৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


নজরুল-কাব্যে ঈদ

-

নজরুল ইসলামের কাব্য ও গানের বেশির ভাগই ইসলামী। ঈদুল ফিতর মুসলিম চেতনার যে জাগরণের উদ্বোধন করে নজরুল ইসলাম তাকে উজ্জীবিত করেছে পথ চলার নির্দেশনামা হিসেবে। এক মাস সিয়াম সাধনার মধ্য দিয়ে সিয়াম সাধক আত্মশুদ্ধি ও আত্মসংযমের প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণ লাভ করে তার মূল সূর হচ্ছে আল্লাহর জমিন আল্লাহর জমিন আল্লাহর সার্বভৌমত্বের অধীন সবাই সমান মর্যাদার অধিকারী। কেউ খাবে আর কেউ খাবে না- এ অবস্থার অবসানকল্পে এবং মানবতাকে সমুন্নত করার দৃঢ় প্রত্যয় সৃষ্টির চেতনা যে রমজান মাসের সিয়াম সাধনা প্রদান করে তা যদি সিয়াম উত্তরকালে বিস্মৃতির অতলে ডুবে না যায় সেজন্য শপথের দিন হিসেবে এবং গরিব, সর্বহারা ও অবহেলিত মানুষকে কাছে টেনে নেয়ার প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণের দিন হচ্ছে ঈদুল ফিতর। নজরুল ইসলামের কবিতায় ঈদুল ফিতরে মূল সুর ঝংকৃত হয়েছে এক কালজয়ী ছন্দের ব্যঞ্জনায়; জীবনে জিজ্ঞাসার পরতে পরতে বিদ্রোহের আগুন ঝরা বাণীর উচ্চারণে তিনি ঈদের চাঁদ শীর্ষক কবিতায় বলেন :
সিঁড়িওয়ালাদের দুয়ারে এসেছে আজ চাষা মজুর ও বিড়িওয়ালা/মোদের হিস্সা আদায় করিতে ঈদে দিলে হুকুম আল্লা তায়ালা।... আনিয়াছে নবযুগের বারতা নতুন ঈদের চাঁদ/শুনেছি খোদার হুকুম, ভাঙিয়া গিয়াছে ভয়ের বাঁধ।

ওই একই কবিতায় বিদ্রোহের মাত্রা তুঙ্গে তুলে কবি জোরালো শব্দ বিন্যাসে মর্দে মুমিনের দৃঢ়তার মাথা উঁচু করে আপন অভিব্যক্তি ব্যক্ত করেছেন এভাবে : আমার ঋণ শোধ কর, যদি বাঁচিবার থাকে সাধ, আমারে বাঁকা ছুরি আঁকা দেখ আকাশে ঈদের চাঁদ। ঈদের চাঁদকে কবি বিপ্লবের প্রতীক, বিদ্রোহের প্রতীক, দাবি আদায়ের মোক্ষম হাতিয়ার এবং খালেদের তলোয়ার ইত্যাদি নানা আখ্যায় আখ্যায়িত করেছেন যুক্তির দৃঢ় গাঁথুনি দ্বারা এবং ছন্দের উচ্ছল ঝংকারে তা হয়েছে সর্বজনগ্রাহী। কবি বলেন : ভেবো না ভিক্ষা চাহি মোরা, নহে শিক্ষা এ আল্লার, মোরা প্রতিষ্ঠা করতে এসেছি আল্লাহ অধিকার এসেছে ঈদের চাঁদ বরাবর দিতে আমাদের ভয়ে, আবার খালেদ এসেছে আকাশে বাঁকা তলোয়ার লয়ে। আসলে নজরুল ইসলাম ইসলামের প্রকৃত মানবিক মূল্যবোধের প্রেরণায় উদ্ভাসিত ছিলেন। তিনি আলোর সন্ধান লাভ করেছিলেন হৃদয়ের গভীর কন্দরে লুক্কায়িত অনুভবের স্পন্দন দ্বারা। যে কারণে গরিবের কথা সর্বহারার কথা, খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের কথা, বঞ্চিত ও লাঞ্ছিত মানুষের কথা তিনি তাদের হয়ে, তাদের পক্ষে তাদের ভাষায় কথা বলেছেন। কবি তাদের সঙ্গে মিশে গেছেন, শামিল হয়েছেন সর্বহারার কাতারে, মিছিলে। তিনি সর্বত্র ইসলামী চেতনা দিয়ে জাগাতে চেয়েছিলেন মানুষকে। অধিকারহীন অধিকার আদায়ের জন্য, বঞ্চিতদের বঞ্চনার মূলে কুঠারাঘাত হানার জন্য তিনি শব্দের ঋজুতায় আহ্বান জানিয়েছেন। ঈদের চাঁদকে তিনি তাই অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ব্যবস্থা জাকাত আদায়ের বাণী বাহক হিসেবে তুলে ধরেছেন তার একাধিক কবিতায়। ঈদের চাঁদ কবিতায় কবি কলেন : ‘ডাকাত এসেছে জাকাত লইতে, খোলো বাক্সের চাবি, আমাদের নহে, আল্লার দেওয়া ইহা মানুষের দাবি।’
আবার জাকাত লইতে এসেছে ডাকাত চাঁদ শীর্ষক কবিতায় তিনি আরো দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন : জাকাত লইতে আসমানে এলো আবার ডাকাত চাঁদ গরিব কাঙাল হাত পাত, ধনী রইস মরাই বাঁধ। এই কবিতায় কবি ঈদের চাঁদকে আলীর জুলফিকার বেলালের রাঙা হাসি, খালেদ, মুসা, তারেকের তেগ ইত্যাদি নানা রূপক আমেজ মেখে জাতি উজ্জীবিত করার প্রয়াস পেয়েছেন। আবার তাকে হৃদয়ের উষ্ণতায় উত্তপ্ত করে অন্যভাবেই উপস্থাপন করেছেন :
এইবার বুঝি ধুলির ধরার তুমি বুলাইয়া তার আনিবে রুপালি বিভব, সোনালি শস্যের সম্ভার উপসী চিত্তে কোন রূপসীর লাগিবে এবার ছোঁয়া কার সুরমার পরশে হইবে বিলীন চোখের ধোঁয়া। চাঁদ নয় ও যে কমলা লেবুর কোয়া তুষিতের তরে একটি নিমেষ, তবুও বসনা উঠিবে ও রসে ভরে।
ক্ষণিক আনন্দের বারতা নিয়ে তো ঈদের চাঁদের আগমনের কথা নয়। কিন্তু অনুষ্ঠানসর্বস্ব হয়ে ওঠে ঈদের আনন্দ। ঈদের চাঁদ যে সর্বাধুনিক সুখ ও সমৃদ্ধির, সাম্য ও সৌহার্দ্যরে, ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বের বারতা নিয়ে আছে তা ঈদের দিনের শেষে যেন সবাই ভুলে যায়। কবি বলেন :
তারপর সেই চিরচেনা দুঃখ শোক দরিদ্র ব্যাধি, উননে শূন্য হাঁড়ি ক্ষুধাতুর ছেলেমেয়ে ওঠে কাঁদি কবি এই আনন্দ অভিনয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। তিনি জানতে চেয়েছেন ঈদের চাঁদের কাছেই সেকি গরিব দূর করার কোনো কার্যকরী কৌশল বয়ে নিয়ে এসেছে। নইলে তো তার মহামিলনের আহ্বান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। কবি বলেন :

জাকাত লইতে ডাকাতি করিতে এসেছে ঈদের চাঁদ? এনেছে কি সখা হাতে হিক্মতী লুট করিবার ফাঁদ? কবি অন্যত্র অধিকার আদায়ের জন্য উচ্চ-গ্রাম-কণ্ঠে সোচ্চার হয়ে বলেছেন :
প্রজারাই রোজ রোজা রাখিয়াছে আজীবন উপবাসী,/তাহাদেরই তার এই রহমত, ঈদের চাঁদের হাসি। শুধু প্রজাদের জমায়েত হবে আজিকার ঈদগাহে, কাহার সাধ্য, কোন ভোগী রাক্ষস সেথা যেতে চাহে? (ঈদের চাঁদ)
কবি ঈদকে আপন বৈভবমণ্ডিত, সৌরভমণ্ডিত সৌকর্যে দেখেছেন। সেখানে ঈদের সর্বজনীন আনন্দ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পরিস্ফুটিত হয়েছে ঈদের আনন্দের প্রকৃত সুরভি যা নজরুল ইসলামের দ্বারাই কেবল সম্ভব হয়েছে। ঈদের বেদনামাখা আকুতিও তিনি যেমন তুলে ধরেছেন একই সঙ্গে ঈদের সর্বজনীন খুশির প্রতিধ্বনি ধ্বনিত হচ্ছে এক অপরূপ অনুভবের সুর ও ঝংকারে :
ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ/তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানি তাকিদ।/তোর সোনাদানা বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ,/যে জাকাত, মুর্দ্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিদ। (জুলফিকার)
নজরুল ইসলামের ওই বাণীর সুর যেন ঈদের চিরকালীন আমেজ মেখে এক সর্বকালীন বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছি। ঈদুল ফিতর নিয়েই কবির কবিতা ও গানের সংখ্যা ষোলোটিরও বেশি। অধিকাংশের আবেদন ও অভিব্যক্তি মানবিক মূল্যরোধের উৎকর্ষ সাধন। আর যে কারণে নিরঙ্কুশ বিদ্রোহ ও সত্য কথনের সৌন্দর্য ও সুষমা লালিত্যে মণ্ডিত হয়ে নজরুল ইসলামের কাব্য ঈদুল ফিতর এসেছে। মুসলিমের তৌহিদী চেতনা সেখানে আরো বুলন্দ হয়েছে এবং তার আকিদা আরো দুরস্ত হয়েছে।
রোজা রাখার ফল ফলেছে, দেখরে ঈদের চাঁদ,/সেহ্রী খেয়ে কাটল রোজা, আজ সেহেরা বাঁধ,/ও রে বাঁধ আমামা বাঁধ, এ প্রমাশ্রুতে ওজু করে চল্ ঈদগাহ মসজিদ। কিম্বা এলো আবার ঈদ ফিরে এল আবার ঈদ, চল ঈদে গাহে। যাহার আশায় চোখে মোদের ছিল নারে নিদ, চল ঈদ্ গাহে...
এসবের মধ্যেই ঈদের সজীবতায় প্রস্ফুটিত আনন্দের অন্তর্নিহিত দিন ফুটে উঠেছে। ঈদ হচ্ছে মুসলমানদের জাতীয় উৎসব। এটাকে সর্ববৃহৎ সর্বজনীন উৎসবও বলা হয়। কারণ এর পটভূমিতে রমজানের এক মাস কৃচ্ছ্রতা সাধনার এক মহাপরীক্ষায় সিয়াম সাধককে উত্তীর্ণ হতে হয়েছে। আর সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জাগতিক পুরস্কার ঈদুল ফিতর।


আরো সংবাদ



premium cement