মধ্যপ্রাচ্যের খ্রিষ্টানপ্রধান একটি ক্ষুদ্র আরব দেশ লেবানন। দ্য প্রফেটখ্যাত কবি খলিল জিবরানের লেবানন। ইরানপন্থী শক্তিশালী মুসলিম সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লার লেবানন। এই গোষ্ঠীটি যুদ্ধে সব আরব দেশকে হারিয়ে দেয়া ইসরাইলকে লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল থেকে উৎখাত করেছিল। তারা প্রমাণ করেছে, সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করলে প্রবল শক্তিমানকেও হারানো সম্ভব। প্রমাণ করেছে, মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে শক্তিশালী বলে বিবেচিত ইসরাইলি সেনাবাহিনী অপরাজেয় নয় যতই সে আমেরিকাসহ গোটা পাশ্চাত্যের মদদ লাভ করুক না কেন; যেমনটা প্রমাণ করেছে আফগানিস্তানের তালেবান আমেরিকাকে ২০ বছরব্যাপী যুদ্ধে নাস্তানাবুদ করে।
লেবাননের রাজধানী বৈরুত। মধ্যপ্রাচ্যের সুন্দরতম এবং এতদঞ্চলের তৃতীয় বৃহত্তম এই শহরটিকে একসময় কারা যেন প্রাচ্যের প্যারিস আখ্যা দিয়েছিল। কিন্তু আজকের লেবাননের অবস্থা কি আমরা জানি? সম্ভবত খুব কম বাংলাদেশীই সেটা জানেন। কারণ বাংলাদেশে লেবাননের প্রসঙ্গ আদৌ আলোচনায় আসেনি যেমনটা এসেছে শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক দুর্দশা ও গণঅভ্যুত্থানের প্রসঙ্গ।
সম্ভবত ভৌগোলিক দূরত্ব এবং লেবাননের ক্ষুদ্রাকৃতি এর একটা কারণ। জনসংখ্যা এক কোটিরও অনেক কম; আয়তন মাত্রই ১০ হাজার ৪৫২ বর্গকিলোমিটার। কিন্তু মিসর, ইসরাইল, ফিলিস্তিনের মতোই লেবাননও বিশ্বের প্রাচীনতম মানব সভ্যতার জন্মভূমি। অবস্থানগত কারণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী দেশটি। সিরিয়া, ইসরাইলের সঙ্গে সীমান্ত আছে। অদূরে তুরস্ক, জর্দান, সৌদি আরব।
শ্রীলঙ্কার খবর আমরা জানি। ক্ষমতাসীনদের ভ্রান্ত নীতি ও লুটপাটের কারণে অর্থনৈতিক ধসের শিকার শ্রীলঙ্কা শেষ পর্যন্ত নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করে। এখনো বাংলাদেশের সব পত্র-পত্রিকা প্রতিদিন শ্রীলঙ্কার খবর নিয়মিতই সরবরাহ করছে। দেশটির প্রতাপশালী প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া এখন বিশ্বের দেশে দেশে একটু মাথা গোঁজার মতো আশ্রয় খুঁজছেন। কিন্তু লেবাননের অবস্থা আরো বেশি সঙ্গীন। বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে সংক্ষেপে গত কয়েক দিনে দেশটির পরিস্থিতি নিয়ে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় যেসব খবর এসেছে তারই কয়েকটির শিরোনাম উল্লেখ করি।
ক’দিন আগে রয়টার্স এক খবরের শিরোনাম করেছে, “টলতে টলতে ‘ব্যর্থ রাষ্ট্রে’র পথে চলমান লেবাননের সরকারি খাত স্থবির।” একই সময়ে মিডল ইস্ট নিউজ নামে একটি পত্রিকার শিরোনাম, ‘তেল নেই, বিদ্যুৎ নেই, পানি নেই: এই হলো লেবাননের জীবন সায়াহ্নের চিত্র।’ এক সপ্তাহ আগে আলজাজিরা এক খবরে লিখেছে, ‘লেবানন গভীর অর্থনৈতিক সঙ্কটে আটকে পড়েছে। জাতিসঙ্ঘের হিসাবে দেশটির প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষের অবস্থান এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে।’
ওই এক সপ্তাহ আগেই (১১ আগস্ট ২০২২) ব্রিটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকা এবং পরদিন বিবিসি খবর দেয়, ‘লেবাননে নিজের টাকা ফিরে পেতে ব্যাংক জিম্মিকারী এখন জাতীয় বীর’। এই ঘটনাটি একটু ব্যাখ্যা দাবি করে। নাহলে পাঠকের পক্ষে বুঝে ওঠা মুশকিল হবে। ঘটনাটি প্রকাশ পায় বিশ্বের প্রায় সব প্রধান পত্র-পত্রিকায়।
গত ১১ আগস্ট রাইফেল হাতে এক ব্যক্তি লেবাননের রাজধানী বৈরুতের কেন্দ্রস্থলে ফেডারেল ব্যাংকে ঢুকে পড়েন। তিনি অস্ত্রের মুখে ব্যাংকের সব কর্মীকে জিম্মি করেন। কিন্তু বিস্ময়কর হলেও সত্য, তিনি টাকা লুট করতে যাননি। ব্যাংক লুটের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা তার ছিল না। তাহলে কেন লোকটি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এমন একটি বিপজ্জনক কাজ করতে গেলেন? কী ছিল তার দাবি?
তিনি বলছিলেন, তোমাদের ব্যাংকে আমি যে টাকা জমা রেখেছি তার কিছু অংশ আমাকে তুলে নিতে দাও। না হলে গায়ে আগুন ধরিয়ে মরে যাব। দরিদ্র লোকটি তার বৃদ্ধ ও অসুস্থ বাবার চিকিৎসার জন্য নিজেরই জমা করে রাখা টাকা থেকে কিছু অংশ তুলতে চাইছিলেন। এটুকুই ছিল তার এত বড় ঝুঁকি নেবার কারণ। দীর্ঘ সাত ঘণ্টা চলে এই জিম্মি নাটক। এরপর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাকে মাত্র ৩৫ হাজার ডলার তুলে নেয়ার সুযোগ দেয় যদিও তার জমার পরিমাণ দুই লাখ ডলারের উপরে। ডেলিভারি ভ্যান চালিয়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সারা জীবন ধরে তিলে তিলে ওই অর্থ ব্যাংকে জমা করেন ৪২ বছরের শেখ বাসাম হোসেন। ব্যাংক অবরোধের পর লেবাননের মানুষের কাছে তিনি এখন জাতীয় বীরের মর্যাদা পাচ্ছেন। কেন? কারণ, সারা দেশের বঞ্চিত দুর্দশাগ্রস্ত মানুষ ভাবছে, আমাদের অন্তত এক ভাই তো নিজের অধিকার আদায় করতে পেরেছেন!
লেবাননে গত দু’বছর ধরে ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের টাকা দিতে পারছে না। তাদের হাতে ডলার নেই। প্রথম দিকে কিছু কিছু দিলেও এখন পুরোই বন্ধ। আমদানি করা যাচ্ছে না জ্বালানি, বন্ধ হয়ে গেছে বিদ্যুৎকেন্দ্র। বন্ধ হয়ে গেছে ঘরে ঘরে পানি সরবরাহ। ডিজেল নেই জেনারেটর চালানোর মতো। শিল্প তো গেছেই। অর্থনীতি ধ্বংসের চূড়ান্তে। চলছে মহামন্দা। একটা ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের আলামত স্পষ্ট। যেকোনো সময় এর অবস্থা সোমালিয়ার মতো হতে পারে। পত্রিকাগুলো শিরোনাম করছে, এখন লেবাননের জনগণের একটাই করণীয় আছে, উপরওয়ালার কাছে প্রার্থনা করা। কোনো পত্রিকা লিখছে, অলৌকিক ঘটনা ছাড়া মৃত্যুমুখী লেবাননের অস্তিত্ব রক্ষার আর কোনো উপায় নেই।
এসবের কারণ কী? এক সময়ের সমৃদ্ধ দেশটি কেন এমন মহামন্দার মুখে এসে দাঁড়াল? প্রধান কারণ অবশ্যই রাজনীতি। বিভেদ ও শক্তি প্রদর্শনের রাজনীতি যাকে কেন্দ্র করে দেশটি ১৯৭৫ সাল থেকে ’৯০ সাল পর্যন্ত ভয়ঙ্কর গৃহযুদ্ধের ভেতর দিয়ে গেছে। কিন্তু ১৫ বছরের সেই গৃহযুদ্ধই একমাত্র কারণ নয়। আরো যেসব কারণ আছে সেগুলোই বরং উল্লেখযোগ্য। বলা হচ্ছে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল নিষ্ক্রিয়। পরিস্থিতি আগে থেকে সামাল দেবার চেষ্টা তারা করেনি। যখন সচেষ্ট হলে সামলে ওঠা যেত, তখন নেতারা ছিলেন আত্মতুষ্ট এবং লুটপাটে ব্যস্ত। অবনতিশীল অবস্থাটা তারা বারবার অস্বীকার করেছেন।
২০১৯-২০ সালেও অর্থনীতিবিদ ও অন্যান্য বিশ্লেষক সরকারকে সতর্ক করেছেন মন্দার আভাস সম্পর্কে। কিন্তু না সরকার, না ব্যাংক ব্যবস্থা, সেই সতর্কবাণীতে কান দিয়েছে। বরং তারা বারবার বলেছেন, কোনো সমস্যা নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে। আমাদের যথেষ্ট রিজার্ভ আছে, আমরা অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সব কিছু করছি।’ তারা মন্দার সতর্কতাকে বিরোধীদের অপপ্রচার, ষড়যন্ত্র, গুজব, কুৎসা রটনা ইত্যাদি বলে সব সমালোচনা অস্বীকার করে এসেছেন। আর জনগণের অর্থের নয়ছয় করেছেন, তছরুফ, আত্মসাৎ, পাচার করেছেন।
২০২২ সালে এসে বিশ্বব্যাংক লেবানন বিষয়ে এক রিপোর্টের শিরোনাম করে, ‘The Great Denial.’ মহামন্দা না বলে, বলা হচ্ছে, ‘মহা অস্বীকৃতি’ ঠিক যেমনটা আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব করে চলেছেন। কেউ বলছেন, এ দুর্ভোগ সাময়িক; এক মাস পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা আবার অপ্রতিরোধ্য গতিতে উন্নয়নের ট্রেন ছুটাব। কেউ বলছেন, আমরা তো অনেক দেশের চেয়ে রীতিমতো বেহেশতে আছি। কেউবা বিরোধীদের পিটিয়ে ঘরে তুলে দেয়ার হুমকি দিচ্ছেন।
লেবাননের এই পরিণতিকে নিছক অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ফল বললে কিছুটা সরলীকরণ হবে। সেখানে আন্তর্জাতিক নানা টানাপড়েন আছে। ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র, ইরান- এই তিন দেশ সেখানে বড় খেলোয়াড়। আছে সিরিয়াও। ইসরাইলের সাথে সমুদ্রবিরোধ মেটাতে অন্যায্য চুক্তি করার জন্য চাপ দিচ্ছে আমেরিকা। সেটা না করা পর্যন্ত লেবাননকে মিসর থেকে গ্যাস, ইরাক থেকে তেল এবং জর্দান থেকে বিদ্যুৎ আনার সুযোগ দিচ্ছে না। ইরান কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে দেশটির রাজনীতি। ইরানপন্থী দল হিজবুল্লাহর অনুমোদন ছাড়া আমেরিকার কথায় ইসরাইলের সাথে চুক্তি করতে পারবে না লেবানন। সুতরাং সেটা সম্ভবত হচ্ছে না। সর্বশেষ যেসব খবর জানা যাচ্ছে, তাতে লেবানন সরকারের (পড়ুন, হিজবুল্লাহর) শর্তেই চুক্তি করতে সম্মতির আভাস দিয়েছে ইসরাইল।
একই পরিস্থিতি কিন্তু আমাদেরও। এখানেও টানাপড়েন আছে অনেক বিশ্বশক্তির। চীনের দিকে যাবেন, আমেরিকার দিকে, নাকি ভারতের দিকে? সমস্যা ত্রিশঙ্কু। সামলাতে হিমশিম। সরকার টিকিয়ে রাখতে বৈদেশিক সাহায্য চাওয়ার মতো রাজনৈতিক দেউলিয়াপনাও প্রকাশ্যে এসে যাচ্ছে। হাজার মিথ্যাচার করেও আর ধামাচাপা দেয়া যাচ্ছে না ভেসে ওঠা ব্যর্থতার ডুবোচর। কত দিনে এবং কী প্রক্রিয়ায় পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটবে তা এখনও স্পষ্ট নয়।
কিন্তু সেসব পরের কথা। মানুষ বাঁচাতে সরকার কী করছেন সেটাই মূলত দেখার বিষয়। আমরা অনেকে জানি, আইএমএফ উদ্ধার করতে ঋণ দেবে কি না সেটাও পুরোপুরি আমাদের এখতিয়ারে নেই। সেটা হতে পারে অন্য কারো ইচ্ছা অনিচ্ছার বিষয়, সন্তুষ্টি বা অসন্তুষ্টির বিষয়। তার পর আসবে কঠিন সব শর্তের প্রশ্ন। যেমন জ্বালানি তেলের দাম বেপরোয়াভাবে বাড়ানো হলো আইএমএফের ইচ্ছায় ভর্তুকি তুলে দেওয়ার নামে। সুতরাং শিক্ষা নেবার জায়গা শুধু শ্রীলঙ্কা নয়। লেবাননসহ অনেক জায়গা আছে যাদের পরিণতি দেখে শিক্ষা নেবার সুযোগ আছে। তবে শঙ্কা হয় এ কারণে যে, আমাদের বর্তমান ক্ষমতাসীনরা কারো সাহায্য সহযোগিতার পরোয়া করেন না। তারা সমস্ত বিরোধীদের দূরে ঠেলে দিয়ে এককভাবে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে চান। এরই মধ্যে মানবাধিকারের ইস্যুতে তারা অর্জন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা। সেটি আপাতত প্রত্যাহারের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। পরিস্থিতি সামাল দিতে হলে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। কিন্তু মন্ত্রীদের লাগাতার অসংলগ্ন কথার ফুলঝুরি দেখে মনে হয় ক্ষমতাসীনরা অস্বস্তিতে আছেন।
কী হবে তাহলে! বাস্তবতা অস্বীকার করলে পরিণতি লেবাননের মতো হবার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যাবে না। আমরা আশা করব নেতারা সতর্ক হবেন। বালুতে মুখ গুঁজে থাকলে ঝড় থেমে যায় না। এই প্রাচীন প্রবাদ মনে করিয়ে দিতেও সঙ্কোচ বোধ হয়। কিন্তু দিতেই হচ্ছে, কারণ সার্বিক ধস ঠেকানোর সময় হয়তো এখনো আছে। সেটা দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে।
ই-মেইল : mujta42@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা