একটি দেশের সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান যখন সংবিধানে প্রদত্ত নির্দেশনা এবং দেশের প্রচলিত আইনানুযায়ী তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে, তখন তাতে দেশের সাধারণ মানুষ সংবিধান ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে ওঠে। আমাদের সংবিধানের বিধানানুযায়ী দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য সংবিধান ও আইন মেনে চলা আবশ্যিক কর্তব্য। আমাদের দেশে বিভিন্ন সাংবিধানিক ও সরকারি পদে যারা আসীন, তাদের সবার বেতন, ভাতা ও সুবিধাদি রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে নির্বাহ করা হয়।
রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা সাকুল্য অর্থ জনগণের দেয়া কর থেকে আসে। সাংবিধানিক ও সরকারি পদে কেউ চিরস্থায়ীভাবে আসীন থাকতে পারে না। সাংবিধানিক ও সরকারি পদ থেকে বিদায় নেয়া পরবর্তী যেকোনো নাগরিক একজন সাধারণ মানুষ। সাংবিধানিক ও সরকারি পদধারীরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। প্রজাতন্ত্রের প্রতিটি কর্মচারীকে কাজে বহাল থাকার সময় জনগণকে নিঃস্বার্থ সেবা দিতে সচেষ্ট থাকতে হয়। এ সেবা দেয়ার কাজটি নাগরিকদের সংবিধান ও আইন মেনে চলার মতো তাদের আবশ্যিক কর্তব্য।
রাষ্ট্রের সাংবিধানিক পদধারীদের মধ্যে রাষ্ট্রপতি ছাড়া প্রধানমন্ত্রী ও তার মন্ত্রিসভার সদস্য এবং স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত। অপর দিকে উচ্চ আদালতের বিচারক, প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার, সরকারি কর্ম কমিশনের সভাপতি ও সদস্য, মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং অ্যাটর্নি জেনারেল প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত। এসব নিয়োগের ক্ষেত্রে সংবিধান ও সংশ্লিষ্ট আইনে উল্লিখিত বিধানাবলি মেনে চলতে হয়। রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্তদের ক্ষেত্রে দলীয় মতাদর্শী অথবা দলীয় সুবিধাভোগী বিবেচনায় নিয়োগ কার্য সমাধা করা হলে সেসব নিয়োগপ্রাপ্তদের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রেখে সৎভাবে দায়িত্ব পালন কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
দেশের সাধারণ জনমানুষ সব সময় রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কোনো ধরনের হয়রানি ও অবৈধ প্রাপ্তি ছাড়া নিঃস্বার্থ সেবা প্রত্যাশা করে। এ নিঃস্বার্থ সেবাপ্রাপ্তিতে দেশের জনগণ বিফল হয় না, যখন বিভিন্ন স্তরে জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হয়। আমাদের দেশে নির্ধারিত মেয়াদান্তে যেসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
জাতীয় সংসদ কিভাবে গঠিত হবে, সে বিষয়ে সংবিধানে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। সংবিধানের বিধানানুযায়ী একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাগুলো থেকে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইন অনুযায়ী নির্বাচিত ৩০০ সদস্য এবং অনুরূপ ৩০০ সদস্যের আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে নির্বাচিত ৫০ জন মহিলা সদস্য সর্বমোট ৩৫০ সদস্য সমন্বয়ে সংসদ গঠিত। সর্বশেষ অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনটি অবলোকনে প্রতীয়মান হয় প্রত্যক্ষ নির্বাচনের জন্য উন্মুক্ত ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৪টি আসনের সদস্য বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এরূপ বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় যারা নির্বাচিত তারা প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে যে নির্বাচিত নন এ প্রশ্নে বিতর্ক করার অবকাশ নেই বললেই চলে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক না হলে সে নির্বাচন অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায় না। এরূপ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সাংবিধানিক ও সরকারি পদে নিয়োজিত অনেকের অবৈধ সহায়তার প্রয়োজন দেখা দেয়। এ ধরনের অবৈধ সহায়তা নিয়ে যারা নির্বাচিত তাদের পক্ষে পরে অবৈধ সহায়তাকারীদের নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়।
আইনের শাসনের অপর নাম সুশাসন। আইনের শাসন ও গণতন্ত্র একটি অপরটির পরিপূরক। আইনের শাসন ও সুশাসন থাকলে দুর্নীতির সুযোগের ব্যাপক হারে হ্রাস ঘটে। আর আইনের শাসন ও সুশাসন না থাকলে দুর্নীতির মাত্রা অসহনীয় হয়ে ওঠে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অর্থ পাচার বিষয়ে যে সংস্থাটি কাজ করে সেটির নাম গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রেটি। সংস্থাটির তথ্য মতে, বিগত দশ বছরে বাংলাদেশ থেকে ছয় লাখ হাজার কোটি টাকার অধিক অর্থ পাচার হয়ে গেছে। এ বিপুল অর্থ যারা পাচার করেছে তাদের অনেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক সরকারের শাসনামলে দলীয় মতাদর্শী বিবেচনায় সুবিধাভোগী ব্যক্তি। যেকোনো রাজনৈতিক সরকার সচেষ্ট হলে দেশ থেকে অর্থ পাচারের সাথে কারা সংশ্লিষ্ট তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়া সম্ভব। কিন্তু যেকোনো অজানা কারণেই হোক, বিভিন্ন সময় দেখা গেছে রাজনৈতিক সরকার এবং সরকার কর্তৃক দুর্নীতি নির্মূলে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণে অনীহ বা কালক্ষেপণের মাধ্যমে বিষয়টি এড়িয়ে চলার প্রবণতা।
আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের জীবনযাপন মান ও জীবনযাপন ব্যয় বিবেচনায় সাংবিধানিক ও সরকারি পদে আসীন ব্যক্তিদের অষ্টম বেতন স্কেল ঘোষণা পরবর্তী যে হারে বেতন, ভাতা ও সুবিধাদি দেয়া হয়ে আসছে তাতে যেকোনো পদধারীর মধ্যে দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার ভাবনা জাগ্রত হওয়া অনুচিত। এ বেতন স্কেল বাস্তবায়ন-পরবর্তী সরকারের শীর্ষ নির্বাহী গর্বভরে শতকরা ১২৩ ভাগ পর্যন্ত বেতন বৃদ্ধি যা পৃথিবীর কোনো দেশে সম্ভব হয়নি কথাটি বললেও যাদের উদ্দেশে তিনি গর্ব করে কথাটি বলেছিলেন তারা কি তার গর্বের যথাযথ মর্যাদা রক্ষা করতে পারছেন?
বর্তমানে সাংবিধানিক ও সরকারি পদে আসীন ব্যক্তিদের একটি বড় অংশ থেকে দেশের সাধারণ মানুষ অবৈধ প্রাপ্তির যোগ না থাকায় কাক্সিক্ষত সেবাপ্রাপ্তিতে বঞ্চিত হওয়া পরবর্তী সময়ে অনন্যোপায় হয়ে প্রাপ্তি যোগের বিনিময়ে সেবা নিচ্ছেন। এ বিষয়টি সবার জানা থাকলেও অবৈধভাবে দেয়া-নেয়া উভয়ই অপরাধ বিধায় যাদের অনেকটা বাধ্য হয়ে এ ধরনের অন্যায়ের সহযোগী হতে হয় তারা নিজেদের অপরাধ আড়াল করার জন্য এসব বিষয়ে জনসম্মুখে মুখ খুলতে অপরাগ।
সাংবিধানিক পদে নির্বাচন ও নিয়োগ এবং সরকারি পদে নিয়োগে সংবিধান ও আইনের বিধিবিধান অনুসৃত হলে সৎ ও যোগ্যদের নির্বাচিত হওয়া ও নিয়োগ লাভ সম্ভব। এর ব্যত্যয়ে যারা নির্বাচিত হন ও নিয়োগ লাভ করেন তাদের পক্ষে নীতিনৈতিকতা সমুন্নত রেখে ও নিরপেক্ষতা বজায় রেখে সৎভাবে দায়িত্ব পালন দুরূহ।
আমাদের দেশে সড়ক, মহাসড়ক, সেতু ও উড়াল সেতুর নির্মাণ ব্যয় ভারত, পাকিস্তান, চীন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র থেকে অনেক বেশি। এসব কাজে প্রাথমিক যে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়, তা দিয়ে কখনো কাজটি সম্পন্ন করা হয় না। কাজ শুরুর পরবর্তী সময়ে মাঝপথে উদ্দেশপ্রণোদিতভাবে ব্যয় বাড়ানোর পাঁয়তারায় কাজ বন্ধ করে দিয়ে ব্যয় বাড়ানোকে যৌক্তিক করার চেষ্টা করা হয়। সরকারের উন্নয়ন বাজেট থেকে এসব কাজের ব্যয় মেটানো হয়। এসব কাজের যেকোনো অতিরিক্ত ব্যয় জনগণের দেয়া করের অপব্যয়। এ ধরনের অপব্যয়ে কাজের গুণগতমান নিশ্চিতে সহায়ক না হয়ে বরং অতিরিক্ত কাজের অনুমোদন এবং তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরাসহ ঠিকাদারের জন্য অবৈধ প্রাপ্তির সুযোগ সৃষ্টি করে।
এ যাবৎকাল পর্যন্ত আমাদের দেশে বড় যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে এর কোনোটির ক্ষেত্রেই প্রাক্কলিত ব্যয়ের মাধ্যমে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্মাণকাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। এ বিষয়ে চীন, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া প্রভৃতি দেশের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে দেখা যায়, এ ধরনের কাজ নির্ধারিত সময়ের আগেই প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে কম ব্যয়ে সম্পন্ন করা হয়। আমাদের দেশের সাথে ওইসব দেশের পার্থক্য হলো সেখানে আইনের শাসন ও সুশাসন থাকায় প্রতিটি পর্যায়ে জবাবদিহিতা রয়েছে, যা দুর্নীতি রোধে ব্যাপকভাবে কার্যকর। আর আমাদের দেশে আইনের শাসন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার ব্যর্থতায় জবাবদিহিতার যে অনুপস্থিতি তার ফলে সব পর্যায়ে দুর্নীতি আজ সর্বগ্রাসী।
আমাদের দেশে ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিবিদেরা সীমাহীন ক্ষমতা ভোগ করে থাকেন। এ সীমাহীন ক্ষমতার কারণে তারা কোনো ধরনের দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ত হলেও সেটিকে আমলে নেয়া হয় না। রাজনীতিবিদদের এ সীমাহীন ক্ষমতার কারণে একশ্রেণীর ব্যবসায়ীর মধ্যে ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে অবৈধভাবে বিত্তবৈভবের বলয় বাড়ানোর উন্মত্ত প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়ার প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
আমাদের দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় উদ্যোক্তা পরিচালকেরা যে পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছেন এসব ব্যাংক থেকে তাদের গৃহীত ঋণের পরিমাণ, তাদের বিনিয়োজিত অর্থের পাঁচ-ছয় গুণ বেশি। এসব বেসরকারি ব্যাংকের উদ্যোক্তা পরিচালকেরা ব্যাংকের সামগ্রিক জমা অর্থের শতকরা আড়াই ভাগের মালিক হয়ে কী করে ব্যাংকের পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত, তা ব্যাংকগুলোর সাধারণ গ্রাহক যারা সামগ্রিক জমা অর্থের শতকরা সাড়ে সাতানব্বই ভাগের মালিক তাদের ভাবিয়ে তোলে। দেশের স্বনামধন্য কয়েকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণালব্ধ তথ্য মতে জানা যায়, ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত বা ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের আশীর্বাদপুুুষ্ট যেসব বড় ধরনের ব্যবসায়ী রয়েছেন এদের প্রত্যেকের দেশে যে সম্পদ রয়েছে তার চেয়ে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে তাদের ঋণের পরিমাণ কয়েক গুণ অধিক। এসব ব্যবসায়ী ঋণের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে যে অর্থ তোলেন, এর একটি অংশ তারা বিদেশে পাচারের মাধ্যমে সেখানে নিজ ও পরিবারের জন্য সুখের নীড় গড়ে তোলে, যা ক্ষমতার পালাবদলে তাদের সাময়িক প্রশান্তির আশ্রয়স্থল।
রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের একটির সাবেক প্রধান নিকট অতীতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেয়ার সময় দেশে যে আইনের শাসন নেই এ কথা যেমন ব্যক্ত করেছেন; পাশাপাশি এটাও বলেছেন, উন্নয়ন প্রকল্পের চল্লিশ ভাগ কাজ হয় আর বাকি ষাট ভাগ নিয়ে দুর্নীতি হয়। যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্প চল্লিশ ভাগ ব্যয় বরাদ্দ দিয়ে সম্পন্ন করা হলে তা কখনো টেকসই ও কাক্সিক্ষত মানের হবে না। এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণ অর্থ স্রেফ জনগণের দেয়া করের অর্থের অপচয়। আর তাই দেশের জনসাধারণের প্রশ্ন, প্রকল্পে প্রাক্কলিত ব্যয়ের চেয়ে দুর্নীতির অংশ অধিক এ ধরনের প্রকল্প কেনইবা গ্রহণ এবং কেনইবা প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের দুর্নীতিলব্ধ অর্থ উপার্জনের সুযোগ দান। আজ দেশের সর্বত্র দুর্নীতির যে বিস্তৃতি, এর মূলে রয়েছে সরকার পরিচালনায় গণতান্ত্রিক শাসনের অনুপস্থিতি। গণতন্ত্রের এ ধরনের অনুপস্থিতি আইনের শাসন ও সুশাসনকে দুর্বল করে দেয়। আর আইনের শাসন ও সুশাসন দুর্বল অর্থ জবাবদিহিতাবিহীন দুর্নীতিতে নিমজ্জিত একটি শাসকশ্রেণী।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা