০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১, ২২ শাওয়াল ১৪৪৫
`


স্মৃতিপটে মাওলানা আযহার আলী আনোয়ার শাহ

মাওলানা আযহার আলী আনোয়ার শাহ - ছবি : সংগৃহীত

মাওলানা আযহার আলী আনোয়ার শাহ রহ:-কে ছাত্রজীবন থেকে চিনতাম। হাকিমুল উম্মত আল্লামা আশরাফ আলী রহ:-এর বিশিষ্ট খলিফা হজরত মাওলানা আতহার আলী রহ:-এর সন্তান হিসেবে তার প্রতি আমার অন্তরের টান ছিল আলাদা। পরবর্তী সময়ে তার যশ, খ্যাতি ও প্রতিপত্তি যখন মধ্যগগনে তখন পরিচিতি আরো প্রগাঢ় হয়। তাকে দূর থেকেও দেখেছি, কাছে থেকেও উপলব্ধি করেছি। সান্নিধ্যের সৌরভে বিমুগ্ধ হয়েছি। তার তাকওয়া, পরহেজগারি, বিনয় ও অতিথিপরায়ণতার কিছু নমুনা আমি নিজ চোখে দেখেছি। তিনি বহুবার জামিয়া ইমদাদিয়ার সালানা মাহফিলে আমাকে দাওয়াত দিয়েছেন। সব মাহফিলে যেতে পারিনি, কিছু মাহফিলে হাজিরা দিয়েছি।

শাহ সাহেব রহ: জীবিত থাকতে যতবার জামিয়া ইমদাদিয়ার মাহফিলে গিয়েছি তিনি মেহমানখানায় এসে আমার খোঁজখবর নিতেন। চা-নাশতা ও খাবারে যাতে কোনো অসুবিধা না হয় তার দেখভাল করতে দায়িত্বশীলদের নির্দেশনা দিতেন। তার বিনয় ও সৌজন্যতাবোধ আমাকে প্রভাবিত করে। মাহফিল শেষে হিসাব বিভাগের লোক পাঠিয়ে গাড়িভাড়া ও হাদিয়া দিতেন এবং ভাউচার লিখে ওখানে আমার স্বাক্ষর নিতেন। এ নিয়ম অন্য কোথাও দেখিনি। এটা জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার দৃষ্টান্ত। লেনদেনে তার স্বচ্ছতা ও সতর্কতা সর্বজনবিদিত। মুসলিম উম্মাহর জাগরণী চেতনা ও অগ্রসর চিন্তার দৃঢ় বন্ধনে ছিল তার জীবনচর্চা।

১৯৮৩ সালে প্রথম তার সাথে আমি পরিচিত হই জামিয়া ইমদাদিয়াতে। আমি তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সে অধ্যয়ন করি। ছাত্রদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখতে আমন্ত্রিত হই। পুরো প্রোগ্রামের আয়োজক ছিলেন জামিয়ার তৎকালীন ভাইস প্রিন্সিপাল মাওলানা আতাউর রহমান খান রহ:। জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ার শায়খুল হাদিস মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ রহ: পাকিস্তান আমলে নেজামে ইসলাম পার্টি করেছেন। মাওলানা আতহার আলী রহ: ও তিনি দু’জনই নেজামে ইসলাম পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা এবং জনগণের ভোটে নির্বাচিত পার্লামেন্ট সদস্য ছিলেন। শাহ সাহেব রহ: দলীয় রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও মাওলানা আতাউর রহমান খান রহ: রাজনীতিতে ছিলেন সক্রিয়।

বহুমাত্রিকতা মাওলানা আনোয়ার শাহ রহ:-এর জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তিনি একাধারে কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ সংস্থা হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশের সদস্য, বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার (বেফাক) সহসভাপতি, কিশোরগঞ্জ জামিয়া ইমদাদিয়ার মহাপরিচালক, কিশোরগঞ্জ ইমাম-উলামা পরিষদের সভাপতি ও কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শহীদী মসজিদের খতিব ছিলেন। এ ছাড়া প্রাজ্ঞ আলিম, সুবক্তা, চমৎকার কুরআন তিলাওয়াত ও বিজ্ঞ মুফাসসিরে কুরআন হিসেবে দেশব্যাপী ছিলেন জনপ্রিয়।

পবিত্র কুরআন তিলাওয়াতে তার উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি ও সুরলহরি ছিল ভিন্ন মাত্রার। মাওলানা আতাউল্লাহ শাহ বুখারী রহ: ও মাওলানা ইহতেশামুল হক থানভী রহ:-এর সুর ও প্রকাশভঙ্গির সার্থক প্রতিনিধি ছিলেন মাওলানা আনোয়ার শাহ রহ:। এ ছাড়া মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন খ্যাতিসম্পন্ন ওস্তাদের কাছে আযহার আলী আনোয়ার শাহ ১৯৬৬ সালে আরবি সাহিত্য ও তাজবিদুল কুরআন শিক্ষা লাভ করেন। ইলমে কিরাত ও তাজবিদে তার ওস্তাদ হলেন কারী আতা সোলাইমান রিযক্ব আল মিসরি রহ: ও ইবরাহিম আবদুল্লাহ রহ:। ফলে আফ্রো-এশিয়ার সম্মিলনে তেলাওয়াতের একটি নতুন সুরের ঝংকার ও নতুন ধ্বনির আমেজের সৃষ্টি হয় মাওলানা আনোয়ার শাহ রহ:-এর কণ্ঠে। তার চমৎকার তিলাওয়াত, শুদ্ধ বাংলা ও সাবলীল আলোচনায় মুগ্ধ হয়েছে দেশের কোটি তাওহিদি জনতা।
বিশ্ববরেণ্য আলিম আল্লামা ইউসূফ বান্নুরি রহ:, মুফতি ওলী আহমদ টুংকী রহ: ও মাওলানা আবদুল্লাহ দরখাস্তীর কাছে তিনি ইলম দ্বীন হাসিল করার সৌভাগ্য লাভ করেন।

শিক্ষা সমাপ্তির পর তিনি আত্মশুদ্ধির লক্ষ্যে বাইয়াত হন হাকিমুল উম্মত হজরত থানভী রহ:-এর বিশিষ্ট খলিফা মুহিউস্সুন্নাহ মাওলানা আবরারুল হক রহ:-এর হাতে। দীর্ঘ সাধনার পর তিনি তার নিকট থেকে খিলাফত লাভ করেন। কওমি মাদরাসার সিলেবাসের ব্যাপারে তার স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। তিনি বলেন, আমি বিভিন্ন সময় সংস্কারের কথা বলেছি। আমাদের নেসাবের মধ্যে আধুনিক কিছু বইপত্র পাঠ্যভুক্ত করার প্রয়োজন রয়েছে, কিন্তু বোর্ডের কিছু দায়িত্বশীলদের ভিন্নমতের জন্য এতে সফল হতে পারছি না। আমার চিন্তা হলো, কিছু সংযোজন-বিয়োজনের প্রয়োজন আছে। আমাদের মৌলিক কিতাবাদি ঠিক রেখে বাকিগুলোতে কিছুটা তারমিম (সংস্কার) করা যেতে পারে। আর এটা করতে পারলে আমাদের মঙ্গল বৈ অমঙ্গল হবে না (আবদুল্লাহ আশরাফ, ইসলাম টাইমস, ঢাকা, ৭ অক্টোবর, ২০১৯)।

নিয়মতান্ত্রিক দলীয় রাজনীতির সাথে তার বিশেষ সংযোগ ছিল না। বাবা মাওলানা আতহার আলী রহ: রাজনীতির পুরোধা থাকালেও তিনি কখনো রাজনৈতিক তৎপরতায় জড়াতে পছন্দ করেননি। এ ব্যাপারে তার বক্তব্য হলো, ‘আমি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করি না কেন এর পেছনে একটা বড় কারণ রয়েছে, আপনারা জানেন, বাবা ছিলেন উপমহাদেশের ইসলামী রাজনীতির পুরোধা এবং এ দেশের আলিমদের রাজনীতির ময়দানে তিনি নামিয়েছেন। তিনি তার তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে এবং বিশেষ কারণে আমাকে রাজনীতি করতে নিষেধ করেছেন। রাজনীতিতে না জড়ানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, আমাদের এ সময়ের রাজনীতিবিদদের মাঝে সেই ইখলাস বা একনিষ্ঠতা নেই। বর্তমান যুগের রাজনীতির কূটিলতায় তিনি অত্যন্ত মর্মাহত, বিরক্ত ও নিরাশ হয়ে পড়েন। রাজনীতি থেকে তিনি তিক্ত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন’। তিনি তার ছেলে মাওলানা আনোয়ার শাহকে প্রদত্ত এক অসিয়তনামায় বলেন, ‘আমার অসিয়ত তুমি কখনো রাজনীতিতে অংশ নেবে না। আমি রাজনীতিতে জড়িত হয়ে বহু তিক্ত অভিজ্ঞতার অধিকারী হয়েছি। এখানে নিজস্ব লোকেরাই গাদ্দারি ও বিশ্বাসঘাতকতা করে’ (মাওলানা শফীকুর রহমান জালালাবাদী, হায়াতে আতহার, পৃ.৩১২)।

তবে ইসলামের জন্য সংগ্রামী অবস্থানের প্রয়োজন সামনে এলে মাওলানা আনোয়ার শাহ রহ: দায়িত্ব নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ান। মোটেও পিছপা হননি। উত্তাপমুখর বহু সময়েই এটা তিনি প্রমাণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘দলীয় রাজনীতির সাথে আমার কোনো সম্পৃক্ততা না থাকলেও শরয়ি আন্দাজে যখন যা বলা ও করা দরকার, তা আমি শহীদি মসজিদের খুতবা এবং প্রয়োজনে রাস্তায় নেমে মিছিল-মিটিংসহ দরকারি ও কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়ে থাকি। আমি এ কাজগুলো দলীয় ব্যানার থেকে বলতে চাই না।’

প্রখর ব্যক্তিত্বসচেতন এ রাহবার আলেমে দ্বীন দেশ, জাতি ও উম্মাহর ক্রান্তিকালে বয়ান ও খুতবার মাধ্যমে অমূল্য দিকনির্দেশনা প্রদান করে থাকেন। ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর ওপর যেকোনো আঘাতের প্রতিবাদে সবার আগে গর্জে ওঠেন তিনি। ভারতের বাবরি মসজিদ ভাঙা, আফগানিস্তানে মার্কিন হামলা, কাশ্মির, ইরাক, বসনিয়া, সিরিয়া, ফিলিস্তিন ও উইঘুর ও রোহিঙ্গা মজলুম মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানিয়ে মিছিল-মিটিং ও প্রতিবাদে অংশ নিয়েছেন তিনি। জেলা শহর থেকে আওয়াজ উঁচু করেছেন বারবার। এ ছাড়াও দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক নানান সঙ্কট-সমস্যার রাহনুমায়ি বয়ান, বিবৃতি ও সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সত্যোচ্চারণ ও হক কথা বলতে কোনো দিন দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন না। বেফাকের অভ্যন্তরীণ সংস্কারের পক্ষে ছিলেন তিনি। বেফাকের সমাবেশেও তিনি তার সংস্কারধর্মী কথা তুলে ধরতে কুণ্ঠিত হতেন না।

মাওলানা আনোয়ার শাহ রহ:-এর ছোট ভাই, যিনি বর্তমানে জামিয়া ইমদাদিয়ার প্রিন্সিপাল, মাওলানা শাব্বির আহমদ রশিদ হাফি.-এর সাথেও আমার হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান। আমি তার দাওয়াতে জামিয়ার সম্মেলনে গেছে। তিনি আমাকে জামিয়া ইমদাদিয়ার মজলিশে শূরার সদস্য মনোনীত করেন। তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। ২০২০ সালের ৩০ জানুয়ারি তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৭৭ বছর।

মাওলানা আনোয়ার শাহ রহ: ছিলেন সময়সচেতন দেশের বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন, মুফাসসির, একজন যোগ্য শিক্ষক, সমাজসেবক ও অসংখ্য দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষক। দ্বীনি শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে মরহুমের বিশেষ অবদানের কথা জাতি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ রাখবে। সারা জীবন পঠন পাঠনে সময় অতিবাহিত করেন। রুটিনমাফিক জীবন পরিচালনায় তিনি ছিলেন অভ্যস্ত। তিনি ছিলেন আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর। দেশে-বিদেশে তার অসংখ্য ছাত্র ও অনুরক্ত রয়েছে। প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ তার নামাজে জানাজায় শরিক হন। এতে তার গগনচুম্বী জনপ্রিয়তার প্রমাণ মেলে। আমরা এ মনীষীর রূহের মাগফিরাত কামনা করি। মানবসভ্যতার ক্যালেন্ডারে তিনি বেঁচে থাকবেন আজীবন তার কীর্তির সাথে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক
drkhalid09@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement