০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`


রমজানের চূড়ান্ত প্রস্তুতি

- প্রতীকী ছবি

দীর্ঘ এক বছর পর রহমত, মাগফেরাত ও নাজাত নিয়ে আমাদের মাঝে উপস্থিত হয় সিয়াম সাধনার মাস মাহে রমজান। রমজানের গুরুত্ব ও ফজীলত অপরিসীম। কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, তোমাদের মধ্যে যে লোক এই মাস পাবে, সে এই মাসে রোজা রাখবে। (সুরা বাকারা : আয়াত ১৮৫) যখন রমজান মাস ঘনিয়ে আসত তখন বিশ্বনবী সা: অনেক আনন্দিত হতেন এবং সাহাবায়ে কেরামের উদ্দেশে বলতেন, ‘তোমাদের দরজায় বরকতময় মাহে রমজান উপস্থিত হয়েছে।’

আল্লাহ তায়ালা রমজানে রোজা রাখা আমাদের ওপর ফরজ করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি পবিত্র কুরআনে বলেছেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে। যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতদের ওপর। যাতে করে তোমরা তাকওয়া ও পরহেজগারী অর্জন করতে পারো।’ (সূরা বাক্বারা, আয়াত : ১৮৩)।

হযরত ইমাম রাযী রহ: হতে বর্ণিত যে, বিশ্ব নবী হযরত মোহাম্মদ সা: শাবান মাসের শেষের দিকে একটি খুৎবা বর্ণনা করেছিলেন। খুৎবায় তিনি বলেছিলেন যে, ‘হে লোক সকল! তোমরা সকলে জেনে নাও যে আল্লাহর মাস রমজান রহমত, বরকত ও আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার সব চাইতে ভাল দিন নিয়ে তোমাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছে। এই মাস আল্লাহর কাছে সব চেয়ে উত্তম মাস। রমজান মাসের দিন বছরের সব দিনের চেয়ে এবং রমজান মাসের রাত বছরের সব রাতের চেয়ে উত্তম। এই মাসে তোমাদের শ্বাস নেয়াও তাসবীহ পাঠের সাওয়াবের সমতুল্য। এই মাসে তোমাদের নিদ্রাও ইবাদতে গণ্য হবে। আর তোমাদের ইবাদত ও দোয়া গ্রহণ করা হবে। সুতরাং তোমরা পরিষ্কার ও পবিত্র মনে আল্লাহর কাছে দোয়া কর এই যে, যেন আল্লাহ তোমাদের রমজান মাসে রোজা রাখার ও কুরআন শরীফ পড়ার সামর্থ্য দান করেন । হে লোক সকল! এ মাসে তোমাদের মধ্য থেকে কেউ যদি কোনো মুমিন ভাইকে ইফতার করায়, আল্লাহ তাকে একজন ক্রীতদাস মুক্তি করে দেয়ার সাওয়াব দান করবেন আর তার অতীতের গুনাহ মাফ করে দেবেন। এ কথা শুনে কয়েকজন সাহাবী বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ স:! রোজাদারের ইফতার করানোর সামর্থ্য আমাদের নেই। হুজুর সা: বললেন, তোমরা দোযখের আগুন থেকে নিজেকে রক্ষা কর আর রোজাদারকে ইফতার করাও, হয় অর্ধেক খোরমার মাধ্যমে, না হয় এক ঢোক পানির মাধ্যমে।’

তারপর নবী সা: বললেন, ‘যে এ মাসে যে প্রচুর পরিমাণে আমার ওপর দরূদ শরীফ পড়বে, আল্লাহ কেয়ামতের দিন তার নেকির পাল্লা ভারি করে দেবেন। আবার এ মাসে যে কুরআন শরীফের একটি আয়াতও পাঠ করবে তাকে অন্য মাসের কুরআন শরীফ খতমের সমান সাওয়াব দান করা হবে। ওহে লোকসকল! এ মাসে জান্নাতের দরজা খুলে দেয়া হয়। তাই দোয়া করো, এই দরজা যেনো তোমাদের জন্যে বন্ধ করে না দেয়া হয়। আর এ মাসে দোযখের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। তাই দোয়া করো যে, এই দরজা যেন তোমার জন্যে খোলা না হয়। আবার এই মাসে শয়তান বন্দী হয়। তাই তোমরা দোয়া করো যেন শয়তান তোমাদের শাসনকর্তা রূপে পরিণত না হয়।’ (তাবাই) এখন আমরা শাবান মাসের প্রায় শেষ দিকে আছি তাই রমজানের প্রস্তুতি ভালোমত গ্রহণ করা দরকার।

আবু বকর আল-বালখি বলেছেন, ‘রজব মাস হলো- বীজ বপনের মাস। শাবান মাস হলো- ক্ষেতে সেঁচ প্রদানের মাস এবং রমজান মাস হলো- ফসল তোলার মাস।’

তিনি আরো বলেছেন, ‘রজব মাসের উদাহরণ হলো- বাতাসের ন্যায়, শাবান মাসের উদাহরণ হলো- মেঘের ন্যায়, রমজান মাসের উদাহরণ হলো বৃষ্টির ন্যায়। তাই যে ব্যক্তি রজব মাসে বীজ বপন করল না, শাবান মাসে সেঁচ দিলো না, সে কীভাবে রমজান মাসে ফসল তুলতে চাইতে পারে?’

রজব মাস গত হয়ে গেছে। আমি-আপনি যদি রমজান মাসে ভালো ফল পেতে চাই, তাহলে শাবান মাসের অল্প কয়েক দিনে আমাদের একটি ভালো পরিকল্পনা সাজিয়ে নিতে হবে। সেজন্য বিগত রমজানের অসমাপ্ত আমলগুলো চিহ্নিত করে নোট করে নেয়া। আমলগুলো করতে না পারার কারণগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করা। যাতে করে এবারের মাহে রমজানে আর সেগুলো ছুটে না যায়, সেজন্য এখনই সে বিষয়ে আমল শুরু করা, যেমন-

কেন বিগত রামজানে নিয়মিত কুরআনে কারীম অধ্যয়ন করা হয়নি?
এখনই রমজানের প্রস্তুতি স্বরূপ কুরআনে কারীমের তেলাওয়াতে যত্নশীল হওয়া। সালামাহ ইবনে কুহাইল বলেছেন, ‘শাবান মাসকে তেলাওয়াতকারীদের মাস বলা হত।’ শাবান মাস শুরু হলে আমর ইবনে কায়েস তার দোকান বন্ধ করে দিতেন এবং কুরআনে কারীমের তেলাওয়াতে নিজেকে নিয়োজিত করতেন।

কেন তারাবিহ পড়া হয়নি?
তারাবীহের নামাজের প্রস্তুতির জন্য এখন থেকে বেশি বেশি নফল নামাজের পাশাপাশি তাহাজ্জুদে মনোযোগী হওয়া, যাতে করে রমজানজুড়ে তারাবীহ ও তাহাজুদ্দের আমল চলতে থাকে কোনো আলসেমি ছাড়াই।

কেন দান-সদকা ও সহযোগিতা করা হয়নি?
হাদিসে পাকে রমজান মাসকে হামদর্দি বা ‘সহানুভূতির মাস’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। দানশীলতা একটি মহৎ গুণ। রসুলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘ওপরের হাত নিচের হাতের থেকে উত্তম।’ আর মাহে রমজানে দানের ফজিলত অনেক বেশি। এ জন্য অন্য ১১ মাসের তুলনায় এ মাসে অধিক দান-সদকা করা উচিত। রাসূলে আরাবী সা: তার উম্মতকে শিক্ষা দিয়েছেন, রমজান মাসে দান ও বদান্যতার হাত সম্প্রসারিত করতে।

রমজানের রোজা ফরজ করার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো- গরিব-দুঃখী মানুষের কষ্ট অনুভব করা। যারা প্রাচুর্যের মাঝে জীবনযাপন করেন তারা সারাবছর ক্ষুধা ও পিপাসার যন্ত্রণা না বুঝলেও রমজানে কিছুটা বোঝেন। এই বোঝা তখনই সার্থক হবে যখন তারা গরিব-অসহায়দের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবেন। সুতরাং এখন থেকে দান-সদকা ও সহযোগিতা বাড়িয়ে দেয়া, যাতে করে এই ধারা রমজান মাসে ব্যাপকভাবে চলতে থাকে।

কেন ইতেকাফ করা হয়নি?
আয়িশা সিদ্দিকা রা: বর্ণনা করেন, নবী করিম সা: আজীবন রমজানের শেষ দশকে ইতেকাফ করেছেন। তাঁর ওফাতের পরও তাঁর বিবিরা ইতেকাফ করতেন। (বুখারি ও মুসলিম; আলফিয়্যাতুল হাদিস: ৫৪৬, পৃষ্ঠা: ১২৯)।

ইতেকাফের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো- শবে কদর প্রাপ্তি; রমজানের শেষ দশক ইতিকাফ করলে শবে কদর প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়। নফল ইতিকাফও অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ আমল; তাই সম্পূর্ণ সুন্নত ইতিকাফ পালন করতে না পারলে যতদূর সম্ভব নফল ইতিকাফ করাও গুরুত্বপূর্ণ। তাই এখন থেকে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রাখা, যাতে মাহে রমজানের শেষ দশদিন ইতেকাফ করে শবে কদর তালাশ করতে পারি।

কেন রোজাদারকে ইফতার করানো হয়নি?
রমজান মাসে রোজাদারকে ইফতার করানো হলো মুমিনের বিশেষ আমল। এ বিশেষ আমলের বিনিময়ে মহান আল্লাহ মুমিন বান্দাকে ক্ষমা করে দেন। এ ছাড়াও রয়েছে অনেক সাওয়াব ও ফজিলত। রোজাদারকে ইফতার করানো প্রসঙ্গে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাওয়াব বৃদ্ধির আমল ও গোনাহ মাফের আমল ঘোষণা করেছেন। হাদিসে এসেছে- ‘হজরত যায়েদ ইবনে জুহানি রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রোজাদারকে ইফতার করালো, তারও রোজাদারের ন্যায় সাওয়াব হবে; তবে রোজাদারের সাওয়াব বা নেকি বিন্দুমাত্র কমানো হবে না। (তিরমিজি, ইবনে মাজাহ, নাসাঈ) মাহে রমজানের প্রস্তুতি স্বরূপ এখন থেকে প্রতিবেশী ও পথচারীদের মাঝে খাবার পানীয় বিতরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা, যেন রমজান জুড়ে ইফতার বিতরণের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার ক্ষমা অর্জন করা যায়।

কেন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাআতের সাথে আদায় করা সম্ভব হয়নি?
কুরআনে কারীমে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতে আদায় করার জন্য বিশেষভাবে বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘রুকুকারীদের সাথে রুকু (নামাজ) করো।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ৪৩) রাসুলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন, ‘জামাতে নামাজের ফজিলত একাকী নামাজের চেয়ে ২৭ গুণ বেশি।’ (সহিহ বুখারি)। রাসুলুল্লাহ সা: সারা জীবন জামাতের সাথেই নামাজ আদায় করেছেন। এমনকি ইন্তেকালপূর্ব অসুস্থতার সময়ও জামাত ছাড়েননি। সাহাবায়ে কেরামের পুরো জীবনও সেভাবে অতিবাহিত হয়েছে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬২৪) তাই এখন থেকেই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতে পড়ার দৃঢ় অঙ্গীকার করা এবং আগে আগে মসজিদে গিয়ে নামাজে তাকবীরে উলায় শরিক হওয়ার চেষ্টা করা।

কেন রমজানের পরিবারের লোকদের হক আদায় করা হয়নি?
আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন, ‘আপনি আপনার নিকটবর্তী পরিবার-পরিজনকে সতর্ক করুন।’ (সূরা শুআরা, আয়াত ২১৪) রাসূল সা: রমজান মাসে নানাভাবে তার স্ত্রীদের শিক্ষা দান করতেন। হাদিসের পাঠক মাত্রই জানেন, রমজান বিষয়ক অধিকাংশ হাদিস তার স্ত্রীদের দ্বারা বর্ণিত। স্ত্রীদের শিক্ষার ব্যাপারে রাসূলের গুরুত্বারোপের উত্তম প্রমাণ এসব হাদিস। যেমন একবার আয়েশা রা: বলেন : ‘হে আল্লাহর রাসূল আপনার কি মত, আমি যদি লাইলাতুল কদর সম্পর্কে জ্ঞাত হই, তাহলে আমি কী দোয়া পাঠ করব? রাসূল সা: তাকে বললেন : তুমি দোয়া করবে : হে আল্লাহ, আপনি ক্ষমাশীল সম্মানিত, আপনি ক্ষমা পছন্দ করেন, সুতরাং আমাকে ক্ষমা করুন। (তিরমিজি, হাদিস ৩৪৩৫)

কেন রমজানে পাড়া-প্রতিবেশী বা আত্মীয়দের হক আদায় করা হয়নি?
পবিত্র কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো। কোনো কিছুকে তার সাথে শরিক কোরো না এবং মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন, এতিম-অভাবগ্রস্ত, নিকট-প্রতিবেশী, দূর-প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথি, মুসাফির ও তোমাদের দাস-দাসীর সাথে ভালো ব্যবহার করো। নিশ্চয় আল্লাহ দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৩৬)

সামাজিক সহাবস্থানের কারণে পারস্পরিক তর্ক-বিতর্কি ও ঝগড়া-বিবাদ হতেই পারে। এসব জিইয়ে রাখা উচিত নয়। প্রকৃত মুমিনের বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিবেশীর সাথে সদ্ভাব বজায় রাখা। কারণ, প্রতিবেশীর প্রতি সম্মান ও সদাচরণকে ঈমানের অনুষঙ্গ সাব্যস্ত করা হয়েছে। এ ব্যাপারে বেশ কয়েকটি হাদিস এসেছে। আবু শুরাইহ রা: বলেন, ‘আমার দুই কান শ্রবণ করেছে, আমার দুই চক্ষু প্রত্যক্ষ করেছে যখন রাসুলুল্লাহ সা: বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে এবং আখিরাতে বিশ্বাস রাখে, সে যেন স্বীয় প্রতিবেশীকে সম্মান করে।’ (বুখারি, হাদিস : ৬০১৮)

মানবতার মূর্ত প্রতীক বিশ্ব নবী সা: বলেছেন, ‘আল্লাহর শপথ সে (প্রকৃত) মুমিন নয়! আল্লাহর শপথ সে মুমিন নয়!! আল্লাহর শপথ সে মুমিন নয়!!! সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, সে কে হে আল্লাহর রাসূল? রাসূল সা: বলেন, যে ব্যক্তির অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়।’ (বুখারি, হাদিস : ৬০১৬)

ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘ওই ব্যক্তি মুমিন নয়, যে পেটপুরে খায় অথচ তার পাশের প্রতিবেশী না খেয়ে থাকে।’ (আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ১১২)

ইসলাম প্রতিবেশীর সাথে সদাচার ও সদ্ব্যবহারের পাশাপাশি তাদের অভাব-অনটনে পাশে থাকার প্রতিও উদ্বুদ্ধ করেছে। প্রতিবেশীকে ক্ষুধার্ত রেখে যে মুমিন উদরপূর্তি করবে, ইসলাম তাকে পূর্ণাঙ্গ মুমিন হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। তাই মাহে রমজানকে সামনে রেখে এখন থেকে প্রতিবেশীর খোঁজ-খবর রাখার চেষ্টা করা। আল্লাহ আমাদের উল্লিখিত সব বিষয়ের ওপর আমল করার তৌফিক দান করুন, আমিন।

-লেখক : তরুণ আলেম ও প্রাবন্ধিক

দেখুন:

আরো সংবাদ



premium cement