০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`


আদালত প্রাঙ্গণেও নিরাপত্তা নেই

আদালত প্রাঙ্গণেও নিরাপত্তা নেই - ছবি : নয়া দিগন্ত

দৈনিক আমার দেশের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সীমাহীন নিগ্রহের শিকার মাহমুদুর রহমান কুষ্টিয়ার একটি আদালতে মানহানির মামলায় জামিন নিতে গিয়েছিলেন গত ২২ জুলাই। আদালত যথারীতি তার জামিন মঞ্জুরও করেছিলেন। কিন্তু আদালত থেকে বের হয়ে আসার সময় পুলিশের সামনে ছাত্রলীগ-যুবলীগের সোনার ছেলেরা মাহমুদুর রহমানের ওপর লাঠি, হকি স্টিক, রড নিয়ে হামলা চালায়। আর সমস্ত ঘটনাই ঘটে পুলিশের সামনে। ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা যখন রড, হকি স্টিক ও লাঠি নিয়ে মাহমুদুর রহমানের ওপর হামলা করে, তখন সদর থানার ওসির উপস্থিতি ছিল। তখন বিপুল পুলিশ সেখানে নীরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। পরে রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে যশোর হয়ে ঢাকা নিয়ে আসা হয়। ঢাকায় এসে তিনি গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি হন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ভাগ্নি টিউলিপ সিদ্দিককে কটূক্তি করার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে এই মানহানির মামলাটি দায়ের করে কুষ্টিয়ার ছাত্রলীগ সভাপতি। জামিন-শুনানিকে ঘিরে সকাল থেকে ছাত্রলীগের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী আদালত এলাকায় অবস্থান নেয়। ছাত্রলীগের মহড়ায় জামিন পাওয়ার পরও নিরাপত্তা শঙ্কায় মাহমুদুর রহমান বিচারকের অনুমতি নিয়ে আদালত প্রাঙ্গণে প্রায় সাড়ে ৪ ঘণ্টা অবস্থান করেন। পরে ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশেই পুলিশ নিরাপত্তা দিতে এলে মাহমুদুর রহমান এজলাস থেকে বের হন এবং হামলার শিকার হন। এ সময় পুলিশ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে। হামলার বর্ণনা দিয়ে মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘প্রথমে ম্যাজিস্ট্রেট আমাদের বললেন, আপনারা আমার এজলাসে আশ্রয় নেন। সাড়ে ৩টা পর্যন্ত আমরা এজলাসে বসা ছিলাম। ম্যাজিস্ট্রেট বললেন, আমি র‌্যাব স্কোয়াডের ব্যবস্থা করছি। সাড়ে ৪টার দিকে কোর্ট ওসি বললেন, এই গাড়িতে করেই আপনি চলে যান। তাদের একটি গাড়িতে আমাদের উঠিয়ে দেয়া হলো। গাড়িতে ওঠার দুই মিনিটের মধ্যে ৪০ থেকে ৫০ জন বড় বড় পাথর, লাঠি, দা দিয়ে হামলা করে। গাড়ির কাচ ভেঙে আমার মাথায় ৩-৪টা পাথর দিয়ে আঘাত করে। তারপর লাঠি দিয়ে আঘাত করে। আমি যত দূর পারি ঠেকানোর চেষ্টা করেছি। আমি গাড়ি থেকে নেমে এক আইনজীবীর চেম্বারে আশ্রয় নিই। এর আধা ঘণ্টা পরে পুলিশ আসে।’

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আদালতে হাজির হওয়ার পর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এম এম মোর্শেদের আদালত মাহমুদুর রহমানের জামিন মঞ্জুর করেন। পৌনে ১২টার দিকে আদালত থেকে বের হতে গেলে ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতার তোপের মুখে আদালতের বারান্দায় দাঁড়িয়ে যান তিনি। এ সময় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে নানা ধরনের স্লোগান দিতে থাকে। তারা মাহমুদুর রহমানকে বহন করা গাড়ি আদালত চত্বরে ঢুকতে বাধা দেয়। মাহমুদুর রহমান তখন সেখানে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, আমার লড়াই বাংলাদেশের মিডিয়ার স্বাধীনতার জন্য। আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে। এরপর কুষ্টিয়ার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে আশ্রয় নেন তিনি। ২০ মিনিট পর সেখান থেকে বেরিয়ে আবার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গিয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে নিরাপত্তার আবেদন করেন।

এ সময় মামলার বাদি কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ইয়াসির আরাফাত তুষার ও সম্পাদক সাদ আহমেদের নেতাকর্মীরা এজলাসের বারান্দায় আশ্রয় নেয়। নিরাপত্তা আবেদনের আদেশের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন মাহমুদুর রহমান। বিকেল ৪-২০ মিনিটের দিকে কোর্ট ইন্সপেক্টর মনিরুজ্জামান এজলাসে এসে মাহমুদুর রহমানকে বলেন, আপনার গাড়িতে বের হতে পারবেন না। আসুন, অন্য গাড়িতে আপনাকে তুলে দিই। এরপর আদালতের বারান্দা থেকে নেমে গাড়িতে ওঠেন তিনি। ১৫ ফুট যাওয়ার পরই তাকে বহনকারী প্রাইভেট কারে ইট ছুড়ে হামলা করে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এ সময় পাশে চায়ের দোকানে ছয়-সাতজন পুলিশ বসে ছিল। তখন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা ছুটে এলে পিছু হটে হামলাকারীরা। এরপর সেখান থেকে ৪০-৫০ ফুট এগিয়ে আবার হামলার শিকার হয় মাহমুদুর রহমানকে বহনকারী গাড়ি। এ সময় গাড়িতে রড, ইট ও হকি স্টিক নিয়ে হামলা করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তারা গাড়ির কাচ ভেঙে মাহমুদুর রহমানকে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করে। সে সময় তারা ড্রাইভার ও আরোহী আরো এক আইনজীবীকেও মারধর করে। পরে আইনজীবীরা তাকে উদ্ধার করে মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শামস তামিম মুক্তির চেম্বারে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন। তখন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ওই চেম্বারের দরজা-জানালায় ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। হামলাকারীদের বেশ কয়েকজনের মুখ গামছা দিয়ে বাঁধা ছিল। বাকিদের মুখ খোলাই ছিল।

হামলার পর রক্তাক্ত অবস্থায় আদালতের বারান্দায় বসে মাহমুদুর রহমান হামলার প্রতিবাদ করেন। এখানে প্রয়োজনে জীবন দেবো। দেশের জন্য, ইসলামের জন্য জীবন দেবো। আদালতের ভেতর হামলার জন্য পুলিশকে দোষারোপ করে তিনি বলেন, নিরাপত্তা দেয়ার কথা বলে পুলিশ আমাকে তাদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে। পরিকল্পিতভাবে আমার ওপর হামলা হয়েছে। এর জন্য একদিন তাদেরও আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। এ সময় সদর থানার ওসি নাসিরুদ্দিন তাকে বিবৃতি দেয়া থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করলে তিনি নাসিরকে বলেন, হামলার সময় কোথায় ছিলেন? আপনারা আমাকে মার খাওয়ালেন। হাসপাতালেও নিয়ে যাচ্ছেন না। আমার সারা মুখ থেকে রক্ত ঝরছে। আমি যন্ত্রণায় দাঁড়াতে পারছি না। পরে বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে অ্যাম্বুলেন্সে করে যশোরের দিকে রওনা দেন মাহমুদুর রহমান।

এত বড় ঘটনা, এরপরও বড় হাস্যকর উক্তি করলেন কোর্ট ইন্সপেক্টর মনিরুজ্জামান। তিনি জানান, জামিনপ্রাপ্ত আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বেলা সাড়ে ১১টা থেকেই আদালত ভবনে অবরুদ্ধ ছিলেন। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে তিনি সেখান থেকে বের হয়ে গাড়িতে করে যাওয়ার সময় কে বা কারা হামলা চালিয়ে তাকে রক্তাক্ত ও জখম করে। মামলার বাদি ইয়াসির আরাফাত তুষার জানান, আমি মামলার বাদি হিসেবে কোর্টে গিয়েছি। এ সময় কেউ যদি কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার শিকার হন, তার জন্য তো আমি দায়ী নই। এ মামলার বিবাদির ওপর কে বা কারা হামলা করেছে সেটাও আমি জানি না। এরপর মাহমুদুর রহমান যশোর বিমানবন্দরে পৌঁছলে সেখানকার অতিথি কক্ষে ডাক্তাররা তাকে চিকিৎসা দেন। এরপর নভোএয়ারের একটি বিমানে করে তিনি ঢাকায় আসেন।

ঢাকায় এসে মাহমুদুর রহমান বিমানবন্দরে উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশি পাহারায় চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা চালিয়েছে। তিনি আদালতের কাছে নিরাপত্তা চেয়ে লিখিত আবেদন করলে আদালত কুষ্টিয়ার সদর থানার ওসিকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেন; কিন্তু কোর্টের সেই নির্দেশনা পুলিশ পালন করেনি। ফলে এ ঘটনার পর থেকে তিনি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত আদালতগুলোতে মামলায় হাজিরা দিতে যাবেন কি না তা নিয়ে ভাবতে হবে।

এই সরকারের আমলে সাংবাদিকদের ওপর যে নিগ্রহ হয়েছে, তা অন্য সব সময়ের নিগ্রহকে হার মানিয়েছে। সাংবাদিক নির্যাতন, সাংবাদিক হত্যা, সাংবাদিকের নামে ভুয়া মামলা দায়ের প্রভৃতি ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া বন্ধের ক্ষেত্রেও এই সরকার চ্যাম্পিয়ন। তারা দিগন্ত টিভি বন্ধ করেছে। ইসলামিক টিভি বন্ধ করেছে। ইটিভির মালিকানা কেড়ে নিয়েছে। দৈনিক আমার দেশ বন্ধ করেছে। আর ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী নিজ মুখে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, এসব টিভির লাইসেন্স আমি দিয়েছি। যে দিতে পারে সে নিতেও পারে। অর্থাৎ কথামতো না চললে, তাদের লাইসেন্সগুলো বাতিল করে দেয়া হবে এবং আশ্চর্য ঘটনা এই যে, এর ফলে সমাজে যা কিছু ঘটছে, যে দুর্নীতি-অনাচার হচ্ছে, ইলেকট্রনিক মিডিয়া সে ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকাকেই বেহতর মনে করছে।

কিন্তু প্রযুক্তির বিকাশের ফলে কোনো কিছুই গোপন থাকছে না। ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে সরকারের দুর্নীতির খবর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। সত্য কথা বলায় মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে। এখন আসছে তথ্যপ্রযুক্তি আইন। যে আইন বলে সাংবাদিকের মুখ-চোখ বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। কলম বা ল্যাপটপ ভোঁতা করে দেয়া হচ্ছে। নো এক্সক্লুসিভ। কোনো কিছুই জনসমক্ষে প্রকাশ করা যাবে না। এ এক আজব হীরক রাজার দেশ।

১৯৭২-৭৫ সালে আওয়ামী লীগের শাসনকালে আমরা প্রায় একই রকম পরিস্থিতি দেখেছিলাম। সে সরকার সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। দৈনিক গণকণ্ঠ, সাপ্তাহিক হলিডে, স্পোক্স্ম্যান, মুখপত্র, ইস্টার্ন এক্সামিনার পত্রিকা প্রাথমিকভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। তারপর ১৯৭৫ সালের ১৬ জুন এক অধ্যাদেশ জারি করে মাত্র চারটি সংবাদপত্র নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে বাকি সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এখন বন্ধ হচ্ছে কম, নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে অনেক বেশি। সাংবাদিকদের মধ্যে ঐক্যের অভাব। কেউ সরকারবিরোধী, কেউ বা সরকারের দালাল। কোনো ইস্যুতেই তারা যেন এক হতে পারছে না। কিন্তু ইতিহাসের নির্মম সত্য এই যে, আজ সরকার সমর্থকেরা সরকারের যে কালাকানুন অনুমোদন করছেন, আগামী কোনো একদিন সেই খড়গই তাদের ওপর নেমে আসতে পারে।

এর মধ্যে কতগুলো নষ্ট উক্তিও আমরা শুনেছি। তার মধ্যে বাচাল আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, মাহমুদুর রহমানের ওপর ছাত্রলীগ হামলা চালায়নি। হামলা করেছে বিএনপি-জামায়াতের কর্মী-সমর্থকেরা। মিথ্যাচারের একটা সীমা থাকে। আমাদের মন্ত্রীদের মিথ্যাচারের মাত্রা এ রকমই। তাদের মধ্যে কোনো বিবেকবোধ কাজ করতে দেখি না। আনিসুল হক যা বলেছেন, কুষ্টিয়ার জেলা ছাত্রলীগ সভাপতিও তা-ই বলেছেন। অথচ সাক্ষ্য হচ্ছে এই যে, মাহমুদুর রহমানের ওপর এই হামলায় তুষারও উপস্থিত ছিলেন। মন্ত্রীরা আর কত নিচে নামবেন? তবে দেশের বিশিষ্ট জনেরা দাবি করেছেন, আদালত প্রাঙ্গণে কারো ওপর হামলা আদালত অবমাননারই শামিল। সুতরাং আদালতের কাছে প্রার্থনা এই যে, তারা যেন সুয়োমোটোভাবে আদালতের ভেতরে কারো ওপর হামলার ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দেন। সেটি না হলে, আদালতের প্রতি মানুষের ক্ষীয়মাণ আস্থা আরো নষ্ট হয়ে যাবে।

ফেসবুকে দেখলাম, মাহমুদুর রহমানকে নিয়ে কোনো কোনো পাঠক ইতর মন্তব্য করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন, এইটুকু রক্ত ঝরাতে মাহমুদুর রহমানের পাপ শোধ হয়নি। কিন্তু কেউ বলেননি, কী তার পাপ! সরকারের জুলুম, নির্যাতন, দুর্নীতি, মিথ্যাচার- এগুলো জনসমক্ষে তুলে ধরাই কি তার পাপ? না হলে, তারা কেন এসব কথা বলবেন! তবে তারা দু-একজন। হাজারো মানুষ মাহমুদুর রহমানের ওপর এই হামলার তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে। আমরাও ধিক্কার জানাই। আর মহান আল্লাহ তায়ালার কাছে দ্রুত তার আরোগ্য কামনা করি। সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement