৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


পানিফল

পানিফল -

নদীমাতৃক দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। এ দেশের নদীনালার জলের সাথে যেমন আমাদের জীবন জড়িয়ে আছে তেমনি এ দেশের খাল-বিলের অগভীর জলের বিভিন্ন উদ্ভিদ ও ফলও আমাদের জীবন ও জীবিকার সাথে জড়িয়ে আছে। অগভীর স্থির স্রোতহীন জলে জন্মানো একটি ফল পানিফল। ফলটি হঠাৎ চোখে পড়লেই মনে হবে এটি অবিকল গরুর মাথার আকৃতির। দু’টি শিং দু’পাশে। অথবা যারা শহরে বাস করেন তাদের চোখে পড়তেই মনে পড়বে সিঙ্গাড়ার কথা। সিঙ্গাড়ার মতো ত্রিকোনাকার। দেখতে সিঙ্গাড়ার মতো বলে অনেক এলাকায় এটা সিঙ্গাড়া ফল নামেও পরিচিত। কালচে লাল বা কালচে নীল সবুজের সংমিশ্রণের এই ফলটি শীতের শুরুতে বাজারে উঠতে শুরু করে। বাংলাদেশের গ্রামীণ ঐতিহ্যের একটা অংশ পানিফল। একটি সময় শাপলা শালুকের মতো এই ফলও খাবারের অংশ হিসেবে নদীকেন্দ্রিক মানুষের কাছে জনপ্রিয় ছিল। এর উপরের অংশ বেশ শক্ত। উপরের খোসা ছাড়ালে ভেতরে নরম অংশ পাওয়া যায়। এই নরম অংশ বা শাঁস খাওয়া হয়। ফলটি ভালো পাকলে অনেকটা মিষ্টি ও বাদামের মতো স্বাদ হয় খেতে। তখন এর গায়ের রঙও পরিবর্তন হয় আর কম পাকলে গায়ের রঙ সবুজ থাকে এবং খেতে বেশ পানসেমিষ্টি লাগে। খেতে বাদামের মতো স্বাদ বলে অনেক এলাকায় একে পানির বাদামও বলে। পানিফল সিদ্ধ করে, রান্না করে কিংবা প্রক্রিয়াজাত করেও খাওয়া যায়। চীনে বিভিন্ন সবজির সাথে মিশিয়ে সবজি রান্না করা হয়। চীনের খাদ্য তালিকায় পানিফল বেশ জনপ্রিয় ও আবশ্যকীয়। চীনারা পানিফলকে শুকিয়ে আটা তৈরি করেন। সে আটা দিয়ে তারা পিঠা কেক বিস্কুট তৈরি করে খায়, বাজারে বিক্রি করে। কোথাও কোথাও আবার পানিফল গোখাদ্য হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। শীতের শুষ্কতায় এই পানিফল শরীরের জন্য বেশ উপকারী। শরীরের অনেকটা পানির স্বল্পতা পূরণ করে এই অবহেলিত কম দামি ফলটি। যথেষ্ট পুষ্টিগুণ থাকা সত্ত্বেও বাজারের ফলের দোকানে তেমন কদর বাড়েনি এই ফলের। ফুটপাথের হকারদের কাছে বা মহল্লার ভ্যানগাড়িতে করে বিক্রি করতে দেখা যায়। অথচ অন্য ফলের মতো এ ফলেরও আছে বেশ পুষ্টিগুণ। প্রায় ৯০ শতাংশ কার্বোহাইড্রেড, ৬০ শতাংশ শর্করা আছে। তা ছাড়া বেশ ভালো পরিমাণ আঁশ, রাইবোফ্লেবিন, ভিটামিন বি, পটাসিয়াম, কপার, ম্যাঙ্গানিজ, আমিষ, ভিটামিন আছে। পুষ্টিমানের বিবেচনায় পানিফলে খাদ্যশক্তি আছে ৬৫ কিলোক্যালরি, জলীয় অংশ ৮৪.৯ গ্রাম, খনিজপদার্থ ০.৯ গ্রাম, খাদ্যআঁশ ১.৬ গ্রাম, আমিষ ২.৫ গ্রাম, চর্বি ০.৯ গ্রাম, শর্করা ১১.৭ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ১০ মিলিগ্রাম, আয়রন ০.৮ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি১ ০.১৮ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি২ ০.০৫ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি ১৫ মিলিগ্রাম। পানিফলের শুধু খাদ্যগুণই নয় রয়েছে ঔষধি গুণও। পানিফলের শাঁস শুকিয়ে রুটি বানিয়ে খেলে অ্যালার্জি ও হাত পা ফোলা রোগ কমে যায়। উদরাময় ও তলপেটের ব্যথায় পানিফল খুবই উপকারী। বিছাপোকা বা অন্যান্য পোকায় কামড়ালে পানিফল বেটে লাগালে ব্যথা ও জ্বালা দ্রুত দূর হয়। কাঁচা পানিফল বলকারক, দুর্বল ও অসুস্থ মানুষের জন্য সহজপাচ্য খাবার। পানিফলে শর্করা ও প্রোটিন আছে যথেষ্ট। শাঁস শুকিয়ে রেখে খাওয়া যায়। পুষ্টিগুণে ভরা এই জলজ উদ্ভিদটির ইংরেজি নাম ডধঃবৎ পযবংঃহঁঃ। তবে স্থানভেদে ডধঃবৎ পধষঃৎড়ঢ়, ইঁভভধষড় হঁঃ, উবারষ চড়ফ নামেও পরিচিত। পানিফলের বৈজ্ঞানিক নাম ঞৎধঢ়ধ হধঃধহং। পানিফলের আদি নিবাস ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকা হলেও এর প্রথম দেখা পাওয়া যায় উত্তর আমেরিকায়। অথচ যুক্তরাষ্ট্রেরই বেশ কিছু জায়গায় পানিফলের গাছকে আগাছা হিসেবে গণ্য করা হয়! জানা যায় যে প্রায় ৩০০০ বছর পূর্বে চীনে পানিফলের চাষ হতো। এটি একটি বর্ষজীবী জলজ উদ্ভিদ। বেশ কয়েকটি প্রজাতির আছে। ফল থেকে বংশবিস্তার হয়। পানিফলের গাছ ৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। গাছের শিকড় থাকে পানির নিচে কাদার মধ্যে আর পাতা ফুল ও ফল ভাসে পানির উপরে। পাতা গোলাকার বিপরীতমুখীভাবে কাণ্ডের ওপর সাজানো থাকে।
পাতা অনেকটা কচুরিপানা পাতার মতো দেখতে তবে ছোট ও পুরু, গাঢ় সবুজ। পাতায় শিরা তেমন চোখে পড়ে না মাংসল ভাবের জন্য। কাণ্ড নলাকার দড়ির মতো বা পেনসিলের মতো মোটা হয়। গাছ ৫ মিটার গভীর পর্যন্ত পানিতে বেঁচে থাকতে পারে। পানি ফলের ৪ পাপড়ির ছোট ছোট ফুলগুলো খুবই মনোমুগ্ধকর। আগাম লাগালে প্রতি গাছে ১০ থেকে ১২টি শাখা হয়। আর দেরিতে লাগালে প্রতি গাছে ছয় থেকে সাতটি শাখা হয়। তবে ফুল আসার আগ পর্যন্ত এর বৃদ্ধি চলতে থাকে। দেরিতে আসা শাখার ফল একটু ছোট ও দুর্বল হয়। জুন-জুলাই মাসে এর চারা রোপণ করা হয় এবং অক্টোবরের শেষের দিকে ফল তোলার উপযুক্ত হয়। খুব সম্ভাবনাময় একটি ফল। বাণিজ্যিকভাবে চাষ ও বাজারজাত করলে এটি মানুষের খবার ফলের তালিকায় উপযুক্ত মর্যাদা পাবে নিশ্চয়ই।


আরো সংবাদ



premium cement