২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ভ্রান্ত জিডিপি প্রবৃদ্ধি বা মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি নয়, চাই অর্থনৈতিক সাম্য

-

বেশ ক’বছর যাবৎ শুনে আসছি, দেশের অর্থনীতিতে মাথাপিছু আয় বাড়ছে লাফিয়ে, বৃদ্ধি পাচ্ছে জিডিপি প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য হারে। আরো শুনে আসছি, মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় দেশের নাম চূড়ান্ত হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। অথচ ৯ মাসের রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আমাদের অর্থনীতির অনেক অসারতাই উন্মুক্ত করে দিলো। এ কথা সত্যি, কিছু দুর্নীতিবাজ হাজার কোটি টাকার মালিক হচ্ছে, অন্য দিকে হাজারো মানুষ ৩০ টাকা কেজির চাল কিনতে ওএমএসের ট্রাকের পেছনে, মাথা ঢেকে, লাইন দিচ্ছে। দেশের জনগণ এখন বলছে, ‘মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি চিনি না, জিডিপির প্রবৃদ্ধির কথা শুনতে চাই না, আমরা চাই সাম্য, চাই সবাই মিলে খেয়েপরে বাঁচতে।’ এ প্রসঙ্গেই আজকের আলোচনা।

প্রথমত, মাথাপিছু আয় : মাথাপিছু আয় কোনো দেশের এক বছরের জাতীয় আয় ও সেই সময়ে দেশের মোট জনসংখ্যার অনুপাত। এই পদ্ধতি জাতিসঙ্ঘ স্বীকৃত ও বিশ্বের সব দেশে অনুসরণীয়। এখানে জাতীয় আয় হলো এক বছরে দেশজ উৎপাদন থেকে অর্জিত আয় ও রেমিট্যান্সের যোগফল। অন্য দিকে, মোট জনসংখ্যা দেশের সর্বশেষ শুমারি অনুযায়ী প্রাপ্ত। মাথাপিছু আয়ের এই সরল হিসাব নিয়ে রয়েছে অনেক বিতর্ক। আসুন, দেখি কেন এই বিতর্ক। শুমারি ২০২২ সাল অনুযায়ী, দেশের জনসংখ্যা সাড়ে ১৬ কোটির কিছুটা বেশি, যা ২০২১ সালের অনুমিত জনসংখ্যা থেকে প্রায় ৮০ লাখ কম। সাথে ধরা হয়নি বিদেশে কর্মরত এক কোটি ২০ লাখ শ্রমিক। সব মিলিয়ে দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৮ কোটি যা শুমারির জনসংখ্যার চেয়ে প্রায় দেড় কোটি কম। জনমত বলছে- মাথাপিছু আয় বেশি দেখানোর জন্যই এই জনসংখ্যা কমিয়ে দেখানো হয়েছে।

অন্য দিকে, দেশের জনসংখ্যার মধ্যে রয়েছে ভিক্ষুক, শ্রমিক থেকে শুরু করে হাজার কোটি টাকার মালিকও। এই বিশাল বৈষম্যপূর্ণ জনসংখ্যার সমষ্টি দিয়ে জাতীয় আয়কে ভাগ দিলে একটি ফলাফল পাওয়া যাবে ঠিকই তবে তা দেশের বাস্তব চিত্র নয়। অধিকন্তু, ধনী ও অতি ধনীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বাড়ছে গরিবের সংখ্যাও। একই সাথে সমাজে বৈষম্য ও মানুষের আয়ের ফারাক অনেক বেশি হচ্ছে, যার প্রতিফলন সরকারি পরিসংখ্যানে হচ্ছে না। সে জন্যই মাথাপিছু আয় মানুষের কাছে গুরুত্ব পায় না।

অধিকন্তু, মাথাপিছু আয় হিসাব করা হয় কোনো এক বছরের জাতীয় আয়কে অন্যতম ভিত্তি হিসাবে ধরে। এই পদ্ধতি নিয়েও রয়েছে অনেক বিতর্ক। যেমন- কোনো বন কেটে শিল্প কারখানা করা হলে, সেই কারখানার আয় জাতীয় আয়ের হিসাবে যুক্ত করা হয়। কিন্তু বনের ক্ষতির বিষয়টি অর্থনৈতিক সেই হিসাবে আসে না। এ ধরনের অনেক বিষয় রয়েছে। ‘বিনিয়োগ বাড়ছে না, সরকারের রাজস্ব আয় কম, বাড়ছে না মানুষের আয়, সীমিত আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দিচ্ছে মূল্যস্ফীতি; অথচ রাতারাতি বেড়ে যাচ্ছে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয়। মানুষের মাথাপিছু এই আয় বর্তমান বাজারের প্রকৃত চিত্রের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কি না তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।

মাথাপিছু আয় হিসাব করার এই অসঙ্গতি প্রকাশ পায় দেশের বর্তমান মাথাপিছু আয়ের তথ্যের ওপর, যা সরকারি হিসাবে দুই হাজার ৮২৪ ডলার। আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরে সেটি বেড়ে দাঁড়াবে তিন হাজার সাত ডলারে। অথচ খোলা বাজারে টিসিবির ট্রাক থেকে কম দামে পণ্য কিনতে মানুষের লম্বা লাইন ও সেখানে মধ্যবিত্তদেরও ভিড় বাড়ছে, এ থেকে প্রশ্ন জাগে, দুই হাজার ৮২৪ ডলার কোথায় গেল বা মাথাপিছু আয় আসলে বাড়ল কাদের? কতজনের বাড়ল? গত অর্থবছরের তুলনায় এবার মাথাপিছু আয় এক লাফে ১৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেলো কী করে? এটি হয়তো ধনী ও নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে অনেক বৈষম্য এবং সাথে তথ্যের বিভ্রাটও থাকতে পারে; থাকতে পারে রাজনীতিও। অর্থাৎ সরকার তার সফলতা দেখানোর জন্য তথ্য যেমন বাড়িয়ে বলে তেমনি বিরোধীমত তার সমালোচনা করছে।

দ্বিতীয়ত, মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) : আইএমএফের সংজ্ঞা অনুযায়ী, ‘জিডিপি হলো কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি দেশের মধ্যে উৎপাদিত সব চূড়ান্ত পণ্য ও পরিষেবার বাজারমূল্য। দেশের জিডিপি প্রকাশের জন্য রয়েছে তিনটি ভিন্ন পদ্ধতি, যেমন- ১. উৎপাদন গণনা পদ্ধতি; ২. আয় নিরূপণ পদ্ধতি এবং ৩. ব্যয় নিরূপণ পদ্ধতি। এই তিনটি পদ্ধতির মধ্যে বাংলাদেশে ব্যয় নিরূপণ পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। অর্থাৎ, বর্তমান বাজারে চূড়ান্ত পণ্যের মূল্যই জিডিপি হিসাব করার জন্য ব্যবহৃত হয়। এতে কোনো কারণে এমনকি মূল্যস্ফীতির কারণেও পণ্যের দাম বেড়ে গেলে ব্যয় বেড়ে যায়, ফলে জিডিপি বেড়ে যায়। এ থেকে বোঝা যায়, কোনো কিছু না করেও মূল্যস্ফীতির ব্যর্থতা জিডিপি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

বাংলাদেশের বর্তমান জিডিপি ৪১৬ বিলিয়ন ডলার ও প্রবৃদ্ধি ৭.২৫ শতাংশ। করোনার প্রাদুর্ভাবে বিগত দিনগুলোয় দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়েছে। আর এই সময়ে এমন চমকপ্রদ তথ্য চিন্তার উদ্রেক করে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিমাপের জন্য জিডিপি কতটা কার্যকর পন্থা তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের মতে, ‘জিডিপির আকার বা প্রবৃদ্ধি মানুষের কাছে দুর্বোধ্য। জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মূল্য সংযোজন এসব দিয়ে মানুষ নিজ দেশের উন্নয়ন বুঝতে পারে না। মানুষ তার নিজেদের যাপিত জীবন দিয়েই উন্নয়ন বোঝে।’ তিনি একটি দেশের উন্নয়ন বোঝার জন্য গণপরিবহন, গণশৌচাগার ইত্যাদির অবস্থা সম্পর্কিত নানা দৃশ্যমান সূচক প্রবর্তনের কথা বলেছেন। অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমানের মতে, ‘জিডিপি গণনার সময় শুধু মাথাপিছু গড় আয় হিসাব করা হয়। কিন্তু সবচেয়ে গরিব ৪০ শতাংশের মাথাপিছু আয় কত, তা হিসাব করা হয় না।’ জিডিপির প্রচারক নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ সাইমন কুজনেটস বলেন, ‘জিডিপি হলো, অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট পরিমাপের চেয়ে তুলনামূলকভাবে নির্ভুল ও কেবল আনুমানিক পরিমাপের সংমিশ্রণ।’

দেশের পরিসংখ্যানের সত্যতা নিয়েও রয়েছে অনেক প্রশ্ন। বিবিএসের হিসাবের সাথে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির সবসময়ে পার্থক্য থাকে। অথচ বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও এডিবির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো খুবই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করে থাকে। এ কথা ঠিক, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে বিবিএসের তথ্যের ওপরই নির্ভর করতে হয়। সুতরাং আমাদের জাতীয় পরিসংখ্যান প্রতিষ্ঠানটির সক্ষমতা আরো বাড়ানো প্রয়োজন। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সাবেক সচিব রীতি ইব্রাহিম বলেছেন, আমি তরুণ বয়সে দেখেছি, জিডিপি কত হবে, তা আগে ঠিক করা হয়। পরে ‘ব্যাক ক্যালকুলেশন’ করে হিসাব ঠিক করা হয়। শতভাগ নির্ভুল না হয়ে ‘তুলনামূলকভাবে নির্ভুল’ হওয়ার জন্যই জিডিপিকে চিহ্নিত করা হয় ‘বিতর্কিত আইকন’ হিসেবে।

তৃতীয়ত, আয়বৈষম্য : সমাজে আয়বৈষম্য নিরূপণের জন্য ব্যবহৃত হয় ‘জিনি সূচক’। জিনি সূচকের মান হতে পারে শূন্য থেকে এক। কোনো সমাজের সব সম্পদের মালিক একজনই হলে, অন্য কারো হাতে কোনো সম্পদ না থাকলে সে সমাজে হবে চূড়ান্ত বৈষম্য ও এর জিনি সূচক হবে ‘এক’। বিপরীত দিকে, যে সমাজের সব সম্পদ সবার মধ্যে শতভাগ সমভাবে বণ্টন হয়ে থাকে সে সমাজের জিনি সূচক হবে ‘শূন্য’। জিডিপির প্রবৃদ্ধি আর মাথাপিছু আয়ের মূল বিতর্কটি, মূলত এর দ্বারা মানুষে মানুষে বৈষম্য বুঝতে না পারা। ওইসিডি যথার্থই বলেছে, ‘জিডিপি আয়ের পরিমাপ করে, তবে সমতা নয়, এটি সামাজিক সংহতি ও পরিবেশের মতো মূল্যবোধকে উপেক্ষা করে।’

জিডিপির প্রবৃদ্ধি আর মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির সাথে সাথে বাংলাদেশে আয়বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরের একটি উন্নয়ন সম্মেলনে বিশেষজ্ঞরা দুঃখ প্রকাশ করে বলছিলেন, স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের যে উল্লেøখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তা একটি বৈষম্যপূর্ণ সমাজের দিকেও নিয়ে যাচ্ছে দেশকে। সাম্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকী উদযাপন করছে তখন দেশে দ্রুত বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে বিষয়টি অত্যন্ত হতাশাজনক। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর গৃহস্থালি আয় ও ব্যয় জরিপে দেখা গেছে, ২০১০ সালের শূন্য দশমিক ৪৫৮ থেকে বেড়ে ২০১৬ সালে দেশের জিনি সহগ শূন্য দশমিক ৪৮২-তে দাঁড়িয়েছে। এর অর্থ, দেশে অসমতা সর্বকালের সর্বোচ্চ অবস্থানে। সর্বশেষ উন্নয়ন সম্মেলনে বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশীদের উদ্যোক্তা মনোভাব, যা দেশকে অসাধারণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে চালিত করেছে, তার প্রশংসা করেছেন। তবে একই সাথে দেশকে ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের দিকে নিয়ে যাওয়া বৃহৎ পরিসরের দুর্নীতিরও সমালোচনা করেছেন তারা।

সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের ব্যাপক অগ্রগতি হলেও স্বাস্থ্য-শিক্ষার সুবিধা দেশের ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে সমানভাবে বণ্টন করা হয়নি। লিঙ্গ ও অন্যান্য সামাজিক বিভাজনও রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি মূলত রাজনৈতিক সমস্যা। সরকারি প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহিতার অভাব শুধু আমাদের অগ্রগতি এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমতার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি, এটি রাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতাকেও চ্যালেঞ্জ করছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য ছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে নানা ধরনের সামাজিক বৈষম্যও বাড়তে দেখছি। ক্ষমতাশালীদের সমালোচনা করার সুযোগ কমছে। নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুললে এখন প্রায়ই তাকে প্রতিপক্ষের দৃষ্টিতে দেখা হয়; কিন্তু এই ধরনের খোলামেলা আলোচনা ছাড়া যে বিষয়গুলো বৃহত্তর অর্থনৈতিক বৈষম্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, সেগুলোর সমাধান করা আরো কঠিন হয়ে উঠবে। বেসরকারি সংস্থাগুলোর দেয়া তথ্য দেখতে না চাওয়ার যে প্রবণতা সম্প্রতি সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে, তা উদ্বেগের আরেক কারণ। প্রশ্ন জাগে, এ ধরনের তথ্য বিবেচনায় না নিয়ে ও সরকারসংগৃহীত তথ্যে নিরপেক্ষতার অনুপস্থিতিতে কর্তৃপক্ষ কি এই কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারবে?

মানব উন্নয়ন সূচক দিয়ে মূল্যায়ন করা বাংলাদেশের সামগ্রিক মানব উন্নয়ন স্কোর ২০১৯ সালে শূন্য দশমিক ৬৩২ ছিল। কিন্তু, তা পরে শূন্য দশমিক ৪৭৮-এ নেমে আসে, যা অসমতার কারণে মানব উন্নয়নে ২৪ দশমিক ৪ শতাংশ ক্ষতি বোঝায়। ক্রমবর্ধমান বৈষম্য কীভাবে আমাদের উন্নয়ন আটকে রাখছে, এটি তার একটি উদাহরণ মাত্র। তাই নীতিনির্ধারকরা যখন দেশের উন্নয়নের জন্য নিজেদের অভিনন্দন জানান, তখন বাস্তবতা হলো- উন্নয়নের বেশির ভাগই দেশের নাগরিকদের কঠোর পরিশ্রম ও বুদ্ধিমত্তার ওপর নির্ভর করে। এমন কিছু নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে যা প্রকৃতপক্ষে উন্নয়নকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করছে। আমরা যদি আমাদের উন্নয়নের স্বপ্ন পূরণ করতে চাই তাহলে এসব নীতি পরিবর্তন করতে হবে। তাই প্রশাসনে অধিকতর জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা আনতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে কাজ করতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে- দুর্নীতি কমাতে সব ধরনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। সেই সাথে বৈষম্য দূর করতে নীতি প্রণয়ন করতে হবে। বিশ্বব্যাংকের মতে, বৈষম্যের দিক থেকে ২০১৮ সালে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৪০তম। অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আয়বৈষম্যকে বাংলাদেশের আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তার মতে, ‘একটি ব্যাপক ও গভীর বৈষম্যপূর্ণ সমাজে উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার টেকসই করা যায় না।’ সম্পদের অসম বণ্টন ও ভোগবৈষম্য কোনো সমাজেই কাক্সিক্ষত নয়। অনাকাক্সিক্ষত হলেও অর্থনীতিতে আয়বৈষম্য বৃদ্ধির পক্ষেও যুক্তি আছে। আছে গবেষণা।

