২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


কীম্যান ভঞ্চঘর রেস্টুরেন্ট

কীম্যান ভঞ্চঘর রেস্টুরেন্ট। - ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশ সময় রাত সাড়ে ১১টায় কাঠমান্ডু পৌঁছি। বেলা সাড়ে ৫টায় ইফতার খেয়ে বাসা থেকে বের হয়েছি। স্বল্পকালীন জার্নি হিসেবে বিমানে কোনো খাবার দেয়া হয়নি। সবার পেটে ক্ষুধা। মালামাল নিয়ে হোটেল রেডিসন (Radission)-এ পৌঁছতে রাত প্রায় ১টা বেজে যায়। ডাল ভাত তরকারি ও চিকেন খাওয়ার জন্য হোটেলে নির্দেশ দিয়ে নিজ নিজ কক্ষে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হই। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে খাবার প্রস্তুত হয়ে যায়। বিমানে খাবার না পেয়ে নেপালিদের ওপর যে রাগ উঠেছিল রেডিসনে ডাল ভাত ও তরকারি খেয়ে সে রাগটুকু পড়ে গেল। ভাত যেমন স্বাদ তেমন সুঘ্রাণ, ডালমাখানির তুলনাই হয় না। বাটি ভরা ডালমাখানি সামনে রাখতে না রাখতে শেষ হয়ে যায়। চামচ বাদ দিয়ে বাটি কাত করে ডাল নিতে শুরু করি।

আর পানির কোনো তুলনা নেই। এ নিরাকার তরলে যে একটা স্বাদ আছে তা নেপাল যাওয়ার আগে আমার জানা ছিল না। এক গ্লাস পান করার পর আরেক গ্লাস পানি পান করতে ইচ্ছে করবে। বাড়িতে আমার পানি কম পান করার বদ অভ্যাস ছিল। ফলে মাঝে মধ্যে গলায় কফ কাশি আটকে থাকত। এ কারণে ডাক্তারের মূল পথ্য ছিল বেশি বেশি পানি পান করা। দৈনিক দু-তিন লিটার পানি পান করলে এ সমস্যা থাকবে না। অশুদ্ধ পানি বিশুদ্ধ করে আমরা পান করি। নানা রকমের মেডিসিন মেরে ওপরে নিচে কত রঙের গড়াগড়ি করার পর দূষিত পানি শোধিত হয়। একবার টেলিভিশনে পানি শোধিত করার প্রক্রিয়া দেখেছি দেখার পর পানি পানে আগ্রহ কমে যায়। তখন থেকে সাপ্লাইয়ের পানি ইচ্ছামতো ফুটিয়ে কলসিতে ভরে ঠাণ্ডা হওয়ার পর পান করি। এতে পানির স্বাভাবিক স্বাদগন্ধ নষ্ট হয়ে যায়। বিভিন্ন কোম্পানির বাজারজাত করা পানিতেও পানির আদিম স্বভাব চরিত্র থাকে না।

আমার ধারণা, কোনো বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির বাইরে পাহাড়-পর্বত নিংড়ানো প্রাকৃতিক পানি স্বাদে গুণে সকল পানির শ্রেষ্ঠ। সে কারণেই গ্রীষ্মকালে ইফতারের আগে বরফ বিক্রেতারা টিউবওয়েলের পানি থেকে তৈরি বরফের টুকরা বের করেই ‘পাহাইড়া বরফ-পাহাইড়া বরফ’ বলে চিৎকার শুরু করে দেয়। হোটেলে প্রথম খেতে বসে প্রক্রিয়াজাত পানির পরিবর্তে ন্যাচারাল পানি গ্লাসের পর গ্লাস পান করলাম ।

হোটেল লবিতেই সকালের নাশতা করতে হবে। ‘সকাল ৮টায় যেন নাশতা করতে আসি’ জানিয়ে দেয়া হয় সবাইকে। পূর্বের অভিজ্ঞতার আলোকে এখন এসব হোটেলে খেতে বসলে সংযমী হওয়ার চেষ্টা করি। বিজ্ঞান প্রযুক্তির যুগে পৃথিবীটা প্রতিদিন ছোট হয়ে আসছে। মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়াও পরিজনদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ ও পর্যটন উপলক্ষে আজ ঢাকা, কাল দিল্লি-দুবাই ঘুরছে। যেখানেই ঘুরুক না, মাতৃভূমি, মাতৃভাষা ও মাতৃ খাবারের টান অস্বীকার করতে পারে না। বিজাতীয় খাবার খেয়ে তৃপ্তি লাভ তো দূরের কথা, ক্ষুধার খুঁত খুঁতানিই দূর হয় না ।

এ কারণে হোটেলে অবস্থানরত নানা দেশের বোর্ডাররা ডাইনিং লবিতে নেমেই নিজ নিজ দেশের খাদ্য খুঁজতে থাকে। তাই এসব হোটেলে শতাধিক খাবারের সবগুলোর স্বাদ পরীক্ষার ঝক্কি ঝামেলায় না গিয়ে প্লেট হাতে খুঁজতে খুঁজতে স্বদেশী খাবারটা বের করে যতো ইচ্ছে খেতে গেলে বাধা নেই, বরং হোটেলের বাটলাররা সহায়তা করবে। বোর্ডারকে সহায়তা করার জন্য চুলায় কড়াই চাপিয়ে ঝুড়ি ভর্তি ডিম, কুচিকুচি কাটা পেঁয়াজ, গাজর, মাশরুম, মরিচ, টমেটোসহ আরো অচেনা কতকিছু। ডিম মামলেট, ওমলেট, ফ্রাই, পোচ, বয়েল ও হাফ বয়েল যেভাবে অর্ডার পাবে ঠিক সেভাবে বানিয়ে দেয়ার জন্য সাদা পোশাক পরা বাটলারগণ দাঁড়িয়ে থাকে ।
এ ছাড়া আছে নানা রকম ফলের জুস। জুস জারের পাশে খালি গ্লাস। লেখা দেখে প্রিয় জুস খুঁজে বের করে নিচের দিকে চাবি ঘুরালে কিংবা চাপ দিলেই জুস বের হবে। জুস জারের ওপরের ঢাকনা খোলার দরকার হবে না। অপারেটিংয়ে আরো আধুনিকতা থাকলে আড় চোখে একটু তাকিয়ে নিলেই হলো। ভুল করার চেয়ে শিখে নেয়া দোষের কিছু নয়। এ বিষয়ে আমি একটা ঘটনা শুনেছিলাম। অজপাড়াগাঁয়ের কোনো এক নেতা জনগণের ভোটে পাস করে ভিআইপি হয়ে যায়। নির্বাচনকালে মনের মতো হোটেলে খাওয়াবে, মর্মে ভোটারদের কাছে অঙ্গীকার করেছিল। নির্বাচনোত্তর ভোটাররা ধরে বসে গাঁয়ের মানুষকে শহরের দামি হোটেলে খাওয়াতে হবে। কী আর করা। এক ফাইভ স্টার হোটেলে নিয়ে যায় তাদের। খাদক-খাদ্য, প্লেট-বাটি, ছুরি-গ্লাস ও কাঁটা চামুচের যোগ-বিয়োগে ভোজ্য সামগ্রীর ছোটাছুটি, লুটা-লুটিসহ ডজনখানেক প্লেটও ধরাশায়ী হয়। খাওয়া শেষে হাত মুখ ধোয়ার জন্য পানি খুঁজতে থাকে। খুঁজতে খুঁজতে ক’জন ঢুকে পড়ে ছোট ঘরে (বাথরুম)। টাইলস বসানো ছোট ঘরের গামলায় (কমোড) টলটলে পানিতেই হাত-মুখ ধোয়ার উদ্যোগ নেয়।

তাই বলা হয়, ভুল করে লজ্জিত হওয়ার চেয়ে জেনে নেয়া উত্তম। অসংখ্য খাবার থেকে কোনটা ছেড়ে কোনটা খাবে, সিদ্ধান্ত নিতে একজন দক্ষ পর্যটকেরও ভুল হয়ে যায় । আর আমার মতো কবি কবি ভাবের হলে তো কথাই নেই।

কাবাব, চিকেন টিকা, ডালমাখানি, বাটার চিকেন, আলু সবজি, গাটাকারী, মাটনকারী, মালাইকোপ্তা, আলু গোব্বি, মিক্সড ভেজিটেবল, ফালুদা, দই, সসেজ, পাকোরা, তন্দুরি, আলু মিথি, মাটারকারী, অরেঞ্জ, আপেল, পাইন আপেল জুস, তরমুজ, কফি ও এলাচি চা খুঁজে পাই। এরকম শ’ খানেক খাবারের মধ্য থেকে দেশী পছন্দের খাবার বেছে নিই। যতো সুন্দরই হোক, অচেনা খাবারের দিকে হাত না বাড়ানোই উত্তম।

কাঠমান্ডু থেকে পোখারা যাওয়ার পথে এক শ’ দুই কিলোমিটার গেলে বাম দিকে কুরিন্টার নামক দর্শনীয় স্থান। নাম রিভার সাইড স্প্রিংস রিসোর্ট। এখানে আমরা চিকেন বিরিয়ানি, সবজি, চিকেন ফ্রাই ও কোল্ড ড্রিংক্স নেই। স্প্রিংস রিসোর্ট যেমন সুন্দর তেমনি সুন্দর পরিচ্ছন্ন এর রান্না, তৃপ্তিসহকারে এখানে লাঞ্চ গ্রহণ করি। পথে অনেক ফলফলাদির অস্থায়ী দোকান। অস্থায়ী দোকানদারগণ দূর থেকে সাইকেল ভ্যানে করে ফলফলাদি নিয়ে আসে, রাস্তার ধারে সাজিয়ে রাখে। সেখান থেকে আমরা আপেল খরিদ করি। বড় বড় লাল লাল আপেল যেমন রসালো, তেমন মিষ্টি। এসব আপেলের সাথে মালয়েশিয়ায় খাওয়া আপেলের তুলনা চলে।

আমরা বিকেল ৪টায় পোখরায় সাংগ্রী-লা হোটেলে পৌঁছি। সকালের নাশতা ও দুপুরের খাবার খুব বেশি হয়ে পড়ায় রাতে শুধু ফলফলাদি খাবো স্থির করি। হোটেলের কাছেই পোখারা বাজার। সন্ধ্যা ৬টায় বাজারে গিয়ে দেখি, অধিকাংশ দোকান বন্ধ। দিনের বেলা আসার সময় রাস্তার দুই পাশে যেসব অস্থায়ী ফলের দোকান দেখেছিলাম; সেসব দোকানের একটাও নেই। ভেলকিবাজির মতো সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে যেন বাইরের সমস্ত দোকানপাট হাওয়ায় মিশে গেছে। দু-একটা স্থায়ী দোকানের ঝাঁপ খোলা রয়েছে। স্থায়ী দোকানের মধ্যে কোনো ফল নেই। কী আর করা, এক মুদি দোকানে ঢুকে রাতের জন্য মুড়ি পাউরুটি ও চানাচুরের প্যাকেট কিনি। চানাচুরের যে প্যাকেট আমাদের এখানে পনের টাকায় পাওয়া যায়, সে রকম একটা প্যাকেটের দাম রেখেছে ৫০ টাকা। অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের মূল্যও বেশি।

হোটেলের লবিতে সকালের ব্রেক ফাস্ট। রেট ছোট, বড় জনপ্রতি পাঁচশ’ রুপি। লেক সাইড এলাকায় বাইরের হোটেলে জনপ্রতি একশ’ টাকায় মোটামুটি ভালো খাবার পাওয়া গেলেও বোর্ডারদের জন্য হোটেলের ব্রেক ফাস্ট প্রায় বাধ্যতামূলক। পোখারায় দুই রাত কাটিয়ে পুনরায় কাঠমান্ডু ফিরে আসার পর আমরা দুপুরের খাবার বাইরের ভালো কোনো হোটেলে খাব, গাইডকে জানাই। গাইড আমাদের শহরের এক চাইনিজ হোটেলে নিয়ে যায়। হোটেলের ভেতরের দৈন্যদশা দেখে আমাদের মন খারাপ হয়ে পড়ে। অর্ডার দেয়ার অনুমান চল্লিশ মিনিট পর রাইছ, চিকেন ফ্রাই, বাটার চিকেন, মিক্সড ভেজিটেবল ও ডালমাখানি আসে। সব খাবারের শেষে আসে টক দই। প্রত্যেক হোটেলেই টক দই থাকে। টক দই, কাটা আপেল, আনারস, তরমুজ, চিড়া ভাজা কিংবা কর্নফ্লেক্সের সাথে চিনি মিশিয়ে খেতে মন্দ লাগে না।

কীম্যান ভঞ্চঘর রেস্টুরেন্টে এক জমকালো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গিয়ে- People of Nepal love to drink Alcohol, party or any kinds of festivals, without alcohol is dificult. এ কথার প্রমাণ পেয়েছি। বিভিন্ন ডিজাইন ও বাহারি পরিচ্ছদ পরিহিত পান যুবতীর হাতে ছিল শাহী আমলের পানপাত্র। পানপাত্র হাতে চার যুবতী ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। নাচতে নাচতে আমাদের সামনে রক্ষিত মাটির পাত্রে মদ ঢেলে রেখে যায় আর কপালে লাগায় সিঁদুর। অনুষ্ঠানে পাশাপাশি বসা আমরা মা, ছেলে ও জামাই শাশুড়ি। সকলের একই অবস্থা। সিঁদুর বুঝতে পেরেই দ্রুত মুছে ফেলি। সুরার উৎকট গন্ধে সামনে রক্ষিত অন্যান্য খাবারও ছুঁয়ে দেখিনি। আমাদের গাইড অনুষ্ঠানে প্রবেশের আগেই সতর্ক করে বলেছিল, সেখানে নর্মাল পানির কোনো কারবার নেই। মদই ওখানে পিপাসা নিবৃত্তির একমাত্র উপায়। একেতো আমরা মুসলিম কান্ট্রির লোক, তার ওপর বিরস সম্পর্কের টানাপড়েনে সবাই অস্বস্তিবোধসহ নাক ছিটকাতে শুরু করি। তা বুঝতে পেরে সম্মুখ থেকে মদের পেয়ালা সরিয়ে নেয়।

আমাদের ফর্মায়েশ মতো ভিন্ন স্থানে পৃথকভাবে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। পৃথক আয়োজিত খাবারের মধ্যে কয়েক প্রকারের শাক, ভর্তা, চিকেন, ডাল ও সাদা ভাত ছিল। পানির বোতল আনা হয় বাইরে থেকে। রেস্টুরেন্টের ছোট্ট একটা কোঠায় বসিয়ে ভিন্ন পরিবেশে দেশীয়ভাবে খাবার পরিবেশন করতেই আমরা খেতে শুরু করি। দশ মিনিটেই প্রথম দফায় পরিবেশিত খাবার শেষ করে ফেলি। আরো খাবারের জন্য বলি। রেস্টুরেন্টের কর্মচারীরা হাসতে হাসতে নাচতে নাচতে আমাদের অপেক্ষা করতে বলে। দশ পনের মিনিটের মধ্যেই পালংশাক, লাল শাক, মাছ, ঝাল গোশত, ডাল ভর্তা ও সাদা ভাত নিয়ে ওরা হাজির হয়। গরম গরম খাবার থেকে বাষ্প নির্গত হচ্ছিল। ডাইনিং টেবিলের মাঝখানে রাখা খাদ্যসামগ্রী আমরা ফুঁ দিয়ে জুড়িয়ে জুড়িয়ে চামুচকাটা ফেলে হাত নামিয়ে মাখামাখি করে খাচ্ছিলাম। তা দেখে এক বাটলার আনন্দে নৃত্য করতে শুরু করে। আমরাও চারদিন পর আজ তৃপ্তিসহকারে খাই আর বলি, বিনে স্বদেশী খাবার, মেটে কি আহার।

(ভ্রমণকাল ০২.১১.২০০৫ সাল)।
লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
mail : adv.zainulabedin@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
উল্লাপাড়ায় গাড়িচাপায় অটোভ্যানচালক নিহত থাইল্যান্ড সফর শেষে সোমবার দেশে ফিরবেন প্রধানমন্ত্রী বিপরীত উচ্চারণের ঈদ পুনর্মিলনী ফরিদপুরে ২ ভাইকে পিটিয়ে হত্যায় জড়িতরা অচিরেই গ্রেফতার করা হবে : র‌্যাব মুখোপাত্র ধর্মঘটে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে পরিবহন বন্ধ, দুর্ভোগে মানুষ আমাদের মূল লক্ষ্য মানুষকে জাগিয়ে তোলা : গাজা ইস্যুতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা গণতন্ত্রকে চিরস্থায়ীভাবে বাকশালে পরিণত করতেই খালেদা জিয়াকে বন্দী রেখেছে সরকার : রিজভী বন্যার আশঙ্কায় সুনামগঞ্জের হাওর এলাকার কৃষকরা ফিলিপাইনে মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রচণ্ড গরম থাকবে তীব্র তাপদাহে পথের ধারে সৌন্দর্য বিলাচ্ছে কৃষ্ণচূড়া তজুমদ্দিনে আগুনে পুড়ে ১৩ দোকান ছাই

সকল