২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শরবত বিক্রেতা এরদোগান, বিশ্বমুসলিমের সুলতান

রজব তৈয়ব এরদোগান। - ছবি : সংগৃহীত

‘গ্যালাপ ইন্টারন্যাশনাল’-এর ২০২০-এর জরিপ অনুযায়ী রজব তৈয়ব এরদোগান সবচেয়ে জনপ্রিয় মুসলিম নেতা। একই সাথে তিনি সারা বিশ্বের পঞ্চম জনপ্রিয় নেতা। এই বিশ্বনেতা হিসেবে এরদোগানের উত্থান এত মসৃণ ছিল না। রাস্তায় শরবত ও রুটি বিক্রি করে রুটি-রুজির ব্যবস্থা করতে হয়েছিল তাকে। এক সময় ফুটবলারও হতে চেয়েছিলেন; কিন্তু হয়েছেন বিশ্বের অন্যতম সফল রাষ্ট্র নায়ক; বিশ্ব-মুসলিমের সুলতান। তার এই ধারাবাহিক উত্থান নিয়ে আজকের আলোচনা।

মুসলিম বিশ্বের সর্বজন স্বীকৃত নেতা এরদোগান আধুনিক তুরস্কের তথাকথিত জনক সেক্যুলার নেতা কামাল আতাতুর্কের পর তুরস্কের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন এনেছেন। তবে আতাতুর্ক আধুনিকতার পাশাপাশি সেক্যুলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করতে যেয়ে তুরস্ক থেকে ইসলাম প্রায় মুছে দিয়েছিলেন। অন্য দিকে এরদোগান আধুনিকতাকে ঠিক রেখে তুরস্কে ধর্ম নিরপেক্ষতার নামে সব ধর্মকে সমান গুরুত্ব দেয়ার বুলির আওতায় তুরস্কে ইসলামকে আবার প্রতিষ্ঠিত করে চলেছেন। রাজনীতিতে এরদোগানের উত্থান হয়েছে মূলত ২০০২ সালে একে পার্টি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার এক বছর পর ২০০৩ সালে ক্ষমতায় আসার মধ্য দিয়ে এবং ২০১৪ সাল পর্যন্ত এরদোগান ১১ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকার মধ্য দিয়ে। এরপর তিনি তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং এখনো আছেন।

প্রাথমিক জীবন
প্রধানমন্ত্রী এবং প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগান জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারিতে ইস্তাম্বুলের কাছিমপাশাতে। তার বাবা ছিলেন জাহাজের ক্যাপ্টেন। আরবি ‘রজব’ মাসে তার জন্ম হওয়ার কারণে তার নাম রাখা হয় রেজেপ (তুর্কি ভাষায় ‘রজব’ কে ‘রেজেপ’ বলা হয়)। অন্য দিকে দাদার নাম তায়্যিপ এফেনদির থেকে নেয়া হয় ‘তায়্যিপ’ আর বংশীয় উপাধি ‘এরদোগান’ যোগ হয়ে নাম হয় ‘রেজেপ তায়্যিপ এরদোগান’।
এরদোগানের বয়স যখন ১৩ বছর তখন তার বাবা পাঁচ সন্তানকে ভালো লেখাপড়া শেখানোর উদ্দেশ্যে ইস্তাম্বুলে আসেন। তরুণ বয়সে এরদোগান লেবুর শরবত এবং বিভিন্ন খাবার বিক্রি করে তার মুনাফা থেকে পরিবারকে সহায়তার পাশাপাশি স্কুলের বেতন পরিশোধ করতেন। ব্যক্তিগত পাঠাগারের জন্য তিনি বইও কিনতেন। ফলে কলেজ জীবনে পা রাখার আগেই তৈরি করে ফেলেন মোটামুটি বড়সড় একটি ব্যক্তিগত পাঠাগার। ইস্তাম্বুলের মারমারা ইউনিভার্সিটি থেকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন তিনি। এর আগে তিনি একটি ইসলামিক স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় পেশাদার ফুটবলও খেলেছেন এরদোগান।

মূল রাজনীতিতে এরদোগান
১৯৭০ থেকে ১৯৮০ সাল মেয়াদে তিনি ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল নেকমেতিন এরবাকানের ওয়েলফেয়ার পার্টির সাথে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৮৯ সালে তুরস্কের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বেইয়্যুলু পৌরসভার মেয়র নির্বাচনের মাধ্যমে এরদোগানের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু হয়। ১৯৯৪ সালে এরদোগান রেফা পার্টি থেকে ইস্তানবুলের মেয়র নির্বাচিত হন। ১৯৯৭ সালের ১২ ডিসেম্বর তুরস্কের শির্ট শহরের এক সমাবেশে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে এরদোগান এক ঐতিহাসিক বক্তব্য দিয়েছিলেন। সেই বক্তব্যে তুরস্কের কবি জিয়া গোকালপ-এর ‘সৈন্যদের দোয়া’ কবিতার কয়েকটি লাইন, ‘মসজিদ হচ্ছে আমাদের ব্যারাক, গম্বুজ হচ্ছে আমাদের হেলমেট এবং মিনার হচ্ছে আমাদের বেয়নেট’ আবৃতি করেন দণ্ডিত হয়ে চার মাস কারাবরন করেন। ১৯৯১ সালে তুরস্কের সাধারণ নির্বাচনে ড. এরবাকানের ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল রেফা পার্টি থেকে এরদোগান সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৭ সালের অভ্যুত্থানের পর তিনি অনেকগুলো সমাবেশে উপস্থিত থেকে নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করতে বক্তব্য রেখেছেন। একপর্যায়ে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে এবং ওয়েলফেয়ার পার্টিকে নিষিদ্ধ করে।

২০০১ সালে তুরস্কের ৩৯তম রাজনৈতিক দল হিসেবে একে পার্টি (জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি) গঠিত হয় যার চেয়ারম্যান হয়েছিলেন এরদোগান। একে পার্টি গঠনের মাত্র ১৪-১৫ মাসের মাথায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসেন। এরদোগানের উপর রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচন করতে না পারায় প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ ছিল না। পরে ২০০৩ সালে তুরস্কের ২৫ তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এরদোগান শপথ গ্রহণ করেন।

অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে সাফল্য
১৯৭০ সাল থেকেই অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা ও মন্দা দূর করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছিল এরদোগান। শেষ পর্যন্ত ২০০২ সালে জনগণ এরদোগানের একেপিকে ক্ষমতায় বসায়। এক দশকের এই সমৃদ্ধি অর্জনের পথে এরদোগান অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে পশ্চিমাদের সাথে সুসম্পর্ক রেখে চলেছেন। জনগণ কামালপন্থীদের শাসনের চেয়ে তার আমলে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত জীবনযাপন করছেন।

অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা, এক সময় ‘ইউরোপের রুগ্ণ মানুষ’ বলে ব্যঙ্গ করা তুরস্ককে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করেন এরদোগান। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির স্বীকৃতি হিসেবে মধ্যবিত্তের সমর্থন নিয়ে তিনি আধুনিক তুরস্কের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের শাসকে পরিণত হন। ২০১৩ সাল পর্যন্ত এরদোগানের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ছিল তুরস্কের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা। একেপি সরকার তুরস্ক থেকে দারিদ্র্য বিদায় করে। ব্যাপক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে। এক দশক আগের তিন অঙ্কে থাকা মূল্যস্ফীতিকে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনেন। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুর্কি মুদ্রা লিরার চাহিদা বাড়ান। অবকাঠামো, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রযুক্তি ও সামরিক খাতে ঈর্ষণীয় অগ্রগতি অর্জন করেন। এমন সাফল্যে রীতিমতো আকাশে উড়ছিলেন এরদোগান।

মুসলিম বিশ্বে এরদোগানের প্রভাব
অর্থনৈতিক সাফল্যের পথ ধরে ভৌগোলিক অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে আঞ্চলিক পরাশক্তি হয়ে তুরস্কের অতীত শৌর্যবীর্য ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর স্মৃতিকাতর এরদোগান। তিনি তুরস্কের উসমানি খেলাফতের অধীনে থাকা অঞ্চলগুলোর প্রতি নজর দেন। ২০০২ সালের পর এরদোগান বিভিন্ন মুসলিম দেশ যেমন ইরাক, ইরান, উপসাগরীয় দেশগুলোর সাথে সম্পর্কোন্নয়নের ব্যাপারে মনোযোগ দেন। বর্তমানে ইরান সিরিয়া ইস্যুর সমাধানসহ বেশ কয়েকটি ব্যাপারে তুরস্কের বিশ্বস্থ অংশীদার। মিসরের ব্রাদারহুডের প্রতিও সমর্থন ব্যক্ত করেছেন এরদোগান। সৌদি সাংবাদিক জামাল খাশোগিকে নৃশংস খুনের মধ্য দিয়ে সৌদি যুবরাজের সাথে তুরস্কের সম্পর্ক তলানিতে ঠেকে। কিন্তু সম্প্রতি সেই সৌদি যুবরাজকে আঙ্কারায় লালগালিচা সংবর্ধনা দেন তিনি। রিজার্ভসঙ্কটে থাকা তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সৌদি আরব ৫০০ কোটি ডলার জমা বা মুদ্রা বিনিময় হিসেবে রাখবে, এমন আলোচনা চূড়ান্ত হয়েছে।

এরদোগান কূটনীতিতে সবচেয়ে ভুল বাজি ধরেছিলেন আরব বসন্তে সমর্থন দিয়ে। সুন্নি বিশ্বের নেতৃত্ব নিয়ে সৌদি আরবের সাথে আগে থেকেই চলছিল স্নায়ুযুদ্ধ। আরব বসন্তে সমর্থন দিলে তা ক্রমেই প্রকট হতে থাকে। তুরস্কের বিরুদ্ধে এক হয়ে নামেন আরব স্বৈরশাসকেরা যার প্রবল নেতৃত্ব দেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ। তুরস্কের পণ্য আমদানির ওপর অঘোষিত অবরোধ আরোপ করে সৌদি-আমিরাত নেতৃত্বাধীন জোট। তার সাথেও সম্পর্ক স্বাভাবিক করার উদ্যোগ নিয়েছেন এরদোগান। বিনিময়ে তুরস্কে বড় বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে আমিরাত।

ফিলিস্তিন থেকে কাশ্মির আর বসনিয়া থেকে জিনজিয়াং হয়ে আরকানের রোহিঙ্গা-মুসলিমদের ওপর নিপীড়নের বিষয়েও জাতিসঙ্ঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে উচ্চকণ্ঠ হন এরদোগান। দাতব্য কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আফ্রিকায় বিশেষ অবস্থান তৈরিতে নজর দেয় তুরস্ক। মিসরের স্বৈরশাসক ফাত্তাহ আল-সিসির সাথে হাত মেলান এরদোগান। অথচ বিরোধীদের ওপর নৃশংসতা চালানোয় এক সময় সিসিকে ‘কসাই’ বলেছিলেন তিনি।
মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, যেমন পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া কিংবা মালয়েশিয়ার সাথে বন্ধুত্ব গড়েন এরদোগান। তবে সিরিয়ার ভূখণ্ড আগ্রাসনের কারণে এরদোগান বেশ সমালোচিত হন। বিশেষ করে কুর্দি ইস্যুতে একাধিকবার তুরস্ক সিরিয়ার সাথে সঙ্ঘাতে জড়ায়। নিজের শুরুর সাফল্যের সময়কার প্রতিবেশীদের সাথে শূন্য সমস্যানীতিতে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছেন তিনি। তুরস্কের এই প্রচেষ্টা তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের সাথে লিবিয়া থেকে সিরিয়া এবং পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত বড় লড়াইয়ের সীমারেখা তৈরি করে।

১৯৪৯ সালে ইসরাইলকে মুসলিম দেশ হিসেবে তুরস্ক সর্বপ্রথম স্বীকৃতি প্রদান করে। বর্তমানে কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও সামগ্রিক সম্পর্ক খুব ভালো নয়। এরদোগান বিশ্ব অর্থনীতিক ফোরামের এক প্যানেল আলোচনায় ইসরাইলকে খুনি হিসেবে আখ্যা দেন এবং ঐতিহাসিক ‘ওয়ান মিনিট’ ঘটনার জন্ম দেন ২০০৯ সালের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম সামিটের প্যানেল আলোচনায়। ‘ওয়ান মিনিট’-এর সেই ঐতিহাসিক ঘটনা ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে এক বড় আওয়াজ। এতে করে ইসরাইলের সাথে তুরস্কের সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকে। বর্তমানে নেতানিয়াহুর উগ্র জাতীয়তাবাদী ও ধর্মীয় জোটের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে, মূলত তুরস্কের ওপর দিয়ে পাইপলাইনের মাধ্যমে ইউরোপে ইসরাইলের গ্যাস রফতানি থেকে সুবিধা নেয়ার জন্য।

সামরিক খাতে ব্যাপক অগ্রগতি
পশ্চিমাদের সামরিক জোট ন্যাটোর অন্যতম সদস্য হওয়া সত্ত্বেও দাসত্ব মানেননি, তোষামোদ করেন না এরদোগান। ন্যাটোর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়েও ন্যাটোর অন্যতম শত্রু রাশিয়ার সাথে সফল সম্পর্ক রেখে চলেছেন। আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্ব কর্তৃক মুসলিম শক্তির উত্থান ঠেকিয়ে রাখার নিরন্তর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তুরস্কের অত্যাধুনিক সমর শক্তির আবিষ্কার, ব্যবহার, রফতানি রীতিমতো বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধে তুরস্কের তৈরি বায়ারাকতার ড্রোনের দাপটে মারাত্মক ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছিল রাশিয়া। তুরস্ক এক সময় আমেরিকা ও রাশিয়ার অস্ত্রের ওপর নির্ভরশীল ছিল, সময়ের ব্যবধানে আজ তুরস্কের দিকে তাকিয়ে আছে বিশ্ব।

এরদোগান সিরিয়ায় কুর্দি পিকেকে গোষ্ঠী ও আসাদ বাহিনীর বিরুদ্ধে নিজস্ব তৈরি ড্রোনসহ অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র ব্যবহার করে সিরিয়ার সীমান্তবর্তী বিরাট এলাকা দখলে নিয়ে ৪০ লাখ শরণার্থীকে পুনর্বাসিত করেন। লিবিয়ার যুদ্ধবাজ নেতা খলিফা হাফতারকে হটিয়ে জাতিসঙ্ঘ সমর্থিত জিএনএ সরকারকে সুরক্ষা, আর্মেনিয়ার জবরদখল থেকে আজারবাইজানের নাগরনো-কারাবাখ পুনর্দখল করা, ওসমানীয় খেলাফতের পর কোনো মুসলিম রাষ্ট্রের এমন দুঃসাহসিক অভিযান কেউ কখনো দেখেনি।

ফ্রান্স-গ্রিসের উসকানি সত্ত্বেও ভূমধ্যসাগর ও ইজিয়ান সাগরে এরই মধ্যে গ্যাসের বিশাল মজুদের কথা জানানো হয়েছে। আট লাখ সেনাসদস্যের দেশ তুরস্ক এরই মধ্যে সিরিয়া, সোমালিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন উপকূল ও ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় ঘাঁটি স্থাপনের মাধ্যমে সামরিক উপস্থিতি তৈরি করে নিয়েছে। অধিকৃত উত্তর সাইপ্রাসে রয়েছে তুরস্কের বিশাল সামরিক ঘাঁটি। ২০২৩ সালের পর বসফরাস প্রণালী দিয়ে জাহাজ চলাচলের ওপর তুরস্কের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ও করারোপের পর তুরস্কের অর্থনৈতিক চিত্র দ্রুত পাল্টে যাবে।

ট্যাংক, মিসাইল, রকেট লঞ্চার, ড্রোন-সব কিছুই তৈরি হচ্ছে তুরস্কের বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে। টর্পেডো উৎপাদনের ঘোষণাও দিয়েছে। হেলিকপ্টার ড্রোন, মনুষ্যবিহীন নৌযানেরও সফল পরীক্ষা চালিয়েছে। বর্তমানে তারা মনোযোগ দিয়েছে মনুষ্যবিহীন সাঁজোয়া যান, আন্ডারগ্রাউন্ড অ্যান্ড টানেল ওয়ারফেয়ার উইপন্স এবং ট্যাংক বিধ্বংসী অস্ত্র, সাবমেরিন, পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধ বিমান, বিমানবাহী রণতরী তৈরিতে। নিজেদের সামরিক বাহিনীর জন্য তুরস্কের উৎপাদিত পণ্যের বাজার ক্রমেই বিদেশেও সম্প্রসারিত হয়েছে। বিশ্বের ১৪তম বৃহত্তম অস্ত্র রফতানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। তুরস্কে স্থাপিত সামরিক শিল্প প্রতিষ্ঠানে আমেরিকা ও তুরস্কের যৌথ উদ্যোগে এফ-১৬ যুদ্ধবিমান তৈরি হচ্ছে। এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান তৈরিতেও মার্কিন টেকনিশিয়ানদের যৌথ অংশগ্রহণ তাদের প্রযুক্তির গুণগত মান সম্পর্কে নিশ্চয়তা প্রদান করে।

ইদানীংকার অর্থনৈতিক বিপর্যয়
জনপ্রিয়তায় উড়তে থাকা এরদোগান প্রথম বড় ধাক্কাটা খান ২০১৩ সালে গেজি পার্ক গুঁড়িয়ে দিয়ে শপিংমল বানানোর উদ্যোগের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে। এরদোগান প্রশাসন কঠোর হাতে এই বিক্ষোভ দমন করলে সরব হয় পশ্চিমা বিশ্ব। বিক্ষোভে পশ্চিমারা উসকানি দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন এরদোগান। এরপর থেকে তার প্রশাসনের সাথে পশ্চিমা বিশ্বের দূরত্ব বাড়তে থাকে। পেছনের দিকে হাঁটতে থাকে উদীয়মান অর্থনীতির দেশ তুরস্ক। এরপর নিজের ক্ষমতা আরো পোক্ত করতে তিনি সংসদীয় সরকারব্যবস্থা তুলে দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন চালু করেন এবং তিনি ২০১৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। বিরোধীরা তার এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করেন। এমনকি এরদোগানকে ছেড়ে যান তার বিশ্বস্ত সাথীরাও।

করোনার ভয়াবহ থাবা অর্থনৈতিক উন্নয়ন প্রচেষ্টায় ছন্দপতন ঘটায়। এরপরও ২০২৩ সালের নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যেকোনো মূল্যে অর্থনীতিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাতে চেষ্টা করেছেন তিনি। এই চেষ্টায় কিছুটা ছন্দপতন ঘটে তুরস্কের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের ভয়াবহ ভ‚মিকম্পে, যাতে ৫০ হাজার লোক প্রাণ হারায় এবং ব্যাপক আহত ছাড়াও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়। সাধ্যমত এই দুর্যোগ মোকাবেলার পরও ব্যপক সমালোচনার মুখে পড়েন যা তাকে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে ব্যাপক বাধার সম্মুখীন করে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে দেশটির মূল্যস্ফীতি ৮৩ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে যদিও স্বাধীন পর্যবেক্ষক সংস্থা ইএনএজির হিসাবে তা প্রায় দ্বিগুণ (১৫০ শতাংশ)। মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য প্রচলিত সূত্রে সুদের হার না বাড়িয়ে বরং কমিয়েছেন। কারণ হয়ত সুদের হার কমিয়ে সাময়িক মূল্যস্ফীতি কমানো গেলেও দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতিতে বিনিয়োগ কমে মন্দা দেখা দেয়। অন্য দিকে ধীরে ধীরে ইসলামের নিষিদ্ধ সুদ প্রথা উঠিয়ে দেয়ার চিন্তাও মাথায় থাকতে পারে। মে মাসে দেশটির বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ মাত্র ৪ দশমিক ৮ বিলিয়ন (৪৮০ কোটি) ডলারে নেমে যায়। চলতি বছর মার্কিন ডলারের বিপরীতে লিরার বিনিময় হার ছিল সবচেয়ে দুর্বল। শুধু গত বছরে ডলারের বিপরীতে ৪০ শতাংশ মূল্যমান হারায় লিরা।

মূলত রাশিয়া থেকে এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষা সেট ক্রয়ের পর থেকেই তুরস্কের অর্থনীতিতে বড় বিপর্যয় দেখা দেয়। বিরোধীদের দমন-পীড়নের অভিযোগে পশ্চিমাদের অঘোষিত অবরোধ শুরু হয়। বিনিয়োগে আগ্রহ হারায় পশ্চিমা কোম্পানিগুলো। তুরস্কের গাড়ি কারখানায় ১৪০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ স্থগিত করে ভক্সওয়াগন গাড়ি নির্মাতা কোম্পানি। যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের অন্যতম রফতানি পণ্য স্টিলের ওপর শুল্কের পরিমাণ বাড়িয়ে দ্বিগুণ করলে দেশটির অর্থনীতিতে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরি হয়। অবস্থা এতটাই খারাপ হয় যে, ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে ইস্তাম্বুলের ৬০ বছর বয়সী বাসিন্দা আয়সে কায়া বলেন, ‘আমরা এক বিপর্যয়ের মধ্যে দিনযাপন করছি। সব কিছুর দাম অনেক বেড়ে গেছে। আমাদের মুদ্রার মান হুড়মুড় করে পড়ে গেছে। আমাদের লিরা সব মূল্যমান হারিয়েছে।’ তবে লুজন চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তেল-গ্যাস উত্তোলন, বসফরাস প্রণালীর বেনিফিট পাওয়া, ব্যাপক অস্ত্র রফতানি এবং পশ্চিমাদের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক হলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে আশা করা যায়।
পরিশেষে বলতে হয়, ভোটের রাজনীতি দিয়ে এরদোগানকে হটানো অসম্ভব মনে করে ২০১৬ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাকে হটানোর চেষ্টা হয়। এই ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পর বিদ্রোহীদের কঠোর হস্তে দমন করেন এরদোগান। এরপর বিরোধীরা ভিন্ন পথে হাঁটে নির্বাচনে হারাতে। তুরস্কের বিরোধী দলগুলোর অদক্ষতা ও বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে থাকার সমালোচনা অনেক পুরনো। তবে মতাদর্শিক ভিন্নতা সত্ত্বেও এবার প্রতিপক্ষ ছয় দলীয় জোট গড়েছে ২০২৩ সালের নির্বাচনে। জোটে রয়েছে ডান, বাম, ইসলামীদল যার নেতৃত্বে রয়েছে কামাল আতাতুর্কের গড়া রিপাবলিকান পিপলস পার্টিসহ (সিএইচপি) যাদের সবার লক্ষ্য এরদোগানকে হটানো। এরই সাথে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পুরো পশ্চিমা বিশ্ব যারা ক‚টনীতির সমস্ত শিষ্টাচার ভুলে, প্রকাশ্যে এরদোগানকে পরাজিত করার যুদ্ধে নেমেছে। তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতাসহ নির্বাচনী যুদ্ধে জয়লাভ করেন ‘তুরস্কের সুলতান’; এখন বিশ্বমুসলিমের সুলতান তথা বিশ্বের নেতা, গলির ওই সরবত বিক্রেতা রজব তৈয়ব এরদোগান।

লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট।
mizan12bd@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement