২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ইউক্রেন যুদ্ধ

- ছবি : নয়া দিগন্ত

রাশিয়া যে মানবতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছে, তার অভিঘাত এখন দুনিয়াজোড়াই সুস্পষ্ট। তারা ইউক্রেন দখল করতে নয়, চায় দেশটি যাতে ন্যাটো জোটের শরিক বা সদস্য না হয়, সেই লক্ষ্য হাসিলের জন্যই মানুষ হত্যার এই যজ্ঞ। কিন্তু এ যুদ্ধের অর্থনৈতিক অভিঘাতের বিষয়টি এতটা গভীরভাবে ভাবেননি পুতিন। ভাবলে ইউক্রেন তিনি আক্রমণ করতেন না। তিনি চাইছিলেন বহুবারই বহুভাবে বলেছেন, কিন্তু ভলোদিমির জেলেনস্কি শোনেননি। জেলেনস্কির রাজনৈতিক ঝোঁক রাশিয়া থেকে দূরে থাকা আর পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোতে যোগ দেয়া। পুতিনের ভয়, যদি ইউক্রেন ন্যাটোভুক্ত হয়, তাহলে তার দেশের নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। সীমান্তলগ্ন ন্যাটো এলেই রাশিয়া ঝুঁকিতে পড়বে এটি একটি বাহানামাত্র। তবে নানান শ্রেণিবিভক্ত পশ্চিমারা তাকে বিশ্বাস করে না। পুতিন আনপ্রেডিক্টেবল মানুষ। মাসের পর মাস ধরে ইউক্রেন সীমান্তে লক্ষাধিক সেনা মোতায়েনের পর তিনি অবলীলায় বলেছেন, রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালাবে না। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলে আসছিলেন, পুতিন ইউক্রেন দখল করে নিতে চায়। সেই লক্ষণই তিনি দেখছেন। শেষমেশ পুতিন ইউক্রেনে হামলা চালিয়ে দেশটিতে আক্রমণ চালিয়ে প্রমাণ করল সে আনপ্রেডিক্টেবল।

তবে তিনি সবসময়ই ভীত থাকেন। আর নিজের দেশের প্রটেকশনের জন্য পরিকল্পনা করতে থাকেন। এ রকম ভয় অমূলক নয় মহাশক্তিধরদের মধ্যে। বিশ্বরাজনীতির সেরা সেরা নেতারা অত্যন্ত ভীত। তারা পান থেকে চুন খসলেই ভয়ে সামরিক অভিযান শুরু করেন। ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান তারই একটি। কিংবা অন্য কোনো মোটিভ রয়েছে তার। রাশিয়ার আক্রমণে ইউক্রেনে মানবিক সঙ্কট দেখা দিলেও পুতিনের মনে তার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। তার প্রতিক্রিয়া হচ্ছে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপে। তার দেশের অর্থনৈতিক ব্যাকবোনে আঘাত পড়ছে এখনি। ফলে একই সাথে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির পতনের জন্য কিয়েভে আঘাত হানছে রাশিয়ান শেলগুলো। কামানের নলগুলো কিয়েভের জনপদের দিকে। অনেক বেসামরিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে এর মধ্যেই। বাড়িঘর গোলার আঘাতে তছনছ হয়ে গেছে। অন্যদিকে হাত পাতছে রাশিয়া ভারতের দিকে, সাহায্যের জন্য। ভারত পৃথিবীর দ্বিতীয় বড় দেশ জ্বালানি তেল আমদানির ক্ষেত্রে। পশ্চিমারা যখন নিষেধাজ্ঞার অস্ত্র হেনেছে রাশিয়ার ওপর, তখন রাশিয়ান তেল বিক্রি বন্ধ হওয়ার জোগাড়। রাশিয়ার ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ জ্বালানি কিনে থাকে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। যদিও ইইউর সব সদস্য দেশ এখনই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি রাশিয়ার ওপর। তারপরও ভীত হয়ে পড়েছে রাশিয়া। অর্থ না থাকলে যুদ্ধ চালানো কঠিন। এটা জানে পশ্চিমারা। জানেন পুতিনও। চীন হয় তো তেল কিনে সাহায্য করতে পারে। কিংবা অন্যভাবে পশ্চিমা জোটের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থানকে জানান দেবে, তবে তাকে জোরালো করে তুলবে না। এটাই বোধহয় শি জিন পিংয়ের রাজনৈতিক নীতি।

মানুষ হত্যার এ যে যুদ্ধ, পৃথিবীর প্রজ্ঞাবানদের নেতৃত্বাধীন এ যুদ্ধ আসলে মানবতা হরণের যুদ্ধ। যখন ২৪ ফেব্রæয়ারি ইউক্রেনে সেনাদের ঢুকিয়ে দেয় রাশিয়া তখনো পৃথিবীর প্রধান আতঙ্কের নাম ছিল কোভিড-১৯। সেই অদৃশ্যপ্রায় হত্যাকারীর বৈশ্বিক তাণ্ডব শেষও হতে দেয়নি রাশিয়ান নেতা পুতিন। তিনি আক্রমণ করে বসলেন ইউক্রেন। মানবতার ইতিহাসে এমন এক অমানবিক মানুষের হত্যাযজ্ঞ চালানোর সিদ্ধান্তই বলে দেয় মানুষ হিসেবে পুতিন রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী, তবে তিনি যে অমানবিক, সেটা কিন্তু প্রমাণ হয়েছে। তিনি কেবল ইউক্রেনীয় মানুষ ও সম্পদ ধ্বংস করেই চলেননি, তিনি রুশ সেনাদের একটি অংশকেও মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন।

এই মানবিক ক্ষতির সামনে এখন তাদের কাছে সামরিকভাবে জয়ী হওয়ার অন্ধ জোশ উঠেছে। আমেরিকা সাহস জোগালেও, ইউক্রেনে সেনা পাঠায়নি। বরং অস্ত্র দিচ্ছে। অস্ত্র কেনার জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার দিয়ে সাহায্য করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের তিন সদস্য দেশ পোল্যান্ড, চেক প্রজাতন্ত্র ও ¯স্লোভেনিয়ার ক্ষমতাসীন নেতারা (তিন দেশের তিন প্রধানমন্ত্রী, ট্রেনে চেপে কিয়েভে পৌঁছান) কিয়েভে সশরীরে গিয়ে জেলেনস্কির পাশে দাঁড়িয়েছেন। বলেছেন, আমরা আপনাদের পাশে আছি। আপনারা নিজেদের স্বাধীনতা, স্বার্বভৌমত্ব রক্ষায় যুদ্ধ করছেন, পাশাপাশি আমাদের জন্যও যুদ্ধ করছেন।

এটা বোঝা কঠিন যে, কিভাবে জেলেনস্কি রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধেই কেবল প্রতিরোধযুদ্ধ করছেন না, ওই তিন রাষ্ট্রনায়কের ভাষায়, তাদের জন্যও লড়ছেন। শাদা চোখে তাদের এ কথা বোঝা কঠিনই বলতে হবে। যে রাজনৈতিক চেতনা থেকে তারা বিষয়টিকে একাত্ম করেছেন, তা মূলত মানবসমাজের যৌথ অবচেতনাজাত। সাব-কনসাসনেসের ভেতরে যুদ্ধের ভয়াবহতা আমরা যেমন টের পাই, ঠিক ইউক্রেনীয় জনগণ যেমন তা ভোগ করছেন, দুর্দশাগ্রস্ত সময়ের মধ্যে থেকে জীবনের মর্মে অনুপ্রবেশ করছে। এর আপাতত কোনো ব্যাখ্যা নেই। একটা বিষয় মনে রাখলেই হবে যে, চেতনাগতভাবে প্রত্যেক মানুষ বহন করে কিছু উপাদান, যা তার পরম্পরার ভেতরে নিহিত। সেই অন্তর্গত সত্যই প্রকাশিত হয় তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও প্রতিরোধের চিন্তা থেকে। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের মনস্তাত্ত্বিক পরিক্রমণ গোটা বিশ্বকেই ছায়াচ্ছন্ন করে ফেলেছে। তার প্রকাশ ঘটে চলেছে নানাভাবে। তার একটি জ্বালানি সঙ্কট, দেশে দেশে খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, সরবরাহে ঘাটতি, সরবরাহে বাধা, আমদানি ও রফতানি কর্টেল, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, রাজনৈতিকভাবে মেরুকরণ করার এক সুদূরপ্রসারী লক্ষণ দেখা দিচ্ছে। এটা প্রায় অবিশ্বাস্য বলে মনে হয় যে, সৌদি আরব চীনের কাছে তেল বিক্রি করতে উৎসাহী। চীনা মুদ্রা ইউয়ানে মূল্য পরিশোধ করবে। গত ৭০ বছরের মধ্যে এটি একটি চমকপ্রদ সিদ্ধান্তই বলতে হবে। কেন সৌদি আরব ডলারে তেল বিক্রি না করে ইউয়ানে বিক্রি করতে উৎসাহ দেখাচ্ছে, তার অন্তর্গত কারণ হলো, সৌদরা যে নিরাপত্তার বিনিময়ে ডলারে তেল বিক্রিতে রাজি হয়েছিল, যাকে আমরা পেট্রোডলার বলে চিনি, সেই আমেরিকার ওপর সন্দেহ করছে সৌদি আরব। সে আজ আর মার্কিনি ভরসায় থাকতে পারছে না। রাশিয়া তার রিজার্ভের ১৩ শতাংশ রেখেছে ইউয়ানে, চীনের জিম্মায়। এর বিকল্প ব্যবস্থার আলোচনা যে বহুদিন ধরেই চলছিল, তার রাজনৈতিক মাথাটি এখন দেখা দিয়েছে। যদি মধ্যপ্রাচ্যের ধনী মুসলিম দেশগুলোও তাদের রিজার্ভ মানির স্থান পরিবর্তন করে, কিংবা তেল বিক্রি করে ইউয়ানে, ইয়েনে, তাহলে আরেকটি নতুন বিশ্ব অর্থব্যবস্থা জারি হতে সময় নেবে বলে মনে হয় না। ইরান তো একপায়ে খাড়া, মার্কিনিদের বিরুদ্ধে যেকোনো ব্যবস্থা নিতে। সেই লক্ষণগুলোই দেখা দিচ্ছে।

চেক, পোলিশ ও ¯স্লোভেনিয়া পশ্চিমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গ, তারা ইউক্রেনের আশাকে জাগিয়ে রাখবে, এটাই তো স্বাভাবিক। যুক্তরাষ্ট্র যা সরাসরি করবে না, তা সে করায় তারই সঙ্গী যুক্তরাজ্য বা পশ্চিমের অন্য কোনো রাষ্ট্র দিয়ে। মধ্যপ্রাচ্যের তেল উৎপাদক দেশ, রাশিয়াসহ অন্যান্য দেশ যদি একাট্টা হয়ে নতুন অর্থব্যবস্থা গড়ে তোলে, তাহলে নতুন বিশ্ব অর্ডার হতে দেরি হবে না।

আমার ধারণা, চীন ও রাশিয়ার যৌথ পরিকল্পনায় এ আলামত দেখা দিতে শুরু করেছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের প্রকাশ্য মার্কিনবিরোধিতাকে যারা হঠকারি বলে মনে করছেন, তারা ভুলে যাবেন না যে, মহাসমুদ্রের তলদেশের চোরাস্রোতের শক্তি কতটা হতে পারে। সৌদি আরবের মতো যুক্তরাষ্ট্রের অনুগত বশংবদ রাজবংশীয় নেতাও ইয়েমেন-প্রশ্নে প্রকাশ্যে দোষারোপ করছে আমেরিকার। তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে মার্কিনি শর্তভঙ্গের পর তারা নতুন পথের দিশারি আজ। যা ছিল অকল্পনীয়। আবার আমেরিকাও আর শিখণ্ডি রাজবংশ সৌদিদের নিরাপত্তা দিয়ে লালন করতে রাজি নয়। তাদের শায়েস্তা করতে চায় সে, বিষয়টি চাপা থাকলেও, সবাই সেই বিষয়ে ওয়াকিবহাল নয়। ভেতরে ভেতরে ভেঙে যাচ্ছে বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থা, ইউক্রেন-রাশিয়ার মধ্যকার রাজনৈতিক বিরোধ মূলত ন্যাটোতে যোগ দেয়ার ইচ্ছার কারণে মনে হলেও আসলে তা নতুন ব্যবস্থা গড়ে তোলার নেপথ্যের এক সুদূর পরিকল্পনার একটি রক্তাক্ত অংশ।


আরো সংবাদ



premium cement
যশোর কারাগারে হাজতিদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ব্যাপক আতঙ্ক চিকিৎসার জন্য ঢাকা ছাড়লেন বিএনপি নেতা আমীর খসরু কুষ্টিয়াতে মসজিদ কমিটি নিয়ে সংঘর্ষে আহত ৫ চেয়ারম্যান তপন ও অজিত মেম্বারকে ধরিয়ে দিতে পারলে পুরস্কার ঘোষণা নারায়ণগঞ্জে ২৪ ঘণ্টায় ১৪ ডাকাত সদস্য গ্রেফতার রাজশাহীতে মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি ছাড়াল যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশী শ্রমিকদের ভিসা সহজ করার আহ্বান প্রবাসী প্রতিমন্ত্রীর চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী না হয়ে অংশীদার হওয়া উচিত : শি জিনপিং ওকাব সভাপতি নজরুল ইসলাম, সম্পাদক জুলহাস আলম পাবনায় ১০ কোটি টাকার অনিয়মে ৩ ব্যাংক কর্মকর্তা কারাগারে চুয়েট ১১ মে পর্যন্ত বন্ধ, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন স্থগিত

সকল