২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শিক্ষাব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনা : একাল-সেকাল

- ফাইল ছবি

দুই শ’ বছর আগে এ দেশে শিক্ষা বলতে ছিল কিছু মাদরাসা ও পাঠশালা। ছিল অতি নগণ্য সংখ্যক হাই ইংলিশ স্কুল তথা হাই স্কুলও। আস্তে আস্তে ইংরেজদের আদলে গড়ে উঠতে লাগল আরো কিছু উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান- কলেজ, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ও। বিভিন্ন জমিদার, স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও শিক্ষানুরাগীদের উদ্যোগে ও আর্থিক সহায়তায়ই মূলত এগুলো চলত। যেমন চট্টগ্রামের কাজেম আলী হাই স্কুল, ডা: খাস্তগীর গার্লস স্কুল, ঢাকার জগন্নাথ কলেজ, সিলেটে এমসি (মুরারি চাঁদ) কলেজ, বরিশালে বিএম (ব্রজ মোহন) কলেজ, খুলনায় বিএল (ব্রজ লাল) কলেজ বা রংপুরে কারমাইকেল কলেজ এবং গ্রামগঞ্জে আরো অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবে বরাবরের মতো শিক্ষাব্যবস্থার প্রাণবায়ু ছিল পাঠশালাকেন্দ্রিক প্রাথমিক ও হাই স্কুলভিত্তিক মাধ্যমিক শিক্ষা। এসব বিদ্যালয় শিক্ষার শুরুর দিকে কিছু ধর্মীয় নৈতিকতা শিক্ষার সাথে ভাষা, গণিত, ভ‚গোল, জ্যোতির্বিদ্যা থাকলেও পরে মুসলিম শাসনামলে পারস্য ও মধ্য এশীয় শিক্ষাক্রমের প্রভাব পড়ে। ফলে ইতিহাস, স্বাস্থ্য, যুক্তিবিদ্যা ও বিজ্ঞানও যুক্ত হয়। আরো পরে এসে সিপাহি বিপ্লবের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি থেকে ব্রিটিশ সরকারের হাতে শাসনব্যবস্থা গেলে অন্যান্য সেক্টরের মতো শিক্ষাব্যবস্থাও ইংরেজ আদলে গড়ে উঠতে শুরু করে। শিক্ষাক্রম ইংরেজ আদলে হলেও বঙ্গীয় অঞ্চলে আমাদের এ দেশে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে মুখ্য ভ‚মিকা ছিল শিক্ষকদের। স্থানীয় ইতিহাস খোঁজ করে দেখা যায়, অজপাড়াগাঁয়েও কোনো কোনো স্থানে চমৎকার সব শিক্ষক বিশেষ করে প্রধান শিক্ষক ছিলেন। কী নিবেদিত প্রাণ ও পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন, যা আজ কল্পনাও করা যায় না। যেমন পঞ্চাশ-ষাটের দশকে চাঁদপুরের মতলব হাই স্কুলের হেডমাস্টার ওয়ালিউল্লাহ পাটোয়ারী যিনি প্রতি সন্ধ্যায় হারিকেন হাতে গেঁয়ো পথ ও উঠোন চষে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তার ছাত্ররা পড়ার টেবিলে আছে কি না দেখতেন। তার ফল হলো প্রায় বছরই ইস্ট পাকিস্তান শিক্ষা বোর্ডে মতলব হাই স্কুলের ছাত্রই হতো ফার্স্ট। তেমনি একজন কিংবদন্তি প্রথম স্থান অধিকার করা শিক্ষার্থী ছিলেন ড. আবদুল মতিন পাটোয়ারী যিনি বুয়েটের শিক্ষক ও পরবর্তীতে ভিসি হয়েছিলেন। আজকাল এসব কল্পনাও করা যায় না। তখনকার হাই স্কুল শিক্ষকদের অনেকেরই হয়তো উচ্চ ডিগ্রি ছিল না কিন্তু নিজস্ব ঢঙে প্রচণ্ড আন্তরিকতার সাথে কিভাবে নিজের ছাত্রছাত্রীদের ব্যক্তিগত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থেকে শুরু করে জ্ঞানদান পর্যন্ত সর্বাত্মক শিক্ষাই দিতেন, তা স্পষ্ট বোঝা যায় তাদের ছাত্রছাত্রীদের দেশী ও বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠা লাভ দেখে। পড়ার বাইরেও এসব শিক্ষক অনেক কিছুই শেখাতেন। যেমন আমাদের শিক্ষাজীবনে আমরা কোনো দিন শিক্ষকদের ক্লাসে অনুপস্থিত থাকতে দেখিনি। স্কুলজীবনে হাতে ঘড়ি পরা বা প্রদর্শন করা রীতিমতো আদবের বরখেলাপ ছিল। এমনকি শিক্ষককে রাস্তায় হাঁটতে দেখলে আমরা কাচুমাচু হয়ে রাস্তার পাশে বা কখনো নিচে নেমে হাঁটতাম। শৃঙ্খলা শেখার জন্য কাব, স্কাউট বা ক্যাডেট- এ তিনটির যে কোনো একটি করা আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল। মাথায় সর্বক্ষণ টুপি পরে থাকা এবং জোহরের নামাজ জামাতে আদায় করা থেকে কোনো মুসলিম ছাত্রের জন্য ছাড় ছিল না। কোচিং নামের কোনো বিষয় আমাদের জমানায় জানাই ছিল না। আর শিক্ষকদের ব্যক্তিগত চরিত্র তো ছিল স্বচ্ছতা ও নৈতিকতার মানদণ্ডে সর্বোচ্চ আদর্শের। আমার এখনো মনে আছে আমাদের এক শিক্ষক এক দিন স্কুলের এক ছাত্রের অভিভাবককে ডেকে বললেন, আপনি যে গতকাল দিনে দুপুরে রাস্তায় রিকশাওয়ালার কাছ থেকে টাকা নিলেন, এটি যদি আপনার ছেলের নজরে পড়ত তা হলে কী হতো? অর্থাৎ শুধু শ্রেণিকক্ষে শিক্ষাদানই নয়, সামগ্রিকভাবে সমাজ গঠনে শিক্ষকরাই ছিলেন আলোকবর্তিকা। তাই শিক্ষাদান পদ্ধতি স্বাভাবিক গতিতে সাবলীলভাবেই চলত।

শিক্ষাদান পদ্ধতি এমন সুন্দর স্বনিয়ন্ত্রিত থাকলেও শিক্ষাব্যবস্থার গঠনে প্রারম্ভে এ দেশের বেশ কয়েকজন মহান জ্ঞানতাপসের উদ্যোগ ও ভ‚মিকা ছিল যুগান্তকারী। যেমনি ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর শিক্ষা সমিতি গঠন করে শিক্ষাক্রম তৈরি ও পাঠ্যপুস্তক রচনার দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন, তেমনি তিনি একটি বিদ্যালয় পরিদর্শন কাঠামো তৈরি করে নিজে বিভিন্ন স্কুল পরিদর্শনে যেতেন পড়ালেখা কেমন হয়, কিভাবে হয় তা দেখতে। নিজের সময় ও শ্রম দিয়ে শিক্ষাবিস্তারে এমন বিরল মহতি উদ্যোগ আজকের প্রেক্ষাপটে কি ভাবা যায়?

সম্ভবত এসব উদ্যোগের আলোকেই ব্রিটিশ সরকার এ দেশের শিক্ষা প্রশাসনের সরকারি দাফতরিক কাঠামো গড়ে তোলে। তৃণমূল পর্যায় থেকে থানায় সাব ইন্সপেক্টর অব স্কুলস, মহকুমা স্কুল ইন্সপেক্টর (এসডিআই), জেলা স্কুল ইন্সপেক্টর (ডিআই), বিভাগীয় স্কুল ইন্সপেক্টর (এসআই) ও সর্বোচ্চ পদে জনশিক্ষা পরিচালক (ডিপিআই) পদ সৃষ্টি করা হয়েছিল। দেশ বিভাগের পর সর্বজন শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞানী-শিক্ষাবিদ ড. কুদরত-ই-খুদা পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম ডিপিআই হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এ দিকে কারিকুলাম-ভিত্তিক সুসংগঠিত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৫০ সালের দিকে যে কলকাতা বুক সোসাইটি গঠন করেছিলেন, তা পরবর্তীতে বঙ্গীয় বুক সোসাইটি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। দেশ বিভাগের পর এরই আদলে আমাদের দেশে প্রথমে ইস্ট পাকিস্তান স্কুল বুক সোসাইটি ও পরে ইস্ট পাকিস্তান স্কুল টেক্সট বুক বোর্ড গঠিত হয়। কালের পরিক্রমায় সেটিই আজ আমাদের জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

শিক্ষাব্যবস্থার আজকের যে ডালপালা ছড়ানো বিশাল মহীরুহ দেখা যায় তা দেশ বিভাগের পর ১৯৪৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত দিনে দিনে গড়ে উঠেছে। শুরুতেই জনশিক্ষা পরিচালকের অধিদফতরের তত্ত্বাবধানেই তৃণমূল পর্যায়ে মাদরাসা ও প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চ মাধ্যমিক (প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয়) স্তর পর্যন্ত শিক্ষা প্রশাসন চলত। প্রশাসন ছিল তৃণমূলে বিকেন্দ্রীকৃত। এক এক থানায় কর্মরত একজন সাব ইন্সপেক্টর অব স্কুলস থানার সব প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষকের নিয়োগ, বদলি ও বেতনভাতা প্রদানসহ সব প্রশাসনিক কাজই করতেন অত্যন্ত স্বাধীনভাবে কোনো রকম হস্তক্ষেপ ছাড়াই। তবে তাদের মূল কাজটি ছিল শিক্ষার গুণগতমান বজায় রাখার ভ‚মিকা পালন করা। এ জন্য তারা মাসের বেশির ভাগ সময়ই বিভিন্ন স্কুল পরিদর্শনে যেতেন, যা কখনো পূর্ব ঘোষিত থাকত আবার অনেক সময় অকস্মাৎ গিয়ে হাজির হতেন। এতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সাথে যে মিথস্ক্রিয়া হতো তা শিক্ষার গুণগত মান সংরক্ষণে বিরাট ভ‚মিকা রাখত। আমার বয়সী সবারই নিশ্চয় মনে থাকার কথা, গ্রামগঞ্জে যে দিন কোনো স্কুলে একজন স্কুল ইন্সপেক্টর পরিদর্শনে আসতেন, সেই দিন সে এলাকায় রীতিমতো একটি সাজ সাজ রব পড়ে যেত। উৎসবের আমেজ বিরাজ করত। স্কুল ও আশপাশের রাস্তাঘাট রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানো হতো। ইন্সপেক্টর সাহেবকে মানপত্র দেয়া হতো। এভাবে মহকুমা, জেলা ও বিভাগীয় স্কুল ইন্সপেক্টরদেরও পরিদর্শন ও তদারকি চলত বিভিন্ন প্রাথমিক ও হাই স্কুলগুলোতে। সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ বিভাগীয় দফতরের মাধ্যমে জনশিক্ষা পরিচালকের অধিদফতর থেকে করা হতো। ড. কুদরত-ই-খুদা, প্রফেসর শামসুল হক (সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ভিসি), ড. মমতাজ উদ্দিন চৌধুরী (ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভিসি) বা ড. আবু রুশ্দ মতিন উদ্দিনের (বব এর লেখক) মতো দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদরা জনশিক্ষা পরিচালকের দায়িত্বে থেকে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ভিত গড়ে দিয়ে গেছেন।
শিক্ষাব্যবস্থায় কী চমৎকার নজরদারি ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু একজন শিক্ষক এবং একসময়ের শিক্ষা প্রশাসনের সাথে জড়িত ব্যক্তি হিসেবে বেশ বেদনার সাথেই আমাকে বলতে হচ্ছে, সে আদর্শ অবস্থা আজ আর নেই। আসলে শিক্ষাব্যবস্থাপনার মূল দায়িত্ব দৃঢ় একক হাতে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর দু’টির ওপরই ন্যস্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু আজকাল পদায়ন, পদোন্নতি, বদলিসহ বিভিন্ন কাজ মন্ত্রণালয় থেকেই করা হয়। সব কাজের জন্যই মন্ত্রণালয়ে যেতে হয়। অধিদফতর অনেকটাই নিষ্প্রভ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ পরিস্থিতির পরিবর্তন হওয়া দরকার। যদি তাই হয় তবে আর অধিদফতর কেন? বাকি অন্য সব কাজ তো বিভাগীয় ও জেলাগুলোর দফতরেই সম্পাদন করা যেতে পারে। সুতরাং সুষ্ঠু ও নির্বিঘ্ন শিক্ষা ব্যবস্থাপনার স্বার্থে সামগ্রিক কাজকর্ম অধিদফতরে হলেই ভালো হয়। তা হলে দায় ও দায়িত্ব দুটোরই স্বচ্ছতা থাকবে। আর অধিদফতরের মহাপরিচালক হিসেবে আগের মতো সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রবীণ শিক্ষকদেরই নিয়োগ দেয়া উচিত। ছোট্ট এ দেশে প্রায় দুই লাখ প্রাথমিক স্কুল, ২৪ হাজার হাই স্কুল ও তিন হাজারের ওপর কলেজ থাকার পরও দেশের শিক্ষার গুণগতমান দিন দিন পড়ে যাচ্ছে। চরম অব্যবস্থাপনা, আন্তরিক উদ্যোগের অভাব, নৈতিক স্খলনজনিত কাজকর্ম ও দুর্নীতিই যে এসবের পেছনে মূল কারণ; সে বিষয়ে খুব বেশি দ্বিমত করার সুযোগ নেই। এ উপলক্ষে আমি ছোট্ট একটি উদাহরণ দেই। আশির দশকের শেষ দিকে শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক ছিলেন ড. এ এইচ এম করিম। পরে মন্ত্রণালয়ে অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদায়ও কাজ করেছিলেন। এতসব দায়িত্বে থাকার পরও অবসর গ্রহণের পর তিনি মিরপুরে হাউজিং সেটেলমেন্টের ৬২৫ বর্গফুটের ছোট্ট একটি ফ্ল্যাট কিনে তাতেই জীবনের শেষদিন পর্যন্ত কাটিয়েছেন। একই অবস্থা ছিল একসময়ের সাড়াজাগানো মহাপরিচালক ড. আবদুল্লাহ আল মূতী শরফুদ্দিনের। আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ‘বব’-এর লেখকখ্যাত প্রফেসর আবু রুশ্দ মতিন উদ্দিনের তো ঢাকায় নিজের কোনো বাড়িই ছিল না। তিনি যখন প্রিন্সিপালের দায়িত্বে ছিলেন তখনো নিয়মিত আমাদের ক্লাস নিতেন। আর চট্টগ্রাম কলেজের মতো বিশাল কলেজের এ অধ্যক্ষ মহোদয় বাসা থেকে কলেজে আসতেন হেঁটে ছাতা মাথায়। আমি হলফ করেই বলতে পারব আজ এসব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আসলে একজন নীতিবান, স্বচ্ছ ও দৃঢ়চেতা মহাপরিচালকের নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী অধিদফতর শিক্ষার মানোন্নয়নে যে ভ‚মিকা রাখতে পারে তা আর কিছুতেই সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে কাজ বিকেন্দ্রীকরণও জরুরি। সব কাজ মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরে হতে হবে এমন বোধহয় জরুরি নয়। যেহেতু এমপিওভুক্তির মাধ্যমে সরকারের অনুদানেই বেসরকারি স্কুল-কলেজগুলো চলে এবং এনটিআরসির মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে শিক্ষক নির্বাচন হয়; তাই স্বচ্ছতা ও কাজের গতি সৃষ্টির জন্য বোধহয় জেলার ভেতর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেও পারস্পরিক শিক্ষক-কর্মচারী বদলি করা প্রয়োজন। সেটি করতে পারেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাই। আবার সরকারি স্কুল-কলেজের বদলি-পদায়ন-পদোন্নতি অধিদফতর থেকেই হতে পারে। পাশাপাশি স্কুল-কলেজে পরিদর্শন প্রক্রিয়াটি নিয়মিত ও জোরালো করাও প্রয়োজন। এটি বিভাগীয় উপপরিচালকের দফতরের মাধ্যমেই চমৎকারভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। মাঠপর্যায়ে স্কুল পরিদর্শন যে কত জরুরি তার চাক্ষুস প্রমাণ আমি দিতে পারি। প্রথম জীবনে চল্লিশের দশক থেকে আমার বাবা ছিলেন একজন স্কুল পরিদর্শক। পঞ্চাশের দশকে একবার নোয়াখালীর এক প্রত্যন্ত পল্লী অঞ্চলের স্কুলে সারপ্রাইজ ভিজিটে গেলেন আমার বাবা। সাথে নিলেন আমাকে। নৌকায় তিন ঘণ্টা লাগল। গিয়ে দেখি স্কুলে ছেলেমেয়েরা হই চই করছে। শিক্ষক নেই। খবর পাঠিয়ে তার বাড়ি থেকে শিক্ষককে ডেকে আনতে হলো। আমার বাবা তাকে তীব্র ভাষায় ভর্ৎসনা করলেন। আবার আরেক দিন আরেক জায়গায় স্কুল পরিদর্শনে গিয়ে দেখলেন কিছু ছেলেমেয়ে মাঠে খেলছে, আবার কিছু ক্লাসে হই চই করছে। শিক্ষক নেই। ছেলেমেয়েদের কাছে জিজ্ঞেস করতেই দেখিয়ে দিলো ওই যে দূরে ক্ষেতে লাঙল চালাচ্ছেন, তিনিই শিক্ষক। এ দুই ক্ষেত্রেই আমার বাবা দ্রæততম সময়ে শিক্ষকদের শাস্তিমূলক আন্তঃজেলা বদলি করে দিলেন। সে সময় অপর জেলার শিক্ষা কর্মকর্তার সাথে কথা বলে এমন ধরনের বদলি করার ক্ষমতা শিক্ষা কর্মকর্তা বা স্কুল পরিদর্শকদের ছিল। আজকাল এ ক্ষমতা নেই। আমার বাবা ৩৪ বছরের চাকরিজীবনে থানা শিক্ষা কর্মকর্তা থেকে বিভাগীয় স্কুল পরিদর্শকের উচ্চ পদ পর্যন্ত উন্নীত হয়েছিলেন। তিনি গর্ব করে বলতেন জেলায় এমন কোনো স্কুল নেই, যা আমি পরিদর্শন করিনি। আজকাল কি এমন হয়? না, হয় না। আর হয় না বলেই নজরদারির অভাবে যে যার মতো করে চাকরি করছেন। চলছে বিশৃঙ্খলা। আমার জানা মতে একসময় নব্বইয়ের দশকে দূরান্তের চরাঞ্চলের একটি সরকারি কলেজে রসায়নের চারটি পদের সব ক’টি দীর্ঘ দিন ধরে শূন্য ছিল। পদায়ন করলে এসে যোগদান করেই চেষ্টা-তদবির করে চলে যান। তা হলে বিভাগ চলে কিভাবে? হ্যাঁ চলে। অর্থনীতির একজন শিক্ষক রসায়ন পড়ে নিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াতে ও কোচিং করাতে লাগলেন। এভাবে দীর্ঘ দিন চলল। কর্তৃপক্ষের কোনো খবর নেই। পদ খালি। কিভাবে শিক্ষক পদায়ন করে সেখানে রাখা যায়, তারও কোনো চেষ্টা নেই। দেশের বিভিন্ন জনপদে এভাবেই চলছে। আরো ভয়াবহ এক চিত্র আমাকে দারুণভাবে বেদনাহত করেছে। গত ২৭ ডিসেম্বরের দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত ব্র্যাক শিক্ষা কার্যক্রমের একজন গবেষকের এক গবেষণা রিপোর্টে দেখলাম দেশের ৬৪ জেলার ২৪টিতেই জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নেই; অর্থাৎ দেশের শতকরা ৪০ ভাগ অংশে মাধ্যমিক শিক্ষা চলছে অভিভাবকহীনভাবে। কোনো নজরদারি ছাড়াই। আরো সাংঘাতিক হলো মাউশির ৯টি রিজিওনাল অফিসের তিনটিতেই পরিচালক এমনকি উপপরিচালকও নেই। ব্র্যাকের গবেষক ভদ্রলোক আরো যে ভয়াবহ তথ্য জানালেন, তা হলো মাউশি থেকে বলা হয়েছে যে বর্তমানে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা পদে পদায়নের মতো উপযুক্ত কোনো শিক্ষক নেই; অর্থাৎ আরো বেশ কিছু দিন এ ভয়াবহ অবস্থা চলবে। সুতরাং বলাই যায় যে, জাতির মেরুদণ্ড যে শিক্ষা তারই তো মেরুদণ্ড ঠিক নেই। এসব ঠিক করার একমাত্র উপায় হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাব্যবস্থাপনার পদ-পদবিগুলো যথাযথভাবে পূরণ করা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়মিত পরিদর্শনের মাধ্যমে কঠোর নজরদারিতে আনার ব্যবস্থা করা।

পরিদর্শনের পাশাপাশি শিক্ষার উন্নয়নে আর একটি অত্যন্ত জরুরি পদক্ষেপ হলো শিক্ষক প্রশিক্ষণ। এ দুটো বিষয় কত জরুরি তা আজ থেকে প্রায় দুই শ’ বছর আগে এ দেশে প্রথম বুঝেছিলেন ঈশ^র চন্দ্র বিদ্যাসাগর। কে কী মনে করল সে দিকে না তাকিয়ে শিক্ষকদের নজরদারিতে আনতে তিনি নিজ উদ্যোগে নিজ ব্যয়ে গ্রামবাংলার স্কুলগুলো মাঝে মধ্যে পরিদর্শন করতে লাগলেন। তার এ উদ্যোগ দেখে ব্রিটিশ সরকার তাকে বঙ্গীয় স্কুল পরিদর্শক হিসেবে সরকারি দায়িত্ব দেয়। আবার যখন দেখলেন শিখন-শেখানো প্রণালী যথাযথ করতে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়ার প্রয়োজন; তখন নিজেই কলকাতায় আঠারোশ’ ষাটের দশকে শিক্ষক প্রশিক্ষণ একাডেমি প্রতিষ্ঠা করলেন, যা আজ ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর কলেজ নামে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সে পদাঙ্ক অনুসরণ করেই দেশ বিভাগের পর ১৯৪৭ সনে আমাদের দেশেও শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক ওসমান গণি ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। তারই ধারাবাহিকতায় আজ এ দেশেও ২৫টি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ এবং চারটি এইচএসটিটিআই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু এত কিছুর পরও শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন যেন কাক্সিক্ষত মানে পৌঁছাতে পারছে না। আসলে সবই আছে, কিন্তু কিছুই ঠিকঠাক মতো চলছে না। নীতিমালা প্রণয়ন ও সামগ্রিক নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রণালয়ের হাতে থাকলেও বাস্তবায়ন বিকেন্দ্রীকরণ করা দরকার। অধিদফতর, আঞ্চলিক উপপরিচালকের দফতর এমনকি জেলা পর্যায় পর্যন্ত দায়িত্ব বণ্টন করা যায়। অনেকেই বলে থাকেন, এতে দুর্নীতি তৃণমূল পর্যন্ত বিকেন্দ্রীভূত হয়ে যাবে। কথাটি মোটেই ঠিক নয়। দুর্নীতি যেমন হয় তেমনি একে নিয়ন্ত্রণও করা যায়। তার সাম্প্রতিক নজির হলো ইন্দোনেশিয়া, নাইজেরিয়া ও ফিলিপাইন। একসময়ের অতিদুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোতে এখন দুর্নীতি বেশ নিয়ন্ত্রণে। চেষ্টা করলেই পারা যায়। আমাদেরও তাই করতে হবে। প্রবল ইচ্ছাশক্তি আর উদ্যোগ সব কিছুকেই সম্ভব করে তুলতে পারে।
আসলে শিক্ষাব্যবস্থায় সেকালকেই আবার একালে ফিরিয়ে আনতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি নীতি-নৈতিকতা আর মূল্যবোধের কঠোর অনুশীলনেরও ব্যবস্থা করতে হবে। এর জন্য শিক্ষাব্যবস্থাপনায় কিছু ব্যতিক্রমী, দৃঢ়চেতা ও অনুকরণীয় উদ্যোগী ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব একান্ত জরুরি। জাতির প্রয়োজনে আউটসোর্সিং দ্বারা একটি শক্ত হাত খুঁজে আনতে হবে; যিনি বা যারা দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে তা সম্ভব করে তুলতে পারেন। আর এ জন্য আমাদের এ মুহূর্তে প্রয়োজন একজন ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের যিনি শিক্ষায় একটি সোনালি সূর্যের উদয়ের ব্যবস্থা করতে পারেন; যা আমাদের প্রিয় মাতৃভ‚মিকে আলোয় আলোয় ভরিয়ে দেবে।

লেখক : প্রফেসর রসায়ন বিভাগ ও সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, ঢাকা


আরো সংবাদ



premium cement