নিঃসন্দেহে জিডিপি প্রবৃদ্ধিই জনগণের জীবনের মান বোঝার জন্য সবচেয়ে উৎকৃষ্ট সূচক নয়। এই সূচকে আয়ের বৈষম্য, পরিবেশের ক্ষতি, গেরস্থালি কাজের হিসাব, সম্পদের অপচয়, সমরাস্ত্রের খরচ, পুঁজি পাচারসহ নানা প্রসঙ্গ সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয় না। সে কারণে জিডিপিকেই একটি দেশের উন্নয়নের একমাত্র সূচক হিসেবে গ্রহণের বিপক্ষে নানা মত রয়েছে যদিও জাতিসঙ্ঘে কিছু সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও পারস্পরিক তুলনার জন্যই এ সহজ পদ্ধতিটি বিশ্বব্যাপী গ্রহণ করা হয়েছে। তবে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, জিডিপির পাশাপাশি যদি মানব উন্নয়ন সূচক উপস্থাপন করা হয়, তাহলে একটি দেশের উন্নয়ন তথা অগ্রগতির সার্বিক চিত্রের সন্ধান মেলে।

আগেই বলেছি, মাথাপিছু আয় ও জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে অনেক আলোচনা হলেও আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু মূলত অর্থনৈতিক সাম্য নিয়ে। এই উন্নয়ন কতটা অন্তর্ভুক্তিমূলক হলো, ঝুঁকি থেকে মানুষকে কতটা নিরাপদ রাখল, কতটা কর্মসংস্থান হলো ও সর্বোপরি কতটা টেকসই হলো সেটিই বিবেচ্য। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, ‘দেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে; কিন্তু পরিবেশের ক্ষতি ও সামাজিক ন্যায়বিচারের বিষয় সামনে আসছে না।’ বর্তমানে বিশ্বব্যাপী যে অর্থনৈতিক সঙ্কট চলছে, সেটি কোভিড-উত্তর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের প্রভাব; ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব ও যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ, ব্যাংক অব ইংল্যান্ড, ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের সুদহার খুব দ্রুত এবং বড় করে বাড়িয়ে দেয়ার প্রভাব। মূলত এই তিন কারণের যৌথ প্রভাবে বৈশ্বিক তারল্যে প্রভাব পড়ে। ফলে বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়, আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে ধাক্কা লাগে। জ্বালানি তেল, গ্যাস, শিল্পের কাঁচামাল, খাদ্যপণ্যসহ আমরা যেসব পণ্য আমদানি করি, সেগুলোর দাম অনেক বেড়ে যায়; কিন্তু তৈরী পোশাকসহ যেসব পণ্য রফতানি করি, সেগুলোর দাম বাড়েনি। এর কারণে আমরা একটি বাণিজ্যঘাটতিতে পড়েছি।

উল্লেখ্য, গত অর্থবছরে সরকারি ও বেসরকারি খাত মিলিয়ে প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ করতে হয়েছে। বর্তমানে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ১৭ থেকে ১৮ বিলিয়ন ডলার। এই বিপুল অঙ্কের টাকা ঋণ করে আমরা বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছি; কিন্তু বাজারে তো তার প্রভাব পড়ছেই। ফলে, অর্থনীতি তথা অর্থব্যবস্থায় একটি গ্যাপ সৃষ্টি হয়েছে। মুদ্রাবাজারে ডলারের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময় হার ২৭ শতাংশ বেড়ে গেছে। অথচ আমরা টাকার মান ধীরে ধীরে অবমূল্যায়ন না করে জোর করে টাকার বিনিময় হার ধরে রেখেছি। ফলে বিশাল একটি চাপ সৃষ্টি হয়েছে আমদানি-রফতানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহে, যা অর্থনীতিকে সঙ্কটে ফেলেছে। ডলারের ব্যাংক হার ও খোলাবাজারের হারে সৃষ্টি হয়েছে অনেক পার্থক্য। ফলে বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহে ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে।

টাকার অবমূল্যায়ন হলেও বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় বাজার এখনো স্থিতিশীল হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে প্রতি মাসে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ বিক্রি করতে হচ্ছে। এভাবে রিজার্ভ বিক্রি চলতে থাকলে দেশের অর্থনীতি বিশাল ক্ষতির মুখে পড়বে; বাজারে আস্থার সঙ্কট সৃষ্টি হবে। বর্তমানে দেশে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ২৬ বিলিয়ন ডলার; মাত্র আট মাস আগে যা ছিল প্রায় ৪০ বিলিয়ন। সুতরাং মুদ্রার বিনিময় বাজার স্থিতিশীল করার জন্য বলিষ্ঠ এবং সার্বিক কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।

সাম্যের জন্য করণীয় : সাম্যের জন্য সবার আগে প্রয়োজন দুর্নীতি জিরো পর্যায়ে নামিয়ে আনা; যদিও এটি কঠিন তবে সরকারের পৃষ্ঠপোষকরা দুর্নীতিমুক্ত হলে এটি সম্ভব। বাজারের মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা; যেন তা দরিদ্র, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে। এর জন্য প্রচলিত অর্থনীতির ধারা মোতাবেক ‘সাধারণ সূত্র সুদহার’ নীতির প্রয়োগ করে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে পৃথিবীর সব দেশ সুদহার ৩ থেকে ৫ শতাংশ বাড়িয়েছে। বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি যখন ৫ শতাংশে ছিল, তখন যে সুদহার ছিল, এখন মূল্যস্ফীতি দ্বিগুণ হয়ে প্রায় ১০ শতাংশ হয়েছে অথচ সুদহার একই রয়েছে। এই সুদহার সমন্বয় করা প্রয়োজন। তবে খেয়াল রাখতে হবে, অর্থনীতির এই অব্যবস্থার মূল কারণ সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থা। সুতরাং ধীরে ধীরে সুদ থেকে বের হয়ে লাভ-লোকসান, ক্রয়-বিক্রয় ও ইজারাভিত্তিক অর্থব্যবস্থা চালু করতে হবে। আইএমএফের ৪৫০ কোটি ডলার ঋণসহায়তা একটি সঠিক সিদ্ধান্ত। এতে রিজার্ভ প্রাণ ফিরে পাবে, বাজারে আস্থা তৈরি হবে। এই ঋণ পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় নীতিগত সংস্কার, যেমন- রাজস্ব খাত, আর্থিক খাত, বিনিময় বাজার ব্যবস্থাপনা, সুদহার নীতি নমনীয় ও করনীতি সংস্কার করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এতে অর্থনীতির অনেক আবর্জনা মুক্ত হবে। অন্যান্য ঋণদাতারাও এগিয়ে আসবে।

মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে উৎপাদন তথা সরবরাহব্যবস্থায় গুরুত্ব দিতে হবে। আগামী আমন ধান সংগ্রহ নিশ্চিত করতে হবে। সামনের বোরো ধানের সর্বোচ্চ উৎপাদন নিশ্চিত করতে সার, পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে যেকোনোভাবে। জ্বালানির ঘাটতি দেশের উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত করে দীর্ঘমেয়াদে সার্বিক অর্থনীতিতে আরো সঙ্কট দেখা দেবে; বেকারত্ব দেখা দেবে; প্রবৃদ্ধি কমে যাবে- ফলে মহামন্দা দেখা দেবে। কৃষিপণ্যের উৎপাদন ও বাজার সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় যেন দুর্নীতি, চাঁদাবাজি না হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। খাদ্যপণ্যের অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমিয়ে আনতে হবে। সব ক্ষেত্রে কৃচ্ছ্রসাধন করতে হবে। সরকারের সামাজিক সুরক্ষার ব্যয় সম্প্রতি কিছুটা বাড়লেও আরো বাড়াতে হবে; কর্মসূচির আওতা আরো বাড়ানো প্রয়োজন।

সর্বোপরি দেশের সঙ্কট মোকাবেলায় চাই বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, চাই রাজনৈতিক সমঝোতা। সমস্যার বাস্তব অবস্থা নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজন সঠিক পরিসংখ্যান এবং সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজন কৌশলগত স্বল্পমেয়াদি রোডম্যাপ। এখন মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি নয়, জিডিপির প্রবৃদ্ধি নয়, প্রয়োজন অর্থনীতিকে সংহত করা। প্রয়োজন মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্তের প্রতি নজর দেয়া; এর জন্য সামাজিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা; সবাইকে নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করা। এর জন্য ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করতে নীতি প্রণয়ন করতে হবে। বাজারের আতঙ্ক কমিয়ে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। বিশ্বের অনেক দেশেই বিলিয়নিয়াররা দেশের সঙ্কটের সময়ে বঞ্চিতদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়ায়; আমাদের দেশে অনেক হাজার-ক্রোড়পতি রয়েছে; তাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে, ‘মানুষ মানুষের জন্য’।

লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট
ইমেইল : mizan12bd@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement