২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`
দেড় যুগ পূর্তি উৎসব

জীবনের বড় সাক্ষী

-

অমর কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ জীবনের মাহেন্দ্রক্ষণে প্যারিসে এসেছিলেন। এক দশকের কিছু বেশি সময় অতিবাহিত করে সেখানে দেহরক্ষা করেছিলেন। তার সে জীবনের বড় সাক্ষীদের মধ্যে আমি একজন। সম্ভবত সেবার তৃতীয়বার তিনি প্যারিসে এসেছিলেন, ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর মাসে। আমি মাত্র দু’মাস আগে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য বৃত্তি নিয়ে সেই প্রখ্যাত নগরীতে এসে হাজির। এক বিশেষ প্রয়োজনে দূতাবাসে গিয়ে জানলাম তিনি সেখানে উপস্থিত। প্রথম পরিচয় এবং দীর্ঘ আলাপ হলো অত্যন্ত আন্তরিক।

এরপর ১৯৬১ সালের প্রথম দিকে সপরিবারে তিনি এলেন। তার স্ত্রী ফরাসি, আনমারি থিবো ও তিন বছরের কন্যা সিমিন। কয়েক বছর পর একমাত্র পুত্রসন্তান ইরাজ জন্মগ্রহণ করে। প্রায় চার-পাঁচটি অভিজাত বাড়িতে বাস করে তিনি ১৯৬৯ সালে ম্যাজোতে একটি বাড়ি কিনে বসবাস শুরু করেন। সে সময়ে তিনি দূতাবাস ছেড়ে ইউনেস্কোর সদর দফতরে চাকরিরত।
আমরা সবাই জানি, ১৯২২ সালের ১৫ আগস্ট চট্টগ্রামে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জন্ম। তার পিতা বিচার বিভাগের কর্মকর্তা, কড়া শোক, স্নেহময়ী মা তার আট বছরে ইন্তেকাল করেন। বড় ভাই সৈয়দ নুরুউল্লাহ আজীবন ছোট ভাইয়ের দেখভাল করেছেন। অথবা ছোট ভাই করেছেন বড় ভাইয়ের। পিতার বদলির কারণে ওয়ালীউল্লাহ বাংলায় বিভিন্ন শহরে লেখাপড়া করেছেন এবং ময়মনসিংহ থেকে উচ্চ সম্মানের সাথে গ্র্যাজুয়েট হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে এমএ ক্লাসে ভর্তি হয়ে তিনি পড়াশোনা শেষ করলেন না, সাহিত্য ক্ষেত্রে সক্রিয় হলেন। তার ছোট গল্পের বই ‘নয়ন তারা’ প্রকাশিত হলো। তিনি ইংরেজি দৈনিকে ‘দ্য স্টেটসম্যান’ চাকরি নিলেন। দেশ ভাগের ফলে ঢাকা, করাচি, দিল্লি, সিডনি, জার্কাতা, ব্যাংকক ঘুরে তিনি বন (জার্মানি) দূতাবাসে থিতু হলেন এবং সেখানে থেকে প্যারিস।
ইতোমধ্যে তার উপন্যাস ‘লালসালু’ প্রকাশিত হলো। পরে মধ্য ষাটে ‘লাল সালু’র ফরাসি ও ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হলে তার খ্যাতি বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল। এ দিকে ফরাসি প্রবাসে রচিত হলো উপন্যাস ‘চাঁদের অমাবস্যা’ এবং সর্বশেষ উপন্যাস ‘কাঁদো নদী কাঁদো’। মাঝখানে নাট্য রচনায়ও তিনি অগ্রণী হলেন ‘সুড়ঙ্গ’, ‘বহ্নিপীর’ ও ‘তরঙ্গভঙ্গ’ শীর্ষক তিনটি পূর্ণাঙ্গ নাটক লিখলেন। সর্বশেষ ১৯৬৪ সালের লিখলেন একাঙ্কিকা ‘উজানে মৃত্যু’।
প্যানিসে প্রথমে বহু দিন ওয়ালীউল্লাহর বাঙালি সাহিত্য সঙ্গী হিমাখ সার্জি। প্রতি মাসে অন্তত একবার আমি তার অফিসে যেতাম। উপলক্ষ পত্রিকা পাঠ। আসলে আমার দেশ-বিদেশ ফ্রান্সের রাজনীতি ও সংস্কৃতি কোনো বিষয়ই বাদ দিতাম না।

অবশ্য এ সময়ে কিছু সময়ের জন্য সঙ্গীত শিল্পী রাজেশ্বরী দত্ত (কর্ম সুধীন্দ্র নাথ দত্তের স্ত্রী), সৈয়দ আলী আহাম্মদ, এ কে নাজমুল করিম, শওকত ওসমান, ফজেল রাব্বি, সানাউল হক, এ কে এম, আহসান, রশদি করীম প্রমুখ অনেকে আসা-যাওয়া করেছেন।
আমার সাথে আমার দুই ‘কাজিন’ ও এক বন্ধু ড. ওয়ালীউল্লাহও তাকে অনেক সঙ্গ দিয়েছেন। প্যারিসে তিনি ছাত্রদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতেন। ফ্রান্সের বিখ্যাত প্রকাশক লারুম এনসাইক্লোপেডিয়ার জন্য আমাদের সংস্কৃতি বিষয়ে কয়েকটি প্রবাদ রচনার নিমিত্তে তার কাছে এসে তিনি তা আমার কাছে পাঠিয়ে দেন। ১৯৭১ সালে তা প্রকাশিত হয়।
১৯৬৮ সালের আগস্ট মাস অবধি আমি তার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করি। শেষের ক’মাস দু’পক্ষে তার স্থলাভিষিক্ত সৈয়দ নাজমুদ্দিন হাশেম ও বুলু ভাবীর বাসায় আমরা অনেক আড্ডা দিয়েছি। এ সময়ে শিল্পী রশীদ চৌধুরীও দেশ থেকে এসে আমাদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন। অনেকে হয়তো জানেন না, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ছিলেন একজন স্বশিক্ষিত শিল্পী। তার কয়েকটি শিল্পকর্ম তার বাসভবনে সুরক্ষিত রয়েছে। আগেও দু’বছরের বেশি সময় রশীদের সাথে সৈয়দ সাহেবের গভীর অন্তরঙ্গ যোগাযোগ ছিল।

প্যারিস প্রবাসে ওয়ালীউল্লাহ অনেক কিছু আয়ত্ত করেছিলেন। ইউনেস্কোতে তিনি কিছু নতুন ধরনের কাজ শুরু করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে কিছু কর্মকর্তা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। তাতে তার কর্মচ্যুতি ঘটে। মিল্টন রোজেন খাজা নামে সাহিত্য বিভাগের এক কর্মকর্তা আমাকে বলেছেন, ‘ওয়ালী ওয়াজ এ ভিকটিম অব ইউনেস্কো’। এটি আমাদের জন্য একটি ট্র্যাজিক ঘটনা। এতদসত্ত্বে¡ও ১৯৭১ সালে সেখানে তিনি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে কর্মকাণ্ড শুরু করেন। একপর্যায়ে লন্ডন সফর করেন। ১৯ মে আমার এক পত্রের জবাবে চিঠি লিখেন। অনেক দিন পর ১০ অক্টোবর তিনি আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণত্যাগ করেন। ১৯১৭ সালে তার শ্যালিকা ফ্রঁসোয়াজসহ আমি তার কবর জিয়ারত করি।
অতি সজ্জন, সুদর্শন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ আমাদের এক বরেণ্য মহান ব্যক্তিত্ব। জন্মশতবর্ষে তার উপযুক্ত স্মরণ আমাদের বাঞ্ছনীয়।
লেখক : মাহমুদ শাহ কোরেশী (১৯৩৬), প্যারিস, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, ও গণবিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। একুশে পদক, ফরাসি শেজিওঁ দ্য এর পদকের অধিকারী বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক


আরো সংবাদ



premium cement
দুই বিভাগে বৃষ্টি হতে পারে ফ্রান্স, ব্রাজিল ও প্যারাগুয়ে সফরে যাচ্ছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী থাইল্যান্ড সফরকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে মাইলফলক বললেন প্রধানমন্ত্রী লালমনিরহাটে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশী যুবক নিহত এখনো শেষ হয়নি বিতর্কিত আউটের রেশ, ব্যতিক্রমী প্রতিবাদ মুশফিকের ‘ফ্রি ভিসার গল্প’ আর শূন্য হাতে ফেরা লাখো শ্রমিক নোয়াখালীতে প্রবাসীর স্ত্রীর ব্যক্তিগত ছবি দেখিয়ে চাঁদা আদায় দেশের উন্নয়নে পাকিস্তান প্রশংসা করে, অথচ বিরোধী দল দেখে না : কাদের আশুলিয়ায় বাঁশবাগান থেকে নারী পোশাক শ্রমিকের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার মিয়ানমারের কর্মকর্তারা ফেরত গেলেন, কিন্তু রোহিঙ্গা সঙ্কট কি আরো জটিল হচ্ছে দিনাজপুরে দুই ট্রাকের সংঘর্ষ, চালক-হেলপার নিহত

সকল