২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


কেন কোথায় এবং কখন পিছু হটবেন

লেখক গোলাম মাওলা রনি। - ছবি : নয়া দিগন্ত

পিছু হটা নিয়ে নিবন্ধ লিখতে গিয়ে সবার আগে মনে পড়ছে শৈশবের সেই পলাপলি কুক কুক খেলার কথা। তারপর মনে পড়ছে স্কুল পালিয়ে বন বাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো এবং বেতেল ফল-গাব-আম-জাম-কলা-লিচু প্রভৃতির প্রাকৃতিক স্বাদ গ্রহণের দুরন্ত আনন্দের কথা। মাঝে মধ্যে স্কুল পালিয়ে হাট-বাজারে গিয়ে ওষুধ বিক্রির মজমা-জাদু কিংবা গানবাজনা উপভোগ করা ছাড়াও বাড়ি থেকে পালানো এবং পরে কাকার হাতে পিটুনি খাওয়ার কথাও মনে পড়ছে। তবে আজকের নিবন্ধে ওসব হালকা ও চটুল বিষয় নিয়ে আলোচনা করব না। আজ আমি রাজনীতির পিছু হটাহটির খেলা এবং শেষ অবধি রাজনীতির ময়দান থেকে সরে যাওয়ার কিছু ঐতিহাসিক উপাখ্যান তুলে ধরব। কিন্তু সবার আগে মানুষ কেন পিছু হটে সে ব্যাপারে কিছু তথ্যগত আলোচনা করব।

পিছু হটা প্রাণীর জীবনের অপরিহার্য একটি উপাখ্যান। প্রকৃতির সব প্রাণীই পালায়। কখনো ইচ্ছে করে অথবা হেঁয়ালির কারণে সরে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। ভয় পেয়ে হটে যাওয়া পরাজিত হয়ে সরে যাওয়া অথবা কৌশলগত কারণে পিছু হটে পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করে ফিরে আসার ঘটনাও প্রকৃতিতে সচরাচর ঘটে থাকে। প্রকৃতির সব প্রাণী-কীট-পতঙ্গ-জীবাণুর পালানোর চক্র বাদ দিয়ে আপনি যদি কেবল মনুষ্য জাতির পিছপা হওয়া নিয়ে গবেষণা করেন তবে এসব মানুষের রুচি-অভিরুচি-অভ্যাস-কর্মকাণ্ড, চিন্তা-চেতনা ইত্যাদি সম্পর্কে এমন সব মজার তথ্য পেয়ে যাবেন যা কিনা যেকোনো নাটক সিনেমার কাহিনীকেও হার মানিয়ে দেবে।

আজকের নিবন্ধে আমি মানুষের সরে যাওয়ার উপাখ্যান সম্পর্কে বিস্তারিত না বলে কেবল রাজনীতির করুণ পরিণতিতে কিভাবে মানুষ সরে যেতে বাধ্য হয় তা নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনার চেষ্টা করব। প্রথমেই গর্ব করার মতো কয়েকটি পিছু হটার ঘটনা বলি। ইতিহাসের কিংবদন্তির মহান শাসক সম্রাট শেরশাহ সুরীর সফলতার জন্য অনেকেই তার অভিনব পালানোর কৌশলকে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করেন। মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের বিশাল বাহিনীকে নানাভাবে উত্তেজিত ও উত্ত্যক্ত করে যুদ্ধের ময়দানে নামানো এবং তারপর যুদ্ধ না করে কৌশলে ক্রমাগত ও উপর্যুপরি সরে পড়ার ক্ষেত্রে শেরশাহ যে দক্ষতা-কৌশল এবং সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন তা সারা দুনিয়ার যুদ্ধের ইতিহাসে বিরল। তার পালানোর কৌশলের কাছে ধরাশায়ী হয়ে মুঘল বাহিনী ক্রমাগতভাবে যখন দুর্বলতা ও অপদার্থতার চরমে পৌঁছে তখন শেরশাহ সর্বশক্তি নিয়ে চূড়ান্ত আক্রমণ করে বসেন। ১৫৩৯ সালের ২৬ জুন প্রথমে বক্সারের যুদ্ধে এবং ১৫৪০ সালের ১৭ মে কনৌজের যুদ্ধে তিনি সম্রাট হুমায়ুনকে চূড়ান্তরূপে পরাজিত করে দিল্লির সিংহাসনে বসেন এবং পরাজিত হুমায়ুনকে দিল্লি ত্যাগে বাধ্য করেন।

বারবার পিছু হটে গিয়ে শক্তি সঞ্চয় করে যুদ্ধের ময়দানে ফিরে আসা এবং চূড়ান্ত বিজয়ের ইতিহাস সৃষ্টিকারীদের মধ্যে যিনি কিংবদন্তিরূপে সারা দুনিয়ায় মশহুর তিনি হলেন রবার্ট ব্রুস। স্কটল্যান্ডের রাজা রবার্ট ব্রুস নিজ দেশের স্বাধীনতার জন্য ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে বারবার পরাজিত হয়েছেন এবং প্রতিবারই কৌশলে পালিয়ে যেতে পেরেছিলেন এবং মোট ১৭ বার চেষ্টার পর তিনি যেভাবে বিজয়ী হয়েছিলেন তা বিশ্ব ইতিহাসের এক অনবদ্য মাইলফলক হিসেবে আজও আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে।

পিছু হটার ইতিবাচক ইতিহাস রেখে আমরা এবার কুখ্যাত ন্যক্কারজনক এবং করুণ কাহিনী নিয়ে আলোচনা করব। ইরানের সাবেক সম্রাট রেজা শাহ পাহলভী, ইরাকের সাদ্দাম হোসেন, লিবিয়ার গাদ্দাফী এবং ইতালির ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির পালানোর ঘটনা পর্যালোচনা করে আমরা আজকের শিরোনামের সাথে বাংলাদেশের হালআমলের রাজনীতির কী সম্পর্ক সে ব্যাপারে আলোকপাতের চেষ্টা করব। পিছু হটার ইতিবাচক ইতিহাসের নায়ক এবং মহানায়করা নিজেদের কর্ম এবং কৌশল সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তারা সরে পড়ার কথা ভাবতেন এবং পালানোর পথ এবং পালানোর কৌশল রপ্ত করে যুদ্ধের ময়দানে যেতেন। অন্য দিকে, পালাতে গিয়ে ধরা পড়া নিন্দিত খলনায়করা সব সময় নিজেদের কর্মচিন্তা ও চেতনা দ্বারা নিজেরাই বিভ্রান্ত ছিলেন এবং তাদের সঙ্গী-সাথী আওলাদ আওতাদ এবং সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করতেন। তারা সর্বদা বাস্তবতা উপেক্ষা করে মনগড়া কল্পনার জগতে ভাসতেন এবং একটি কল্পিত বিধি ব্যবস্থার স্পষ্টারূপে মিথ্যার বেসাতি এবং মিথ্যার ওপর প্রাসাদ নির্মাণ করে বসবাস করতেন। ফলে তারা স্বপ্নেও নত হয়ে যাওয়ার কথা ভাবতেন না। এ অবস্থায় সরে পড়া যখন অনিবার্য হয়ে পড়ত তখন তারা সবাই এতটা শিশুতোষ নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিতেন যা তাদের পরিণতিকে আরো নির্মম নিষ্ঠুর এবং একই সঙ্গে হাস্যকর করে তুলত।

পালানোর ইতিবাচক ও নেতিবাচক উপাখ্যান নিয়ে উপরোক্ত আলোচনার মধ্যে একটি সাধারণ প্রশ্ন স্বভাবতই এসে যায়- আর তা হলো- ভালো মানুষেরা কেন পূর্বপরিকল্পনা করে সরে যাওয়ার পথ খোলা রাখে এবং নিরাপদে সরে যায়। আর অন্যদিকে মন্দ মানুষেরা কেন হটে যাওয়ার চিন্তা করে না এবং কার্যত সরতে গিয়ে তারা কেন ধরা খায়। প্রশ্নটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং একই সাথে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, আমাদের সমাজে সাধারণত পরাজয়ে ডরে না বীর। মরিব তবু সরব না- শিরশ্ছেদ হবে তবু শির নত করব না ইত্যাদি প্রবাদবাক্য খুবই জনপ্রিয়। সুতরাং পালিয়ে যাওয়া, তা সে যে কারণেই হোক না কেন সেটা সাধারণ বুদ্ধিতে নিন্দনীয়। অন্য দিকে মন্দ লোকদেরকে যদি আমরা চোর-ডাকাত গুণ্ডা বদমাশদের সাথে তুলনা করি তবে দেখতে পাবো ওসব লোক কাজ করার আগে পালানোর রাস্তা পরিষ্কার করে রাখে। সুতরাং ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচারী শাসকরা কেন সরে পড়ার পথ পরিষ্কার রাখে না, বিষয়টি ভালোভাবে অনুধাবনের জন্য আপনাকে প্রথমত আধ্যাত্মিক জ্ঞানের সাহায্য নিতে হবে এবং দ্বিতীয়ত মনোবিজ্ঞানের আশ্রয় নিলেও আপনি অনেক প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবেন।

পৃথিবীর সব ঐশীগ্রন্থের অনুসারীরা জানেন, মানুষ পাপ করতে করতে এক সময় এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যখন সে ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায় এবং দিন-রাতের পার্থক্য নির্ণয় করতে পারে না। তার জন্য হেদায়েতের দরজা বন্ধ হয়ে যায় এবং তার অন্তরে মোহর মেরে দেয়া হয়। অন্য দিকে বিজ্ঞানের সূত্র হলো মানুষ যখন কোনো কর্মে সফলতা পায় হোক সে চুরি ডাকাতি রাহাজানি খুন কিংবা ধর্ষণ তখন তার মন মস্তিষ্কে এক ধরনের অটো সাজেশন বা স্বয়ংক্রিয় পরামর্শযন্ত্র বসে যায়। কুকর্মে ক্রমাগত সফলতার কারণে কুকর্মকারীরা মনে করে তারা সঠিক কাজটি করছে- তাদের কর্মে কোনো পাপ নেই এবং মানুষের শুভকর্মের মতো তাদের মন্দকর্মগুলোও তাদের রুটি রুজি ও আয় রোজগারের নিষ্পাপ অবলম্বন। সফলতার এক পর্যায়ে তারা শুভকর্মগুলোকে মন্দকর্ম হিসেবে বিবেচনা করে এবং নিজেদের কুকর্মগুলোকে শুভকর্ম হিসেবে ধ্যান জ্ঞান ও বিশ্বাস করতে আরম্ভ করে।

উল্লিখিত অবস্থায় মন্দকর্মের জনক-জননীরা জীবনের একটি পর্যায়ে এসে ভাবতে থাকে, তাদের মধ্যে অলৌকিক কোনো ক্ষমতা নিশ্চয়ই রয়েছে। তারা তাদের বিত্ত-বৈভব ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী মনে করতে থাকে এবং মৃত্যুর কথা বেমালুম ভুলে যায়। জ্ঞানার্জন পূর্বাপর বিবেচনা বিবেকবোধ, অনুশোচনা, ভয় আতঙ্ক বিবর্জিত হয়ে মিথ্যাচার, দাম্ভিকতা, জুলুম-অত্যাচার, অবিচার-অনাচারকে নিজেদের অলঙ্কার বানিয়ে নেয়। এমতাবস্থায় যখন অনিবার্য পতন তাদের সামনে এসে যায় তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে অনেকটা অলস অবশ মাংসপিণ্ডে পরিণত হয় এবং আক্রমণকারীদের জালে ধরা পড়ে যায়। সরে পড়ার কৌশল তো দূরের কথা পিছপার জন্য পা বাড়ানোর হিম্মত পর্যন্ত হারিয়ে ফেলে।

আমরা আজকের আলোচনার একদম শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। এবার শিরোনাম প্রসঙ্গে কিছু বলে নিবন্ধের ইতি টানব। শিরোনামে যেভাবে প্রশ্ন করা হয়েছে অর্থাৎ কেন কোথায় এবং কখন হটবেন তার উত্তরে শুধু এতটুকু বলব যে, সরে পড়া যদি আপনার বীরত্ব প্রমাণের উসিলা হয় তবে আপনি কখন কোথায় সরে যাবেন তা কাউকে বলে দিতে হবে না। কিন্তু আপনি যদি কুকর্ম দ্বারা আক্রান্ত হতে হতে নিজের বিয়োগাত্মক পতনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে থাকেন তবে কালবিলম্ব না করে পিছনে ছোটার আধুনিক কলাকৌশল রপ্ত করার জন্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। আপনি যদি একাকী হটে যেতে চান তবে এক ধরনের সমীকরণ তৈরি করুন- আর যদি পরিবার পরিজন সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে সরে যেতে চান তবে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করুন। সরে পড়ার সময় যদি আপনি অর্থ-বিত্ত হীরা মণি মুক্তা জহরত সাথে নিতে চান তবে এমন দেশে আপনাকে যেতে হবে যেখানকার লোকজনের অভাব প্রকট। এ ক্ষেত্রে আপনি যদি অখ্যাত অজ্ঞাত সব জায়গাকে পছন্দের তালিকায় রাখেন এবং একবার নিরাপদে ওইসব ভূখণ্ডে যেতে পারেন তবে আশা করা যায় আপনাকে নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি কম হবে।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement