৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


সেনা-অভ্যুত্থান উত্তর সুদান কোন পথে?

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী আবদাল্লাহ হামদোক ও জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ বুরহান - ছবি : সংগৃহীত

সুদানে অন্তর্বর্তীকালীন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্ব গ্রহণের পর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জে পড়েছেন জান্তা নেতা জেনারেল আবদুল ফাত্তাহ বুরহান। অভ্যুত্থানের প্রতিবাদী বিক্ষুব্ধ রাজনৈতিক শক্তি সারা দেশে গণবিস্ফোরণের ডাক দিয়েছে। এর অংশ হিসেবে গত শনিবারের বিক্ষোভে ব্যাপক রক্তক্ষয় ঘটেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কায় জেনারেল বুরহান ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী আবদাল্লাহ হামদোকের সাথে একটি বোঝাপড়ায় আসার চেষ্টা করতে পারেন বলেও আভাস পাওয়া যাচ্ছে। এর অংশ হিসেবে পুরনো কাঠামো ফিরিয়ে না এনে পদচ্যুত প্রধানমন্ত্রীকে স্বúদে বহাল করা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

তিন দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশিরকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে সৌদি-আমিরাত-ইসরাইল-মিসরের ইন্ধনে সেনা-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। সেনাবাহিনীর শীর্ষ নেতৃত্বের ইশারায় তখন সুদানের পেশাজীবীদের বৃহৎ সংগঠন এই বিক্ষোভের ডাক দেয়। বিক্ষোভের অজুহাতে জেনারেল বুরহান সুদানের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে মিসরের স্টাইলে রাষ্ট্র চালানোর প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু প্রেসিডেন্ট বশিরের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীরা আরেক দফা রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সামরিক-বেসামরিক অংশীদারিত্বমূলক অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে যার অধীনে ২০২৪ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ জন্য গৃহীত সাংবিধানিক সনদ অনুসারে আগামী বছর জুলাই মাসে সামরিক শাসনের ২১ মাসের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে সার্বভৌম কাউন্সিলের নেতৃত্ব গ্রহণের কথা বেসামরিক ব্যক্তিদের। তবে বুরহান তাদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি শেষ পর্যন্ত পরিত্যাগ করেছেন।

সামরিক নেতারা একটি অভ্যুত্থান মঞ্চস্থ করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবশ্য অভিপ্রায় গোপন রাখেননি। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে, তারা সার্বভৌম কাউন্সিলের বৈঠক ডাকা বন্ধ করে দেন। তাছাড়া, তারা মুহাম্মদ আল-ফাকি সুলেমানসহ বিশিষ্ট বেসামরিক নেতাদের হয়রানি করেছেন, যারা কাউন্সিলের নেতৃত্বে বুরহানের স্থলাভিষিক্ত হবেন বলে আশা করা হয়েছিল। কিন্তু এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা জেনারেলদের ক্ষমতা দখল বন্ধ করেনি।

জেনারেল বুরহানের মেয়াদ শেষ হয়ে আসার আগেই সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব গ্রহণের দাবি জানিয়ে খার্তুমের রাস্তায় বিক্ষোভ প্রদর্শনের আয়োজন করা হয়। ক্ষমতায় থাকা শীর্ষ জেনারেলরা মনে করেছিলেন, মিসরের প্রেসিডেন্ট মুরসির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়ে জেনারেল সিসির সর্বময় কর্তৃত্ব গ্রহণের মতো একটি ব্যবস্থা সুদানেও করা যাবে। কিন্তু এই ধারণা ভুল হতে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।

কে এই বুরহান-হেমেতি?
সুদানে সামরিক অভ্যুত্থানের কেন্দ্রে রয়েছেন সুদানী সশস্ত্রবাহিনীর প্রধান এবং সুদানের ট্রানজিশনাল সার্বভৌম কাউন্সিল প্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান। কিন্তু এর পটভূমিতে লুকিয়ে আছেন আরেকজন সামরিক ব্যক্তি, জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো, যিনি ব্যাপকভাবে ‘হেমেতি’ নামে পরিচিত। আধাসামরিক র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) প্রধান, হেমেতির সৈন্যরা রাস্তায় বেরিয়ে বেসামরিক মানুষকে হত্যা ও আহত করছে। কিন্তু লোকটিকে প্রকাশ্যে খুব কমই দেখা যায়, যার ফলে তার অবস্থান এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে নানা আলোচনা হয়ে থাকে। এখন জানা যাচ্ছে, গত শুক্রবার রাতে তিনি সুদানে জাতিসঙ্ঘের বিশেষ প্রতিনিধি ভলকার পার্থেসের সাথে সাক্ষাৎ করছিলেন, যিনি টুইট করেছেন যে, তিনি হেমেতিকে ‘৩০ অক্টোবর, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অনুমতি দিতে এবং যেকোনো সংঘর্ষ এড়াতে’ অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু সেটি বাস্তবে হয়নি।

জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান ছিলেন তিনজন সুদানি সামরিক ব্যক্তির একজন যিনি ওমর আল-বশির নিজেই এপ্রিল ২০১৯ সালে সুদানের অন্তর্বর্তীকালীন সামরিক কাউন্সিলের প্রধান মনোনীত হওয়ার পরপরই বিবিসিকে বলেছিলেন, ‘আমি তাকে বলেছিলাম সশস্ত্রবাহিনীর নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নিয়েছে- পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে এবং তার পদত্যাগ করা উচিত।’

১৯৬০ সালে খার্তুমের উত্তরের এক গ্রামের সুফি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন বুরহান। একটি সুদানি আর্মি কলেজে তিনি পড়াশোনা করেন। তারপর জর্দানে এবং কায়রোর মিসরীয় সামরিক অ্যাকাডেমিতে তিনি পড়াশোনা করেন, যেখানকার প্রাক্তন ছাত্র ছিলেন মিসরের রাষ্ট্রপতি জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি। বুরহান এবং সিসি দীর্ঘদিনের বন্ধু, যদিও সিসি যে ধরনের ইসলামী আন্দোলনকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন তার সাথে সুদানি জেনারেলের দীর্ঘদিন সম্পর্ক ছিল। আফ্রিকা কনফিডেন্সিয়ালের সম্পাদক প্যাট্রিক স্মিথের মতে, দুই সামরিক নেতা ‘গণতন্ত্র বন্ধ করার বৃহত্তর কল্যাণ’ দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে এক হয়েছেন।

সুদানের ডি ফ্যাক্টো বা প্রকৃত রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার পর বুরহানের প্রথম আন্তর্জাতিক সফর ছিল ২০১৯ সালের মে মাসে মিসরে। সেখান থেকে তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরব যান। তার কর্মজীবনের শুরুতে, বুরহান বেইজিংয়ে সুদানের প্রতিরক্ষা অ্যাটাশে হিসেবে সংক্ষিপ্ত দায়িত্ব পালন করেন, কিন্তু বশিরের অধীনে তার সামরিক কর্মজীবন দক্ষিণ সুদান, দারফুর এবং ইয়েমেনে। ইয়েমেনে ভাড়াটে সেনা জোটের নেতৃত্বে থেকে তিনি সৌদি আরবকে সহায়তা করেছিলেন। বুরহান রিয়াদকে ‘চিরন্তন মিত্র’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন আর আরব আমিরাতের সামরিক কমান্ডারদের সাথে তার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক রয়েছে।

সুদানি সেনা সরকারের প্রথম ও দ্বিতীয় ক্ষমতাধর জেনারেল বুরহান ও হেমেতি উভয়ই মিত্র এবং পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী। হেমেতি ট্রানজিশনাল মিলিটারি কাউন্সিলের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, কিন্তু তার পরিবার এবং আরএসএফ দারফুরের সোনার খনির নিয়ন্ত্রণ ও সেই সাথে ইইউ-সৌদি আরব এর পৃষ্ঠপোষকতা থেকে ব্যাপকভাবে লাভবান হয়।

বুরহান-হেমেতি সম্পর্কে প্যাট্রিক স্মিথ বলেন, ‘এই দুই ব্যক্তির মধ্যে সম্পর্ক বেশ কঠিন। কারণ অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে, হেমেতি বিদেশে একজন নেতা হিসেবে নিজেকে প্রদর্শন করেন এবং সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান ও আবুধাবির ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদের ঘনিষ্ঠ তিনি। সে তুলনায় বুরহানকে মিসরের ঘনিষ্ঠ বলে বেশি মনে করা হয়।’

হেমেতি শান্তভাবে কথা বলেন, পদ্ধতিগতভাবে বুরহানের চেয়ে তিনি আরো বেশি ক্যারিশম্যাটিক, বেশি কার্টুনিস্ট ব্যক্তিত্ব এবং আরএসএফ নেতা হিসেবে গণতন্ত্রে উত্তরণকে ঘিরে সৃষ্ট নৃশংসতা বিশেষত ২০১৯ সালের জুনে খার্তুমে ১২৮ জনেরও বেশি লোকের গণহত্যার সাথে তিনি বেশি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।

পেছনে কারা কতটা?
আমেরিকান সাময়িকী ‘ফরেন পলিসি’র এক প্রতিবেদন অনুসারে, ধনী আঞ্চলিক শক্তি, বিশেষ করে উপসাগরীয় রাজতন্ত্র, সুদানের সামরিক জান্তাকে কূটনৈতিক এবং আর্থিক সহায়তা ঢেলে দিয়েছে। এটি সুদানের জনগণের সুবিধার জন্য করা হয়নি বরং অর্থনৈতিক চাপ উপশম করার জন্য এবং গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে তার পরীক্ষা জয়ী করতে আর দেশটিকে তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কক্ষপথে টেনে আনার জন্য দেয়া হয়েছে। গত এক দশকে, অন্যান্য দেশে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার জন্য সৌদি ও আমিরাতের ধ্বংসাত্মক প্রভাবের অনেক উদাহরণ রয়েছে। ২০১৩ সালের মিসরে অভ্যুত্থানের মতো আরেক উদাহরণ সুদানে সৃষ্টি করা হয়।

সুদানের এই সপ্তাহের ঘটনাগুলো মধ্যপ্রাচ্যের অন্য কোথাও ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর সাথে আশ্চর্যজনকভাবে মিলে যায়। জেনারেলরা যখন বুঝতে পারেন, তারা এটি দমন করতে পারবেন না তখন একটি জনপ্রিয় বিপ্লবের তরঙ্গে সওয়ার হন। তারা তখন কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রপ্রধানকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং নিজেদেরকে ‘গণতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন’ হিসেবে উপস্থাপন করেন। এর পরের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে, তারা সঙ্কট জাগিয়ে তুলতে কঠোর পরিশ্রম করেন যা অন্তর্বর্তী রোডম্যাপের ব্যাপারে মোহভঙ্গের জন্ম দেয়। শেষ পর্যন্ত, বেসামরিক ব্যক্তিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরপ্রক্রিয়া ব্যর্থ হয়। মিসরে এই ঘটনা ঘটেছে। তার পুনরাবৃত্তির কাজ চলছে সুদানে।

গত জুলাই মাস থেকে সুদানে স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়নের সিদ্ধান্তের পর মূল্যস্ফীতি বিশ্বের সর্বোচ্চ হারের একটিতে লাফিয়ে গিয়ে ৪০০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। গুরুতর অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে বেসামরিক নেতাদের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছে আর স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধি পুনরুদ্ধারের আড়ালে সামরিক বাহিনীর পক্ষে ক্ষমতা কেড়ে নেয়া সহজ হয়েছে। সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের উদার আর্থিক সহায়তা এটাকে সমর্থন করেছে।

বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরপরই, এপ্রিল ২০১৯ সালে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সামরিক শাসনের জন্য তিন বিলিয়ন ডলার ঋণ এবং সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয়। এই অঙ্গীকারটি দেয়া হয়েছিল অন্তর্বর্তী সামরিক বেসামরিকদের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে রাজি হওয়ার আগে। ক্ষমতা ভাগাভাগির পর সেটি আর বাস্তবে রূপ পায়নি। আগামী সপ্তাহগুলোতে, অভ্যুত্থান জয়ী হলে এই সাহায্য আবার প্রবাহিত হতে পারে বলে উল্লেখ করা হচ্ছে।

ব্যাপক আঞ্চলিক সমর্থন আর সেই সাথে অভ্যন্তরীণ সমর্থনের অভাবে সুদানে অভ্যুত্থান এখনো নাজুক অবস্থায় রয়েছে। বিদেশে বেশ কয়েকজন সুদানি রাষ্ট্রদূত ইতোমধ্যেই এর নিন্দা করেছেন। মিসরে জেনারেলদের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তি ইসলামিস্ট হওয়ার কারণে বিশ্বরাজনীতির নিয়ন্ত্রকরা চোখ বন্ধ করে জান্তাকে সব নির্মমতা ও মানবাধিকার হরণের কর্মকাণ্ডে নীরবে সমর্থন দিয়ে যান। সুদানে বশির-বিরোধী যে রাজনৈতিক শক্তি তার বিকাশ ঘটে ভিন্নভাবে। এখানে এক সময়ের বামধারার পেশাজীবী সংগঠনগুলোকে ইসলামিক ভাবধারার প্রেসিডেন্ট বশিরের বিরুদ্ধে সংগঠিত করতে মূল ভূমিকা রেখেছে পাশ্চাত্য শক্তিবলয়। আর সেক্যুলারপন্থী হওয়া সুদানি পেশাজীবী ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়ে ক্ষমতার অংশীদার করেছে ইউরোপ আমেরিকা। বশিরের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের পর ট্রাম্প প্রশাসনের ইন্ধনে সামরিক বেসামরিক দু’পক্ষ একজোট হয়ে দেশটির অভ্যন্তরীণ জনমতের বিপক্ষে গিয়ে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার সিদ্ধান্ত নেয় ।
এখন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় বাইডেন প্রশাসন। বাইডেন প্রশাসনের নতুন হিসাব-নিকাশের কারণে সামরিক বাহিনীর সর্বময় কর্তৃত্ব গ্রহণকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা পুরোপুরি মেনে নেয়নি। সামরিক জান্তার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন সুদানের ৭০০ মিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তা স্থগিত ঘোষণা করেছে। প্রশ্ন হলো, এই অবস্থায় জেনারেল বুরহান কি পারবেন মিসর সৌদি আমিরাতের সমর্থনে সিসি মার্কা শাসন সুদানে চালু করতে?

ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের অ্যাজেন্ডা কার্যকর করলে তেল আবিবের জন্য বুরহানের কর্তৃত্ব গ্রহণে কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। বশিরের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের আগে বুরহান ও তার প্রধান সহযোগী জেনারেল হেমেতি ইসরাইলি গোয়েন্দাদের সাথে গোপন বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। সেখানেই ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার বিনিময়ে সেনা নেতৃত্বকে ক্ষমতা দখলে সমর্থন দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বলে জানা যায়। পরবর্তী বিক্ষোভ ও বশিরের ক্ষমতাচ্যুতির যে দৃশ্যপট মঞ্চায়িত হয় তার কাঠামো এই ধরনের গোপন বৈঠকগুলোতে নির্ধারণ হয়েছিল। এ জন্য আয়োজন করা বৈঠকে শুধু ইসরাইলি গোয়েন্দা কর্মকর্তারাই নন, সেই সাথে সৌদি-আমিরাত-মিসর ও কয়েকটি পশ্চিমা দেশের গোয়েন্দা কর্মকর্তারাও অংশ নেন।

টানাপড়েন কোথায়?
জেনারেল বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করতে এই বলয়ের মধ্যে ঐকমত্য থাকলেও সর্বশেষ অভ্যুত্থানে সবাই একমত বলে মনে হচ্ছে না। মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিকভাবে এবং বৈশ্বিকভাবে একনায়কতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সৌদি আমিরাত মিসর বা রাশিয়া-চীন একমত হলেও বাইডেন প্রশাসনের অ্যাজেন্ডা এর বিপরীতে। বাইডেন প্রশাসন আমেরিকার ঐতিহ্যগত মানবাধিকার ও উদার গণতন্ত্রের প্রতি সমর্থনকে যতটা সম্ভব অব্যাহত রাখতে চায়। এর অংশ হিসেবে যেসব রাজনৈতিক শক্তিকে যুক্তরাষ্ট্র দেশে দেশে সমর্থন দিয়ে এসেছে তাদের পেছনে দাঁড়াতে চাইছে আমেরিকান প্রশাসন। এর ধারাবাহিকতায় সুদানের বেসামরিক ব্যক্তিদের ক্ষমতার অংশ করে রাখার ব্যাপারে ওয়াশিংটন সিরিয়াস বলেই মনে হয়। এখন বুরহানের টিকে যাওয়াটা নির্ভর করবে সৌদি, মিসর, আমিরাত লবি কতটা বাইডেন প্রশাসন ও ইসরাইলি নেতৃত্বকে প্রভাবিত করতে পারে, তার ওপর। ইসরাইল অবশ্য জেনারেল বুরহানের পরিবর্তে তার সহযোগী জেনারেল হেমেতির ব্যাপারে বেশি আগ্রহী। তাকে ভেতর থেকে বশির-বিরোধী অভ্যুত্থানের অনুঘটক এবং ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পেছনে মূল ব্যক্তি মনে করা হয়।

সুদানের তিন দশকের শাসক ওমর আল বশির ইসলামিস্টদের একটি বড় অংশের সমর্থনপুষ্ট হয়ে সুদান শাসন করেছিলেন। তিনি একই সাথে সৌদি আরব ও তুরস্কের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা করেছিলেন। দক্ষিণ সুদানের স্বাধীনতার দাবি মেনে নেয়ার মতো কিছু ইস্যুতে তিনি পাশ্চাত্যের প্রবল চাপে নতি স্বীকার করেন। তবে তিনি ইসলামী শক্তিকে দমন করে ক্ষমতায় থাকার ব্যাপারে সৌদি-মিসর-আমিরাত-ইসরাইলের চাপে নত হননি। তার এই অবস্থান নিয়ে ক্ষমতায় থাকার জন্য যে সমর্থন তুরস্ক ও অন্য মিত্রদের কাছ থেকে প্রয়োজন ছিল সেটি পাননি তিনি। তুরস্ক নতুন সরকারের সাথেও কাজের সম্পর্ক বজায় রাখতে চেয়েছে বলে মনে হয়, যদিও উসমানী আমলের পরিত্যক্ত একটি বন্দর উন্নয়নের ব্যাপারে আগের সরকারের সাথে করা চুক্তি বুরহানের জান্তা সরকার শুরুতেই বাতিল করে দেয়।

নতুন বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে আদর্শবাদের চেয়ে নিজস্ব রাষ্ট্রিক স্বার্থ প্রাধান্য পাচ্ছে আর চীন-রাশিয়ার মধ্যে বৈশ্বিকভাবে কর্তৃত্ববাদী সরকারের পাশে দাঁড়ানোর একটি প্রবণতা দেখা যায়। মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরব-আমিরাত-মিসরও নিজ নিজ দেশে রাজতন্ত্র ও কর্তৃত্ববাদী শাসনকে বজায় রাখতে একই নীতি অনুসরণ করে থাকে।

কিন্তু বাইডেন প্রশাসন ও আমেরিকার প্রধান মিত্র যুক্তরাজ্য কর্তৃত্ববাদিতার রাস টেনে ধরতে কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখতে চায়। এ ব্যাপারে ইউরোপের কোনো কোনো রাষ্ট্রের সমর্থনও মাঝে মধ্যে পাওয়া যায়। অবশ্য কর্তৃত্ববাদিতার বিরোধিতার ব্যাপারে নিজস্ব স্বার্থকে বড় করে দেখার কারণে মিসরে সিসি বা সৌদি আরবের শাসকদের ব্যাপারে যতটা না বিরোধিতা করা হয় তার চেয়ে ন্যাটোমিত্র ও উদার গণতন্ত্র অনুসরণকারী তুরস্কের বিরোধিতা অনেক বেশি করছে আমেরিকান প্রশাসন।

সুদানের বাস্তবতা
সুদানের এখনকার বাস্তবতা হলো, সামরিক সরকারের বিরোধীরা এই সর্বশেষ অভ্যুত্থানের মুখে সম্ভবত চুপ থাকবে না। বশিরের পতনের আগে কয়েক মাস ধরে প্রতিবাদকারীরা গণতন্ত্রের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। আর মিসরের সেনাবাহিনীর মতো সুদানি সেনাবাহিনীর ততটা সামর্থ্য ও জনপ্রিয়তা নেই যাতে সামরিক জান্তা মিসরীয় রাজনীতির ওপর তার আধিপত্য ন্যায্য করার জন্য তার শক্তিকে ব্যবহার করতে পেরেছে। সুদানের জনগণের অভিজ্ঞতা হলো, অভ্যুত্থান গণতন্ত্র আনে না। সামরিক অভ্যুত্থানের প্রথম মুহূর্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে এলেও অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। বিরোধী বাহিনী দেশব্যাপী ধর্মঘটের ডাক দেয়, জুন ২০১৯ সালে যা বশিরকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরে সেনাবাহিনীকে বেসামরিক ব্যক্তিদের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে বাধ্য করে।

এই সময়ে অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে একটি জরুরি আন্তর্জাতিক শীর্ষ সম্মেলনসহ আরো কিছু উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে যা সুদানের ক্ষেত্রে একটি পার্থক্য তৈরি করতে পারে। আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোকে সুদানের রাজনীতিতে তাদের ক্ষতিকর সম্পৃক্ততা বন্ধ করতে বুরহানের আঞ্চলিক সমর্থক কায়রো, রিয়াদ এবং আবুধাবিতে স্পষ্ট বার্তা পাঠানো যেতে পারে। এই দেশগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে তাদের সম্পর্কের জন্য প্রচুর বিনিয়োগ করে। তারা এই অঞ্চলে কর্তৃত্ববাদিতাকে স্থিতিশীলতার ভিত্তি হিসেবে সমর্থন করার যুক্তি দেখায়। তারা বাইডেন প্রশাসনের সাথে একটি ক্ষীণ সম্পর্ক বজায় রাখে আর তারা মৌখিক সমালোচনার বাইরে সর্বশেষ অভ্যুত্থানের প্রতি আমেরিকার কার্যকর অবস্থান দেখার জন্য অপেক্ষা করছে।

সুদানের অভ্যুত্থানের পর আন্তর্জাতিক নিন্দা অনেক হয়েছে। তবে সমালোচনাকে ‘কংক্রিট’ দাবিতে রূপান্তরিত করা এবং নিষেধাজ্ঞার সাথে যুক্ত একটি জবাবদিহিতার সময়রেখা সুদানের সামরিক নেতাদের ক্ষমতা দখলের বিষয়ে পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করবে। সাহায্য কমানোর মার্কিন সিদ্ধান্ত একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ, তবে তা পর্যাপ্ত নয়। সুদানের প্রতিবিপ্লবকে সমর্থনকারী আরব সরকারগুলোর ওপরও ওয়াশিংটনকে চাপ দিতে হবে। এ ছাড়া একটি উদাহরণ অবশ্যই সামরিক নেতাদের জন্য তৈরি করা উচিত যারা আঞ্চলিক সমগোত্রীয়দের সাথে মিলে গত ১০ বছরে আরব অঞ্চলে নাগরিক আন্দোলন ধ্বংস করেছেন। অভ্যুত্থানের পিছনে থাকা বুরহান, হেমেতি এবং অন্য নেতাদের বিচার করার বিষয় নিয়েও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আলোচনা তাদের জন্য চাপ তৈরি করতে পারে ।

শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা সেক্যুলার বেসামরিক শক্তির সাথে ক্ষমতা ভাগ করে দেশ পরিচালনায় জান্তাকে হয়তো উৎসাহিত করতে পারে। এ ধরনের প্রশাসনকে দিয়ে সুদানি সমাজের গভীরে যে ইসলামী আদর্শ ও মূল্যবোধের প্রভাব রয়েছে, সেটিকে নমনীয় করতে পারবে বলে এ শক্তি মনে করতে পারে। সুদানে ইসলামিস্টদের বড় অংশ প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশিরকে সমর্থন করেছিল। সামরিক অভ্যুত্থানের পর এ শক্তিটি এক প্রকার কর্তৃত্বহারা অবস্থায় রয়েছে। তবে সুশাসন ফেরানো ও জনগণের অর্থনৈতিক দুর্দশা নিরসনে বর্তমান সরকার আশাবাদী হওয়ার মতো কিছুই করতে পারেনি। ফলে সাধারণ সুদানিদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ দানা বাঁধছে। আর একই সাথে মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি গণসমর্থনও বৃদ্ধির প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে পেশাজীবী রাজনৈতিক শক্তির চলমান আন্দোলনে ইসলামিস্টদের ভূমিকা কী হবে তা এখনো স্পষ্ট নয়। ড. হাসান তুরাবির দলের সাথে পেশাজীবীদের সম্পর্ক ও একাত্মতা আগেই ছিল। এখন মূল ধারার ইসলামিস্টরা এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত হলে জান্তা সরকার বেকায়দায় পড়বে। তবে আন্তর্জাতিক খেলোয়াড়রা সামরিক বাহিনীর সাথে সেক্যুলার রাজনৈতিক ও পেশাজীবী শক্তির মধ্যে মেলবন্ধনটিকে আবার জোড়া লাগিয়ে সামনে এগোতে চায় কি না সেটি একটি বড় বিবেচ্য হতে পারে।

mrkmmb@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
আইডিবি ২৮ দশমিক ৯ কোটি ডলারের ঋণ সহায়তা দিবে গাজায় সাহায্য সরবরাহ বাড়ানোর উপায় নিয়ে আলোচনায় ব্লিঙ্কেনের জর্ডান যাত্রা বৃষ্টি আইনে ভারতের কাছে বাংলাদেশের হার ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে রংপুরে শ্রম আদালতের মামলার কার্যক্রম হাইকোর্টে স্থগিত নোয়াখালীতে নজিরবিহীন লোডশেডিং ‘আইসিজের গ্রেফতারি থেকে বাঁচতে যুক্তরাষ্ট্রকে চাপ দিচ্ছে ইসরাইল’ ‘আনারসের পাতা থেকে সিল্কের জামদানি শাড়ি আশার আলো জাগাবে’ গাজীপুরে তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে বেঁকে গেছে রেললাইন, ঢালা হলো পানি সিলেটে বহুতল ভবন থেকে পড়ে সিসিক কর্মচারীর মৃত্যু ঢাকা সাব-এডিটরস কাউন্সিলের সভাপতি মুক্তাদির, সম্পাদক জাওহার ফিলিস্তিনে আহত ও বাস্তুহারাদের জন্য আর্থিক সহায়তা

সকল