২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

যুদ্ধের খরচ জরুরি, হিউম্যান রাইটও

-

(গত সংখ্যার পর)
কলোনি যুগের আমেরিকা উদ্বৃত্ত সঞ্চিত সম্পদের জোরে বড় অর্থনীতি হিসেবে সবাইকে ছাড়িয়ে গেলেই তাকে দুনিয়ার ‘গ্লোবাল অর্থনীতিতে নেতা’ বলে সবাই মেনে নিয়েছিল। এককালে আমেরিকা নেতা হয়নি। তাকে প্রায় ৫০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল দুই দুটো বিশ্বযুদ্ধের জন্য। মূল কারণ দুনিয়া তখন কলোনি দখলের রামরাজত্বে ডুবেছিল, যার অবসান দরকার ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৮) ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে (১৯৩৯-৪৫) দুনিয়ার কলোনি দখলদার শক্তিগুলা যারা দুনিয়ার ওপর একচ্ছত্র খবরদারি চালিয়ে বেড়াত তারা যুদ্ধের মাঝপথে সবাই দেউলিয়া হয়ে গেছিল। ফলে নেতা হিটলার (সাথে মুসোলিনির ইতালি আর মার্শাল তেজো জাপানসহ অন্যরা) এক দিকে আর অন্য দিকে আমেরিকার নেতৃত্বে বাকিরা এভাবে এক পোলারাইজেশন ঘটতে পেরেছিল বলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার নেতৃত্বের অংশ জয়লাভ করেছিল।

এই যুদ্ধের আসল ফ্যাক্টর যে যুদ্ধের পোলারাইজেশন এবং তা এমন কেন হয়েছিল ও কিসের ভিত্তিতে; তা আমাদেরকে তখন পরিষ্কার জানতে দেয়া হয়নি। তবে দুটো শক্তি ঘটনা যেভাবে ব্যাখ্যা করে দিয়েছিল আমরা খাপছাড়াভাবে তাই জানতাম।

এরই একটা হলো, ইউরোপ যেন ব্রিটিশদের মতো ভালো মানুষদের নেতৃত্বে মানে প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের নেতৃত্বে খারাপ মানুষ হিটলার আর তার বন্ধুদের পরাজিত করেছিল। এই ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গল্প। এ ছাড়া ওদিকে আরেক ব্যাখ্যা চালু ছিল কমিউনিস্টদের। এটিও আরেক ভালভালাইয়া; মানে চার দিকে সব খালি ভালো আর ভালো। ভালো মানুষ সোভিয়েত ইউনিয়নের স্টালিনের হাতে জর্মানির হিটলারের পরাজয়, এটিই নাকি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মূল গল্প। কিন্তু আমরা খুবই সরি, এ দুটোর একটিও বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস, পোলারাইজেশন ও মুখ্য ফ্যাক্টর ছিল না। কেন?

আমরা চার্চিলকে দিয়ে বিশ্বযুদ্ধ বুঝতে গেছিলাম আর সেটি এ জন্য যে তারাই তো আমাদেরকে ইউরোপ চিনিয়েছিল। তারাই আমাদের প্রভু ছিল। ইউরোপের ভাষাগুলোর মধ্যে একমাত্র ইংরেজি আমাদের এলিটরা বুঝত আর তারা কেবল ব্রিটিশ মিডিয়া পড়ে সেগুলো অনুবাদ করত। এভাবে গ্লোবাল কাহিনীর যতটুকু নাগালে আসত তা দিয়েই কেবল আমরা বিশ্বযুদ্ধ যতটুকু যা বুঝতাম। তাই আমেরিকা বলে কোনো দেশ আছে কি না ঠিকমতো বুঝতাম না; অর্থাৎ চার্চিলের চোখ দিয়েই আমরা বিশ্বযুদ্ধ বুঝেছিলাম।

অথচ হার্ডকোর সত্য এই যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আমাদের মতো কলোনি হয়ে থাকা দেশগুলো আর ইউরোপের কারো না কারো কলোনি শাসন হয়ে থাকবে কি না- এটিই ফয়সালা করে দিয়েছিল। কঠিন সত্যটা ছিল, চার্চিল আমাদের ত্রাতা বা মুক্তিদাতা ছিলেন না। কলোনি থেকে আমাদের আসল মুক্তিদাতা হয়েছিল আমেরিকা। যদিও তা আমেরিকার নিজ স্বার্থেই। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট দুনিয়ার সব কলোনি দখলদার চার্চিলসহ সব কুতুবকে দাসখত দিতে বাধ্য করেছিল যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিজয়ে শেষ হলে পরে তাদের সবাইকে দুনিয়া থেকে কলোনি ব্যবস্থা উঠিয়ে ফেলতেই হবে; যাতে দুনিয়া কলোনিমুক্ত প্রায় শ দুয়েক স্বাধীন রাষ্ট্রের এক দুনিয়া হয়। মূল কথাটা হলো, আমাদের স্বার্থের দিক থেকে দেখলে চার্চিলও আসলে আমাদের ভিলেন ছিল। কিন্তু হিটলারের মারের মুখে নিজের যুদ্ধের খরচ চালানোর মুরোদ ছিল না বলে আমেরিকান শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। অতএব যুদ্ধ শেষে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় ১৯৬৫ সালের মধ্যে সবচেয়ে অসংখ্য দেশের কলোনিমুক্তি ঘটে গিয়েছিল।

অখণ্ড ভারতের দিক থেকে দেখলে বিশ্বযুদ্ধের এটিই ছিল আসল ইতিহাস, আমাদের কলোনিমুক্তির ইতিহাস। গ্লোবাল ইতিহাসের দিক থেকে বললে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আসল ও একচ্ছত্র নেতৃত্ব ছিল আমেরিকার হাতে আর তাই স্বাভাবিকভাবেই যুদ্ধশেষে প্রথম গ্লোবাল অর্থনীতির নেতা হয়েছিল আমেরিকা।

এই আমেরিকান নেতৃত্ব মানে কী? এর মানে আর আবছা রেখে লাভ নেই, যা স্টালিন বা চার্চিল আমাদেরকে সেকালে জানতে দেয়নি তা হলো, আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের নেতৃত্বে গঠিত মিত্রবাহিনীর পক্ষে যুদ্ধে খরচের বড় অংশটি একাই বহন করেছিল আমেরিকা। মানে ইউরোপ এমনি এমনি আমেরিকান নেতাগিরি মেনে নেয়নি।

এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে আরেক যে ব্যাখ্যা- আমাদের রাজনীতি ভালো বোঝে এমন ভাবধারা কমিউনিস্টদের মুখ থেকে জানি, সেটিও আসলে সোভিয়েত ভাষ্য। আর সেখানেও যুদ্ধের বড় খরচদাতা ওই একই আমেরিকা হলেও কমিউনিস্টদের ইতিহাস ভাষ্যে সেটি এড়িয়ে যাওয়া হয়ে এসেছে।

তবে ফ্যাক্টস হলো, আমেরিকাও দাসখত বা ‘সহযোগিতা’ চুক্তিতে স্তালিন বা চার্চিলকে অপমানজনকভাবে শামিল হতে বাধ্য করেননি। এসব চুক্তিতে অপরপক্ষ হিসেবে প্রথম ও একক স্বাক্ষরদাতা ছিলেন চার্চিল আর সেটির নাম আটলান্টিক চুক্তি, ১৬ আগস্ট ১৯৪১। আর পরে সেই ড্রাফটটাই কিন্তু এবার চার রাষ্ট্র ব্রিটেন, আমেরিকা চীন ও সোভিয়েত মিলে আবার স্বাক্ষরিত হয়েছিল ১ জানুয়ারি ১৯৪২ সালে। তবে এবার ওই চুক্তির নাম দেয়া হয়েছিল ‘জাতিসঙ্ঘের জন্ম ঘোষণায়’ স্বাক্ষর এই নামের আড়ালে। সাথে একই দিনে আরো ২৬ দেশ ওই একই ডকুমেন্টে প্রতি স্বাক্ষর করেছিল। এটিই আমেরিকার নেতৃত্বে হিটলারবিরোধী জোটের দলিল। কিন্তু তবু কোথাও কলোনি ছেড়ে দিতে চলে যেতে হবে- এই ভাষা বা শব্দ কোথাও নেই। তবে ঘুরিয়ে বলা হয়েছে- যেকোনো ভূখণ্ডের বাসিন্দারাই একমাত্র নির্ধারক হবে যে ওই ভূখণ্ডের শাসন কিভাবে চলবে; অর্থাৎ কলোনি করা নিষিদ্ধ হলেও এ ভাষায় তা বলা হয়নি।

এ প্রসঙ্গকথা এবার গুছিয়ে বলে শেষ করা যাক। তা হলে আমেরিকা কিভাবে গ্লোবাল নেতা হয়েছিল সেটি আমাদের মতো দেশের এলিট বা কুতুবরা কেউ জানত বা টের পেয়েছিল তা মনে হয় না। এর কাহিনী বা ঘটনার দিক এটিই। আর এটিই এখন আমাদের জন্য খুব প্রাসঙ্গিক। কারণ গত ১১-১৬ জুন জুড়ে বাইডেন জি-৭ আর ন্যাটোর মিটিংয়ে গিয়ে চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উসকানি বা হুমকি তুলেছিলেন। অথচ আসল কথাটা এই যুদ্ধের খরচ কে দেবে সেটিই বলেননি। অথচ আমরা উপরে দেখলাম যুদ্ধের খরচই আসল। এটিই সেকালে ওই পরিস্থিতিতে একমাত্র বহন করতে সক্ষম ছিল রুজভেল্টের আমেরিকা। তাই ইউরোপ হিটলারের হাতে দখল ও বিলীন হওয়ার বদলে আমেরিকান নেতৃত্বকেই বেটার বিকল্প বোধ করেছিল। আর আমেরিকার স্বার্থ শুধু গ্লোবাল নেতা হওয়া ছিল তা নয়, তার হাতে জমা থাকা বিপুল সারপ্লাস বা উদ্বৃত্ত সম্পদ তখন বিনিয়োগযোগ্য সম্পদ হয়ে উঠেছিল, কারণ দুনিয়া তখন কলোনিমুক্ত স্বাধীন। ফলে এরা সবাই তখন আমেরিকার ঋণের সরাসরি অথবা বিশ্বব্যাংকের মাধ্যমে খাতক। আমেরিকা এসব স্বাধীনমুক্ত দেশকে ঋণের খাতক হিসেবে পেয়েছিল।

কাজেই একালে বাইডেনের ভাবি যুদ্ধের খরচের সংস্থান না করে চীনকে যুদ্ধের হুমকি দেখানো এগুলোকে কী বলা যায়? এর মানে কি আমেরিকা-চীনের ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ নামে যে বিরোধ প্রকাশ্যে বাজারে হাজির আছে, তা বাইডেন এখন যুদ্ধের মাধ্যমে সমাধান করতে চাইছেন? হ্যাঁ তাই। সে জন্যই এটিকে ছেলেমানুষি চিন্তা বলছি। কারণ এক তো খরচের ব্যাপার আছে; সেটি ছাড়াও চীনের সাথে আমেরিকান বিরোধ মূলত হাতে থাকা উদ্বৃত্ত সম্পদ না থাকা থেকে উদ্ভূত বিরোধ- এমন বিরোধকে বাইডেন যুদ্ধে গিয়ে সেটিকে নিজের পক্ষে জিতে আনবেন কী করে?

ধরা যাক, যুদ্ধ একটি হলো আর আমেরিকা তাতে জিতেও গেল। কিন্তু তার পরে এতে কি আমেরিকার হাতে যথেষ্ট ‘সঞ্চিত উদ্বৃত্ত সম্পদ’ না থাকার সঙ্কট, সেটি এখন আছেও তা কেটে যাবে? বিপুল সম্পদটা আসবে কোথা থেকে? কিভাবে?

আসলে তখনো দুনিয়ায় সম্ভাব্য একমাত্র উদ্বৃত্ত সম্পদের উৎস দেশ হয়ে থাকবে এ চীনই। আর সেই চীনের কাছে হাত পেতে আমেরিকা তার জনগণকে খাওয়াবে, দুনিয়া রুল করবে- এমন কল্পনা এবসার্ড বলারও সুযোগ দেখি না। এ জন্য বলেছি, সম্পদ থাকা না থাকার সঙ্কট যুদ্ধে জিতেও কেটে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।

তা হলে অথর্ব ন্যাটোকে সামনে আনা কেন?
বাইডেন ন্যাটোকে সামনে রেখে হুমকিটা দিয়েছেন। ন্যাটোকে দিয়ে তিনি আর্টিকেল পাঁচ চালু করার সামরিক ইঙ্গিত দিয়েছেন। আবার হাসির কথা হলো, চীন-রাশিয়া নাকি পারমাণবিক অস্ত্রে তাদের সমান হয়ে যাচ্ছে। এতে আমেরিকা হুমকি দেখছে। আচ্ছা খোদ পারমাণবিক অস্ত্রই যেখানে সবার জন্যই হুমকি, সেটি যার হাতেই থাকুক; সেখানে ওরা আমার সমান হয়ে যাচ্ছে কেন- এটি কী নাকিকান্নাময় যুদ্ধের অজুহাত তোলা নয়!
কিন্তু আসল কথাটা হলো, সেই ওবামা আমল থেকে, চাক হেগেল যখন প্রতিরক্ষামন্ত্রী (২০১৩-১৫), তখন থেকেই ন্যাটো যে একটি খরচের ডিব্বা, আর সেই খরচের বেশির ভাগ (প্রায় ৯৫ শতাংশ) কেন আমেরিকা একা বইবে- এসব প্রশ্ন আর অজুহাত তুলে কি চাক হেগেল সেকালেই ইউরোপকে অপমান করেনি? ট্রাম্পও তো একই প্রশ্ন তুলেছিলেন। আরো এগিয়ে গিয়ে বলেছিলেন, একালে ন্যাটো একটি অপ্রয়োজনীয় সংগঠন। আফগানিস্তানের পর ন্যাটোর আর দুনিয়ায় কোনো ভূমিকা নেই- ট্রাম্পের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এমন সব ঘোষণা দেয়নি কি? এমনকি তিনি ইউরোপে (জার্মানিতে) ও জাপানে সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে এখনো আমেরিকান সৈন্যের সামরিক ব্যারাক মেনটেন করে যাওয়ার খরচ এবার থেকে ইউরোপকে দিতে হবে বলে ট্রাম্প দাবি করেননি?

তা হলে সেসব প্রশ্নের সদুত্তর কী? বাইডেনের কাছে এসব খরচের ব্যয়ভার প্রসঙ্গে সমাধান কী আছে? অর্থাৎ খরচ বইবার প্রশ্নে ন্যাটো এখন একটি পর্যদুস্ত সংগঠন হয়ে আছে! অথচ এসব নিয়ে কোনো কথা না বলে, এক দিনের ন্যাটো বৈঠকে গিয়ে চীনকে হুমকি দিয়ে এলেন বাইডেন! এটি কি তামাশা?

অভ্যন্তরীণ বিতর্কও আছে গভীরে
তবে মনে হচ্ছে, ইউরোপের সবাই এখনো বোকা ধামাধরা নেতাদের দেশ হয়ে যায়নি। তাই খোদ সিএনএন খবর দিচ্ছে কানাডা বাদে জি-৭ এর বাকি নেতাদের মধ্যে বাইডেনের চীনের প্রতি আক্রমণাত্মক অবস্থান নিয়ে অস্বস্তি ও আপত্তি দেখা দিয়েছে। গরম তর্ক-বিতর্কও হয়েছে। এতে সবচেয়ে বড় অস্বস্তি প্রকাশ করেছে ইতালি। এ নিয়ে চীনা ব্যাখ্যা হলো, ইতালিই ইইউর প্রথম দেশ যে চীনের বেল্ট-রোডে প্রকাশ্যে অংশ নিয়েছে।
তবে সামগ্রিকভাবে বললে, চীনের বিরুদ্ধে কামান দাগানো যৌথ বিবৃতি ধরনের কাগজে চীনকে কী ভাষায় কতটা অভিযুক্ত করছে মূলত এই প্রশ্নেই ভিন্নতাগুলো দেখা দিয়েছে। স্বভাবতই সবচেয়ে শক্ত ভাষায় বাইডেন ওই সব ড্রাফট দেখতে চাচ্ছেন। কিন্তু কেউই চীনের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত যাতে না হয় ততটুকুতেই থাকতে চায়। যেমন জাপান টাইমস, যৌথ বিবৃতি ড্রাফট করতে গিয়ে বড় মতভেদের কথা তুলে ধরেছে। বিশেষ করে মানবাধিকার প্রসঙ্গে চীনকে কতটা সমালোচনা করা হবে সে বিষয়ে।

এ দিকে ভয়েস অব আমেরিকা লিখেছে, ইতালি জার্মানি আর ইইউ প্রতিনিধিকে দেখা গেছে, চীনের বিরুদ্ধে কড়া বক্তব্য দিতে এরা অনিচ্ছুক; বরং সহযোগিতামূলক সম্পর্কের মধ্যে থাকতে আগ্রহী। আবার এসব প্রশ্নে কানাডা, ফ্রান্স, ব্রিটেন আর আমেরিকা নিজে এভাবে এরা চারজন চার মাত্রায় চীনের বিরোধিতা করতে চায়। আর জাপান যে কোন দিকে অবস্থান নেবে, তা সবচেয়ে অনিশ্চিত।

সিএনএন লিখছে, এক আমেরিকান ডিপ্লোম্যাট তাদেরকে জানিয়েছেন, বিশেষ করে ইতালি ও জার্মানি খুবই অস্বস্তিতে ছিল বিবৃতির ভাষা নিয়ে। যেন চীন এটিকে কোনোভাবেই উসকানিমূলক হিসেবে না দেখে। চ্যান্সেলর মার্কেল তো বলেই বসেছিলেন যে, চীন আমাদের প্রতিদ্ব›দ্বী বটে কিন্তু আবার অনেক ইস্যুতে আমাদের পার্টনারও তো বটে। ফরাসি নেতা ম্যাক্রোঁও যোগ করেছেন, জি-৭ কে তো ওই চীনের সাথেই আবার জলবায়ু, বাণিজ্য, উন্নয়ন ও অন্য অনেক ইস্যুতে ভিন্নমত থাকলেও একসাথে কাজ করতে হবে। তাই তিনি পরিষ্কার করে রাখার পক্ষে যে, তাদের জি-৭ কখনো চীনবিরোধী কোনো ক্লাব হতে পারে না।

সারকথায়, ভেতরে বড় মাত্রায় বাইডেন বিরোধিতা বজায় আছে। তবে সবচেয়ে মজার অবস্থানে ভারত। ভারতের মিডিয়াই ভেতরের বিরোধের খবরগুলো সামনে এনেছে। যেমন ন্যাটো মিটিংয়ে একসময় এমন উত্তপ্ত ভাষায় বাইডেনের সাথে ইউরোপীয়দের বিতর্ক শুরু হয়েছিল যে কমিউনিকেশন সুইচ অব করে রাখতে হয়েছিল, যাতে বাইরে মিডিয়ার কাছে তা না পৌঁছায়। আবার আরেক ভারতীয় মিডিয়া খবর দিয়েছে, মানবাধিকার প্রসঙ্গে বিবৃতিতে কিছু অবস্থান প্রসঙ্গে খোদ ভারতেরই অস্বস্তি দেখা দিতেছে।

তবে অভ্যন্তরীণভাবে সবচেয়ে বড় অস্বস্তির প্রশ্ন ছিল, উইঘুর বা ফোর্সড লেবার ইস্যুতে কতটা চাপ দিয়ে তা বলা হবে, এ নিয়ে বিতর্ক।
প্রসঙ্গ বাংলাদেশ

এসব প্রসঙ্গে বাংলাদেশেরও বলার আছে। প্রথমত, বাইডেন আমাদেরকে যে পটেনশিয়াল বিপদের মধ্যে রেখেছেন তা হলো, সত্যিই যদি তিনি চীন-আমেরিকার সম্পর্ককে যুদ্ধের দিকে টেনে নিয়ে যান, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমি হয়ে উঠতে পারে তাদের দুই দেশের যুদ্ধের রণক্ষেত্রে। বাংলাদেশে কেমন ধরনের সরকার থাকবে বা কে থাকবে- এ প্রশ্নে আমরা নিশ্চয় বাংলাদেশকে চীন-আমেরিকার রণক্ষেত্র হিসেবে দেখতে চাইতে পারি না। আমরা তাদের স্বার্থের ওই যুদ্ধের বলি হতে পারি না। যেমন বার্মা নিয়ে তাদের স্বার্থের লড়াইয়ের কোনো অংশ হয়ে যেতে পারি না। এ ব্যাপারে আমাদের দেশেও নানা পক্ষ আছে স্বাভাবিক। তাদের সবার প্রতি পরামর্শ থাকবে আমরা যাই করি আমরা কারো হাতিয়ারে যেন পরিণত না হই। বিশেষত বাংলাদেশকেই না তাদের বিবাদের রণক্ষেত্রে বানিয়ে ফেলি সেটি আমাদের খেয়াল রাখতেই হবে। আর উইঘুর বা মানবাধিকার প্রশ্নে স্বাভাবিকভাবে আমাদের অবস্থানটা হবে সবাইকেই হিউম্যান রাইট কমপ্লায়েন্স অবস্থানে যেতে হবে। আমরা কি উইঘুরে সত্যি মানবাধিকারের বাস্তবায়ন দেখতে চাই? নাকি এ নিয়ে চীনের ওপর চাপ সৃষ্টি করার সুযোগ নিতে চাই, যাতে সেটি আমেরিকার বাণিজ্য সুবিধা অর্জনের হাতিয়ার হয়? এ দুয়ের মধ্যে ঠিক কোনটা চায় তা আমেরিকাকে স্পষ্ট করতে হবে।

কথিত ডেমোক্র্যাসি বনাম অটোক্র্যাট
এবার দাবি করা হচ্ছে, এবারের জি-৭ মিটিং নাকি কথিত ডেমোক্র্যাসি বনাম অটোক্র্যাটের লড়াই। আচ্ছা এই জি-৭ এটি কী এককালে জি-৮ করে নেয়া হয়নি? রাশিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়ে। পরে যদিও ইউক্রেন-ক্রিমিয়া প্রশ্নে এক বিবাদে ২০০৭ সালে আবার রাশিয়াকে বের করে দেয়া হয়েছিল এবং সেই থেকে রাশিয়ার ওপর আমেরিকান অবরোধ আরোপ হয়ে আছে। তা হলে সেসব সময় রাশিয়া যখন ভেতরে ছিল, তখন সবাই জি-৮ এর সবাই ডেমোক্র্যাসির লোক হয়ে গেছিল? হায়রে ডেমোক্র্যাসি!

আবার সৌদিদেরকে ইয়েমেন তছনছ করতে আমেরিকান সমর্থন এটিও কি ডেমোক্র্যাসির তাণ্ডব অথবা দুই দিন পরে পরে নিয়মিত গাজায় ইসরাইলি হামলা এটিই বা কোন ডেমোক্র্যাসি? আমেরিকার এসব বক্তব্য আসলে চরম বিরক্তিকর জায়গায় পৌঁছেছে।

তবে চীনের প্রসঙ্গেও অন্তত দুটো কথা বলার আছে। বিশেষ করে বাইডেনের সমালোচনা করছি বলে ভুল বোঝার সুযোগ নেই। হিউম্যান রাইট ইস্যুটা জাতিসঙ্ঘের জন্মের সময় ও পরে ১৯৪৮ সালের সম্মেলনে উঠলেও এর অগ্রগতি খুবই হতাশজনক। অথচ এরই মধ্যে গ্লোবাল অর্থনীতির নেতৃত্বে বদলের সময়কাল আসন্ন। এত দিন কমিউনিস্টদের রাজনীতি ও দেশ যেভাবেই চলুক, এখনকার প্রশ্ন আলাদা। অন্তত গ্লোবাল নেতা হওয়ার স্বার্থে চীনের ন্যূনতম একটি অবস্থান গ্রহণ পূর্বশর্ত। নইলে প্রতি পদে এই ইস্যুতে সঙ্ঘাতে গ্লোবাল সব কাজ বাধাগ্রস্ত হতে থাকবে। চীন নিশ্চিত থাকতে পারে হিউম্যান রাইট ইস্যুতে ন্যূনতম একটি অবস্থান ছাড়া চীনের নেতা থাকা খুবই কঠিন হবে। ফেলও করতে পারে।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com


আরো সংবাদ



premium cement