২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

হারিকেন মোমবাতির প্রত্যাবর্তন

-

আমাদের শৈশবে অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর জমানায় হারিকেন ছিল রীতিমতো বড়লোকি ব্যাপার স্যাপার। আর মোমবাতি ছিল উঁচুতলার মানুষদের আনন্দ-উৎসব এবং আভিজাত্য প্রদর্শনের হাতিয়ার। বেশির ভাগ হতদরিদ্র পরিবার সন্ধ্যার আগে সব কাজকর্ম সেরে ফেলত। কারণ রাতে এক চিলতে আলো জ্বালানোর সঙ্গতি তাদের ছিল না। হতদরিদ্রদের চেয়ে যারা আরো একটু ভালো ছিলেন তারা কেরোসিনের প্রদীপ, রেড়ির তেল বা অন্য কোনো তেল দিয়ে সলতে জ্বালিয়ে সন্ধ্যা রাতের কিছু সময় আলোকিত থাকতেন। সন্ধ্যার পর ঘুটঘুটে অন্ধকারে যদি কেউ পথ চলতে বের হতেন তবে বেশির ভাগ লোক অন্ধকারের মধ্যে নির্বিঘ্নে চলার দুরন্ত এক শক্তি প্রকৃতি থেকে আহরণ করতেন। যারা একটু ভীতু বা সতর্ক প্রকৃতির ছিলেন তারা খড়কুটো, পাটখড়ি বা বাঁশ-কঞ্চির টুকরোর সঙ্গে পরিত্যক্ত বস্তা-ন্যাকড়া ত্যানা পেঁচিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে অন্ধকারে পথ চলার চেষ্টা করতেন।

আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন বিজলী বাতি ছিল স্বপ্নময়। এমনকি কারো কাছে যদি একটি দুই ব্যাটারির টর্চলাইট থকাত তবে তার বাহাদুরিতে নিজের বউ তো বটেই পাড়া প্রতিবেশীর বউরা পর্যন্ত গর্ব অনুভব করতেন। আর তিন ব্যাটারির টর্চলাইট হলে তো কথাই নেই। আজকের জমানার অডি-মার্সিডিজ-বিএমডব্লিউ গাড়ির মালিকদের যেমন সামাজিক প্রতিপত্তি তদ্রূপ সে সময়ের গ্রামবাংলায় একটি তিন ব্যাটারির টর্চলাইট, একটি তিন ব্যান্ডের রেডিও কিংবা একটি র‌্যালি ব্রান্ডের সাইকেলের মালিকও হতে পারতেন অঘোষিত রায় বাহাদুর-খান বাহাদুর অথবা নবাব সাহেব।

আমি যে জেলার বাসিন্দা অর্থাৎ ফরিদপুর তা ছিল অন্যান্য জেলার চেয়ে তুলনামূলক দরিদ্র। বিশেষ করে গোপালগঞ্জ, ভাঙ্গা, মাদারীপুর, শরীয়তপুর প্রভৃতি এলাকার দরিদ্র মানুষের নিদারুণ কষ্ট, জীবন সংগ্রাম এবং দু’মুঠো ভাতের জন্য নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এলাকা ছেড়ে অন্য জেলায় গিয়ে বছরের বেশির ভাগ সময় কাটিয়ে আসতেন এবং শীতকালে ফিরে এসে গ্রামের বাড়িতে কয়েক দিন থেকে আবার চলে যেতেন। অভাবের তাড়নায় ছেলে-মেয়ে বিক্রি, ক্ষুধার যন্ত্রণায় নারীর ইজ্জত বিক্রি এবং মহাজনী ঋণের করাল গ্রাসে প্রায় সব দরিদ্র-পরিবার মানবেতর দিন যাপন করত। প্রতিটি গ্রামে প্রতি তিন চার হাজার অধিবাসীর মধ্যে বড় জোর তিন চারটি পরিবারের সঙ্গতি ছিল তিন বেলা পেটপুরে আহার করার এবং সারারাত হারিকেন জ্বালিয়ে রাখার।

আমার ছেলেবেলায় সৌভাগ্য হয়েছিল বাংলার বিস্তীর্ণ এলাকা ভ্রমণ করার। ফরিদপুর জেলার বিভিন্ন অঞ্চল ছাড়াও আমি রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, পাবনা, ঈশ্বরদী, সান্তাহার, নওগাঁ, খুলনা, বরিশার, পটুয়াখালীসহ আরো অনেক অঞ্চল ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছিলাম। ফলে আবহমান বাংলার সত্তর দশকের দারিদ্র্য এবং দারিদ্র্যপীড়িত মানুসের অভ্যাস, চিন্তাচেতনা ও চরিত্র আমার মানস পটে এমনভাবে গেঁথে রয়েছে যার কারণে সাম্প্রতিক কালের ভুয়া রায় বাহাদুর-খান বাহাদুরদের হম্বিতম্বি দেখলে মেজাজ ঠিক রেখে জবান নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।

এতক্ষণ ধরে যে লম্বা ভূমিকা টানলাম তার কারণ হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ের হালচাল, অর্থনৈতিক-সামাজিক ও রাজনৈতিক সঙ্কট ক্রমশ ঘনীভূত হয়ে যেভাবে জনগণের দিকে ধেয়ে আসছে তাতে মনে হচ্ছে সত্তরের দশকের অভাব অনেকের কাছে গর্বের বস্তু হিসেবে বিবেচিত হবে। কারণ সেই জমানার অন্ধকার রাতে চলতে গিয়ে কেউ হয়তো গর্তে পড়ে যেতেন, কেউবা মনুষ্য বিষ্ঠা মাড়িয়ে তা ধোয়ার জায়গা না পেয়ে দূর্বাঘাসে ঘষাঘষি করতেন অথবা কেউ কেউ অন্ধকারে পথ হারিয়ে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে চলে যেতেন।

অন্ধকার রাতে যাদের হাতে হারিকেন-মশাল বা টর্চলাইট থাকত না তারা সাপ-ব্যাঙের ভয় পেতেন। বাঘডাসা-শিয়ালের ভয় ছাড়াও ভূত-প্রেত-শয়তান-জিন-পিশাচ ছাড়া কবরস্থান-শশ্মানের অশরীরী আত্মার ভয়ে তটস্থ থাকতেন এবং তা থেকে বাঁচার জন্য তাবিজ-কবজ-ঝাড়-ফুঁকের আশ্রয় নিতেন।

উল্লিখিত অবস্থার সাথে যদি বর্তমান জমানার তুলনা করি তবে দেখতে পাবো, রাতের আঁধারের চেয়েও ভয়ঙ্কর আঁধার আমাদের মন-মস্তিষ্ক ও চিন্তাচেতনা ও বিশ্বাসকে মারাত্মকভাবে গ্রাস করেছে। আমরা স্বপ্ন দেখতে পারছি না- ভালোবাসতে ভুলে গেছি এবং নিজেদের পছন্দ-অপছন্দ-ঘৃণা-ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রদর্শনের পরিবর্তে মেরুদণ্ডহীন নির্জীব অসাড়-পঙ্গু এবং পক্ষাঘাতগ্রস্ত প্রাণীতে পরিণত হয়েছি। আমাদের মনে এখন বাঘ-ভাল্লুক-সাপ-ব্যাঙের ভয় নেই। ভূত-প্রেত-শয়তানরা এখন বাংলাদেশের সীমানায় নেই। কারা যেন তাদের ‘ঝেটিয়ে বিদায় করে দিয়ে তাদের ঘরবাড়ি-আবাসস্থল দখল করে এমন নয়া কুকর্ম চালু করেছে যার ফলে শয়তান-ভূত প্রেত্মীর কর্মকাণ্ড এখন জাদুঘরে চলে গেছে।

গত এক দশকের উন্নয়নের গল্প, অল্প গণতন্ত্র-অধিক উন্নয়ন এবং দেশ সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়া ছাড়িয়ে লন্ডন-আমেরিকা হয়ে গেছে এমনতর গল্পে বিভোর জাতি ২০২২ সালের অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে যেভাবে বাংলার ঐতিহ্যবাহী হারিকেন এবং মোমবাতিতে প্রভাবিত হচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে ভূ-পৃষ্ঠ পাড়ি দিয়ে আমরা হয়তো কোনো অনন্তলোকের দিকে যাত্রা শুরু করছি। আর যারা আমাদেরকে নক্ষত্রলোকের নক্ষত্র বাড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছে তারা কোনো সাধারণ মানুষ নয়- হয়তো গ্রিক পুরাণ অথবা সনাতন ধর্মে বর্ণিত দেবদেবী জাতীয় কিছু একটা হবেন। দুটো কারণে তারা মনুষ্যত্যের সীমা পরিসীমা অতিক্রম করে ফেলেছেন। প্রথমত মানুষ নামের পদবাচ্য তারা অতিক্রম করে ফেলেছেন। বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য মানুষ পদবাচ্য নিয়ে একটু বিস্তারিত আলোচনা আবশ্যক!

বাংলা ভাষায় মানুষ শব্দের অর্থ কী বা বৈশিষ্ট্য কী তা না বলে সত্তরের দশকে দাদা-দাদীদের কাছে মানুষ শব্দের অর্থ সম্পর্কে যা শুনেছি তা আজ আপনাদের বলব। দাদী বলতেন, মানুষ বোঝা যায় হুঁশ থেকে। অর্থাৎ যতক্ষণ হুঁশ তৎক্ষণ মানুষ। বেহুঁশ হলেই আর মানুষ থাকে না। দ্বিতীয়ত মানুষ চেনা যায় খানা-খাদ্যের ধরন প্রকৃতি অনুযায়ী। খানা অর্থ খাও এবং খেয়ো না, অর্থাৎ মানুষ সব সময় খায় না এবং সব কিছু খায় না। তো পুরনো দিনের আঞ্চলিক সদবাচ্য দিয়ে যদি মানুষ চিনতে বলে তবে বর্তমান জমানার ক্ষমতাধর লোকদের দেখবেন তারা সব সময় খাই খাই করে এবং সব কিছু খায় অর্থাৎ সর্বভুক। কাজেই তাদের খানা-খাদ্য বিবেচনায় নিলে তাদের আর মানুষ পদবাচ্যের অন্তর্ভুক্ত রাখা সম্ভব নয়।

মানুষ শব্দের আরেকটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সেটি হলো, সব মানুষ ভুল করে। আরবিতে মানুষের প্রতিশব্দ হলো ইনসান। আর আরবি ব্যাকরণ মতে, ইনসান হলো তারা যারা ভুল করে। দ্বিতীয়ত পশুর ভুল আর ইনসানের ভুলের মৌলিক পার্থক্য থেকেও মানুষের বৈশিষ্ট্য বোঝা সম্ভব। পশু তার যত ভুল কোনো দিন বুঝতে পারে না। ভুলের জন্য অনুশোচনা করে না বা ক্ষমা প্রার্থনা করে না। অন্য দিকে মানুষ যদি ভুল করে তবে তার মানবিক সত্তা সব সময় তাকে খোঁচাতে থাকে এবং ভুুলের অনুশোচনা অথবা ভুল থেকে বেরিয়ে এসে সঠিক পথে চলার জন্য তাগিদ দিতে থাকে।

মানুষের উল্লিখিত ভুলের সাথে দেব-দেবীর ভুলেরও কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। হিন্দু পুরাণ, গ্রিক পুরাণ অথবা আইয়ামে জাহিলিয়াতের যেসব দেব-দেবীর গল্প আমরা জানি সেখানে দেখেছি, তারা প্রায় সবাই শেষ পর্যন্ত ভুলের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল- ভুল নিয়ে গর্ব করত এবং তাদের সেসব কৃত ভুলই তাদের অনুসারীরা পূজা করতে অভ্যস্ত। তারা অর্থাৎ দেব-দেবীরা ভুল জানার পরও ভুল প্রতিষ্ঠায় যুদ্ধ করত, অহঙ্কার করত এবং প্রতিপক্ষকে অভিশাপ দিত। দেব-দেবীদের সবচেয়ে কট্টর যে বৈশিষ্ট্য পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি বিপত্তি সৃষ্টি করেছে তা হলো দেবীরূপে পূজা অর্চনা। ভোগ প্রদান এবং দেব-দেবীর খুশির জন্য অর্থ-বিত্ত সম্মান এবং জীবন বিসর্জন ছিল পূজারীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য।

উল্লিখিত অবস্থার সাথে যদি বর্তমানকালের হারিকেন এবং মোমবাতির প্রত্যাবর্তন বিচার বিশ্লেষণ করেন তবে দেখতে পাবেন যে, আপনি হারিকেন ও মোমবাতির নয়া জনক-জননী সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করতে পারবেন না। সমালোচনা তো দূরের কথা ঠিক মতো দোয়াও করা নিষিদ্ধ। আধুনিক সভ্যতার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উপকরণ বিদ্যুৎ নিয়ে গত এক যুগ ধরে যে ভেলকিবাজি চলছিল তার জারিজুরি এই অক্টোবর মাসে এসে এমনভাবে ফাঁস হয়ে গেছে যে, সে দেবীর কোনো কারামাতই আর কাজে আসছে না। ফলে গাঙ্গেয় বদ্বীপের আধুনিক সভ্যতা পঞ্চাশ বছর পিছিয়ে হারিকেন মোমবাতি সলিতা খড়কুটোর মশালের দিকে ধাবিত হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হলো, বিজলীবাতির সাথে যেসব বিজলী দানা রাক্ষস খোক্ষস ইত্যাদি পয়দা হয়েছিল তাদের কী হবে। তারা কি হারিকেনের আলোতে টিকতে পারে। নাকি আদিকালের হারিকেন জমানার মেছোভূত গেছোভূত, লম্বা শয়তান বদ জ্বিনের আক্রমণে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হবে।

আমরা আজকের নিবন্ধের একেবারে শেষপ্রান্তে চলে এসেছি। সবার শেষে বিখ্যাত একটি উক্তি দিয়ে আজকের প্রসঙ্গের ইতি টানতে চাই। কোনো এক লেখক বলেছেন, ফিরিয়ে দাও সেই অরণ্য। আমরা সেই লেখকের সাথে সহমত পোষণ করে বলতে চাই, ফিরিয়ে দাও আমাদের হারিকেন, ফিরিয়ে দাও আমাদের মোমবাতি। আর ফিরিয়ে নাও তোমাদের দুর্নীতি, অনিয়ম, চুরিচামারি এবং বিদ্যুতের নামে সফল ভেলকিবাজি। দোহাই দিয়ে এবং আমাদের কান ঝালাপালা করা উন্নয়নের গানবাজনা থেকে এবার আমাদের দয়া করে নিষ্কৃতি দাও।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement