২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জ্ঞানী-গুণীদের দায়িত্ব সমাজকে সঠিক পথে রাখা

-

মানুষের অভিজ্ঞতা বলে সব সময় সম্ভাব্যতার মধ্যে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলিম জীবনধারা সমান্তরালভাবে বয়ে গেছে। বাস্তবতা মেনে তাই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি অবলম্বন করাই সবার জন্য কল্যাণকর বিবেচিত হওয়াই বাঞ্ছনীয়। হিন্দু ও মুসলমান, দু’টি সম্প্রদায়ই আস্তিক। তবে আস্তিকতার ধরন ও চরিত্রগত বিরোধ স্পষ্ট। মুসলমানরা একেশ্বরবাদী ও নিরাকার আল্লাহতে বিশ্বাসী, হিন্দুরা সাকার ও বহুঈশ্বরে বিশ্বাসী। যদিও এ নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ বাধেনি। গোল বেধেছে গো-রক্ষা আর মসজিদের সামনে মিছিল নিয়ে যাওয়ার সময় ঢোল বাজনা বাজানো নিয়ে কিংবা অন্য কোনো তুচ্ছ অছিলায়। আসলে প্রবাদ আছে, যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা। হিন্দু-মুসলিম বিরোধ নিয়ে অনেক মনীষীই আলোচনা করেছেন। অন্নদাশঙ্কর রায় বাঙালি হিন্দু মুসলিম বিরোধ নিয়ে একটি মূল্যবান সত্য উচ্চারণ করেছেন। তার মতে এ বিরোধ তত্ত্বের নয়, স্বত্ব নিয়ে। নোয়াখালীর দাঙ্গা-উপদ্রুত অঞ্চল পরিদর্শন করতে এসে মহাত্মা গান্ধী প্রসঙ্গক্রমে জানতে চেয়েছিলেন নোয়াখালীর লোকসংখ্যার কতভাগ মুসলমান আর কতভাগ হিন্দু? তাকে জানানো হয়, শতকরা ৮০ ভাগ মুসলমান এবং শতকরা ২০ ভাগ হিন্দু। আর জমিজমার মালিকানা? ঠিক এর বিপরীত। গান্ধী এই জবাব শুনে বলেছিলেন, তোমরা অর্ধেক জমিজমা মুসলমানদের দিয়ে দাও। তার পরও তোমাদের ২০ শতাংশ লোকের জন্য পঞ্চাশ শতাংশ থাকবে। আর মুসলমানরা ৮০ শতাংশ হয়েও ৫০ শতাংশ পাবে। কিন্তু মহাত্মার এ প্রস্তাবে হিন্দুরা সাড়া দিতে সম্মত হয়নি। এ থেকে বোঝা যায়, অন্নদাশঙ্কর রায় একেবারে ফাঁকা কথা বলেননি। রবীন্দ্রনাথ তার রাজশাহীর পতিসরের জমিদারিতে এসে হিন্দু প্রজাদের পার্টিতে বসা আর মুসলিম প্রজাদের মাটিতে বসার ব্যবস্থা দেখে এক বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। তিনি তার নায়েব-গোমস্তাদের নির্দেশ দেন সবাইকে পার্টিতে বসানোর ব্যবস্থা করার। কিন্তু তারা সেই নির্দেশ মানতে অস্বীকার করেন। তারা বলেন, দীর্ঘকাল থেকে যে রেওয়াজ এই জমিদারিতে চালু আছে তার কোনো ব্যতিক্রম তারা করতে পারবেন না। রবীন্দ্রনাথ তার কর্তৃত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া সত্ত্বেও তারা তাদের সিদ্ধান্তে অবিচল রইলেন। এই ঔদ্ধত্য দেখে রবীন্দ্রনাথ পুণ্যাহ অনুষ্ঠানে অংশ নিতে অস্বীকার করলেন। শেষ পর্যন্ত নতুন জমিদার বাবুর কাছে বৈষম্যমূলক ঐতিহ্যপূজারীরা নতি স্বীকার করতে বাধ্য হলেন। একই ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখার্জি। ইস্যুটি ছিল মৌলভী মোহাম্মদ শহিদুল্লাহর সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার আগ্রহ নিয়ে। কিন্তু গোল বাধে হিন্দু অধ্যাপকরা তাকে সংস্কৃত পড়াতে নারাজ। স্যার আশুতোষ মুখার্জি অধ্যাপকদের অনুরোধ করেও রাজি করাতে পারলেন না। সংস্কৃত শিখে মুসলমান শহীদুল্লাহ হিন্দুদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বেদ অধ্যয়ন করবেÑ এটা তারা বরদাশত করতে সম্মত হলেন না। অগত্যা শহীদুল্লাহ সাহেবকে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব নিয়ে পড়তে হয়েছিল। এই ঘটনা সম্পর্কে কংগ্রেস নেতা অতুল্য ঘোষ কংগ্রেসের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকাটির বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত একটি লেখায় দুঃখ করে বলেছিলেন, ভারত বিভক্তির জন্য যারা একে ওকে দায়ী করেন, কারা বাস্তবতা সম্পর্কে কম জ্ঞান রাখেন। হিন্দু অধ্যাপকরা একবারও ভেবে দেখলেন না এই অস্বীকৃতির সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে! সমস্যাটি কেবল আধুনিককালের ব্যাপার ছিল না, কিংবা যারা বলেন, ইংরেজরা এসে রোমান ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসিতে ভারত শাসন করতে গিয়ে এই বিভেদ ডালপালা মেলে পত্রপল্লবে বিস্তার লাভ করেছে তারাও পুরো সত্য বলেন না। যদি সেটাই সত্য হতো তাহলে দশম শতকে আলবিরুনী এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ-বিদ্বেষ দেখতে পেতেন না। তিনি সত্যনিষ্ঠ গুণী ও পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। তার পাণ্ডিত্য পক্ষপাতদুষ্ট ছিল না। তিনি তার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে হিন্দু-সমাজের দোষ-গুণ, ভুল-ত্রুটি, কূপমণ্ডকতা এবং নির্বুদ্ধিতা সম্পর্কে তীর্যক ও অপ্রিয় মন্তব্য করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধান্বিত হননি, সেই সাথে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন প্রাচীনকালের হিন্দু মুণি-ঋষিদের অনুসন্ধিৎসা ও দার্শনিকতার। তিনি মুসলিম বিজয়ীদের অশ্ববাহিনীর খুরের আঘাতে ভারতীয় আর্য সভ্যতাকে ধূলোকণার মতো উড়ে যেতে দেখেছেন। এ নিয়ে হিন্দুমনে জমাট বেঁধেছিল নিদারুণ ক্ষোভ। সময় সব কিছু প্রশমিত করে দেয়, এমনকি ভুলিয়েও দেয়। কিন্তু মানুষ সুখের স্মৃতি যত সহজে ভোলে দুঃখের স্মৃতি তত সহজে ভোলে না। হিন্দু সমাজও সে স্মৃতি ভুলতে পারেনি। অন্তর থেকে ক্ষমা করতে পারেনি মুসলমানদের। ফলে পাঠান, মোগল, তুর্কিদের উপর শোধ তুলতে না পেরে যারা ভারতের মাটিতে জন্ম নিয়ে ভারতের বুকে সমাধিস্ত হয়েছেন তাদের বংশধরদের বিরুদ্ধেই ক্ষোভ বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে, এ কথা যদি বলা হয় তাহলে কি ভুল বলা হবে? তবে বংশপরস্পরায় সেই ক্ষোভ বয়ে নিয়ে বেড়ানো কতটা যুক্তিযুক্ত সেটাই বিচার্য ও ভাববার বিষয়। আর্য মেধা ও সংস্কৃতি ভারতকে সমৃদ্ধ করেছে, মুসলিম মেধা ও সংস্কৃতিও ভারতকে কম সমৃদ্ধ করেনি। অবিচার-অনাচারের কথা তোলা হলে অনার্যদের প্রসঙ্গ আসবে। তাদের প্রতি আর্যরা যে ব্যবহার করেছে তার সাথে রেড ইন্ডিয়ানদের বিরুদ্ধে মার্কিনিদের ব্যবহারই তুলনীয়। তাই সব কিছু সময় ও যুগধর্মের নিরিখে বিচার্য হওয়া বাঞ্ছনীয়।
অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ভারতবর্ষ বিদেশী শাসনের অধীন হলে সাথে সাথে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হয়, প্রতিরোধও গড়ে ওঠে। ভারতীয় হিন্দু অধিপতি শ্রেণী ক্ষমতার এ পালাবদলকে আশীর্বাদ হিসেবে গ্রহণ করলেও মুসলিম অধিপতি শ্রেণী তাকে অভিশাপ হিসেবেই দেখে এবং আন্দোলন জারি রাখে। জাতীয় জাগরণের প্রসঙ্গ উঠলে উনিশ শতক থেকে আলোচনা শুরু করা হয়। ফলে ভারতীয় মুসলমানদের শতাব্দীব্যাপী আন্দোলন আড়ালে থেকে যায়। ইতিহাসের পরস্পরা রক্ষা করে আলোচনা করা না করায় সত্য উপলব্ধি ব্যাহত হয়। মুসলমানদের মধ্যে আগে থেকেই জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ও বিকাশ লাভের সবগুলো উপাদানই বর্তমান ছিল। তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অভিন্নতা থেকে উৎসারিত ঐক্যানুভূতি জাতীয় জাগরণের জন্য যথেষ্ট বিবেচিত হয়েছিল। মুসলিম জনগোষ্ঠীর পাশ্চাত্য থেকে জাতীয়তাবোধ আমদানি করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। ওটা বঙ্কিমচন্দ্র ইংরেজদের চিন্তা-ভাণ্ডার থেকে ধার করে এনে হিন্দুয়ানী রঙ লাগিয়ে উপস্থাপন করেন। হিন্দুয়ানী রঙ লাগানোর জন্য একশ্রেণীর মুসলিম লেখক-সাহিত্যিক তাকে সাম্প্রদায়িক বলে গাল পাড়েন। শিল্পীর স্বাধীনতা মানলে তাকে উপেক্ষা করা যায় সহজেই। আদতে হিন্দুর চেতনায় কিংবা ধর্মীয় সাহিত্যে পরিবারপ্রীতি, বসুধাপ্রীতি, ঈশ্বরপ্রীতির কথা থাকলেও দেশপ্রীতির কথা ছিল না। তাই চিন্তাবিদ বঙ্কিমকে ইংরেজের চিন্তাভাণ্ডার থেকে দেশাত্মবোধের আইডিয়া ধার করতে হয়। তবে মনীষী বঙ্কিম তার জাতীয়তাবোধকে ইউরোপের মতো আগ্রাসী রূপ দিতে চাননি। সবার প্রতি সমদৃষ্টি, এটা হিন্দু ধর্মের একটা মৌলিক মূল্যবোধ। তার জাতীয়তাবোধ যাতে ফ্যাসিবাদী রূপ পরিগ্রহ না করে সেজন্য তার সতর্ক দৃষ্টি ছিল। পরদেশ গ্রাসের এবং পরদেশের সম্পদ লুণ্ঠনের ইতিহাস ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই তো তার নিজের জীবন অতিবাহিত হয়েছে। তিনিই একমাত্র লেখক ও চিন্তাবিদ যিনি বঙ্গীয় কৃষকের সমস্যা অন্তর দিয়ে অনুভব করেছিলেন। তিনি কৃষক হাসিম শেখ ও রামা কৈবর্ত্যরে জন্য চোখের জল ফেলেছিলেন। তিনি ব্যক্তি স্বাধীনতা, সামাজিক সাম্য এবং উন্নত জাতির সমকক্ষতা অর্জনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। হিন্দু সমাজকে জাগিয়ে তুলতে দেশপ্রেমকে ধর্মীয় কর্তব্য হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন। তিনি নাস্তিকতা থেকে ফিরে এসে হিন্দুর ধর্মীয় চিন্তার পুনর্গঠন করেছিলেন। বৈষ্ণব আদর্শকে ঢেলে সাজাবার প্রয়াস পেয়েছিলেন। এখানে বিস্তৃত আলোচনায় যাব না। তার সাহিত্যকর্ম নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যতই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য প্রকাশ করুন না কেন, প্রকৃত সত্য হচ্ছে, তিনি প্রচণ্ড শক্তিমান লেখক ছিলেন। রক্ষণশীল হিন্দুসমাজের কানে তিনি বন্দে মাতরমের ধ্বনি তুলে হিন্দু হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন। তার সমতুুল্য বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিপ্রবণ, প্রতিভাবান সাহিত্যিক বাংলাভাষায় বিরল। তার সীমাবদ্ধতাকেও সেই সময়ের যুগধর্মের আলোকে বিচার করে দেখা সমীচীন। তিনি জাতীয়তাবোধের প্রেরণা জোগানো সত্ত্বেও জাতীয় ঐক্যসূত্রের সন্ধান দিতে ব্যর্থ হয়েছেন, এমন অনুযোগ যারা করেন তাদের উদ্দেশে বলা যায়, সে রকম আদর্শিক ঐক্যসূত্রের কোনো চাহিদা তখনকার বঙ্গীয় বা ভারতীয় সমাজে ছিল না। মুখে ঐক্যের কথা বলা হলেও বাস্তবে ঐক্যবোধের কোনো অঙ্কুরোদগম হতে দেখা যায়নি। দার্শনিক ইকবাল বলেছেন, মুরগি ডাকাডাকি করেছে প্রচুর কিন্তু কোনো ডিম পাড়েনি। স্মরণ করুন, কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত মেঘনাদ বধ মহাকাব্য লেখার পর কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে আরো একটি মহাকাব্য লেখার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু তার কোনো কোনো বন্ধু তাকে পরামর্শ দেয় ওটা না লিখতে। এটা ছিল এক ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক পরামর্শ। ফলে বাংলা সাহিত্য আর একটি মহৎ সৃষ্টি থেকে চিরকালের জন্য বঞ্চিত থেকে গেল।
ভারতীয় ইতিহাসে ঐক্যবোধ সৃষ্টির কিছু অবিস্মরণীয় মুহূর্ত আমরা দেখতে পাই। ঐতিহাসিক সিপাহি বিদ্রোহের সময় হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের এক অভূতপূর্ব দৃশ্যপট তৈরি হয়েছিল। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময়ও হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের তীব্র তাগিদ অনুভূত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং গানে ও ভাষণে ঐক্যবন্ধনের সন্ধান দিয়েছিলেন। রশিদ আলী দিবস পালনকালেও কলকাতার রাজপথে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের এক বিদ্যুৎ ঝলক দেখা গিয়েছিল। আবার অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলন চলাকালে হিন্দু-মুসলিম একযোগে আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। কিন্তু কখনো সে ঐক্যবোধ ইস্পাত কঠিন রূপ পায়নি। ইংরেজ শাসকরা চাতুর্য্য ও বুদ্ধিমত্তার সাথে দু’টি সম্প্রদায়কে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থানে দেখতে পছন্দ করেছে। তারা নিজেদের দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উপর জোর দিলেও উপনিবেশে ধর্মীয় শিক্ষার উপরই জোর দিয়েছে। তাই মাদরাসা ও সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠায় আগ্রহ দেখিয়েছে। প্রশাসনিক কাজ-কারবার চালানোর জন্য এ দেশীয় ভাষা শেখার ব্যাপারে আগ্রহই দেখিয়েছে; কিন্তু এ দেশীয়দের একাধিক ইউরোপীয় ভাষা শেখানোর কোনো ব্যবস্থা করেনি। ভারত শাসনের ১০০ বছর পর সিপাহি বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে মাদ্রাজ, মহারাষ্ট্র ও বাংলায় তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে তারা ভারতে উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করার প্রয়াস পায়। সঙ্গত কারণে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ইতিহাসের এই পর্বে বঙ্গীয় সমাজে শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য দ্রুত বাড়তে শুরু করে। স্কুল, কলেজগুলো গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন জেলা শহরে। আর শহরগুলোর বাসিন্দা হওয়ার সৌভাগ্য তারাই অর্জন করেছিলেন যারা ছিলেন ইংরেজদের অনুগ্রহভাজন। অর্থাৎ নব্য জমিদার, বেনিয়া, মহাজন, ঠিকাদার, দালাল, ফড়িয়া, মুৎসুদ্দি এবং ব্যবসায়ী শ্রেণীর সন্তান-সন্তুতিরাই আধুনিক শিক্ষা লাভ করার সুযোগ পেয়েছিল। চেহারা-সুরতে তারা ভারতীয় হলেও চিন্তা-চেতনায় বনে গিয়েছিল সাহেব। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাপ্রাপ্তরা সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে ঢুকে লাভ করেছিল নতুন জীবন গড়ে তোলার অভূতপূর্ব সুযোগ। আধুনিক ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণের ব্যাপারে মুসলিম সমাজ অনীহা দেখিয়েছিল, এ রকম একটা ভ্রান্ত তত্ত্ব সমাজে চালু করা হয়েছিল উদ্দেশ্যমূলকভাবে। আলেম-ওলামাদের ফতোয়া শুনে মুসলিম যুবকরা আধুনিক শিক্ষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন, এ রকম কথার কোনো ঐতিহাসিক সত্যতা নেই। এটা একটা মিথ, প্রকৃত সত্য হচ্ছে ব্রিটিশ শাসনে মুসলিম সমাজের আর্থিক মেরুদণ্ড ভেঙে গিয়েছিল। সিপাহি বিদ্রোহের কারণ অনুসন্ধান করতে এসে ব্রিটিশ মনীষী ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার সে কথা তার ‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ গ্রন্থে ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন। বঙ্গীয় সমাজের গরিষ্ঠ অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও ব্রিটিশ নীতি বরাবর তাদের বিরুদ্ধে গৃহীত হয়েছে। তার এই যৌক্তিক বিশ্লেষণ এবং মানবিক মূল্যায়ন ব্র্রিটিশ সরকারের নীতি বদলে বিরাট ভূমিকা রাখে। অথচ অক্সফোর্ডের ইতিহাসের বাঙালি অধ্যাপক ‘বাঙাল নামার’ লেখক তপন রায় চৌধুরী একবার ঢাকায় এসে জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে হান্টারের তীব্র সমালোচনা করেন। তার সাথে দ্বিমত পোষণ করে আমি একটি লেখা ইংরেজি দৈনিক নিউ নেশানে প্রকাশ করেছিলাম। তিনি তখনো বেঁচে ছিলেন; কিন্তু তার কোনো মতামত পাওয়া যায়নি।
ইংরেজ পণ্ডিত হান্টারের মুখে ঝাল না খেয়েও আমরা যদি আমাদের সাধারণ বুদ্ধি-জ্ঞান দিয়ে বুঝতে চেষ্টা করি তাহলেও দেখতে পাবো উনিশ শতকের শেষ দিকে এবং বিশ শতকের প্রথম দিকে শহরের সাথে গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল দুর্গম। সন্তানদের শহরের কলেজে ভর্তি করিয়ে হোস্টেলে রেখে লেখাপড়া শেখানোর সামর্থ্য বেশির ভাগ মুসলিম পরিবারের ছিল না। শহরে তাদের তেমন আত্মীয়স্বজনও ছিল না, যেখানে লজিং থেকে তারা পড়বে। এই পরিস্থিতি আমলে না নিয়ে মাওলানা, মুফতিদের ফতোয়ার ওপরে দোষ চাপানো সমীচীন নয়। বিষয়টি নিয়ে প্রফেসর ড. কাজী আবদুল মান্নান তার ‘বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাধনা’ শীর্ষক গবেষণা গ্রন্থে তথ্য-প্রমাণসহ বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন। আলেম-ওলামাদের বিরুদ্ধে যে কথা বলা দরকার ছিল সেটা তেমন জোরালোভাবে বলা হয়নি। আরবি ভাষার কুরআন এবং হাদিসকে মাতৃভাষা বাংলায় চর্চা অনুশীলন করার ফজিলত উপলব্ধি না করে ফারসি এবং উর্দুতে অনুশীলন করতে গিয়ে অনেক বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়, বিশেষ করে ভাষান্তরকে কেন্দ্র করে। সাধারণ মানুষ কুরআনের মর্মবাণী ঠিকমতো উপলব্ধি করতে পারে না। স্যার সৈয়দ আমীর আলী, নওয়াব আবদুল লতিফের মতো ইংরেজি শিক্ষিত বিজ্ঞ ব্যক্তিও এ বিষয়টি উপেক্ষা করেন। ধর্মীয় শিক্ষার পোষকতায় লাখেরাজ সম্পত্তির একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ইংরেজরা সে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করলে ধর্মীয় শিক্ষাও সঙ্কটে পড়ে। তার পরও মুসলিম সমাজের স্বেচ্ছাদানে গড়ে ওঠা কওমি মক্তব, মাদরাসা ধর্মীয় শিক্ষার ঐতিহ্য অনির্বাণ রাখে। চরিত্র গঠনের বুুনিয়াদি শিক্ষা গ্রহণের পর এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের শিক্ষা যুক্ত করার ইসতিহাদ বা চিন্তা গবেষণার খুবই দরকার ছিল। সেই গবেষণা কেউ করেনি। তাই গতানুগতিক ধারায় চলছে ধর্মীয় শিক্ষা। অন্য দিকে আধুনিক শিক্ষা চরিত্র গঠনে ব্যর্থ হয়েছে। সৎ সাহস ও আত্মমর্যাদাবোধ জাগাতে পারেনি। সততা ও সহমর্মিতা সমাজ থেকে বিদায় নিয়েছে। দুর্জন বিদ্বানরা এখন সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য দায় বা বোঝা হয়ে দেখা দিয়েছে। অথচ ইসলামের নবী দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত সময়কে শিক্ষাকাল বলেছেন, শিক্ষার্থীর কলমের কালিকে শহীদের রক্তের চেয়ে ভারী বলেছেন, সর্বোপরি জ্ঞান যদি দূরবর্তী দেশ চীনেও থাকে তবে সে জ্ঞান অর্জন করার তাগিদ দিয়েছেন। আলীগড় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে (১৯২৯) প্রধান অতিথির ভাষণে বিজ্ঞানাচার্য আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ইসলামে নবীর শিক্ষাবিষয়ক উপরের বাণীগুলোর উল্লেখ করে বলেছিলেন, ‘জ্ঞান অর্জনের প্রতি এ রকম প্রণোদনা আর কোনো মহামানব দিয়েছেন বলে আমার জানার সুযোগ হয়নি।’ তাই আধুনিক জ্ঞানার্জনের ব্যাপারে মুসলিম সমাজের মনোভাব নেতিবাচক হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। নিজেদের অজ্ঞতা এবং অপারগতা ঢাকবার জন্য গোঁড়ামির আশ্রয় নেয়া, ধর্মীয় ফতোয়ার দোহাই দিয়ে বিদেশী ভাষায় শিক্ষা গ্রহণে অনীহা দেখানো মুসলিম সমাজের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। কারণ মুসলিম নর-নারীর জন্য বিদ্যার্জন অবশ্য কর্তব্য। এই কর্তব্য পালন না করে কোনো মুসলমান তার ধর্মীয় জীবনের তাৎপর্য বুঝতে সক্ষম হতে পারে না। কুরআন পড়লেই হবে না পাঠকৃত অংশের অর্থ ও তাৎপর্য অনুধাবন করতে হবে। এখানেই শেষ নয়, ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে সেই অর্জিত জ্ঞানের প্রয়োগ করতে হবে। যার পক্ষে যেটুকু জানা সম্ভব হয়েছে তার ওপর আমল শুরু করতে হবে। তবেই তো সমাজ জীবনে রূপান্তর আসবে। এ তো গতানুগতিক বিদ্যায়নী শিক্ষা নয় যে, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য পড়া এবং সার্টিফিকেট অর্জনের পর বিদ্যা বিসর্জন দিয়ে যেন তেন প্রকারে অর্থ উপার্জন করে জীবন নির্বাহ করা। ধর্মীয় জ্ঞানের কিছু অপরিহার্য বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যেমনÑ করণীয় বর্জনীয় মেনে চলার নির্দেশনা। মাতা-পিতার প্রতি কর্তব্য পালন, সন্তান-সন্তুতির প্রতি কর্তব্য পালন, নির্ভরশীল এবং অধিনস্তদের প্রতি দায়িত্ব পালন, পাড়া-প্রতিবেশীর প্রতি দায়িত্ব পালন। নিজের স্ত্রীকে যে ভালোবাসে না, নিজের মা-বাবাকে যে ভালোবাসে না, ভাইবোনকে যে ভালোবাসে না, প্রতিবেশীর সাথে যে ভালো ব্যবহার করে না, তাদের প্রয়োজনে সাড়া দেয় না, অন্য ধর্মের লোকদের সাথে যে সম্প্রীতির সম্পর্ক বজায় রাখে না, বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান করে না, ছোটদের করে না স্নেহ তার জন্য কেউ জান্নাতের সুখবর দেয়ার ক্ষমতা রাখে না। কেউ যদি নিজের কৃতকর্মের মাধ্যমে সে তার জান্নাতের দরজা বন্ধ করে দেয় তবে সে দরজা খুলতে হলে তাকেই অনুতপ্ত হতে হবে, আন্তরিকভাবে আত্মসমর্পণ করতে হবে। ইমান, সালাত, জাকাত, রোজা এবং হজ তথা ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালন তখনই সার্থক এবং অর্থবহ হয়ে উঠবে যখন তা উত্তম চরিত্র নির্মাণ করবে।
চারিত্রিক সততার অভাব যত দিন থাকবে তত দিন সমাজে ইতিবাচক রূপান্তর আসবে না। ব্যক্তিগত সততা ও গুণাবলীর জন্য সম্মানীয় জনেরা ইহকালীন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য উপভোগ করার সাথে স্বর্গ সুখেরও স্বপ্ন দেখতে পাবেন; কিন্তু সামাজিক অবক্ষয় ও অধঃপতনের জন্য জবাবদিহি তাদের করা লাগবে এবং আত্মগ্লানির নরক অনলেও তাদের পুড়তে হবে। কারণ, যিনি জানেন এবং যিনি জানেন না এই দুই ধরনের লোকের দায়-দায়িত্ব সমান হতে পারে না। হ
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, গবেষক

 


আরো সংবাদ



premium cement
গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ অব্যাহত পাবনায় ১০ কোটি টাকার অনিয়মে ৩ ব্যাংক কর্মকর্তা আটক জীবন্ত মানুষকে গণকবর আগ্রাসন ও যুদ্ধকে ‘না’ বলার আহ্বান মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে আনা অভিযোগ ভিত্তিহীন : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বৃষ্টির জন্য সারা দেশে ইসতিস্কার নামাজ আদায় আরো ৩ দিনের হিট অ্যালার্ট তাপপ্রবাহ মে পর্যন্ত গড়াবে আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে ঢাকার ভূমিকা চায় যুক্তরাষ্ট্র বিদ্যুৎ গ্যাসের ছাড়পত্র ছাড়া নতুন শিল্পে ঋণ বিতরণ করা যাবে না মিয়ানমারে ফিরল সেনাসহ আশ্রিত ২৮৮ জন বিএনপি ক্ষমতায় যেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে : কাদের

সকল