২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ডেটলাইন ১৭ নভেম্বর

- ছবি : নয়া দিগন্ত

যেকোনো সমাজেই ছোট ছোট সমস্যা একত্রে জড়ো হয়ে বড় বড় সমস্যার সৃষ্টি করে। সমস্যাগুলো যখন ছোট থাকে তখন তাতে মনোযোগ দিলে সহজেই সমাধান করা সম্ভব হয়। কিন্তু সমস্যাগুলো জমিয়ে রাখলে সমাধান করা তো সম্ভব হয়ই না বরং তা বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। বাংলাদেশে এখন তেমনই এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সরকার বলতে পারে সমস্যা কখনো ছোট ছিল না। প্রতিটা সমস্যাই বড় সমস্যা। তাই যদি হয় তাহলে তার অবসানের জন্য শুরু থেকেই মনোযোগী হননি কেন? এই যেমন ধরা যাক নির্বাচনের সমস্যা। প্রতিটি নির্বাচনে ছলেবলে কৌশলে বিজয় ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। কখনো সফল হয়, কখনো ব্যর্থ। সফল বা ব্যর্থ যাই হোক না কেন- এ ক্ষেত্রে ভোটারদের ওপর তারা চরম দমনমূলক ব্যবস্থা নেয়। ভোটাররা থাকে নিরস্ত্র কিন্তু সরকার নানা শক্তিতে বলীয়ান থাকে। তারা তাদের দলীয় গুণ্ডা মাস্তান যেমন লেলিয়ে দেয়, তেমনি মাস্তানদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের দিকে চোখ বন্ধ করে থাকে। ফলে অপরাধীগুলো সঙ্ঘবদ্ধ হয় এবং খুন খারাবিতে জড়িয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে সরকারের গুণ্ডা মাস্তান বাহিনীই তাদের একমাত্র ভরসা নয়। তারা এর সাথে যুক্ত করে হেলমেট বাহিনী। দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পেটোয়া বাহিনী, র‌্যাব ও পুলিশবাহিনী, বিজিবি বাহিনী প্রভৃতি সশস্ত্রবাহিনী। এদের প্রধান কাজগুলো করে বিরোধীদের হত্যা এবং তারা নিশ্চিত যে এসব নরহত্যার কোনো দিনই বিচার হবে না। সরকারের তরফ থেকে তাদের এক ধরনের দায়মুক্তি দেয়া হয়। পুলিশ বিনা কারণে বিরোধীদের দমনে যত নৃশংস। সরকারি দলের লোকদের প্রতি ততই নমনীয়। আমরা লক্ষ করেছি যেকোনো ঘটনা ঘটলেই হাজারে হাজারে বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা দায়ের করে দেয়।

শুধু পুলিশ নয়, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও শত শত, কখনো কখনো হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করে। এতো নেতাকর্মীকে তারা চেনে কিভাবে। চিনতে তো পারে না। তখন পুলিশ ও আওয়ামী লীগাররা হাজারে হাজারে গায়েবি মামলা দায়ের করে। এদের পাঁচ-দশ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। বাকি হাজার হাজার আসামি থাকে গায়েবি। অর্থাৎ যেকোনো মামলায় যখন যাকে খুশি গ্রেফতার করে জেলে ভরে দেয়া যায়। এই পৈশাচিক ব্যবস্থা আওয়ামী লীগ চালু করেছে। এখন আর একটি ব্যবস্থা চালু হয়েছে।

আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই যে পুলিশের ছত্রছায়ায় আওয়ামী নেতাকর্মীরা বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। হামলা শেষে তারাই আবার বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে মামলা করছে। গ্রেফতার করে কারাবন্দী করছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এই মামলাগুলো দেয়া হচ্ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে, যার কোনো জামিন নাই। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পৃথিবীর দেশগুলোতে সবচেয়ে নিকৃষ্ট আইন বলে অভিহিত হচ্ছে। এবং সারা দুনিয়ায় বলতে গেলে এই আইনের বিরোধিতা করেছে। তারা বলছেন গণতন্ত্র ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন একসাথে চলতে পারে না। সরকার এ নিয়ে খুব বেশি উচ্চবাচ্য না করলেও আইনের যথেচ্ছ প্রয়োগ চালিয়ে যাচ্ছে। এখন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে মামলা মানে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা। যাও, অনির্দিষ্ট কালের জন্য জেলের ঘানি টানতে থাকো। জামিনের আশা কুহকমাত্র। নিম্ন আদালত থেকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত কোথায়ও সহজে জামিন মেলে না। বহুদিন পর রাজশাহীর সাবেক মেয়র মিজানুর রহমান মিনুকে উচ্চ আদালত জামিন দিয়েছেন। এটি একটি বিরল ঘটনা।

ইতোমধ্যে পশ্চিমাবিশ্ব র‌্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা তো জারি করেছেই, একই ভাবে ভিসা নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করেছে। এই ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরো বড় অস্ত্র। এই নিষেধাজ্ঞা অনুযায়ী পুলিশ প্রশাসন, সাবেক বা বর্তমান আমলা, বিচার বিভাগ যে কারো ওপর পশ্চিমা দেশগুলো ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারবে। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে তাদের সন্তানসন্ততি, আত্মীয়স্বজন, ব্যবসায়ী অংশীদার কেউই আর পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলোর ভিসা পাবে না। শুধু তাই নয় যুক্তরাষ্ট্রে যাদের সহায় সম্পদ আছে সেগুলো বাজেয়াফত হয়ে যাবে। এর প্রতিক্রিয়ায় সরকার সংশ্লিষ্টদের সাহস দেয়ার জন্য মাঝে মধ্যেই হুঙ্কার ছাড়ে, রাষ্ট্রদূতদের তলব করে, ভিয়েনা কনভেনশন দেখায়। কিন্তু ওইসব দেশ সামান্যই গুরুত্ব দেয়।

এই ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় আছে ব্যবসা বাণিজ্য ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা। সরকার যতই হম্বিতম্বি করুক পশ্চিমাদের এই সব নিষেধাজ্ঞার প্রতি তাদের গুরুত্ব দিতে হচ্ছে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র মানবাধিকার পরিস্থিতি ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অবস্থা ভয়াবহ। দুর্নীতি ও লুটপাট সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেই। নেয়ার কোনো সম্ভাবনাও নেই। ফলে এর বিরুদ্ধেও পশ্চিমারাও সোচ্চার। এতে বিদেশে ব্যাংকে গচ্ছিত বাংলাদেশীদের হাজার হাজার কোটি ডলার জমা পড়ে আছে। তার মধ্যে বাংলাদেশীরা তুলে এনেছে দশ হাজার কোটি ডলার। সে টাকা নিলো কোথায় সরকারের কাছে তার কোনো হিসাব নেই। এখন অর্থনীতি প্রায় দেউলিয়া হয়ে গেছে। ডলারের অভাবে তেল কয়লা আমদানি করা যাচ্ছে না। ফলে বিদ্যুৎ বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য লাগাম ছাড়া। সাধারণ মানুষের ত্রাহি অবস্থা।

এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষ এবং সারা বিশ্ব বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছে। একটি অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য এই মুহূর্তে গোটা পশ্চিমা দুনিয়া বাংলাদেশের মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার আহ্বান জানাচ্ছে। কিন্তু বর্তমান সরকার প্রায় ১৫ বছর ধরে মানুষের যে ভোটাধিকার দমন করে রেখেছে। গত ১৫ বছরে কোনো পর্যায়েই মানুষ স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারেনি। সরকার যদিও বলছে যে তারা মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করেছে। কিন্তু কোথাও কেউ নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পেরেছে এমন শোনা যায় না। অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের যাবতীয় পথ সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। জনগণের ওপর হামলা মামলা, ভোট দানে বাধা স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। এখন জনগণের কোনো চয়েজ নেই। তারা আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য। এর ব্যতিক্রম কেউ করলে তাদের এমনকি প্রাণ সংশয়ও সৃষ্টি হতে পারে। সে কারণে মানুষ ভোটকেন্দ্রে যাওয়া প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। এখন যে যুবকের বয়স ২৫ বছর, সে জানেই না অবাধ ও নিরপেক্ষ ভোট কাকে বলে। কিভাবে নিজের পছন্দের প্রার্থীকে জিতিয়ে আনা যায়।

সরকার এই অবস্থা সৃষ্টি করেছে গুম, খুন, হামলা মামলা প্রভৃতি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবি সরকারের হয়ে এই সব খুন-খারাবি ও দমন পীড়ন চালিয়েছে। ফলে মানুষ ভোটকেন্দ্রে যেতে রীতিমতো আতঙ্কিত এবং নিজের প্রাণনাশের আশঙ্কায় ভীতসন্ত্রস্ত। এ রকম একটা বর্বর নিষ্ঠুর ও পৈশাচিক অবস্থার মধ্যে সরকার নির্বাচনের নামে প্রহসন চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারের এরকম জনবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে দেশে যেমন তেমনি গোটা গণতান্ত্রিক বিশ্বে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। দুনিয়ার ধনী দেশগুলো সরকারকে নানাভাবে এই বলে সতর্ক করছে যে, সরকার যদি এভাবেই স্বৈরশাসন চালিয়ে যেতে থাকে তাহলে তারা পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের অবরোধের শিকার হবে। সরকার এমন কথায় শুরুতে তেমন একটা গুরুত্ব নেয়নি। কিন্তু র‌্যাবের ওপর যখন মার্কিন নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো তখন এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য দেশে দেশে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরতে থাকলো। র‌্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা মাজেজা ছিল সর্বব্যাপী। প্রথমত নিষেধাজ্ঞা অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিরা তাদের সন্তান-সন্ততি কেউই যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাবেন না। এমনকি তারা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারবেন না। সবচেয়ে বড় আশঙ্কাটি ছিল র‌্যাবে কর্মরত কেউ জাতিসঙ্ঘ শান্তি মিশনে যোগ দিতে পারবেন না।

র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবি, সেনাবাহিনীর সদস্যরা সাধারণত জাতিসঙ্ঘ শান্তি মিশনে যোগ দিতেন, যেখান থেকে তারা এক ধাক্কায় সৎপথে কোটি টাকা উপার্জনও করতেন। সরকার প্রথমে এই অবস্থা উলটানোর চেষ্টা করেছে। ব্যর্থ হয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে হুমকি পর্যন্ত দিয়েছে। এই হুমকি যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমাবিশ্বকে ভয় দেখানোর জন্য নয় বরং তার ত্রাসের অংশীদার র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবি, প্রশাসন ও বিচার বিভাগের মনে সাহস জোগানোর জন্য।

এর মধ্যে যারা পৃথিবী থেকে সরকারের জন্য তদবিরের পর একটা সুসংবাদ আসতে থাকে। কেউ বলে, বাণিজ্য হ্রাস করে দিবে, কেউ বলে বাংলাদেশে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হলে তৈরী পোশাক আমদানি বন্ধ করে দিবে। রাগের চোটে প্রধানমন্ত্রী বলে বসলেন যে, আমরা ২২ ঘণ্টা বিমান জার্নি করে যুক্তরাষ্ট্রেই যাবো না। পৃথিবীতে আরো অনেক মহাসাগর মহাদেশ আছে আমরা তাদের সাথে বাণিজ্য করব। এগুলো পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কিছু নয়।

কিন্তু সরকার নিশ্চিত জেনে গেছে যে, তাদের স্বৈরশাসন, অপশাসন, দুঃশাসন ও ব্যাপক লুণ্ঠনের ফলে দেশ ইতোমধ্যেই ফোকলা হয়ে গেছে। পশ্চিমা দেশগুলোর দাবি বাংলাদেশে যে কোনো মূল্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে আর মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অবারিত করতে হবে। এখানে কোনো ছাড় নেই।

বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনই মুখ্য দাবি কিন্তু সরকার সে পথে হাঁটছে না তারা জানে যে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচনে তাদের শোচনীয় পরাজয় ঘটবে। আর তাই ঢাকা-১৭ উপনির্বাচনে তারা একটা কারচুপির নির্বাচন করল। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মোহাম্মদ আলী আরাফাত। তার প্রতিদ্ব›দ্বী ছিলেন একজন সাধারণ মানুষ- হিরো আলম। তার কোনো দল ছিল না। তিনি খুব উচ্চশিক্ষিত নহেন। তিনি জনগণের শক্তিতে বলীয়ান ছিলেন। কিন্তু গোটা সরকার র‌্যাব, পুলিশ, বিজিবি হেলমেট বাহিনী, লাঠি বাহিনী এমনই সব শক্তি নিয়ে সরকার হিরো আলমের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভোটের আগে নির্বাচনী প্রচারণার সময় তার ওপর হামলা চালানো হয়। আর নির্বাচনের দিন তো রীতিমতো যুদ্ধ। কেন্দ্রের ভিতরে আওয়ামী লীগের অনুসারীরা তার ওপর হামলা চালায়। তখন পুলিশের সদস্যরা তাকে কেন্দ্র থেকে বের করে লাঠিসোটাধারী আওয়ামী ঘাতকদের হাতে তুলে দেয়। তারপর তারা হিরো আলমকে ইচ্ছেমতো পিটায়। তাকে মারায় পরিস্থিতি এতোটাই খারাপ ছিল যে শেষ পর্যন্ত তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। যে পুলিশ সদস্য হিরো আলমকে আওয়ামী লীগের ঘাতক বাহিনীর মধ্যে ছেড়ে দিলো তার কি কোনা বিচার হবে? আওয়ামী শাসন আমলে না হলেও বিচার একদিন হবেই। এরকম হাজার হাজার লোক পুলিশ ও প্রশাসন আছে। ন্যায়বিচার করেননি এমন বিচারকও আছেন। তারা সবাই মার্কিন ভিসার নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসবেন। আমরা সেই সুদিনের অপেক্ষায় আছি।

লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement