২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ভানুমতির খেলা বনাম ন্যাড়ার বেলতলা

- ছবি : নয়া দিগন্ত

কোনো সঙ্কট হলেই সংলাপের প্রশ্ন ওঠে। সংলাপ যেকোনো সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ সমাধানের সহায়ক একটি পদক্ষেপ। এ জন্য প্রধান দুটো দলের কেউই দায়িত্বশীল অবস্থান অতীতে দেখাতে পারেনি। তবে এই সরকারের আমলে ক্ষমতাসীনদের একগুঁয়ে আচরণ সব ধরনের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। তালগাছ আমার- এই অবস্থান থেকে তারা সরতে পারেনি। ২০১৮ সালে তারা সংলাপকে প্রতারণার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। সে জন্য দলটিকে এখন কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না।

সংলাপ তখনই ফলপ্রসূ হয় যখন সংলাপ আহব্বানকারীর মধ্যে সমস্যা সমাধানে সৎ ইচ্ছার কোনো প্রকার অভাব থাকে না। বিদেশীরাও সংলাপের পক্ষে মত দিয়েছেন। সংলাপ ডাইরেক্ট বা ভায়া মিডিয়া অর্থাৎ ইনডাইরেক্ট হয়ে থাকে। সংলাপের উদ্দেশ্য যদি হয় কালক্ষেপণ বা চতুরতার মাধ্যমে এক পক্ষ অপর পক্ষকে ঠকিয়ে নিজ অবস্থানে অনড় থাকা, তবে সে ক্ষেত্রে সংলাপের মধুরতা নিমতিতায় পর্যবসিত হয়। যেমনটি হয়েছিল ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের সংলাপ, যার ফলে বিএনপিকে দেয়া হয়েছে মাত্র ছয়টি আসন। বিএনপিকে ভানুমতির খেলার খেলোয়াড় বানিয়ে তথাকথিত নির্বাচনের বৈধতা নেয়া হয়েছে, যদিও নির্বাচনটি জনগণের গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।

জাতীয় নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে আসছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন হবে মর্মে সরকার অনড়। বিএনপি ও সমমনা জোট অনড় রয়েছে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে যাবে না। দুই দলই তাদের নড়াচড়ার কোনো অবকাশ নেই। তবে স্থানীয় প্রবাদ রয়েছে, ‘অল্প বয়সে মুখে দাড়ি এবং নদীর পাড়ে বাড়ি’র কোনো বিশ্বাস নেই। তেমনি রাজনৈতিক কঠোর অবস্থান কখন কোথায় বিলীন হয়ে যায় তা কেউ নিশ্চয়তা দিতে পারে না।

বিএনপির সামনে এখন দু’টির যেকোনো একটি অপশন খোলা রয়েছে। প্রথমত, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে গণঅভ্যুত্থান ঘটানো, নতুবা দ্বিতীয়ত, ২০১৪ সালের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন শুধু বর্জন নয়; বরং গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা। আন্দোলনকে তখনই গণঅভ্যুত্থান বলা যায় যখন বিচার বিভাগ, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জনগণের দাবির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করতে বাধ্য হয়। জনতার দাবির সাথে এ তিন বিভাগের একাত্ম না হলে আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয় না।

উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ১৯৭১ সালের ৯ মার্চ পূর্বপাকিস্তান হাইকোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী যদি পূর্বপাকিস্তানের নবনিযুক্ত গভর্নর জেনারেল পদে মেজর জেনারেল টিক্কা খানকে শপথবাক্য পাঠ করাতেন তবে মাত্র ৯ মাসে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কল্পনাও করা যেত না। বিচারপতি বি এ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন বিচার বিভাগের ভ‚মিকা ছিল তৎসময়ে পূর্বপাকিস্তানের জনগণের পক্ষে। বর্তমানে ২০২৩-এর প্রেক্ষাপট এবং ১৯৬৮ থেকে ১৯৭১-এর প্রেক্ষাপট আকাশ-পাতাল ভিন্ন। এ দেশে আইন দুই ভাগে প্রয়োগ হয়। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী অসুস্থ, তিনি প্রায় ৮০ বছরের বয়স্ক, কথিত সাজার কারণে চিকিৎসার জন্য তিনি বিদেশে যাওয়ার অনুমতি পান না। পক্ষান্তরে ক্যাসিনো সম্রাটখ্যাত এক ব্যক্তির, বিদেশে যাওয়ার অনুমতি বাতিল করার জন্য দুদকের আবেদন শুনানির আগেই তিনি ভারতে চলে গেছেন বা এর সুযোগ পেয়েছেন।

সংবিধান হলো সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি। তবে যেখানে রাজতন্ত্র সেখানে রাজা বা রানীর সিদ্ধান্তই শিরোধার্য হলেও একটি নিয়মকানুনে রাষ্ট্র চলে যা ‘অলিখিত সংবিধান’ নামে পরিচিত। সে রাষ্ট্রগুলোর অলিখিত সংবিধান আমাদের রাষ্ট্রের ‘লিখিত সংবিধানের’ চেয়ে বেশি সচল। রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা ও নাগরিক অধিকারের মধ্যে সমন্বয় সাধন করাই হলো সংবিধানের মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধান জনগণের অধিকার কতটুকু নিশ্চিত করেছে এবং এ মর্মে ব্যর্থতা কেন এবং কোথায়, এটিই এখন পর্যালোচনার বিষয়। বিভিন্ন সময়ে সরকার, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হঠকারী কার্যকলাপ ও সরকারি দলের আনুক‚ল্য পাওয়ার জন্য একপেশে ভ‚মিকা রাখায় ভোটদানের প্রতি ভোটারদের আগ্রহ দারুণভাবে কমে গেছে।

গুলশানের মতো অভিজাত এলাকায় (ঢাকা-১৭) নির্বাচন কমিশনের ভাষ্যমতে, মাত্র সাড়ে ১১ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছে। আবহাওয়া ছিল স্বাভাবিক, অধিকন্তু ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার স্বদর্পে বলেছিলেন, শান্তিশৃঙ্খলার যদি কোনো ব্যত্যয় ঘটে তবে তিনি নাকে খত দিয়ে দায়িত্ব ছেড়ে চলে যাবেন। ভোটারদের নিরাপত্তা তো দূরের কথা, ভোটকেন্দ্রে জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে নিকটতম প্রধান প্রতিদ্ব›দ্বী হিরো আলমকে হামলা করার নগ্ন দৃশ্য সোশ্যাল মিডিয়া, ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও পত্রপত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে। এমতাবস্থায় ডিএমপি কমিশনার নাকে খত দিয়ে দায়িত্ব ছেড়ে চলে গেলে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন হতো, কিন্তু মুখে লম্বা কথা বললেও কার্যত এমন দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে নেই। তবে তিনি পদত্যাগ করবেন, নাকি জনগণকে বোকা বানিয়ে স্বপদে বা উচ্চতর পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন সেটি অচিরেই আমরা দেখব।

প্রধানমন্ত্রী সংবিধান মোতাবেক রাষ্ট্রের সর্বময় কর্মকর্তা, তিনি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এহেন পরিস্থিতির কী জবাব দেবেন? কারণ ইইউ প্রতিনিধিদের কাছে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেয়ার জন্য তিনি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। একটি আসনের নির্বাচনে তিনি প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীকে নিরাপত্তা দিতে পারেননি, তিনি কিভাবে ৩০০ আসনের প্রার্থীকে নিরাপত্তা দেবেন? শেখ হাসিনা সরকারের শাসনামলে বিষয়টি প্রমাণিত যে, নির্বাচন করতে এখন আর ভোটার লাগে না, আমলা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমর্থন থাকলেই হলো। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে সরকারের ক্ষমতার পরিবর্তন হওয়ার কথা নয়। তার পরও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রশাসন ও পুলিশের আগ্রাসী ভ‚মিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। বরিশালে সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলন (চরমোনাই) মনোনীত প্রার্থীকে সরকারি দল কর্তৃক আহত হওয়ার খবর শুনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছিলেন- তিনি (চরমোনাই মেয়র প্রার্থী) তো মরেন নাই। সরকারের কতটুকু আজ্ঞাবহ একজন আমলা হলে এ ধরনের বক্তব্য সিইসি দিতে পারে তা বোঝার কোনো অপেক্ষা থাকে না। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর বাড়ি থেকে নির্বাচনের আট দিন আগে থেকেই গ্রেফতার কার্যক্রম পুলিশ চালু করেছিল, কর্মী-সমর্থকদের বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করেছে তখন।

বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা হলো গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান, যেখানে থাকবে ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে ভোট দেয়ার নিশ্চয়তা। দেশের রাজনীতিবিদরাই ক্ষমতাকে আঁকড়ে রাখার জন্য নানাবিধ ফন্দিফিকির করে পরিস্থিতি জটিল করে ফেলেছেন, যার চূড়ান্ত যবনিকা টেনেছে শেখ হাসিনা সরকার। কোনো নির্বাচনই এখন প্রভাবমুক্ত নয়, জাতীয় থেকে স্থানীয় পর্যায়ে মসজিদ, মাদরাসা, হাট-বাজার, স্কুল-কলেজ, এমনকি প্রতিবন্ধী প্রতিষ্ঠানকে সরকারি দলের হাতের মুঠোয় রাখার জন্য একতরফা নির্বাচনপদ্ধতি তারা বেছে নিচ্ছে, দায়িত্বপ্রাপ্ত আমলা ও পুলিশ সরকারি দলের ক্যাডার হিসেবে নগ্নভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য না হওয়া পর্যন্ত স্থানীয় পর্যায়সহ সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি দলের রক্তচক্ষু থেকে রক্ষা পাচ্ছে না।

সরকারি দল যখন শোডাউন করে তখন এর নাম হয় শান্তি সমাবেশ। বিরোধী দল যখন শোডাউন করে তখন পুলিশ অরাজকতার গন্ধ পায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সরকার এলাকাভিত্তিক শান্তি কমিটি করেছিল। কিন্তু সে শান্তি কমিটি কি আসলেই সমাজে শান্তি স্থাপনের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল? সরকারি দলের শান্তি সমাবেশ কি শান্তি প্রতিষ্ঠার সমাবেশ, নাকি পাল্টাপাল্টি শোডাউন। নির্বাচনের একটি সুষ্ঠু পদ্ধতি নির্ভর করে রাজনৈতিক দলের সদিচ্ছার ওপর। রাজনৈতিক দলের জবাবদিহিমূলক আচরণ থাকা আবশ্যক। বিভিন্ন কারণে দলীয় নমিনেশন চলে গেছে টাকার প্রতিযোগিতার ওপর। দলীয় নমিনেশন বাণিজ্য কথাটি উঠে আসে প্রথমে সাংবাদিকদের মুখে, এখন আলোচনা হয় গ্রামগঞ্জে চায়ের দোকানে। আলোচনা হয় কে কত টাকার বিনিময়ে নমিনেশন বাগাতে পারবেন। ফলে নীতিবান কর্মী/নেতা সৃষ্টির পরিবর্তে রাজনীতি এখন ধনকুবের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এ অবক্ষয় চলে গেছে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত। দুই যুগ আগেও সমাজের স্বচ্ছ ব্যক্তিকেই স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতি/সেক্রেটারির দায়িত্ব দেয়া হতো, সে দায়িত্ব এখন চলে গেছে ধনকুবেরদের হাতে, এখন মানুষ ধনকুবেরদের মূল্যায়ন করে টাকার বিনিময়ে, নষ্ট চরিত্র বা নৈতিকতার বর্তমান সমাজে কোনো মূল্যায়ন নেই বলেই সামাজিক অস্থিরতার কোনো সমাধান নেই, সমাধানে নেই কোনো সমষ্টিগত উদ্যোগ।

২০১৮ সালে শেখ হাসিনার সাথে সংলাপ হয়েছে। সে সংলাপ থেকে বিরোধী দলের কী উপার্জন হয়েছিল? দেশবাসী লক্ষ করেছে, সংলাপে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির জোরালো দাবি করা হয়নি, যা হওয়া উচিত ছিল নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রথম ও প্রধান শর্ত। সবচেয়ে ভালো হতো ম্যাডাম জিয়ার সংলাপে উপস্থিতি, যে দাবি বিএনপি করেনি। ম্যাডাম যদি মুক্তি পেতেন তবে একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সৃষ্টি হতো। তার ভাবমর্যাদা দলের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করত। দ্বিতীয়ত, বিএনপি নেতাকর্মীদের মামলা প্রত্যাহারের কোনো ব্যবস্থা না করেই শেখ হাসিনার ফাঁদে পা রাখে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যজোট ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, যার নেতৃত্বে ছিল বিএনপি। নির্বাচনের দিন বেলা ১১টায় বিএনপির বিপ্লবী মহাসচিব ঠাকুরগাঁও থেকে মিডিয়াতে যখন বলেছেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু হচ্ছে’, অথচ তখন আগের রাতেই ভোটের বাক্স ভর্তি হয়ে গেছে। সংসদে বিএনপি আসন পেয়েছিল মাত্র ছয়টি। যে এমপি শপথ নেবে তাকে দল থেকে বহিষ্কারের ঘোষণা দেয়ার পর ছয়জন এমপিই সংসদে শপথ নিয়েছেন। প্রথমে একজনকে বহিষ্কার করা হলেও পরে ছয়জনকেই স্বাগত জানানো হয়। সকালে যা হয় রাম, বিকেলে হয়ে যায় রহিম। এ ধরনের ভানুমতির খেলা দেশবাসী দেখতে চায় না। ফলে ন্যাড়া বেলতলায় না যাওয়ায় মহাসচিবের উপলব্ধিকে শুভেচ্ছা, স্বাগতম। স্মরণ রাখা দরকার, বিএনপির অগণিত নেতাকর্মী জীবন দিয়েছে, হয়েছে কারাবন্দী।

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)

E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement