প্রতিদিন বনানী-‘কাকলি’ পার হওয়ার সময় তার কথা মনে পড়ে। অসংখ্য স্মৃতি ভেসে ওঠে মানসপটে। বছর পেরিয়ে গেছে, রাজী ভাই নেই। কিন্তু মনে হয়, তিনি আছেন। এই বুঝি দেখা হবে কাকলির মোড়ে অথবা বাসার নিচে হাঁটতে হাঁটতে গল্প হবে। রাষ্ট্র, রাজনীতি, আন্তর্জাতিক ঘটনা, সংবাদপত্র, সাংবাদিকতা, কূটনীতি কোনোটাই বাদ যেত না রাজী ভাইয়ের গল্পে। বড় ভাইয়ের সমবয়সী জিল্লুল হাই রাজীর মধ্যে সব সময় অগ্রজের নির্ভরতা খুঁজে পেতাম।
পারিবারিক পরিমণ্ডল, জানাশোনার পরিধি অথবা কর্মস্থল- সবটাতেই রাজী ভাইয়ের সাথে আমার ব্যবধান অনেক। কিন্তু এই দূরত্ব অতিক্রম হয়ে তিনি যে কখন অসম্ভব এক নির্ভরশীল ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন, তা কোনো দিন ভাবার সময় আসেনি। এই নশ্বর দুনিয়ায় কাকে কত দিন পরম করুণাময় রাখবেন, তা কেবল তিনিই জানেন। তার ইচ্ছার কাছেই সমর্পিত হতে হয় সবাইকে।
১৯৮৩ সালে আমার দীর্ঘ সময়ের জন্য ঢাকায় আসা। তখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষা মাস্টার্স হয়নি। ঢাকায় এসে বড় ভাইয়ের বাসায় উঠি। বড় ভাই তখন ভাড়া থাকতেন কবি ও সমালোচক আব্দুল কাদিরের ধানমন্ডি মধুবাজারের বাসার তিনতলায়। কবি নিজে থাকতেন দোতলায়। অবসর জীবনে অনেক গুণী মানুষেরও অফুরন্ত সময় থাকে। তখন কর্মজীবনের নানা স্মৃতি নিয়ে তরুণ-যুবকদের সাথে গল্প করে সময় পার করে তৃপ্তি পেতেন। আমি বড় ভাইয়ের বাসায় ওঠার পর কবির সাহচর্যে আসার বিরল সুযোগ ঘটে। কবির কলকাতার জীবন, সাহিত্যচর্চা, ছন্দের নানা দিক, নজরুলের সাহচর্যসহ- বিভিন্ন বিষয় গল্প ও স্মৃতিচারণে স্থান পেত। কবির ছিল বিশাল এক লাইব্রেরি, যা দেখে আমার চট্টগ্রামের বাংলাদেশ পরিষদের লাইব্রেরির কথা মনে পড়ত। শিক্ষাবিদ পণ্ডিত কবি সৈয়দ আলী আহসানের ব্যক্তিগত পাঠাগারের ব্যাপ্তিটিও এ রকমই ছিল। এ সময়টাতে ঢাকায় আমার পরিচিত পরিসর ছিল বেশ ছোট। একটি বড় প্রকাশনার কাজে সহায়তার দায়িত্ব আসে আমার ওপর। এ কাজের জন্য বন্ধু-সুহৃদ ওবায়েদ ভাই নিয়ে যান শাহ আব্দুল হালিমের অফিসে। তিনি তখন সৌদি দূতাবাসের জনসংযোগের বিষয়টি দেখাশোনা করতেন।
বাংলাদেশে তখন সৌদি আরবের বিস্তৃত ও নানামুখী কর্মকাণ্ড ছিল। এই হালিম ভাইয়ের মাধ্যমেই রাজী ভাইয়ের সাথে আমার প্রথম পরিচয়। হালিম ভাই দুইজন বিরল প্রতিভার ব্যক্তির গল্প মাঝে মধ্যে করতেন, তাদের একজন ছিলেন জিল্লুল হাই রাজী। সিলেটের বিখ্যাত এক পরিবারে জন্ম। বেড়ে ওঠা রাজশাহীতে, বাবা অধ্যক্ষ আবদুল হাইয়ের কর্মস্থলের সুবাদে। রাজী ভাইয়ের কর্মস্থল ছিল ঢাকায়। আর তার বন্ধুপরিসর ছিল অনেক বৈচিত্র্যপূর্ণ। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি কাজী আকরাম হোসেন ছিলেন তার অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজন। আবার দৈনিক সংগ্রামের সাবেক কার্যনির্বাহী সম্পাদক মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের সাথেও ছিল তার বিশেষ ঘনিষ্ঠতা। রাজী ভাই চাকরির শুরুটা করেছিলেন একটি সংবেদনশীল প্রতিষ্ঠানে। কর্মজীবনের মূল সময় কাটিয়েছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের ট্রেড অ্যান্ড ইকোনমিক অ্যাডভাইজার হিসেবে। অবসরের পর খণ্ডকালীন কাজ নিয়েছিলেন প্রথম আলোর বিজনেস জার্নালিজম কনসালট্যান্ট হিসেবে।
রাজী ভাইয়ের চরিত্রের অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল ভাবনার গভীরতা আর প্রকাশে সহজতা। অনেক কঠিন বিষয়কে অতি সহজভাবে তুলে ধরতে পারতেন তিনি। তার জ্ঞানের পরিধি এত বিস্তৃত ছিল যে, আমরা সংবাদকর্মীরা রিপোর্ট করা বা কলাম লেখার ক্ষেত্রে জটিল কোনো সমস্যায় পড়লে নিঃসঙ্কোচে পরামর্শ করার জন্য ফোন করতাম অথবা রাজী ভাইয়ের বাসায় চলে যেতাম। রাজী ভাইয়ের অতি ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু ছিলেন জাভেদ ভাই। ইউরোপীয় ইউনিয়নের চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর মিরপুর ডিওএইচএসে তিনি একটি ফ্ল্যাট কেনেন। আগের মতো যখন তখন বাসায় হানা দেয়ার সুযোগ তখন আর থাকেনি। তখন বনানীর জাভেদ ভাইয়ের অফিস ছিল আড্ডার কেন্দ্র। এর কাছাকাছি বনানী জামে মসজিদের সামনে রাজী ভাইয়ের পৈতৃক বাড়ি। রাজী ভাইয়ের বাবা প্রতিষ্ঠাকাল থেকে দীর্ঘ সময় ধরে এই মসজিদ কমিটির সভাপতি ছিলেন। মসজিদটির উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের অনেক কাজে রাজী ভাইয়ের বাবার সংস্পর্শ ছিল।
মসজিদের সামনে রাজী ভাইয়ের পৈতৃক বাড়িটির নিচতলায় একটি সুপরিসর কক্ষ ছিল পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের আড্ডা দেয়ার জন্য সংরক্ষিত। অনেক দিনই রাজী ভাইয়ের সাথে গল্প করার জন্য সেই ‘বনানী আড্ডায়’ গিয়েছি এবং রাজী ভাইয়ের বড় ভাইয়ের বানানো চা এবং পুরি-সিঙ্গাড়া খেয়েছি। আর এই বনানী মসজিদেই রাজী ভাইয়ের সাথে আমার শেষ দেখা। তখন পরম করুণাময়ের কাছে না-ফেরার জগতে, চলে গেছেন তিনি। শেষ দেখায় মনে হয়েছিল, রাজী ভাই কেবলই ঘুমিয়েছেন। আবার হয়তো আড্ডায় রাজী ভাইয়ের কণ্ঠ শুনতে পাবো। মাহমুদ ভাইও বললেন সেই অনুভূতির কথা। শেষ বিদায়ের কয়েক দিন আগে ভাবীসহ মাহমুদ ভাইকে দেখতে গিয়েছিলেন তার গুলশানের বাসায়। তিনিও ভাবতে পারছিলেন না, রাজী ভাই আর নেই।
রাজী ভাইয়ের কণ্ঠ এখনো শুনি। কখনো স্মরণে, আবার কখনো মননে এ ধ্বনি বেজে ওঠে। বাস্তবেও কোনো কোনো সময় শুনি। বন্ধু সাংবাদিক, ভয়েস অব আমেরিকার আমীর খসরু বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ে রিপোর্ট করতে গিয়ে প্রায়ই রাজী ভাইয়ের বক্তব্য বা সাক্ষাৎকার নিতেন। শেষবার নিয়েছিলেন সম্ভবত জুন ২০১৭ সালে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন মানবাধিকার পরিস্থিতিসহ কিছু কারণে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে পারে বলে একটি খবর তখন আলোচিত ছিল। এ নিয়ে ভয়েস অব আমেরিকার প্রতিবেদনের অংশ ছিল রাজী ভাইয়ের সাক্ষাৎকারটি। সেই রেকর্ডটি সংরক্ষণ করেছি। রাজী ভাইয়ের কথা মনে পড়লে এখনো রেকর্ডটি শুনি। মনে হয়, কথা বলছি তার সাথে।
রাজী ভাইয়ের বিদায়ের খবর প্রথম যখন ফেসবুকের ইনবক্স বার্তায় মসিউর ভাইয়ের কাছ থেকে পাই, তখনো তা ভুল কোনো খবর বলেই মনে হচ্ছিল। কিন্তু জাফর ভাইয়ের ফোনে জানতে পারলাম, রাজী ভাই আসলেই আর নেই। জাফর ভাই ভাবীর সাথে কথা বলে বিস্তারিত জেনেছেন। তিনি শুধু রাজী ভাইয়ের ঘনিষ্ঠতম এককালের সহকর্মীই ছিলেন না। একান্ত বিষয় শেয়ার করার অতি নির্ভরশীল এক বন্ধুও ছিলেন তিনি। রাজী ভাইয়ের বিদায়ের পর অদ্ভুত এক পরিবর্তন তার মধ্যে লক্ষ করি। তিনি অনেক বেশি আধ্যাত্মিক চিন্তার মানুষে পরিণত হয়ে গেলেন। বাংলা ভাষায় ‘অজাতশত্রু’ বলে একটি শব্দ আছে। রাজী ভাইকে তেমন একজন মানুষ মনে হতো আমার। তার কোনো শত্রু দেখিনি কোনো সময়। তিনি একটি বিশ্বাসের বিষয়কে লালন করতেন। বাংলাদেশের সার্বভৌম অস্তিত্বের ব্যাপারে রাজী ভাই এ বিশ্বাসকে অকপটে প্রকাশও করতেন। তিনি বলতেন, আপনাকে যদি প্রশ্ন করি বাংলাদেশ কেন আলাদা স্বাধীন একটি দেশ হবে? এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মবিশ্বাস এবং সেটিকে কেন্দ্র করে সাংস্কৃতিক ও কৃষ্টিগত স্বাতন্ত্র্য বাদ দেয়া হলে পশ্চিম বাংলা থেকে আলাদা থাকার কোনো যুক্তি থাকে না বাংলাদেশের। এই পরিচয় ও স্বাতন্ত্র্য থেকে যখন এ দেশের মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, সেদিন সত্যিকার অর্থেই পৃথক ভূখণ্ড ও স্বাধীন থাকার যুক্তি হারাবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌম অস্তিত্বের এই ভিত্তিমূলকে এত সহজভাবে ব্যাখ্যা করতে আর কাউকে দেখিনি।
রাজী ভাইয়ের চরিত্রটি ছিল এমন যে, তিনি নিজের বিশ্বাসে অটল থাকতেন, কিন্তু সেই সাথে অন্যদের বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীলও ছিলেন। তিনি কাউকে আঘাত দিতে জানতেন বলে মনে হতো না। বনানী মসজিদের দোতলায় রাজী ভাইয়ের দোয়ার অনুষ্ঠানে অনুজ নিজামী ভাই, ভাবী ও মেয়েরা যখন কথা বলছিলেন, তখন মনে হচ্ছিল মানুষটি সত্যিই ভেতরে-বাইরে এক রকমই ছিলেন। যতদূর মনে পড়ে, নিজামী ভাই দোয়ার অনুষ্ঠানে রাজী ভাই দুনিয়ায় আসার আগে তাঁর বাবার একটি স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। তিনি স্বপ্নে দেখেন ব্যতিক্রমী চরিত্রের এক সন্তানের বাবা হচ্ছেন তিনি। রাজী ভাইয়ের নামের ব্যাপারে তখনই নাকি মনস্থির করে ফেলেন তিনি। রাজী ভাই সত্যিই ছিলেন এক ব্যতিক্রমী মানুষ। ছিলেন এক গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও ভাবনার মানুষ, আর সবারই যেন কল্যাণকামী ছিলেন তিনি। রাজী ভাইয়ের দোয়ার অনুষ্ঠানে তার মামা ইনাম আহমদ চৌধুরী এবং ভাবী ও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বোন সদ্য পরলোকগত রাজী ভাইয়ের স্মৃতিচারণের কথাগুলো আমার এখনো কানে বাজে।
দোয়া মাহফিল থেকে বিদায়ের সময় মসজিদের নিচতলায় একটি চেয়ারে বসে থাকতে দেখি অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিতকে। সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠতে না পারায় তিনি হয়তো নিচেই অপেক্ষা করছিলেন। স্মরণ করছিলেন রাজী ভাইয়ের অতীত জীবনের নানা ঘটনা। এক দিন আগে ফেসবুকে একটি বক্তৃতা শুনছিলাম অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের। তার ৫০ বছর আগের ছাত্ররা এক পুনর্মিলনীর আয়োজন করেছেন স্যারের সংস্পর্শ পাওয়া ও বক্তৃতা শোনার জন্য। সায়ীদ স্যারের ছাত্র সবার বয়স ৭০-এর কোঠায়। সেখানে অধ্যাপক আবু সায়ীদ বলছিলেন, তার জীবনের লক্ষ্য ছিল, লেখক হওয়ার। সে লক্ষ্য অর্জনে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। এক দশক কাটিয়েছেন টিভি প্রোগ্রামে। কয়েক দশক কাটিয়েছেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের জন্য। আর এখন দিনের বড় সময় চলে যায় ‘বক্তৃতাবাজি’তে। আবু সায়ীদ স্যার সফল লেখক হয়ে অনেক গ্রন্থ রচনা করলে এর মাধ্যমে হয়তো দীর্ঘকাল স্মরণীয় থাকতে পারতেন। যদিও তার ছাত্র ও সমকালীন ব্যক্তিরা বক্তৃতা শুনে উদ্দীপ্ত হচ্ছেন। অন্যদের ভাবনার ওপর তার প্রভাব বাড়ছে।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের রম্যরসে ভরা এই বক্তৃতা শোনার সময় আমার রাজী ভাইয়ের কথা মনে পড়ছিল। তার জ্ঞান, তার ভাবনা ও তার অভিজ্ঞতাকে বইয়ের মধ্যে বিন্যাস করলে, তিনি থেকে পরের জেনারেশন অনেক কিছু পেতে পারত। তখন হয়তো আমরা সিনিয়র-জুনিয়র বন্ধুরা তার আড্ডা আর আলোচনার অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হতাম। এখন রাজী ভাই স্মৃতি হওয়ার এক বছর পর মনে হচ্ছে, রাজী ভাই লেখক হলেই মনে হয় ভালো হতো।
মোবাইল ফোনের হোয়াটসঅ্যাপ ভাইবারে রাজী ভাইয়ের ফোনটা এখনো সেভ করা আছে। ভাবী হয়তো সেটি সচল রেখেছেন। নেট ফোন খুললে রাজী ভাইয়ের ছবি ভেসে ওঠে। রাজী ভাইয়ের স্মৃতিবিজড়িত আলমারিটি এখনো আমার বেডরুমে। শুধু শুনতে পাই না তার কণ্ঠটি। অন্যের জন্য নিবেদিত এমন একজন মানুষকে পরম করুণাময় দয়াবান নিশ্চয়ই জান্নাতের একটি স্থানে রাখবেন। হে প্রভু, আমাদের মিনতি কবুল করুন।
mrkmmb@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা