২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ব্রিটেনে ইসলামী মূল্যবোধের ক্রমবিকাশ

অক্সফোর্ড সেন্টার ফর ইসলামিক স্টাডিজ - ছবি - সংগৃহীত

বিগত তিন দশকে ইউরাপের বিভিন্ন জনপদে বিশেষত ব্রিটেনে এক নীরব বিপ্লব সংঘটিত হচ্ছে এবং প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় যোগ হচ্ছে নতুন মাত্রা। ব্রিটিশ প্রচারমাধ্যমে ইসলামের নামে আতঙ্ক সৃষ্টি (ইসলামোফোবিয়া) সাধারণ নিয়ম। ব্রিটিশ মিডিয়া অষ্টপ্রহর মুসলমানদের টার্গেট করে ভিলেন, মৌলবাদী, সন্ত্রাসী হিসেবে চিত্রায়িত করা সত্তে¡ও মুসলমানদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত গতিতে চলছে। নও মুসলমানদের সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তেমনি প্রসারিত হচ্ছে মসজিদের পরিধিও। মুসলমানরা বহু পরিত্যক্ত গির্জা কিনে রূপান্তরিত করেছেন মসজিদে। এটি ইসলামের অন্তর্নিহিত শক্তির বহিঃপ্রকাশ। ত্রিত্ববাদের পাদপীঠ পরিণত হচ্ছে তাওহিদবাদীদের ইবাদতগাহে। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বহু উচ্চশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ পেশাজীবী মানুষ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়ায় গোটা ব্রিটেনে আলোড়নের সৃষ্টি হয়। দি গার্ডিয়ানের তথ্য মতে, প্রতি বছর পাঁচ হাজার নারী-পুরুষ ইসলাম ধর্ম কবুল করেন। পবিত্র কুরআনের তাফসির, হাদিস, ফিকহ, ইসলামের ঐতিহ্য ও ইতিহাসের বিভিন্ন গ্রন্থাদি ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়ে ব্রিটেনের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ছে ক্রমাগতভাবে। ইসলামিক স্কুলের পাশাপাশি গড়ে উঠছে বিভিন্ন মাদরাসা। বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশ্বের বহু মেধাবী আলিম দাওয়াত, তাবলিগ, তালিম ও গবেষণার কাজে ব্রিটেনের নানা স্থানে, নানা প্রতিষ্ঠানে ইসলামের খিদমতে নিয়োজিত রয়েছেন। বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীভুক্ত মুসলমানরা বেশির ভাগ বসবাস করে লন্ডন, বার্মিংহাম, লিডস, ম্যানচেস্টার, লেইস্টার, সাউথ ওয়েলস, ইয়র্কশায়ার, মিডল্যান্ড, নর্থ ওয়েস্ট ও লিভারপুল এলাকায়। কেবল লন্ডনে বাস করে চার লাখ মুসলিম। ব্রিটেনে মসজিদ বা নামাজের ঘরের সংখ্যা প্রায় এক হাজার ৫০০। রিজেন্ট পার্কে অবস্থিত কেন্দ্রীয় মসজিদটি লন্ডনের সবচেয়ে বড় মসজিদ। লিভারপুলের মসজিদ ব্রিটেনের প্রাচীন মসজিদগুলোর অন্যতম। প্রায় প্রতিটি মসজিদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ইসলামিক সেন্টার। মসজিদের ভ‚মিকা অনেকটা আমাদের দেশের মাদরাসার মতোই। শিশু-কিশোরদের ইসলাম ও কুরআন সম্পর্কে প্রাথমিক পাঠদানের ক্ষেত্রে মসজিদগুলোর অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মিলনক্ষেত্র হচ্ছে মসজিদ। বর্তমানে ব্রিটেনে সাড়ে চার লাখ স্কুলগামী মুসলিম শিক্ষার্থী রয়েছে। ক্রমবর্ধিষ্ণু বিপুলসংখ্যক শিশুর শিক্ষার চাহিদা মেটানোর জন্য আরো ইসলামিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। আইরিশ ঔপন্যাসিক জর্জ বার্নাড শ’-এর মন্তব্য সফল হতে চলেছে দেখে অবাক হতে হয়। বহু বছর আগে তিনি বলেন, ‘আগামী ১০০ বছরের মধ্যে ইংল্যান্ড তথা ইউরোপকে শাসন করার সুযোগ যদি কোনো ধর্মের থেকে থাকে, সেটি আছে একমাত্র ইসলামের। আমি সব সময় হজরত মুহাম্মদ সা:-এর ধর্মকে উচ্চ মর্যাদা দিয়ে এসেছি এর বিস্ময়কর প্রাণশক্তির কারণে। আমার বিবেচনায় এটি একমাত্র ধর্ম যা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজকে খাপখাইয়ে নিতে সক্ষম, সব যুগেই রয়েছে এর আবেদন। হজরত মুহাম্মদ সা: কর্তৃক আনীত ধর্ম সম্পর্কে আমি ভবিষ্যদ্বাণী করেছি যে, এটি আজকের ইউরোপে যেমন গ্রহণযোগ্য তেমনি আগামীতেও ইউরোপে এর গ্রহণযোগ্যতার কমতি থাকবে না (George Bernard Shaw, The Genuine Islam, vol.1, No.8, 1936)।

ব্রিটেনের সাউথএন্ড এলাকায় বসবাসরত মুসলমানদের নামাজের বড় ধরনের জামায়াত ও দাওয়াতি সম্মেলন করার জন্য পর্যাপ্ত স্থানের অভাব বহুদিনের। দি এসেক্স জামে মসজিদ ট্রাস্ট লিমিটেড নামক একটি সংস্থা এ এলাকায় ১৯৮৬ সাল হতে নামাজের এবং দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। প্রাথমিক অবস্থায় ছোট্ট মুসলিম কমিউনিটি ৫৩ হাজার পাউন্ডের বিনিময়ে পরিত্যক্ত একটি ওয়ার্কশপ কিনে নেন। ওয়ার্কশপকে কেন্দ্র করে নামাজ ও ধর্মীয় কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে থাকে। ধীরে ধীরে মুসল্লিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকায় নামাজের জায়গার সঙ্কট দেখা দেয়। জুমার নামাজের সময় স্থানের অভাবে বহু মুসল্লিকে গলিপথের দ্বারে, সিঁড়িতে অথবা জুতা রাখার স্থানে নামাজ আদায় করতে হয়। এসব সমস্যার সমাধানকল্পে মুসলিম কমিউনিটি মসজিদ সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেন। ইউনাইটেড রিফর্মড চার্চ নামক একটি অব্যবহৃত গির্জা এবং এর সন্নিহিত চারটি আবাসিক ভবনের সন্ধান মেলে। কর্তৃপক্ষ মুসলমানদের কাছে এ গির্জা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ১৪ কোটিতে বিক্রি করতে নীতিগতভাবে সম্মত হয়। দি এসেক্স জামে মসজিদ ট্রাস্ট লিমিটেড স্থানীয় মুসলমানদের সহায়তায় এ গির্জাটি ক্রয় করে। মসজিদকেন্দ্রিক এক বিশাল সাংস্কৃতিক কেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এটি অত্র এলাকায় বসবাসরত মুসলমানদের বংশপরম্পরায় ধর্মীয়, শিক্ষাগত ও সাংস্কৃতিক প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম হবে। মসজিদের বর্তমান ইমাম ও খতিব লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক, কীর্তিমান ইসলামিক স্কলার মাওলানা মাহমুদুল হাসান আজহারী গির্জা কিনে মসজিদে রূপান্তরের এ প্রজেক্টে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ওই গির্জাটি ১০০ বছর আগে নির্মিত হয় এবং কয়েক বছর ধরে এটি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে ছিল।

ব্রিটেনের খ্যাতনামা সংবাদপত্র দি ডেইলি টাইমস সাম্প্রতিক এক সংখ্যায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, ‘আফগানিস্তানের তালেবান কর্তৃক সৃষ্ট ইসলামী বিপ্লব এত মারাত্মক যে, এর প্রভাব ব্রিটেনে ও ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ বিপ্লবের পেছনে রয়েছে দেওবন্দি চিন্তাধারার অনুসারীরা যারা মৌলবাদী ও গোঁড়া হিসেবে পরিচিত। তারা চান সারা দুনিয়ায় এ বিপ্লব ছড়িয়ে দিতে।’ রিপোর্টে আরো উল্লেখ করা হয় যে, ব্রিটেনের বিভিন্ন মসজিদে তরুণদের দেওবন্দের তৈরি করা সিলেবাস পড়ানো হয়। এতে আফগানিস্তানের তালেবানদের সাথে ব্রিটেনের মসজিদকেন্দ্রিক ছাত্রদের মধ্যে চিন্তা ও চেতনায় ঐক্য গড়ে উঠেছে। কারণ দেওবন্দের সিলেবাস গোটা দুনিয়ায় প্রায় অভিন্ন। ব্রিটেন থেকে ছাত্রদের ভারতের দেওবন্দের দারুল উলুম মাদরাসায় পাঠানো হয়। আট বছর শিক্ষা-দীক্ষা ও প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা ব্রিটেনে ফিরে আসে এবং বিভিন্ন মসজিদ ও মাদরাসায় ঢুকে দেওবন্দি ধারায় শিক্ষা কার্যক্রম চালায়। টাইমসের রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, ‘সৌদি আরবের সাহায্যে ব্রিটেনে বহু মসজিদ গড়ে উঠেছে। ব্রিটেনে বসবাসকারী ৩৩ লাখ মুসলমান যারা বেশির ভাগই তুরস্ক, আফ্রিকা, আরব, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান ও ভারত থেকে এসেছে; তাদের মধ্যে ২০ শতাংশ দেওবন্দি চিন্তাধারার পোষক। দাওয়াত, তালিম ও তাবলিগের মাধ্যমে এ চিন্তাধারা দিন দিন প্রসারিত হচ্ছে।’ টাইমসের ঢালাও মন্তব্য যথার্থ নয়। দেওবন্দি মাদরাসাগুলোতে ব্রিটিশ সিলেবাসের পাশাপাশি ধর্মীয় গ্রন্থাদি পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

যুক্তরাজ্য ইসলাম প্রচারকদের জন্য এক উর্বর ক্ষেত্র। গোটা ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডজুড়ে রয়েছে তাবলিগ জামাতের দাওয়াতি কর্মসূচি। মুসলিম অধ্যুষিত বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠা তাবলিগি মারকাজগুলো দাওয়াতি কাজে বেশ সফলতা লাভ করেছে। বিভিন্ন মুসলিম দেশ থেকে যেসব মেধাবী ছাত্র-শিক্ষক উচ্চশিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গমন করেন তাদের মধ্যে তাবলিগি প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। অমুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যেও দাওয়াতি প্রোগ্রাম সক্রিয় রয়েছে। ব্রিটেনের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত মুসলমানদের মধ্যে কয়েকটি ইসলামী সংগঠন তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম সম্প্রসারিত করেছে। প্রতি বছর সরকারের অনুমতি নিয়ে বড় আকারের ইসলামী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য, ব্রিটিশ সরকার ঐতিহ্যগতভাবে কাদিয়ানি মতবাদের পৃষ্ঠপোষক ও অর্থ জোগানদাতা। কাদিয়ানি ধর্ম প্রচারকরা রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে বিভিন্ন ভাষায় কাদিয়ানি মতবাদ প্রচার করে থাকে। ফলে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী থেকে ব্রিটেনে আগত মুসলমানরা কাদিয়ানিদের মুসলমান মনে করে থাকেন। এ ভুল নিরসন ও সঠিক ইসলাম পেশ করার জন্য আন্তর্জাতিক মজলিসে খতমে নবুওয়াতের উদ্যোগে ব্রিটেনের ম্যানচেস্টার, লিভারপুল, সারে, বার্মিংহাম, ব্রিস্টল, গ্লাসগো ও লন্ডনে প্রতি বছর খতমে নবুওয়াত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আরব বিশ্বের বিভিন্ন স্কলার ছাড়াও ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ওলামা মাশায়েখ এতে যোগদান করেন। সমসাময়িক ইউরোপীয় চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা, ইসলামী ধ্যান ধারণার বিকাশ, ইসলামী সাহিত্য সৃষ্টি, ইসলামী আন্দোলনে গণমানুষকে সম্পৃক্তকরণের লক্ষ্যে ব্রিটেনে মুসলমানরা নানাধর্মী সেবা ও শিক্ষা সংস্থা গড়ে তুলেছেন। এসব সংস্থা বৈরী পরিবেশে দ্বীনের পক্ষে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে আসছে। এ ক্ষেত্রে দি মুসলিম ইনস্টিটিউট, দি মুসলিম এডুকেশন ট্রাস্ট, দি কুরআন একাডেমি, দি ইসলামিক একাডেমি অব ম্যানচেস্টার, ইউনিয়ন অব মুসলিম অর্গানাইজেশন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। অনেক স্কলার বিশেষত আল্লামা ড. খালিদ মাহমুদ, ড. আবদুস সালাম আজাদী, ড. আকরাম নদভি, অধ্যাপক মফিজুর রহমান, মাওলানা মাহফুয আহমদ বহু দিন ধরে শিক্ষা, গবেষণা ও দাওয়াতি কাজে মেহনত করে যাচ্ছেন। ড. খালিদ মাহমুদ সম্প্রতি ইন্তেকাল করেছেন। অক্সফোর্ড সেন্টার ফর ইসলামিক স্টাডিজের শিক্ষা ও গবেষণাবিষয়ক ভ‚মিকা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। মরহুম সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভি এর সাথে যুক্ত ছিলেন। প্রিন্স অব ওয়েলস (চার্লস) এ সম্পর্কে মন্তব্য করেন,
“The Oxford Centre for Islamic Studies has done so much to promote and improve our understanding of the Islamic world. That mission has great importance in our increasingly interdependent world. The relationships between Islam and the West matter more today than ever before.”

যুক্তরাজ্যের মার্কফিল্ড পল্লীতে অবস্থিত ইসলামিক ফাউন্ডেশন ইউরোপের অন্যতম বৃহত্তর ইসলামী শিক্ষা ও গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দু’জন ইসলামী চিন্তাবিদ প্রফেসর খুরশিদ আহমাদ ও ড. মানাযির আহসান যথাক্রমে ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও মহাপরিচালক হিসাবে কর্মরত ছিলেন। ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে সৃষ্টিশীল উৎকর্ষের কেন্দ্ররূপে ফাউন্ডেশনকে গড়ে তোলাই হচ্ছে উদ্যোক্তাদের দৃষ্টিভঙ্গি। ইসলামিক ফাউন্ডেশন মূলত শিক্ষা, গবেষণা, প্রকাশনা, প্রশিক্ষণ তথা আন্তঃধর্ম ও আন্তঃসাংস্কৃতিক সংলাপের কেন্দ্র। ইসলাম সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণা, মুসলিম ও অপরাপর ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে বিদ্যমান সহমর্মিতামূলক সম্পর্ক দৃঢ়করণ, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি এবং মুসলিম জনগোষ্ঠী তথা বিশ্ব মানবতার জন্য একটি সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ সৃষ্টিতে অবদান রাখাই হচ্ছে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অন্যতম লক্ষ্য। ফাউন্ডেশনের রয়েছে ইসলাম ও বিশ্বের প্রধান প্রধান ধর্ম ও সংস্কৃতি নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ের দুর্লভ গ্রন্থ, সাময়িকী ও দলিল দস্তাবেজ সমৃদ্ধ এক বিশাল পাঠাগার। আরবি, উর্দু ও ইংরেজি ভাষায় রচিত, পাঠাগারে গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। ফাউন্ডেশন এরই মধ্যে বিশ্বের বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সাথে অ্যাকাডেমিক সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। এর মধ্যে খড়ঁমযনড়ৎড়ঁময বিশ্ববিদ্যালয়, জেদ্দাকেন্দ্রিক ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় এবং মরক্কোর ইসলামী শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ওঝঊঝঈঙ) অন্যতম। এ পর্যন্ত ফাউন্ডেশন কুরআন, হাদিস, সিরাত, রাজনীতি, অর্থনীতি, আইন, ব্যবহার শাস্ত্র, দাওয়াত, ইসলামী আন্দোলন, হস্তনির্মিত ইসলামী শিল্পকর্ম, নারী অধিকার, ইউরোপীয় ও ব্রিটিশ মুসলমানদের আত্মপরিচিতি ও খ্রিষ্টান-মুসলিম সম্পর্ক বিষয়ে ইংরেজি ভাষায় চার শতাধিক গ্রন্থ প্রকাশ করে।

গ্রেট ব্রিটেনের ৩৩ লাখ মুসলমান ব্রিটিশ সমাজের মূল স্রোতধারায় গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ভ‚মিকা পালন করে আসছেন। ব্রিটিশ জনসংখ্যার ক্ষুদ্রাংশ হিসেবে এ সম্প্রদায়ের হিসাব-নিকাশে অনেক সুবিধা-অসুবিধা এবং প্রচুর সফলতা ও বিফলতা জমা রয়েছে। সম্পূর্ণ বৈরী পরিবেশে ও উন্নত বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির কেন্দ্রভ‚মি ব্রিটেনে বসবাসকারী মুসলমানরা নিজেদের ঈমান, আকিদা, তাহজীব, তামাদ্দুন ও উত্তরাধিকার ঐতিহ্য সংরক্ষণ করে বিভিন্ন পেশা, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি ও শিক্ষাধারায় প্রশংসনীয় অবদান রেখে চলেছেন। সমসাময়িক বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় তাদের নিরন্তর সংগ্রাম ইউরোপ ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের সংখ্যালঘু মুসলমানদেরকে আত্মনির্ভশীলতার প্রেরণা ও উৎসাহ জোগাচ্ছে।

খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের পর ব্রিটেনে মুসলমানরাই হচ্ছে দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় সম্প্রদায়। সাধারণত বঞ্চনা ও দরিদ্রতার পক্ষে নিমজ্জিত হওয়া সত্তে¡ও মুসলমানরা অনেকেই সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। ব্রিটেনের বিভিন্ন স্থানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলিম ডাক্তার, ব্যারিস্টার, ইঞ্জিয়ার, ট্রাইবুনাল জজ, মেয়র, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি কর্মরত রয়েছেন। একসময় ব্রিটেনে ১৬০ জন মুসলিম কাউন্সিলর ছিলেন, কমন্সসভায় একজন ও লর্ডস সভায় দু’জন মুসলিম সদস্য ছিলেন। পিটারবার্গ, ব্ল্যাকবার্ন, শেফিল্ড, ব্র্যাডফোর্ড শহরে লর্ড মেয়র ছিলেন মুসলমান এবং নিউহ্যাম ও লুটন শহরে ছিলেন মুসলিম মেয়র। পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশ থেকে আগত অস্থায়ী মুসলমান সদস্য টেলিভিশন, সংবাদ মাধ্যম, শিল্পকলা ও পাইকারি ব্যবসার অঙ্গনে ঢুকে পড়ছেন। কিছু দিন আগেও ব্রিটেনে দু’জন মুসলমান জজ কর্মরত ছিলেন যারা রাজনৈতিক আশ্রয় ও ইমিগ্রেশন বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করতেন। হাইকোর্টেও একজন মুসলিম বিচারপতি কর্মরত ছিলেন।

বিভিন্ন পেশায় বিশেষত শিল্প ও ব্যবসায় মুসলমানদের সংখ্যার হার সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যানের অভাবে বলা না গেলেও এটি বাস্তব সত্য যে, ব্রিটিশ অর্থনীতির উন্নয়নে শিল্পপতি, বৃহত্তর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক, এমনকি দোকানদার হিসেবে মুসলিম সম্প্রদায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন। একসময় ব্রিটেনে স্যার আনোয়ার পারভেজের মতো অনেক শিল্পপতি ছিলেন যাদের প্রত্যেকের বার্ষিক লেনদেনের পরিমাণ ৭০০ মিলিয়ন পাউন্ড বা তার চেয়েও বেশি। মুহাম্মদ বিন ঈসা আল জাবের ও তার পরিবারের ব্যবসায়িক সম্পদের পরিমাণ ৫,৯৩৫ মিলিয়ন পাউন্ড। সামী আহমদ, নূন প্রোডাক্টসের নূন ও লর্ড নাজির আহমদ সফল ব্যবসায়ী হিসেবে ব্রিটেনের বুকে নিজেদের আসন গড়ে নিয়েছিলেন। লর্ড নাজির আহমদ হালাল ওয়ার্ল্ড পিএলসি নামে হালাল খাদ্যসামগ্রীর একটি বড় ধরনের ব্যবসা চালু করেন, যাতে মুসলমানরা শূকরের পরিবর্তে শরিয়ত মতে জবাই করা মুরগি, গরু, ছাগল ও মহিষের গোশত কিনতে পারেন। তিনি তার প্রকল্পে ৫০০ লোক নিয়োগের ব্যবস্থা চূড়ান্ত করেন এবং স্টক একচেঞ্জের মাধ্যমে বাজারে শেয়ার ছেড়ে ৩০ লাখ পাউন্ডের ফান্ড গড়ে তোলেন। ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরাঞ্চলে হালাল সামগ্রীর দোকান গড়ে উঠছে। এভাবে হালাল সামগ্রীর ব্যবসার মাধ্যমে হালাল জীবিকা অর্জনের একটি সুষ্ঠু পরিবেশ ক্রমেই জনপ্রিয় হচ্ছে। অনুরূপভাবে ট্যাক্সি চালনা, রেস্টুরেন্ট পরিচালনা, দোকানদারি ও ছোটখাটো ব্যবসায় মুসলমানরা অর্থনৈতিক পুঁজি এবং শারীরিক শ্রম বিনিয়োগ করছে। এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে ব্রিটেনে শিক্ষা, সংস্কৃতি, প্রকাশনা, দাওয়াত, অর্থনীতির ক্ষেত্রে মুসলমানরা অচিরেই প্রাধান্য বিস্তারকারী শক্তি হিসেবে আবিভর্‚ত হবে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক
drkhalid09@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement