত্বের এক বছর হতে আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি।

খাদিজাতুল কুবরার অপরাধ কী? তার অপরাধ কি এতটাই ভয়ঙ্কর যে, তিনি ছাড়া পেয়ে গেলে রাষ্ট্র ওলট-পালট হয়ে যাবে? তিনি কেন রাষ্ট্রের রোষানলে? মহামান্য হাইকোর্ট তাকে জামিন দিয়েছেন। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ ঝাঁপিয়ে পড়ে এই জামিন আদেশ স্থগিত করেছে চেম্বার জজ আদালতে। তরুণ বয়সের এই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে সরকার কেন জেলে আটকিয়ে রাখতে চাচ্ছে? বর্তমানে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে বন্দী রয়েছেন খাদিজা।

অনলাইনে সরকারবিরোধী একটি বক্তব্য প্রচারসহ দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণের অভিযোগ এনে ২০২০ সালের অক্টোবরে খাদিজা ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর দেলোয়ারের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে পৃথক দুটি মামলা হয় রাজধানীর কলাবাগান ও নিউ মার্কেট থানায়। দুটি মামলার বাদিই পুলিশ। ওই মামলাতেই খাদিজা গ্রেফতার হন। তার নামে যখন মামলাটি হয়, তখন খাদিজার বয়স মাত্র ১৭ বছর। অর্থাৎ তখনো সে শিশু-কিশোর পর্যায়ের। তাকে জেলে বন্দী করার কথা নয়। কোনো মানবিক রাষ্ট্রে কখনো এমনটি হয় না। কিন্তু মেয়েটির দুর্ভাগ্য যে, তাকে জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটাতে হচ্ছে। দিনের পর দিন চলে যাচ্ছে; অন্যান্য বন্ধুর মতো সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করতে পারছে না। সে আদৌ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করতে পারবে কি না, তার ছাত্রত্ব থাকবে কি না, সে ব্যাপারেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কিছু বলছে না।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই বা কেমন? তাদের একজন ছাত্রীকে এভাবে মাসের পর মাস জেলে বন্দী করে রাখা হচ্ছে অথচ তাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই। তারা টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করছেন না। না ভিসি, না কোনো শিক্ষক। শিক্ষকরা তো বিবেকবান হন। আজ কোথায় তাদের বিবেক? বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদেরও কী হলো? তাদেরও তো কোনো প্রতিবাদ করতে দেখছি না!

সরকার মন্ত্রিসভার বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট থাকবে না। সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট নামে নতুন আইন হবে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট যদি নাই থাকে, তাহলে এই আইনে করা মামলায় মেয়েটি কেন জেল খাটছে? তাকে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে না কেন? মহামান্য হাইকোর্ট মেয়েটিকে জামিন দিয়েছেন। সেই জামিন কেন স্থগিত করা হলো? সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে কেন যেতে হবে? তাই আমার মনে হয়, কালবিলম্ব না করে খাদিজাতুল কুবরাকে মুক্তি দিয়ে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেয়া হোক। তার সামনে সোনালি ভবিষ্যৎ পড়ে আছে। তার সেই ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দেয়ার অধিকার কারো নেই। অনলাইনে সরকারবিরোধী বক্তব্য প্রচারে তার হয়তো ভুল হয়েছে। সে জন্য তার ভবিষ্যৎ শেষ করে দিতে হবে? তাই অবিলম্বে তাকে মুক্তি দেয়া হোক এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে নিয়ে সঠিকভাবে তার লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেবে, সেই আশা আমরা করছি।

একই সঙ্গে নিবর্তনমূলক কালো আইন ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে যেসব মামলা হয়েছে সেগুলো তুলে নিয়ে এ মামলার সব আসামিকে মামলা থেকে খালাস করা হোক। ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে যে, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট একটি ভয়ঙ্কর কালো আইন। এই আইনে বেশি শিকার হয়েছেন সাংবাদিক ও রাজনৈতিক কর্মীরা। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সম্প্রতি সংসদে বলেছেন, ২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত এই আইনে ৭ হাজার একটি মামলা হয়েছে। গত পাঁচ মাসে নিশ্চয়ই আরো কয়েক শ’ মামলা হয়েছে। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট পাস হয় এবং ১১ অক্টোবর সেটি কার্যকর হয়। আইনটির ২২টি ধারাই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। এর ১৪টি ধারাই ছিল জামিন অযোগ্য। জাতিসঙ্ঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও দেশ আইনটি বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে। জাতিসঙ্ঘ এই আইনের ৮টি ধারাকে খুবই ভয়ঙ্কর উল্লেখ করে তা বাতিলের জন্য সরকারকে চিঠিও লেখে। এই আইনটির আগে আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারা ব্যবহার করে সরকার নির্যাতন চালিয়েছে। এই ৫৭ ধারার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। সরকার আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারা বাতিলের ঘোষণা দিলেও তা ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে ঢুকিয়ে দেয়। বর্তমানে আন্তর্জাতিক চাপে আইনটির পরিবর্তনের কথা বলা হলেও সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টে তা আবার রেখে দেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন মহল থেকে বলা হয়েছে, সরকারের এই পদক্ষেপ ‘নতুন বোতলে পুরনো মদ’ কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব
abdal62@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement