২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আজারবাইজান যুদ্ধবিরতি মেনে নিলো কেন

আজারবাইজান যুদ্ধবিরতি মেনে নিলো কেন - ছবি সংগৃহীত

১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর এর অন্য সব স্টেটের মতো আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এর পরপরই প্রতিবেশী দেশ দু’টি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। সেই যুদ্ধ ছিল আজারবাইজানি অঞ্চল হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নাগরনো-কারাবাখের দখল নিয়ে। ওই অঞ্চলের আর্মেনীয় জাতিগোষ্ঠীর বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদদ দিতে গিয়ে আর্মেনিয়া সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে যুদ্ধ শুরু করে এবং অঞ্চলটি ‘দখল’ করে নেয়।

আর্মেনিয়ার চাপিয়ে দেয়া সেই যুদ্ধে অন্তত ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। তবে আন্তর্জাতিক বিশ্ব সেই জবরদখলের স্বীকৃতি দেয়নি; বরং জাতিসঙ্ঘের চারটি প্রস্তাবে ভূখণ্ডটি আজারবাইজানের বলে স্বীকৃতি দিয়ে সেখানে পূর্বাবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য বলা হয়। ১৯৯৪ সালে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপে যুদ্ধবিরতি অর্জিত হয়। কিন্তু আর্মেনিয়া দখল ছাড়েনি। আজারবাইজানও দাবি ছেড়ে দেয়নি এবং যেকোনো সময় যুদ্ধবিরতি নাকচ করে দিয়ে ফের যুদ্ধ শুরুর মতো একটি অবস্থান ধরে রেখেছিল। গত ২৭ অক্টোবর সেই ১৯৯৪ সালের যুদ্ধবিরতিই ভেঙে পড়ে।

ছয় সপ্তাহের যুদ্ধে আজারবাইজান এবার চমক দেখিয়েছে। ওই সময়ের মধ্যে তারা ২৬ বছর আগে হারানো ভূখণ্ডের প্রায় ২০-২২ শতাংশ পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়। পুরো যুদ্ধটাই যেন আজারবাইজানের অনুকূলে ছিল। হয়তো শেষ পর্যন্ত আজেরি বাহিনী পুরো নাগরনো-কারাবাখ মুক্ত করে নিতেও পারত। কিন্তু আজারবাইজান যখন চূড়ান্ত বিজয়ের পথে তখনই রাশিয়া যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে মাঠে হাজির হয়। আজেরি সেনারা ওই অঞ্চলের কৌশলগত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি শহর শুশা দখলে নেয়ার পরই রাশিয়া হস্তক্ষেপ করে এবং দু’পক্ষকে দ্রুত আলোচনার টেবিলে নিয়ে গিয়ে সমঝোতায় রাজি করায়। ফলে হঠাৎ করেই যেমন শুরু হয়েছিল তেমনই সহসাই থেমেও যায় যুদ্ধ। ছয় সপ্তাহের যুদ্ধেই উভয়পক্ষে অন্তত চার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে বলে জানা যায়।

গত ১০ নভেম্বর রাশিয়ার প্রস্তাবিত ৯ দফা শান্তিচুক্তিতে রাজি হয় আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান। চুক্তিতে সই করেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ ও আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ান।

চুক্তি অনুযায়ী নাগরনো-কারাবাখ নিয়ে চলমান যুদ্ধ বন্ধ এবং সঙ্ঘাতপূর্ণ ওই অঞ্চলে দীর্ঘমেয়াদি শান্তির পথ খুঁজে বের করতে রাজি হয়েছে উভয়পক্ষ। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ১০ নভেম্বর মস্কোর সময় মধ্যরাত থেকে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। চুক্তি মোতাবেক, দুই দেশের সেনারা বর্তমানে যে অবস্থানে রয়েছে সেখানেই থাকবে। অর্থাৎ সাম্প্রতিক যুদ্ধে আর্মেনিয়ার কাছ থেকে নিয়ন্ত্রণে নেয়া শুশা শহর ও অন্যান্য এলাকায় আজারবাইজান অবস্থান করবে। চুক্তিমতে আর্মেনিয়া আগামী ২০ নভেম্বর আঘদাম জেলা আজারবাইজানের কাছে ফেরত দেবে। এ ছাড়াও আর্মেনিয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকা কালবাজার জেলা আগামী ১৫ নভেম্বর ও লাচিন জেলা আগামী ১ ডিসেম্বর আজারবাইজানের কাছে হস্তান্তর করবে আর্মেনিয়া। আগে শুশা শহরের ভেতর দিয়ে নাগরনো-কারাবাখের সাথে যোগাযোগ করত আর্মেনিয়া। এখন তারা পাঁচ কিলোমিটার প্রশস্ত লাচিন করিডোর দিয়ে যোগাযোগ রক্ষা করবে। মূল ভূমি থেকে দূরে, আজারবাইজানের নাখচিভান স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে যাতায়াত করতে নিজেদের ভূমি ব্যবহার করার অনুমতি দেবে আর্মেনিয়া। যোগাযোগ অবকাঠামো তৈরিতেও কাজ করবে দেশটি।

বিরোধপূর্ণ অঞ্চলে শান্তিরক্ষার দায়িত্বে থাকবে রাশিয়ার দুই হাজার সেনা সদস্য। তারা দুই দেশের নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর অবস্থান নেবে। এ ছাড়াও আর্মেনিয়ার সাথে সংযোগ রক্ষাকারী লাচিন করিডোরের নিরাপত্তা দেবে রুশ সেনারা। আজারবাইজান চাইছে রাশিয়ার সেনাদের সাথে তুরস্কের সেনারাও অবস্থান করবে। এ বিষয়ে রাশিয়া সম্ভবত রাজি হবে না।

যাই হোক, চুক্তিতে বলা হয়েছে- কোনো পক্ষ চুক্তি থেকে সরে না গেলে এই স্থিতাবস্থা আগামী পাঁচ বছর চলবে। পাঁচ বছর পর চুক্তি স্বয়ংক্রিয়ভাবে বলবৎ হবে। অবশ্য এ সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য ভবিষ্যতে কী উদ্যোগ নেয়া হবে, চুক্তিতে সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি।

সাম্প্রতিক যুদ্ধে আজারবাইজানের পক্ষে সমর্থন দেয়া তুরস্ক ওই চুক্তিকে ‘আজারবাইজানের বিজয়’ বলে উল্লেখ করেছে। চুক্তির পর আজারবাইজানের নাগরিকরা আনন্দ-উল্লাসে মেতেছে। উল্টো দিকে আর্মেনিয়ায় হয়েছে বিক্ষোভ। উঠেছে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবি। এমনকি অভ্যুত্থান ঘটিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করে ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্রের অভিযোগে জাতীয় নিরাপত্তা সার্ভিসের সাবেক প্রধান আর্তুর বেনেৎসিয়ানকে ১৪ নভেম্বর গ্রেফতারও করা হয়েছে। এরই মধ্যে অধিকৃত যেসব এলাকা আজারবাইজানকে ফেরত দেয়া হবে বলে চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে, সেসব জায়গা থেকে আর্মেনীয় বংশোদ্ভূতরা দলে দলে ঘরবাড়ি ছেড়ে আর্মেনিয়ার দিকে চলে যাচ্ছে। অনেকে যাওয়ার আগে আগুন দিয়ে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে বলেও এক খবরে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি। বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার কারণ, এসব বাড়ি তারা নিজের রক্তঘামে অর্জিত অর্থ দিয়ে কেনেনি। প্রায় ৩০ বছর আগে আর্মেনিয়া যখন ওই এলাকাটি দখল করে, তখন এগুলো আজারবাইজানি মুসলমানদের সম্পত্তি ছিল। দখলের পর আর্মেনিয়া সরকার বাড়িগুলো নামমাত্র মূল্যে সেখানে আসা আর্মেনীয়দের হাতে তুলে দিয়েছিল।

এমনই এক পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, আজারবাইজান তার সমূহ বিজয়ের মুখে কেন যুদ্ধবিরতিতে রাজি হলো এবং শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করল? এ প্রশ্নের জবাব এক কথায় দেয়া সম্ভব নয়। সবাই জানেন, যুদ্ধরত দু’পক্ষের পেছনেই আরো বেশ কিছু বৈশ্বিক শক্তি নৈতিক ও বৈষয়িক সমর্থন নিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। এটি শুধু আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং তুরস্ক, ফ্রান্স, ইরান ও রাশিয়ার সংশ্লিষ্টতায় এটি ছিল এক জটিল লড়াই। রাশিয়া ও ফ্রান্স ছিল আর্মেনিয়ার পক্ষে। বিস্ময়কর হলেও সত্য, ‘ইসলামী বিপ্লবের দেশ’ ইরানও যুদ্ধরত মুসলিম দেশ আজারবাইজানের পক্ষে না থেকে ছিল খ্রিষ্টান আর্মেনিয়ার পক্ষে। এর কারণ ইরানের সাথে আজারবাইজানের সীমান্ত এবং কাস্পিয়ান সাগরের তেল-গ্যাস নিয়ে বিরোধ। এ দিকে রাশিয়া চায় নাগরনো-কারাবাখ নিয়ে সমস্যা জিইয়ে রাখতে। এতে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান- দুই দেশকেই তার নিয়ন্ত্রণ করতে সুবিধা হবে।

ওদিকে ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের ক্রমবর্ধমান প্রভাব খর্ব করতে চায় ফ্রান্স। নিজ নিজ স্বার্থে এই তিন দেশই আর্মেনিয়াকে অস্ত্র ও ভাড়াটে সেনা দিয়ে সহায়তা করেছে। তবে সব থেকে বেশি উচ্চকিত ছিল ফ্রান্স। কারণ বিশ্বজুড়ে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের বেশ ক’টি বিরোধপূর্ণ ইস্যুতে ফ্রান্স তুরস্কের সাথে পাল্লায় তেমন কায়দা করে উঠতে পারেনি। সম্প্রতি রাসূল সা:-এর ব্যঙ্গচিত্র ইস্যুতে ইসলামবিরোধী বক্তব্য দিয়ে বেকায়দায় পড়া ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁকে মানসিক চিকিৎসা নেয়ার পরামর্শ দিয়ে একহাত নিয়েছিলেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান। সেটিও গায়ে জ্বালার কারণ ছিল ম্যাক্রোঁর। আবার সাগরে তেল আহরণ নিয়ে গ্রিসের সাথে তুরস্কের বিরোধে ম্যাক্রোঁ খুব হম্বিতম্বি করলেও তুরস্ককে হটাতে ব্যর্থ হয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্য বিশেষ করে, লিবিয়ায় ফ্রান্সের নীতি চরমভাবে মার খেয়েছে তুরস্কের কাছে। সব মিলিয়ে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের প্রতি যেন একধরনের ব্যক্তিগত আক্রোশে ভুগছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট।

সেসব বিরোধের কারণেই তুরস্ক যখন আজারবাইজানের পক্ষে সমর্থন দিয়েছে, তখন অস্ত্র ও ভাড়াটে সেনা নিয়ে সরাসরি আর্মেনিয়ার পাশে দাঁড়ায় ফ্রান্স। তবে দেখা গেল, ওই সর্বশেষ সেক্টরেও গো-হারা হেরে গেল দেশটি। তা হলে দাঁড়াচ্ছে এই যে, যুদ্ধে জয় হয়েছে আজারবাইজানের, তুরস্কের ও রাশিয়ার। পরাজিত আর্মেনিয়া ও ফ্রান্স। রাশিয়ার বিজয়ের ব্যাপারে সন্দেহের কোনো কারণ নেই। চুক্তি সম্পাদনের মধ্য দিয়ে সে বিবদমান দুই দেশের ওপর প্রভাব অটুট রাখতে পারছে। শান্তি রক্ষার নামে সেনা বসাতে পারছে এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ করিডোরের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ বলবৎ রাখতে পারছে। সুতরাং বিজয় রাশিয়ারও। প্রকৃতপক্ষে এবারের লড়াইয়ে লাভবান হলো রাশিয়া ও তুরস্ক। রাশিয়া ধীরে ধীরে মধ্যপ্রাচ্যের সীমান্তে চলে আসছে। নাগরনো-কারাবাখে সেনা মোতায়েনের মানে হলো ইরানের মাথার ওপর অবস্থান নেয়া। আর তুরস্ক আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে নিজের অবস্থান সংহত করছে। শুধু তা-ই নয়, নাগরনো-কারাবাখে সেনা পাঠাতে না পারলেও মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়া মাইনরে প্রভাব বৃদ্ধির দৌড়ে এখন পর্যন্ত তুরস্ক এগিয়ে রইল। নাগরনো-কারাবাখ থেকে আর্মেনিয়ার পিছু হটায় তুরস্কের বিরুদ্ধে উসমানীয় খেলাফতের আমলে আর্মেনীয় গণহত্যার বৈশ্বিক প্রচারণা এখন অনেকটাই স্তিমিত হয়ে আসবে বলেও অনেকে মনে করছেন।

ত্রিপক্ষীয় এ যুদ্ধবিরতি কত দিন টিকবে বলা মুশকিল। কারণ এরই মধ্যে উভয়পক্ষ পরস্পরকে চুক্তি ভঙ্গের জন্য অভিযুক্ত করেছে। আর আজারবাইজান অভিযোগ করেছে, ১৪ নভেম্বর দিবাগত রাতে তার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর গানজায় গোলা নিক্ষেপ করে আর্মেনিয়া সাতজনকে হত্যা এবং ৩৩ জনকে জখম করেছে। গণমাধ্যমে সে ছবি ছাপা হয়েছে।

একটি বিষয় স্পষ্ট করেই বলা যায়, এ সঙ্ঘাতে আর্মেনিয়ার অবস্থান ছিল সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য ও অযৌক্তিক। সারা বিশ্ব যেটিকে আজারবাইজানের ভূখণ্ড বলে স্বীকার করে এবং যার পক্ষে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব রয়েছে, সেটি চিরকাল জবরদখলে রাখা আর্মেনিয়ার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। তাই এ চুক্তি করার মধ্য দিয়ে দেশটি যুদ্ধে অপমানজনক হারের মুখে একটি সম্মানজনক অপসারণের পথ বেছে নিয়েছে বলা যায়। এ বাস্তববুদ্ধির কারণেই দেশটিকে বাহবা দেয়া যেতে পারে। অন্য দিকে আজারবাইজানের অবস্থান ছিল ন্যায়সঙ্গত এবং আন্তর্জাতিক আইনের ভেতরে থেকেই সে এগিয়েছে। তার পরও যুদ্ধবিরতি মেনে নিয়ে তারা শান্তির প্রতি যে আগ্রহ ও সদিচ্ছার প্রমাণ দিয়েছে তাতে দেশটিকে পুরস্কৃত করা উচিত। তা ছাড়া দীর্ঘমেয়াদে যুদ্ধ করার মতো অর্থনৈতিক সক্ষমতাও দেশটির নেই, সে কথাও মাথায় রাখতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement