০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১, ২২ শাওয়াল ১৪৪৫
`


জগৎশেঠের আমলনামা

জগৎশেঠ - ফাইল ছবি

বাংলাভাষায় জগৎশেঠের মতো কুৎসিত গালি খুব কমই আছে। অসভ্য ও অশিক্ষিতজনদের মধ্যে জন্তু-জানোয়ারের নাম করে কেউ গালি দিলে যেভাবে ভুক্তভোগীদের আঁতে ঘা লাগে তার চেয়েও বেশি আঘাত হানে যখন শিক্ষিত সমাজের কাউকে মীরজাফর কিংবা জগৎশেঠ বলে গালি দেয়া হয়। দেশের বাজারে এখন গালাগালির আগুন ঝরছে। মানুষ তার দৈনন্দিন দুর্ভোগ, দুর্দশা, অভাব-অভিযোগ-চাহিদা কিংবা প্রয়োজন অথবা আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিকার না পেয়ে সমানে খিস্তিখেউড় অথবা গালাগাল দিয়ে যাচ্ছেন এবং যার যার অবস্থান শিক্ষা-দীক্ষা এবং পরিবেশ প্রতিবেশ অনুযায়ী জন্তু-জানোয়ার কিংবা মীরজাফর-জগৎশেঠের নাম উল্লেখ করে পথে-মাঠে-হাটে-বাজারে, অফিস-আদালতে কিংবা জুয়ার কোর্টে অথবা আরো পাপ-পঙ্কিল স্থানগুলোতে হরহামেশা গালাগাল দিয়ে যাচ্ছেন!

মানুষ কেন গালি দেয়- কখন গালি দেয় এবং গালাগালের বাহারি রসায়নে ত্রিভুবনে অর্থাৎ স্থলভ‚মিতে মাটির নিচে অথবা আকাশে কি সব ঘটনা ঘটে তা নিয়ে রসঘন একটি আলোচনা হতে পারে। কিন্তু আজকের নিবন্ধে ওসব নিয়ে কিছু বলব না। আজ শুধু জগৎশেঠ নিয়ে কিছু কথা বলব। আলোচনার শুরুতে বলে নেয়া ভালো যে জগৎশেঠ নামটি মূলত একটি উপাধি যা কি না দেয়া হয়েছিল মানিক চাঁদ নামে জনৈক ব্যক্তিকে। লোকটির বাড়ি ছিল ভারতের রাজস্থানে এবং তিনি ব্যবসায়-বাণিজ্য করতেন তৎকালীন জমানার ভারতবর্ষ এবং ভারতবর্ষের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে এমন সব এশীয় ও ইউরোপীয় দেশগুলোর সাথে।

মানিক চাঁদের মূল ব্যবসায় ছিল ব্যাংকিং এবং ভারতবর্ষ তো বটেই সম্ভবত দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিক ছিলেন মানিক চাঁদ। বাংলার তৎকালীন রাজধানী মুর্শিদাবাদে তার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সদর দফতর ছিল এবং সেখানে তার যে প্রাসাদ ছিল যা হাউজ অব জগৎশেঠ নামে মশহুর ছিল তার প্রভাব ও গুরুত্ব তৎকালীন ভারতবর্ষের রাজা-মহারাজা এবং সম্রাটদের প্রাসাদের তুলনায় বেশি ছিল। মানিক চাঁদ এবং তার পরিবারের সদস্যরা মিলে এমন এক অর্থ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন যার সাথে বর্তমান জমানার কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়িক গোষ্ঠী অথবা সিন্ডিকেটের তুলনা চলে না। হাল আমলের রাজনীতি এবং রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে দেশ-বিদেশে যেসব জগৎশেঠ পয়দা হয়েছে সেসব জগৎশেঠের আদি ও আসল পিতা মানিক চাঁদ যে কত বড় জগৎশেঠ ছিলেন তার কিছু নমুনা পেশ করলেই সম্মানিত পাঠক প্রকৃত ঘটনা অনুধাবন করতে পারবেন।

আলোচনার শুরুতেই বলেছি, জগৎশেঠ কোনো নাম নয় অর্থাৎ ইংরেজিতে নাউন (Noun) বলতে যা বোঝায় তা নয়। এটি একটি উপাধি অর্থাৎ বিশেষণ। আমরা কমবেশি সবাই জানি যে, নামের আগে দোষ-গুণ ইত্যাদি বোঝাতে যে উপাধি ব্যবহার করা হয় তাই বিশেষণ। জগৎশেঠ বিশেষণটি এখন দোষবাচক উপাধি। কিন্তু আদতে অর্থাৎ আদিকালে এটি ছিল গুণবাচক। মুঘল সম্রাট ফররুখ শিয়ার মানিক চাঁদকে যখন জগৎশেঠ উপাধি দিয়েছিলেন তখন পুরো ভারতবর্ষে হই চই পড়ে গিয়েছিল। এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলার আগে মানিক চাঁদের ব্যবসায়-বাণিজ্য ও জগৎশেঠের আভিধানিক অর্থ নিয়ে দু’-চারটি কথা বলা অবশ্যক।

জগৎশেঠের দুটো অর্থ ইংরেজিতে পাওয়া যায়। Banker of the world Ges Merchant of the world অর্থাৎ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ব্যবসায়ী অথবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ব্যাংকার। ১৭৫০ সালের পৃথিবীতে জগৎশেঠ অর্থাৎ মানিক চাঁদের চেয়ে বড় ব্যবসায়ী দুনিয়ার কোথাও ছিল না- এমনকি কোনো রাজকোষেও তার মূলধনের সমপরিমাণ অর্থ ছিল না। ব্যাংকিং, হুন্ডি, মুদ্রা বিনিময়, সুদের ব্যবসায়, রাজনীতি-যুদ্ধ ইত্যাদিতে বিনিয়োগ ছাড়াও বিভিন্ন রাজা-বাদশাহ-সম্রাটদের দীর্ঘমেয়াদে ঋণ দেয়ার যে ব্যবস্থা তিনি গড়ে তুলেছিলেন তার সাথে তুলনীয় কোনো বিধিব্যবস্থা তার পরে পৃথিবীতে আর দেখা যায়নি। পুরো ভারতবর্ষ-ইউরোপ-আফ্রিকা, মধ্য এশিয়া-চীন-মধ্যপ্রাচ্যসহ সিল্করুট কেন্দ্রিক ব্যবসায়-বাণিজ্যে জগৎশেঠের পরিবারের আধিপত্য ছিল একচেটিয়া।

মানিক চাঁদ ওরফে জগৎশেঠের বিনিয়োগে মুঘল প্রাসাদে যে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে তাতে সম্রাট হিসেবে শাহজাদা ফররুখ শিয়ার সিংহাসন লাভ করেন এবং ক্ষমতায় বসেই তিনি তার অর্থদাতা মানিক চাঁদকে জগৎশেঠ উপাধিতে ভ‚ষিত করেন। সম্রাট ফররুখ শিয়ারের জমানায় জগৎশেঠ অতিমাত্রায় রাজনৈতিক ক্ষমতার মালিক হয়ে পড়েন এবং রাষ্ট্রক্ষমতার আনুক‚ল্যে তার ব্যবসায়-বাণিজ্য ফুলে ফেঁপে রীতিমতো গগনচুম্বী হয়ে ওঠে। সম্রাট ফররুখ শিয়ারের পূর্ববতী মুঘল শাসকরা জগৎশেঠের কাছ থেকে নিয়মিত অর্থ ধার নিতেন আর বাঙলা, বিহার, উড়িষ্যার শাসক হিসেবে নবাব মুর্শিদকুলি খান, সরফরাজ খান, আলিবর্দী খান- সবাই জগৎশেঠের সাহায্য নিয়ে রাজকোষ চালাতেন। তার মাধ্যমে খাজনা বিনিময়-সৈন্য সামন্ত-রাজ কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও মুঘল দরবারে খাজনার অংশ পাঠানোর কাজ করতেন।

ভারতবর্ষের রাজা-বাদশাহ আমির-ওমরাহ ও ব্যবসায়ী ছাড়াও বিদেশী কোম্পানিগুলো জগৎশেঠের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ গ্রহণ করত। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছাড়াও ফরাসি, ওলন্দাজ, পর্তুগিজ, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আর্থিক সঙ্কটে ও ব্যাংকিং লেনদেনে জগৎশেঠ ছিলেন প্রধানতম ভরসা।

উল্লিখিত জগৎশেঠের যে উত্থান রাজনীতি ও রাষ্ট্রক্ষমতার মাধ্যমে হয়েছিল তা আবার বিপর্যয় ও পতনের মুখে পড়ে রাজনীতির কারণে। দিল্লিতে কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতা, একের পর এক প্রাসাদ-ষড়যন্ত্র ও ঘনঘন ক্ষমতার পরিবর্তনের কারণে জগৎশেঠ দিল্লির শাহী প্রাসাদ রাজকোষ এবং তৎসংলগ্ন ব্যবসায়-বাণিজ্য থেকে পুঁজি প্রত্যাহার করে বাংলায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি করেন এবং ভারতে ব্যবসারত বিদেশী কোম্পানি বিশেষত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করেন।

জগৎশেঠ পরিবারের ব্যবসায়-বাণিজ্য রাজনৈতিক প্রভাব ও কর্তৃত্ব সব কিছুই ঠিক ছিল। কিন্তু বাংলার সিংহাসনে তরুণ নবাব সিরাজউদ্দৌলার যখন অভিষেক হলো, তখন তিনি হঠাৎ এক আর্থিক বিপত্তির মধ্যে পড়ে গেলেন। নতুন নবাব জগৎশেঠের কাছে তৎকালীন জমানার তিন কোটি মুদ্রা অনুদান হিসেবে চেয়ে বসলেন। জগৎশেঠ নতুন নবাবকে ঋণের পরিবর্তে অনুদান দিতে অস্বীকার করলেন। নবাব ও জগৎশেঠের বিরোধ বারুদের মতো ছড়িয়ে পড়ল। জগৎশেঠ নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য পরে যে নোংরামি করেছেন এবং যেভাবে নবাব মীর কাসিমের হাতে তার নির্মম মৃত্যু ঘটেছে তার দ্বিতীয় নজির পৃথিবীতে নেই।

আমরা আজকের আলোচনার একেবারে শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। জগৎশেঠের উল্লিখিত আমলনামার সাথে জগৎশেঠ নামের যে ঘৃণিত গালি তার কারণ বর্ণনা না করলে আজকের নিবন্ধ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। কোনো ব্যবসায়ী যখন টাকা উপার্জনের ক্ষেত্রে নীতি-নৈতিকতা অনুসরণ করেন না তখন তাকে জগৎশেঠের সাথে তুলনা করা হয়। আবার কোনো ব্যবসায়ী যখন কেবল টাকা উপার্জনের জন্য রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন এবং নিজের অবৈধ অর্থ দিয়ে অবৈধ শাসক তৈরি ও অবৈধ শাসন প্রলম্বিত করার জন্য রাষ্ট্রের অর্থব্যবস্থা তছনছ করতে থাকেন তখন তার জন্য জগৎশেঠ গালিটি অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কোনো বৈধ শাসকের পতন অবৈধ শাসকের পদলেহন ও রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করে রাজনীতির ধ্বংস সাধনের জন্য যখন ব্যবসায়ীরা হর্তাকর্তা, ত্রাণকর্তা, সর্বেসর্বায় পরিণত হন তখন তাদের জন্য জগৎশেঠ গালিটি তাদের গলার মালায় পরিণত হয় ও নিয়তির টানে তারা নবাব মীর কাসিমের কবলে পড়েন এবং ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত বিখ্যাত মুঙ্গের দুর্গের চূড়ায় উঠিয়ে তাদেরকে নদীতে নিক্ষেপ করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement