ধানক্ষেতে বুনো হাতির পাল
- ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন
- ০৯ জানুয়ারি ২০২২, ২০:০৫
নানা কারণে বাংলাদেশে বন্য হাতির সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ ও আশু বাস্তবায়নের মাধ্যমে হাতি প্রতিপালন ও সংরক্ষণে কালক্ষেপণ করলে বন্য হাতি বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এশিয়ান বুনো হাতি আছে এমন দেশের সংখ্যা মাত্র ১৩টি। বাংলাদেশে বৃহত্তর চট্টগ্রাম, সিলেট বিভাগ ও গারো পাহাড়সংলগ্ন শেরপুরে হাতির এই বিরল প্রজাতির আবাসস্থল। কিন্তু ওই সব জঙ্গল ও বন বাদাড়ে পর্যাপ্ত খাবার না থাকায় হাতির পাল লোকালয়ে হানা দেয় প্রতিনিয়ত। একটি পূর্ণবয়স্ক হাতি দৈনিক ৪৫০ কেজি লতাপাতা, বাকল ও গাছ খায়। বিস্তীর্ণ অঞ্চলে চা-বাগান, নির্দিষ্ট বৃক্ষের বনায়ন, বেসরকারি টিম্বার গার্ডেন ও ফলের বাগান সৃষ্টি হওয়ায় কলাগাছসহ হাতির উপযোগী লতাগুল্মের খাবারের অভাব দেখা দিয়েছে। ফলে লোকালয়ের বিপুল ফসল, আম, কাঁঠাল, ধান, তরমুজ ও পেঁপে হাতির পেটে চলে যায়। প্রায় সময় হাতির পাল বসতবাটিতে তাণ্ডব চালায় এবং মানুষকে আছড়িয়ে হত্যা করে। শত শত হেক্টর ধানিজমি বছরের পর বছর ধরে অনাবাদি পড়ে আছে। বিপুলসংখ্যক কৃষকের মাথায় এখন হাত। জনগণ বাধ্য হয়ে হাতির ‘আগ্রাসন’ রোধে সঙ্ঘবদ্ধ হচ্ছে। খাবারের সাথে বিষ প্রয়োগ করে এবং জেনারেটরের মাধ্যমে বৈদ্যুতিক ফাঁদ বানিয়ে হাতি নিধন করা হচ্ছে। রাতেই গর্ত খুঁড়ে খাবারের খোঁজে আগত অতিথি হাতিকে সমাহিত করা হয়। সমাধির ওপর রোপণ করে দেয়া হয় নতুন চারাগাছ অথবা লতাপাতা ও আগাছা দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়।
শেরপুরের গারো পাহাড় থেকে নেমে আসা হাতির পালের আক্রমণে শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতি ও নালিতাবাড়ী উপজেলায় এরই মধ্যে অর্ধশতাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। জনগণের প্রতিরোধের মুখে একটি হাতি মারা পড়ে। এতে বন বিভাগ কৃষকদের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেয়। গত বছর চট্টগ্রামের কাপ্তাইর ব্যস্ত সড়কে বন্য হাতির পায়ের তলায় পিষ্ট হয় দু’জন মারা গেছেন। তারা হলেন মুহাম্মদ তাওহিদ নামে একজন নৌবাহিনী সদস্য ও অভিষেক পাল নামের রাজধানীর তেজগাঁও টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী। বিগত দুই বছরে হাতির আক্রমণে কাপ্তাইয়ে ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে (সমকাল, ১১ মার্চ, ২০২১)। চট্টগ্রাম-কাপ্তাইয়ের ব্যস্ত সড়কে দিনের বেলা দলে দলে হাতি বিচরণ করে। আনোয়ারা থানার কর্ণফুলীর কোরিয়ান ইপিজেডের আশপাশের এলাকাজুড়ে হাতির উৎপাত বৃদ্ধি পেয়েছে। ইপিজেড এলাকায় ১৩টি শিল্পকারখানার ২৩ হাজারেরও বেশি শ্রমিক কাজ করেন। বান্দরবান থেকে নেমে আসা হাতি দলে দলে চকরিয়া থানার ফাঁসিয়াখালী, লোহাগাড়া থানার চুনতি ও সাতকানিয়া থানার মাদার্শা এলাকায় তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। হাতির তাণ্ডবে হাজার হাজার একর ফসলি জমিতে চাষ করা যাচ্ছে না। কৃষকরা প্রাণ হারাচ্ছেন হাতির পায়ের তলায়। লোকালয়, ক্ষেত বা সড়ক থেকে হাতি তাড়ানোর উদ্যোগ বা জনবল কোনোটাই বন বিভাগের নেই।
বাংলাদেশের আইনে হাতি নিধন নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু প্রয়োজন তো আইন মানে না। ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের ৩৬ (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘লাইসেন্স গ্রহণ না করিয়া কোনো বাঘ বা হাতি হত্যা করিলে তিনি অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন ও উক্তরূপ অপরাধের জন্য জামিন অযোগ্য হইবেন এবং তিনি সর্বনিম্ন দুই বছর এবং সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং সর্বনিম্ন এক লাখ এবং সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন এবং একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটাইলে সর্বোচ্চ ১২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন। তবে শর্ত থাকে যে, বাঘ বা হাতি কর্তৃক কোনো ব্যক্তি আক্রান্ত হইলে এবং উহার ফলে তাহার জীবনাশঙ্কার সৃষ্টি হইলে জীবন রক্ষার্থে উক্ত আক্রমণকারী বাঘ বা হাতিকে হত্যার ক্ষেত্রে এই ধারার বিধান প্রযোজ্য হইবে না।’
বিবিসি জানায়, বন্যপ্রাণীবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা-আইইউসিএনের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে এশীয় প্রজাতির পূর্ণাঙ্গ বয়সী হাতির সংখ্যা ২৫০টির কম। এ জন্য এ প্রাণীটিকে বাংলাদেশে ‘মহা-বিপন্ন’ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মোস্তাফা ফিরোজ আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এমনটি চলতে থাকলে মহা-বিপন্ন এ প্রাণীটি বাংলাদেশ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। এ ধরনের বড় স্তন্যপায়ী প্রাণীর নতুন পপুলেশন গ্রোথ কম; মানে একটা মা হাতি কয়েক বছর পরপর বাচ্চা জন্ম দেয়। সে হিসাবে শেরপুরের হাতির গ্রোথ ভালো হলেও যেভাবে হাতি মারা হচ্ছে, তাতে এই প্রজাতির টিকে থাকা নিয়েই প্রশ্ন উঠবে।
বন বিভাগের তথ্যমতে, ২০০৪ সাল থেকে গত ১৭ বছরে মানুষের হাতে হত্যার শিকার হয়েছে ১১৮টি হাতি। ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল- এই ছয় বছরে দেশে মোট ৬৯টি হাতির মৃত্যু হয়েছে। তবে দেশের প্রাণী বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, গত দুই বছরেই ৩৮টি হাতি মারা গেছে। এর মধ্যে ২০২০ সালে ২২টি ও ২০২১ সালের সাড়ে ১০ মাসে ১৬টি। এর মধ্যে বেশির ভাগই খাবারের খোঁজে পাহাড় থেকে নেমে মানুষের হাতে হত্যার শিকার হয়েছে। হাতির সংখ্যা নিরূপণের প্রথম তথ্য পাওয়া যায় ১৯৮০ সালে। ড. রেজা খানের জরিপ অনুযায়ী, দেশে হাতি ছিল ৩৮০টি। আবার ২০০০ সালে ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ডের গবেষণা অনুযায়ী হাতি ছিল ২৩৯টি। ২০০৪ সালে আইইউসিএনের জরিপ অনুযায়ী হাতির সংখ্যা ছিল ২২৭টি। চট্টগ্রাম বিভাগীয় বন কর্মকর্তা সূত্রে জানা যায় যে, ‘২০১৬ সালের জরিপ অনুযায়ী, দেশে আবাসিক হাতি আছে ২৬৮টি। এর বাইরে পাশের দেশ থেকে আরো কয়েকটি হাতি আসে, আবার ফিরেও যায়। এসব হাতিসহ ৩২০-৩৩০টি হাতি আছে দেশে। এখন হত্যাযজ্ঞের কারণে হাতির সংখ্যা দ্রæত কমছে’ (দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ১৮ নভেম্বর ২০২১)।
সেইভ দ্য নেচারের সভাপতি বলেন, ‘রোহিঙ্গারা বর্তমানে যেখানে বসতি করছে সেটি পুরোটাই হাতির বিচরণক্ষেত্র ছিল পাঁচ বছর আগেও। এশিয়ান হাতি মিয়ানমার থেকে এ রুটেই টেকনাফ হয়ে বাংলাদেশের বনে আসা-যাওয়া করে। সেই রাস্তায় রোহিঙ্গা ক্যাম্প হওয়ায় হাতিগুলো দেশের ভেতর একপ্রকার কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। আর যেগুলো পারাপারের চেষ্টা করেছে বা অন্যত্র সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে সেগুলোই মানুষের হামলায় মারা পড়ছে’ (দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ১৮ নভেম্বর ২০২১)।
বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ির গহিন জঙ্গলে হাতি নেই বললে চলে। এর কারণ রহস্যে ঘেরা। চোরাকারবারিরা দাঁতের জন্য হাতি মেরে ফেলতে পারে। অথবা পাহাড়ি জনগোষ্ঠী জুমচাষের ক্ষতি করায় হাতি নির্বংশ করতে পারে। বিশ্ববাজারে হাতির দাঁতের চাহিদা ব্যাপক। কালোবাজারে এক কেজি দাঁতের দাম এক হাজার ডলার। আর গণ্ডারের শিংয়ের দাম আরো অনেক বেশি। কেজিতে ৬০ হাজার ডলার এক কেজি সোনা বা কোকেনের দামের চেয়েও যা বেশি। চোরাচালান হওয়া হাতির দাঁতের শেষ ঠিকানা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এশিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীন (প্রথম আলো, ১ মে ২০১৬)। হাতির দাঁত দিয়ে গলার মালা, লকেট, আংটি, চুড়ি, চিরুনি, দাবার ঘুঁটি, চামচসহ অনেক কিছু তৈরি করা হয়। বিভিন্ন ধরনের শোপিস, মূর্তি, মুকুট, তলোয়ার বা চাকুর খাপ তৈরি ও আসবাবপত্রের নকশা করা হয় হাতির দাঁত দিয়ে। হাতির দাঁত সহজলভ্য না হওয়ায় এসব সামগ্রীর দাম অনেক বেশি হয়ে থাকে; যে কারণে শৌখিন ধনীরা সাধারণত এসব পণ্য ব্যবহার করেন। একটি হাতির দাঁত থেকে যে পরিমাণ পণ্য তৈরি হয়, তার দাম কয়েক কোটি টাকা পর্যন্ত হতে পারে। হাতি শিকার নিষিদ্ধ হওয়ায় এর দাম ক্রমেই আরো বাড়ছে। চীনের রাষ্ট্রীয় মাধ্যম বলছে, হাতির দাঁতের দাম এরই মধ্যে ৬৫ শতাংশ কমে গেছে। আগে চীনে ঢোকার সময় হাতির দাঁত বা তার তৈরি সামগ্রী যত ধরা পড়ত- তার পরিমাণও কমে গেছে ৮০ শতাংশ। হাতির দাঁতের জিনিস তৈরির ৬৭টি কারখানা এবং দোকান বন্ধ হয়ে গেছে আগেই, আরো ১০৫টি কিছু দিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা। তবে একটি উদ্বেগের বিষয় এখনো আছে। তা হলো চীনের এই নতুন আইনের আওতায় হংকং পড়বে না। হংকং হচ্ছে হাতির দাঁতের ব্যবসার একটি বড় কেন্দ্র এবং এর ক্রেতাদের বেশির ভাগই চীনের মূলভ‚মির বাসিন্দা বলে মনে করা হয়। এ ছাড়া ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, মিয়ানমার, লাওস প্রভৃতি দেশে রয়েছে হাতির দাঁতের বাজার। এসব দেশে প্রকাশ্যেই চলছে বেচাকেনা। এর পরিণতিতে প্রাণ দিতে হচ্ছে নিরীহ হাতিগুলোকে (বিবিসি, ২ জানুয়ারি ২০১৮)।
পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাসকারী দরিদ্র কৃষকদের তো লাইসেন্সধারী অস্ত্র থাকে না। কোনোক্রমেই মানুষের চেয়ে হাতির মূল্য বেশি হতে পারে না। মানুষ তার জীবন, জীবিকা ও সম্পদের নিরাপত্তা লাভের অধিকার সংরক্ষণ করেন। হাতি-মানুষের দ্ব›দ্ব নিরসনে নতুন আইন ও বাস্তবভিত্তিক প্রকল্প প্রণয়ন আশু প্রয়োজন। থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, বতসোয়ানা, জাম্বিয়া, নামিবিয়া, কেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ যেসব দেশে অধিকসংখ্যক হাতি সংরক্ষণের ব্যবস্থা বেশ শক্তিশালী, এ জন্য সেসব দেশ থেকে প্রযুক্তিগত সহায়তা নেয়া যেতে পারে। থাইল্যান্ড আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে হাতির গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
হাতির জন্য লোকালয়ের রাস্তাঘাটে অবাধে চলাচল ও ফসল নষ্ট করার সুযোগ অবারিত রাখলে মানুষের হাতে হাতির অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়া স্বাভাবিক। হাতির কারণে মানুষের বাড়িঘর ও জীবন-জীবিকা বিপন্ন হতে দেয়া যায় না। বন বিভাগের উদ্যোগে হাতির জন্য গহিন জঙ্গলে নিরাপদ জোন তৈরি করতে হবে। হাতির খাবার জোগান দিতে হবে। হাতির খাবারের উপযোগী কলাগাছ ও লতাগুল্মের বাগান সৃষ্টি করতে হবে। লোকালয়ে হাতির পাল নেমে এলে তাড়ানোর ব্যবস্থা রাখতে হবে। হাতির আক্রমণে কোনো মানুষ মারা গেলে বা হাতি ফসলের ক্ষতি করলে কোনো বিড়ম্বনা ও আমলতান্ত্রিক জটিলতা ছাড়াই পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। শ্রীলঙ্কায় বেশ কয়েকটি ‘এলিফ্যান্ট অরফ্যানেজ’ রয়েছে। ওখানে খাবার সরবরাহ করা হয় এবং নির্ধারিত সময়ে হাতি পুকুরে গোসল করতে আসে। অসুস্থ হাতির চিকিৎসারও ব্যবস্থা রয়েছে। এসব কাজ আঞ্জাম দেয়ার জন্য বন বিভাগ কর্তৃক মাহুত নিয়োগ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ওই সব দেশ থেকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নিতে পারে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও গবেষক
drkhalid09@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা