২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সিন্ডিকেটের শক্তির উৎস

সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে বাড়ছে ডিমের দাম। - ছবি : সংগৃহীত

ইংরেজি সিন্ডিকেট শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ চক্র। চক্রের অর্থ যে সবসময় ঋণাত্মক হয় তা নয়। ব্যবহারের ভিন্নতায় এটি ‘ইতি-নেতি’ মানে ইতিবাচক-নেতিবাচক দুই অর্থই বহন করে। যেমন- পাঠচক্র, মানে পাঠের ক্ষেত্রে দলবেঁধে পড়াশোনা করলে অবশ্যই তা ইতিবাচক। চা-চক্র হয় খানিকটা সময় আমোদে কাটানো। আবার বাণিজ্যের বেলায় কোনো পণ্যের দাম বাড়াতে ব্যবসায়ীরা একজোট হলে বলা হয় বাজার সিন্ডিকেট। যা শতভাগ নেতিবাচক। আমাদের দেশে হরহামেশাই দেখা যায়, সাধারণ মানুষের পকেট কাটতে ব্যবসায়ীরা বাজারে সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। এ ব্যাপারে তাদের জুড়ি মেলা ভার। তাই সাধারণের কাছে সিন্ডিকেট বা চক্র এখন ঋণাত্মক। একটি আতঙ্ক। শব্দটি শুনলে আমজনতার পিলে চমকে ওঠে। সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে কখন কোনো পণ্যের দাম আকাশছোঁয়া হয়, এই দুশ্চিন্তায় নাগরিক জীবনে ঘুম হারাম হওয়ার অবস্থা। এর মধ্যে যদি সরকার সিন্ডিকেটের কাছে অসহায় হয়ে পড়ে তা হলে সাধারণের দুঃখের আর সীমা-পরিসীমা থাকে না।

বাস্তবতা হলো, দেশে সিন্ডিকেট এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে, সরকারকেও রীতিমতো ব্যবসায়ী চক্রকে তোয়াজ করতে হচ্ছে। আপস করে চলতে হচ্ছে। আসলে দেশ এখন চলছে সিন্ডিকেটের অঙ্গুলি হেলনে। হোক তা ব্যবসায়-বাণিজ্যে কিংবা প্রশাসনে। ডিন্ডিকেটের নির্দেশই বড় কথা।

গত দেড় দশকে সরকারের একটি অংশের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশের ব্যবসায়-বাণিজ্যে গড়ে উঠেছে কিছু ব্যক্তির শক্ত দুষ্টচক্র। এরাই মূলত অলিগর। যাদের কাছে এখন বিপুল অর্থ। আসলে ক্ষমতার বলয়ের একটি অংশের হয়ে এদের কাছে জমা রাখা হয়েছে এই অর্থ। যে কারণে বাংলাদেশ এখন অতি ধনী হওয়ার দেশের তালিকায় বিশ্বসেরা। কতিপয় ব্যক্তি বা ক্ষুদ্র গোষ্ঠী রাতারাতি রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে বৈধ-অবৈধ উপায়ে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয়ার সুযোগ পেয়েছে। অন্য অর্থে বললে বলতে হয়, সুযোগ করে দেয়া হয়েছে- যাতে রাষ্ট্রীয় কোষাগার ফাঁকা করতে পারে। ফলে দেশের প্রায় সবাই দুর্বিষহ জীবনযাপন করলেও ওই গোষ্ঠীর টাকার কোনো অভাব নেই। নেই কমতি। তাদের ভোগে কোনো ধরনের টান পড়ছে না। রয়েছে ছেদহীন। তারা বিদেশে লাখ কোটি টাকা পাচার করে স্ত্রী-সন্তানদের ভিন দেশে আয়েশি জীবন নিশ্চিত করেছেন। তবে হালে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার অজানা আতঙ্কে অনেকে এখন আতঙ্কিত।

রাষ্ট্র বা দেশ চালাতে ক্ষমতাসীনরা কতটা পারদর্শি তা বোঝা যায়, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতায়। দেশে মূল্যস্ফীতির হার এক বছরের বেশি সময় ধরে বাড়তি। এ প্রবণতা শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও দেখা যাচ্ছে। তবে অনেক দেশ মূল্যস্ফীতি কমাতে পেরেছে। এমনকি শ্রীলঙ্কার মতো অর্থনৈতিকভাবে দুর্দশাগ্রস্ত দেশও অনেকটা নিয়ন্ত্রণে এনেছে। কিন্তু বাংলাদেশ পারছে না। গত বছরের আগস্ট মাস থেকে দেশে মূল্যস্ফীতির চাপ শুরু হয়। এ সময়ে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৮ শতাংশের নিচে নামেনি। এখন ১০ শতাংশের কাছাকাছি। সরকারি হিসাবে এতটা হলে বাস্তব পরিস্থিতি যে আরো নাজুক, তা বলাই বাহুল্য। মূল্যস্ফীতির কারণে দরিদ্র ও সীমিত আয়ের মানুষের অবস্থা সঙ্গিন। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে প্রতিটি নিত্যপণের দাম কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষের আয় বাড়েনি। উল্টো আরো কমেছে। ফলে তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে দারিদ্র্যের ফাঁদে পড়ে খাবি খাচ্ছেন। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছেন না।

বাস্তবে নিত্যপণ্যসহ কাঁচাবাজারে সব জিনিসের দাম বেশি। মাছ-গোশতের দাম অনেক আগে থেকে চড়া। এখন ডিমের দামও বাড়তি। এতে সাধারণ মানুষের বাজার খরচ আরেক দফা বাড়ল। এখন প্রতি হালি ডিমের দাম পড়ছে ৬০ টাকা। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ডজনে দাম বেড়েছে ১৫-২০ টাকা। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত এক মাসে ডিমের দাম বেড়েছে ১০ শতাংশের মতো।

সব কিছুর দাম কীভাবে বেড়েছে তা বুঝতে এখন আর কোনো উদাহরণের প্রয়োজন পড়ে না। তবু একটি জাতীয় দৈনিকের চিঠিপত্রের কলামে লেখা একটি পত্রের উদ্ধৃতি দিচ্ছি- ‘যেখানে গত বছরেও প্রতিটি ডাব কিনতে খরচ হয়েছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা, সেখানে বর্তমানে প্রতিটি ডাব কিনতে ১৫০-২০০ টাকা গুনতে হচ্ছে। রাজধানী ঢাকায় প্রতিটি ডাব কিনতে ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা করে গুনতে হচ্ছে। বর্তমানে দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা লাখ ছুঁই ছুঁই। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের সুস্থ ও সবল রাখতে ডাবের পানি কার্যকর ভূমিকা রাখছে। এ জন্য সম্প্রতি ডাবের চাহিদা তুলনামূলক বৃদ্ধিতে দেশের ডাব বিক্রেতা সিন্ডিকেট তৎপর। ডাবের আকাশচুম্বী দামের বিরূপ প্রভাব দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর ওপরও পড়ছে।’ (১৩ আগস্ট ২০২৩, প্রথম আলো)

এখন প্রশ্ন হলো, কেন সিন্ডিকেট গড়ে কারসাজির মাধ্যমে কিছু ব্যবসায়ী বাজার থেকে ক্রেতাদের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার পরও তাদের টিকিটি ছোঁয়া যাচ্ছে না? এর একটা ইঙ্গিত মিলবে গত ২৬ জুন দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও বাজার সিন্ডিকেট নিয়ে জাতীয় সংসদে কয়েকজন সংসদ সদস্যের বক্তব্যে। সেদিন তোপের মুখে পড়েন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।

ওই দিন সংসদে বক্তব্য দিতে গিয়ে গণফোরামের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান বলেছিলেন, ‘বর্তমান সরকারের সবচেয়ে ব্যর্থ মন্ত্রণালয় হচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাজারে গেলে মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এতটাই ব্যর্থ যে, এটিকে মানুষ সিন্ডিকেটবান্ধব মন্ত্রণালয় বলে।’ (২৬ জুন, ২০২৩, ডেইলি স্টার বাংলা) দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট জড়িত অভিযোগ করে তিনি আরো বলেছিলেন, ‘অনেকে সংসদে বলেছেন, বাণিজ্যমন্ত্রী এর সাথে জড়িত। কিন্তু তিনি এভাবে বলতে চান না। বাণিজ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে মোকাব্বির খান বলেন, ‘এত কিছুর পরও কেন আপনি পদত্যাগ করেন না?’

জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান বলেছিলেন, ‘শিল্প প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, বাজারে গিয়ে মানুষ কাঁদছে, তার একমাত্র কারণ সিন্ডিকেট।’ পীর ফজলুর রহমান আরো বলেন, ‘আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, পণ্যমূল্যে কিছু ব্যবসায়ী সুযোগ নিচ্ছেন। যারা এই সুযোগ নিচ্ছেন, যারা সিন্ডিকেট করে মূল্যবৃদ্ধি করেন, আমাদের বাণিজ্যমন্ত্রী তাদের ধরেন না কেন? তিনি নিজে একজন ব্যবসায়ী মানুষ। তিনি তো জানেন কোন ব্যবসায়ীরা এটি করছেন। তাহলে এই ব্যবসায়ীরা কি ওনার ঘনিষ্ঠজন, যে কারণে উনি সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের ধরতে পারছেন না?’ জবাবে বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে হঠাৎ করে ক্রাইসিস তৈরি হবে বলে মন্তব্য করেছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তখন সংসদে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘চাইলে জেল-জরিমানাসহ বাজার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব। এটি ঠিক যে, বড় বড় গ্রুপগুলো একসাথে অনেক বেশি ব্যবসায় করে। আমাদের লক্ষ্য রাখা দরকার- আমরা জেলে ভরলাম, জরিমানা করলাম, সেটি হয়তো করা সম্ভব। কিন্তু তাতে হঠাৎ করে যে ক্রাইসিস তৈরি হবে সেটি সইতে তো আমাদের কষ্ট হবে। এ জন্য আমরা আলোচনার মাধ্যমে নিয়মের মধ্যে থেকে চেষ্টা করি।’

এখনো বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, ‘সিন্ডিকেট সবসময় সুযোগ খোঁজে বাজারে কারসাজি করে মূল্যবৃদ্ধির জন্য। ভোজ্যতেল, চিনি ও গমের মতো অনেক পণ্যের ৯০ শতাংশই আমদানিনির্ভর, যা মাত্র কয়েকটি কোম্পানি নিয়ন্ত্রিত। তবে কারসাজির অভিযোগে কোনো কোম্পানির কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়াও সমাধান নয়, তাতে সরবরাহ ব্যাহত হয়ে ভোক্তাদের দুর্ভোগ আরো বাড়বে’। (১২ আগস্ট, ২০২৩, আমাদের সময়)

উপরের উদ্ধৃতিগুলো থেকে কারো এটি বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, ব্যবসায়-বাণিজ্যে সিন্ডিকেটের নামে যে দুষ্টচক্র আমাদের অর্থনীতিতে জেঁকে বসেছে তা আসলে ‘সর্ষের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ভূত’। এ ভূত তাড়ানোর কথা সরকারের। কিন্তু খোদ ক্ষমতাসীনদের একটি অংশ এর সাথে জড়িত মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এতে করে সরকার অসহায় সিন্ডিকেট ভাঙতে। তাই তো এ ভূত বহাল তবিয়তে রয়েছে। তা না হলে যে অনেকের অর্থের উৎস বন্ধ হয়ে যাবে? তাদের আয়েশি জীবনে টান পড়বে!


আরো সংবাদ



premium cement