১৯ মে ২০২৪, ০৫ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ১০ জিলকদ ১৪৪৫
`


কোরবানি ও আমাদের ত্যাগ

-

কোরবানি শব্দের উৎপত্তি কারিবুন শব্দ থেকে। কোরবান শব্দের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে নৈকট্য, সান্নিধ্য বা উৎসর্গ।
জিলহজ মাসের ৯ তারিখ হজ পালন করে ১০ তারিখ কোরবানির মাধ্যমে ঈদুল আজহা পালন করা হয়। এদিন ধনী-গরিব, রাজা-প্রজা সবাই ঈদগাহে সমবেত হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দু’রাকাত নামাজ আদায়ের মাধ্যমে ঈদের সকাল শুরু হয়।
হজ, কোরবানি আর মেহমানদারির মাধ্যমে খুশির উৎসবই হচ্ছে ঈদুল আজহা।
মানব সভ্যতার বিকাশে মুসলমানের ত্যাগ ও কোরবানির গুরুত্ব অপরিসীম। ত্যাগ ব্যতীত কোনো সমাজে সভ্যতা বিনির্মাণ করা সম্ভব হয়নি। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সাফল্যের পেছনেও থাকে কারো না কারো ত্যাগ-তিতিক্ষা। তেমনি পিতা-মাতার ত্যাগ ও কোরবানির বদৌলতেই সন্তান প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠে। যেকোনো সমাজের সফলতা ও ব্যর্থতা নির্ভর করে ত্যাগ ও কোরবানির ওপর। ঈদ আমাদের শুধু আনন্দই দেয় না বরং সব হিংসাবিদ্বেষ এবং ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার শিক্ষা দেয়। ঈদুল আজহা মুসলমানকে ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করে ত্যাগ ও কোরবানির আদর্শে উজ্জীবিত করে। মানুষের সব বৈষম্য দূর করে একটি শোষণমুক্ত সমাজ কি নির্মাণের জন্য অনুপ্রেরণা দেয়। ঈদুল আজহার শিক্ষা নিয়ে আমরা সবাই বাস্তব জীবনে ইসলামি আদর্শ অনুসরণ করতে পারলেই কেবল এই ঈদের আসল উদ্দেশ্য সার্থক হবে। ঈদের আনন্দের পাশাপাশি মহান আল্লাহর বাণী আমাদের স্মরণ রাখা প্রয়োজন।
‘হে নবী! তুমি বলো আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন, আমার মৃত্যু সব কিছুই সারা জাহানের মালিক আল্লাহ তায়ালার জন্য।’ (সূরা আনআম : ১৬২)
কোরবানির মহান আদর্শ নিয়ে পবিত্র ঈদুল আজহা আমাদের দ্বারে দ্বারে সমাগত হয়। ত্যাগের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সবাই বাস্তব জীবনে ইসলামি আদর্শ অনুসরণ করে সমাজে ন্যায় ও ইনসাফ কায়েম করতে পারি তবেই আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা সম্ভব। যারা সত্য পথের পথিক তারা কেবলমাত্র সত্যকেই প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। কারণ সত্যই সুন্দর; সুন্দরই সত্য। আমরা আল্লাহ্ নবী-রাসূল ও সাহাবিদেরকে দেখিনি। কিন্তু তাঁদের ত্যাগ ও কোরবানির ইতিহাস আমরা কম-বেশি সবাই জানি। আল্লাহর নৈকট্য, আত্মত্যাগ, আত্মোৎসর্গ, সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, সম্প্রীতি এবং সৌহার্দ্যরে সহজ পথ হচ্ছে কোরবানি। এই কোরবানির প্রচলন শুরু হয় আমাদের আদি পিতা আদম আ: ও তাদের পুত্র হাবিল-কাবিলের মাধ্যমে। কাহিনীটি সূরা মায়েদার ২৭ নম্বর আয়াতে বর্ণিত আছে।

ঘটনাটি হলো
যখন হজরত আদম আ: ও বিবি হাওয়া রা: পৃথিবীতে আগমন করেন তখন বংশ বিস্তারের লক্ষ্যে আল্লাহ তায়ালা তাদের যমজ সন্তান দান করেন। প্রতি গর্ভে একটি পুত্র ও একটি করে কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করে। তখন ভাইবোন ছাড়া আদম আ:-এর আর কোনো সন্তান ছিল না। অথচ ভাইবোন পরস্পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে না। তখন আল্লাহ তায়ালা সময়ের প্রয়োজনে আদম আ: কে এক নির্দেশ জারি করেন যে, একই গর্ভ থেকে যে যমজ পুত্র ও কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করবে তারা পরস্পর ভাইবোন হিসেবে গণ্য হবে। তাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক হারাম হবে। কিন্তু পরবর্তী গর্ভ হতে জন্মগ্রহণকারী পুত্রের জন্য প্রথম জন্মগ্রহণকারিণী সহোদরা বোন গণ্য হবে না। তাদের পরস্পর বিবাহ বৈধ হবে। ঘটনাচক্রে কাবিলের সহোদরা বোনটি ছিল পরমা সুন্দরী, তার সাথে বিবাহ হয় হাবিলের আর হাবিলের সহোদরা সহজাত বোনটি ছিল অপেক্ষাকৃত অসুন্দর। তার সাথে বিবাহ হয় কাবিলের। এই নিয়ে কাবিল অসন্তুষ্ট হয়ে হাবিলের শত্রুতে পর্যবসিত হয়ে পড়ে। এই মতভেদ দূর করার জন্য হজরত আদম আ: শরিয়ত মোতাবেক দুই পুত্রকে আল্লাহর নামে কোরবানি পেশ করতে নির্দেশ দেন। হাবিল ভেড়া, দুম্বা পালন করত। সে একটি উৎকৃষ্ট মানের দুম্বা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কোরবানি করল। আর কাবিল করত কৃষিকাজ। সে কিছু শস্য, গম কোরবানির উদ্দেশ্যে পেশ করল। নিয়মানুযায়ী আকাশ থেকে অগ্নিশিখা এসে হাবিলের কোরবানিটি ভস্মীভূত করে দিলো আর কাবিলের কোরবানি যেমন ছিল তেমনি পড়ে রইল। অর্থাৎ আল্লাহর তরফ থেকে হাবিলের কোরবানি গ্রহণ করা হলো। কারণ তিনি মনোযোগ ও ভালোবাসার সহিত কোরবানি করেছিলেন। অন্য দিকে কাবিলের কোরবানির ব্যাপারে কোনো প্রকার মনোযোগ বা ভালোবাসা ছিল না। তাই তার কোরবানিও আল্লাহ্ তায়ালার দরবারে কবুল হয়নি।
দ্বিতীয়বার মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিম আ:-এর সুমহান আত্মত্যাগ ও আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা ধর্মীয় রীতি-নীতি ও বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটায়। ঠিক তেমনি মুসলমান জাতির জন্য ঈদুল আজহা একটি ঐতিহাসিক দিন। আরবি জিলহজ মাসের ১০ তারিখে সারাবিশ্বে যথাযোগ্য মর্যদায় ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ পালিত হয়ে থাকে। এ কোরবানির ঈদের একটি সুদীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে।
কোরবানির ঈদের প্রেক্ষাপটটি হচ্ছে ইব্রাহিম আ: মহান আল্লাহ্ তায়ালার নির্দেশ মেনে প্রেম ভালোবাসা, ইচ্ছা-আকাক্সক্ষা কোরবানির জন্য প্রস্তুত করেন। বহুকাল তিনি নিঃসন্তান থাকার পর বার্ধক্যে উপনীত হন। তারপর ও আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও আস্থার ফলে একটি সন্তান লাভের আশায় তাঁর দরবারে হাত তোলেন। তিনি তার দোয়া কবুল করেন ও একটি সন্তান দান করেন। যাঁর নাম রাখা হলো ইসমাঈল আ:। পুত্রের প্রতি পিতার গভীর ভালোবাসা দেখে আল্লাহ্ তায়ালা পরীক্ষার জন্য স্ত্রী হাজেরাসহ শিশু পুত্র ইসমাঈলকে মক্কায় নির্বাসন দিতে আদেশ দেন। সুতরাং মহান আল্লাহ্ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য স্ত্রী-পুত্রকে মক্কায় জনমানবহীন মরুভূমিতে নির্বাসন দিয়ে আসেন। কিন্তু সন্তানের প্রতি পরম মমত্ববোধের কারণে নবী ইব্রাহিমের অন্তর সর্বদা ব্যাকুল থাকত। আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর প্রিয় বন্ধুর অন্তরের ব্যাকুলতা দেখে আবার আরেকটি পরীক্ষায় ফেললেন। আল্লাহর তরফ থেকে নির্দেশ এলো প্রাণপ্রিয় সন্তানকে আল্লাহর রাস্তায় কোরবানি করার। নির্দেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইব্রাহিম আ: ছুটে গেলেন মক্কায়। গিয়ে দেখলেন পুত্র তার শৈশব থেকে কৈশোরে পদার্পণ করেছে। পিতার কাজে সহযোগিতা করার মতো উপযুক্ত হয়েছে। এত সুন্দর পুত্রকে দেখে ইব্রাহিম আ:-এর চক্ষুযুগল শীতল হয়ে আসে। তাঁর মন চাচ্ছিল পুত্রকে সারাক্ষণ কাছে রেখে বহু কিছু শেখাবেন। কিন্তু বিধি বাম। মহান সৃষ্টিকর্তা যিনি এই পুত্র সন্তান তাঁকে দান করেছেন তাঁর নির্দেশেই তাকে কোরবানি করার মনস্থির করেছেন। পুত্রের মতামত জানতে চাইলে তিনি উত্তর দেন, হে আমার পিতা আপনি আপনার নির্দেশ মতো কাজ করুন, আমাকে আপনি ধৈর্যশীলদের মধ্যেই পাবেন। আল্লাহর প্রতি ইব্রাহিম আ:-এর কতটা গভীর ভালোবাসা থাকলে এ ধরনের সিদ্ধান্তে অবিচল থাকা যায়।
আল্লাহ্ তায়ালা শুধু এইটুকু দেখতে চেয়েছেন এবং তাঁদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে জান্নাত থেকে একটি পশু পাঠিয়ে কোরবানির ব্যবস্থা করালেন। ইব্রাহিম আ: তাঁর অন্তরে একমাত্র আল্লাহপ্রেম ছাড়া অন্য কিছুই স্থান দেননি। তাই তিনি এমন কঠিনতম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পেরেছিলেন। ইব্রাহিম আ:-এর কোরবানি ছিল ত্যাগের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কোরবানির মাধ্যমে আমাদের মনের পশুত্বকে হত্যা করে সঠিক ত্যাগ স্বীকার করে কোরবানি দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
হজরত মুহাম্মদ সা: মদিনায় হিজরতের পরই আল্লাহর পক্ষ থেকে কোরবানির আদেশ পান। এই আদেশ পাবার পর তিনি দশ বছর বেঁচেছিলেন এবং ওই দশ বছরই তিনি কোরবানি দেন।
‘আল্লাহর কাছে কখনো কোরবানির গোশত বা রক্ত পৌঁছায় না। বরং তাঁর কাছে তোমাদের তাকওয়াটুকুই পৌঁছায়।’
(সূরা হাজ : ৩৭)


আরো সংবাদ



premium cement