২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নো, জেদ্দা টাইম

- ফাইল ছবি

১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৯ সাল। সৌদি এয়ার লাইন্সের ৮০৩ নং বিমান। বিমানটি ঢাকা থেকে বিকেল ৫টায় ছাড়ে জেদ্দা পৌঁছবে বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৯টায়। উভয় দেশে সময়ের ব্যবধান তিন ঘণ্টা। রমজান মাস। আমি ও সালমা পবিত্র ওমরাহ করতে বের হয়েছি। এ কাজের জন্য অনেকেই ইহরামের পরিচ্ছদসহ ভাবগম্ভীর অবস্থায় বিমানে উঠেছেন। বিমানের স্বল্প পরিসর আসনে ইহরামের পরিচ্ছদসহ ভাবগম্ভীর অবস্থা বজায় রাখা সম্ভব হবে না মনে করেই আমি উঠেছিলাম সাধারণ পরিচ্ছদে। আমি ধর্মকর্মের দিক দিয়ে অপরিপক্ব ও দুর্বল চিত্তের মানুষ। তবুও গত রাতে জার্নির হাই টেনশনে অনিদ্রায় ভুগেছি। অনিদ্রার কারণে ঠিকমতো সাহরিও খেতে পারিনি। তারপর বিমানবন্দরে লাগেজ টানাটানিসহ এম্বারকেশন কার্ড পূরণে নাকানিচুবানি খাওয়ার ফলে একেবারে লেজেগোবরে অবস্থা। এসব কারণে ক্ষুৎপিপাসায় কাতর হয়ে পড়েছিলাম। ক্ষুৎপিপাসায় কাতর হয়ে পড়লেও রোজা ভঙ্গ করা চলবে না।


পবিত্র হজব্রত (ওমরাহ) পালন করতে রওনা হয়ে রোজা-নামাজে ত্রুটি করা আর দারোগার নায়ে ডাকাতি করা সমান কথা। দারোগার মাইরের চেয়ে আল্লাহর মাইর হাজারগুণ কঠিন। মুখে মুখে যে যাই বলুক না কেন, আল্লাহর মাইরকে ভয় করে না এমন লোক সারা দুনিয়ায় একটিও পাওয়া যাবে না। বিমানে বসার কিছুক্ষণ পরই পরিপাটি পরিচ্ছদ পরিহিত প্রাচ্যের পটিয়সী পদ্মিনীরা পরাগযুক্ত পানাহারের পসরা সাজিয়ে তিন চাকার ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে পাশে এসে পরিতোষিত ভাষায় প্রত্যেককে প্রশ্ন করে-
রোজা?
ইয়েস রোজা।
রোজা?
নো, রোজা।
তাদের একজন একটি নোটবুকে ‘রোজা’ উত্তর প্রদানকারীদের বিষয়ে কী যেন টোকাটুকি করে ‘নো রোজা’ উত্তর প্রদানকারীদের মধ্যে খাবার বিতরণ করতে থাকেন।

‘নো রোজা’ উত্তর প্রদানকারীরা পরাগযুক্ত পানাহার পাওয়ার সাথে সাথে এমনভাবে গ্রাস করতে শুরু করে যেন তারা এতক্ষণ যাবৎ এ পানাহারের অপেক্ষায়ই বসেছিল। তা দেখে আমার নিজের প্রতি রোজার অহংবোধসহ ‘নো রোজাদারের’ প্রতি ঘৃণাবোধ শুরু হয়। অহংবোধের কারণ, আমি এত ক্ষুৎপিপাসার মধ্যেও কঠোর সিয়াম সাধনা অবলম্বন করে চলছি। আর ঘৃণাবোধের কারণ, পবিত্র রমজান মাসের শেষ বিকেলে মুসলিম দেশের একটি বিমানের ভেতর- হজগামী শতশত ধর্মভীরু মুসলমানের মাঝখানে বসে প্রকাশ্যে পানাহার শুধু নির্বুদ্ধিতাই নয়, নিকৃষ্ট রকমের নাস্তিকতাও বটে। শুধু মুসলমানদের বেলায় নয়, অমুসলমানদের বেলায়ও এ সময় এ পরিবেশে সংযমী হওয়া আবশ্যক। এ কাণ্ডের দ্বারা ‘নো রোজাগণ’ যে ভুল করেছে ‘রোজা’ তালিকাভুক্ত হওয়ায় মনের মধ্যে ‘অহংবোধ’ জাগ্রত হওয়ার কারণে আমার ভেতরেও ভুলের সৃষ্টি হয়েছে। জীবনে বহুবার রোজা ভঙ্গ করেছি। কষ্টকর একটি রোজা রাখতে না রাখতেই মনের ভেতর ‘অহংবোধ’সহ বেরোজদারের প্রতি ‘ঘৃণাবোধ’ জাগ্রত হওয়া থেকেই সমাজে শ্রেণিবিভাগ সৃষ্টি হয়ে থাকে। সিয়াম সাধনা মানুষকে শুধু পেটের দিক থেকে সংযমী হতে শিক্ষা দেয় না, মনের দিক থেকেও সংযমী হতে শিক্ষা দেয়। পেটের ওপর জোরাজুরি চললেও মনের ওপর জোরাজুরি চলে না। তা পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ থেকে ধীরে ধীরে অর্জিত হয়ে থাকে।

ঢাকায় আজ সন্ধ্যা ৭টা ১০ মিনিটে ইফতার। ‘নো রোজাগণ’ এতক্ষণে তাদের পানাহার পর্ব শেষ করে কেউ ঘুমানোর চেষ্টা করছে, কেউবা টেলিভিশনে ছবি দেখছে। সন্ধ্যা পৌনে ৭টা সমাগত। বিমান কর্তৃপক্ষ জানিয়েছিল, রোজাদারদের জন্য ইফতারের প্যাকেট রয়েছে। ইফতারের ১৫-২০ মিনিট আগে প্রত্যেকের কাছে ইফতার ভর্তি প্যাকেট পৌঁছে যাবে। ৭টা ১০ মিনিটের আর মাত্র ১৫-২০ মিনিট বাকি। বিমানের জানালা দিয়ে বিমানের ডানার উপর পড়ন্ত বিকেলের ঝলমল রোদের খলখল খেলা দেখছিলাম। বিমানের গতি ছিল প্রতি ঘণ্টায় ৬০০.৪৫০ মাইল। পৃথিবী নিজ অক্ষের ওপর ২৪ ঘণ্টায় এক পাক ঘুরে আসে। পৃথিবীর পরিধি কমবেশি ২৫ হাজার মাইল। বিশ্বের ওপর রয়েছে ৩৬০টি কাল্পনিক দ্রাঘিমা রেখা। ২৫ হাজার মাইলকে ৩৬০দিয়ে ভাগ করলে প্রতি ভাগের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬৯.৪৪ মাইল। এক দ্রাঘিমা থেকে আরেক দ্রাঘিমার দূরত্ব ৬৯.৪৪ মাইল। সূর্যের আলো প্রতি চার মিনিটে ৬৯.৪৪ মাইল অতিক্রম করে। আমাদের বিমানের গতি যদি প্রতি চার মিনিটে ৬৯.৪৪ মাইল হয় তাহলে ঘড়ির কাঁটা অচল হয়ে পড়বে। অর্থাৎ বেলা ৪টায় পশ্চিম দিকে রওনা হলে সময়ের পরিবর্তন হবে না- বেলা যেখানে আছে সেখানেই অবস্থান করবে। সূর্যাস্তের পর ইফতারের টাইম ধরা হলে বিমানারোহীরা আর কোনোদিনও ইফতার করতে পারবেন না। বিমান এর চেয়েও বেশি বেগে চলতে থাকলে ঘড়ির কাঁটা উল্টোদিকে চলতে শুরু করবে। ছাত্রবেলা রোজা রেখে সময় অতিক্রম করার জন্য এরকম পিথাগোরাসের জ্যামিতি খুলে বসতাম।

‘নো রোজাদারগণ’ পানাহার শেষ করে কেউ কেউ নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। টেলিভিশনে অ্যারাবিয়ান ছবি চলছে। ছবি থেকে মাঝে মধ্যে ঘোড়ার খুরের শব্দ ছাড়া সব কিছু নিশ্চুপ থমথমে। ইফতারের আর মাত্র ১০ মিনিট বাকি। কিন্তু প্যাকেট কোথায়? বিমানবালারা হয়তো ইফতারের সময়টা ভুলেই গেছে! ঘণ্টার কাঁটা সাতের দাগে পৌঁছে গেছে। সেকেন্ডের কাঁটা টিকটিক করে যতই ১০ পাক ঘূর্ণন শেষ করতে চাচ্ছে- আমার মনের সন্দেহের কাঁটা টিকটিক করে ততই ধৈর্যের দশমী দশার দিকে এগোচ্ছে। সন্দেহের কারণ, আজকের ইফতার বাংলাদেশ টাইম, না সূর্যাস্তের টাইম?

‘দশমী দশা’ শব্দটি বৈষ্ণব সাহিত্যে পেয়েছি। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙাসহ যেখানে গিয়ে দুর্দশার পিঠ ঠেকে যায় সে স্থানই দশমী দশা। বাংলা সাহিত্য পড়তে গিয়ে বৈষ্ণব সাহিত্য উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। যে গ্রন্থ থেকে ‘নো, জেদ্দা টাইম’ প্রবন্ধটি নিয়েছি সে গ্রন্থের নাম, ‘আমার দেখা আরব’। ‘আমার দেখা আরব’ একটি চিরায়ত কাহিনী। চিরায়ত কাহিনী লিখতে গিয়ে যেরকম ভাবগম্ভীর ভাষা ও পরিবেশ বজায় রাখা দরকার তা বজায় রাখতে পারিনি। তাই ‘আমার দেখা আরব’ গ্রন্থের ভূমিকাতেই লিখেছিলাম, ‘বায়তুল্লাহ প্রদক্ষিণ, সমাধি জিয়ারত, ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত স্থান দর্শন, পানাহার ও পরিবহনে যেসব সমস্যার মখোমুখি হয়েছি সেসব সমস্যাসহ সমস্যা উত্তরণের কলাকৌশল খুঁজতে গিয়েই ‘আমার দেখা আরব’ নামক জিয়ারত কাহিনী। পাঠক পাঠ না করলে পণ্ডিতের পুরো পাণ্ডিত্যই পণ্ড হয়ে পড়ে। সাধারণ পাঠকের পাঠযোগ্য করতে হলে পণ্ডিতের পাণ্ডিত্যের সাথে পঞ্চগুণ যুক্ত করতে হয়। পঞ্চগুণের অন্যতম উপাদান রূপ, রস ও শব্দ। রূপ, রস ও অনুপম শব্দ ছাড়া শুধু জ্ঞান আর পুণ্য লাভের জন্য সবাই বই পড়ে না। এ লক্ষ্যে আমি আমার জিয়ারত কাহিনীতে পরিমিত পরিমাণ রূপ, রস ও অনুপম শব্দ সংযোজিত করে ওমরাহ ও জিয়ারতকে উৎসবমুখর করেতে চেয়েছি।

কোনো ধর্মই কাউকে ফাঁসিকাষ্ঠের আসামির মতো সর্বক্ষণ ভয়াকুল ও মুখ গোমড়া করে থাকতে বাধ্য করে না। ‘ব্রহ্মই আনন্দ, আনন্দ হতেই এ জীবসকল জন্মগ্রহণ করে, জন্মের পর আনন্দের জন্যই জীবন ধারণ করে, মৃত্যুর পর আনন্দেই প্রতিগমনের দ্বারা আনন্দে প্রবেশ করে’ তৈত্তরীয় জ্ঞানকাণ্ডে অনেক মুনি-ঋষি এ কথা স্বীকার করে গেছেন। প্রাচীন ভারতের চার্বাক স¤প্রদায় ‘ঋণ করে ঘি খাওয়ার’ মন্ত্রটি অনেক আগেই সবার ঘরে পৌঁছে দিয়ে গেছেন। হাসপাতাল চেম্বার ও ওষুধ-পথ্য ফেলে হাসির পাঠশালা খুলেছেন অনেক চিকিৎসক। দুঃখ, কষ্ট ভারাক্রান্ত জীবনে আনন্দ ছড়িয়ে দিতে পারলে কোনো কোনো জটিল রোগ এমনি এমনি সেরে যায়। তাই মানুষকে ভালোভাবে বেঁচেবর্তে থাকার জন্য জ্ঞান ও ধর্মচর্চার পাশাপাশি হাস্যরসেরও দরকার আছে। পরিমিত পরিমাণ নৈতিক হাস্যরসের পক্ষে আমাদের নবী করিম সা:-এরও সমর্থন ছিল। নবী করিম সা: হিজরতের পর আনসারদের মধ্যে ‘নওরোজ’ ও ‘মিহিরজান’ নামক দু’টি আনন্দ উৎসবের পরিবর্তে ‘আজহা’, ‘ফিতর’ দু’টি আনন্দ উৎসবের প্রচলন করে গেছেন। কাউকে হেয় করার উদ্দেশে নয়, ভয়াকুল না হয়ে সহজ-সরলভাবে হৃদয়ের ভাষায় উৎসবমুখর পরিবেশে আমি আমার স্র্রষ্টাকে রাজি-খুশি করতে চেয়েছি মাত্র। আমার বিশ্বাস, সৃষ্টির উৎসবমুখর আহ্বানে স্র্রষ্টা নিরুৎসুক হয়ে থাকতে পারেন না। ধর্মচিন্তাবিষয়ক গ্রন্থে যেরকম ভাষা ও ভাবগম্ভীর পরিবেশ বজায় রাখা আবশ্যক, এ গ্রন্থে সেরকম ভাষা ও ভাবগম্ভীর পরিবেশ বজায় রাখতে পারলাম না বলে সবার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।’

বাংলাদেশ সময়ে ইফতারের সমর্থনে নানা রকম কূটকৌশলসহ ইফতারের সঠিক সময়টি জানার জন্য অস্থির হয়ে পড়ছিলাম। মনের সাথে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল অনেকক্ষণ আগেই। যুদ্ধ, আজকের ইফতার বাংলাদেশ টাইম, না সূর্যাস্তের টাইম? আমরা সাহরি খেয়েছি বাংলাদেশে, বর্তমানে রয়েছি ভারতের উপর, অবতরণ করব জেদ্দায়- তিন দেশের তিন সময়ের ভেতর ইফতার করব কোথায়? ইফতার বাংলাদেশ টাইমেই করা আবশ্যক (আমার ব্যক্তিগত বিচারে)। আইনের ভাষায় যখন যেখানে যাবে, তখন সেখানকার আইন প্রযোজ্য। এ নিয়ম প্রযোজ্য হওয়া উচিৎ ধর্মের বেলায়ও। নয়তো আমরা এখন যে দেশের উপর আছে সে দেশে বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭টা ১০ মিনিটে সূর্যাস্ত হয় না। এ সময় কোনো রোজাদারের সামনে বসে ইফতার শুরু করলে বিমানে ‘নো রোজাদারের’ খাওয়া দেখে আমার কাছে যেরকম খারাপ লেগেছিল সেরকম খারাপ লাগবে একজন রোজাদারের কাছেও। তারপরও মনের খুঁতখুঁতি দূর করার জন্য আমার নোটবুকের পাতায় ইংরেজিতে, ‘এক্সকিউজ মি, আই টেক সাহরি অ্যাট বাংলাদেশ টাইম, আই হ্যাভ রাইট টু টেক ইফতার অ্যাট বাংলাদেশ টাইম।’ লিখে উত্তরের জন্য একজন বিমানবালার সামনে তুলে ধরতেই আমার লেখার দিকে চোখ ফেলে খসখস করে লিখে দিলো-
‘নো, জেদ্দা টাইম’। (আমার দেখা আরবের ২০ থেকে ২৩ পৃষ্ঠা অনুসরণে)

লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
E-mail: adv.zainulabedin@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement