১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ জিলকদ ১৪৪৫
`


করোনায় প্রাইভেট স্কুল শিক্ষকদের মানবেতর জীবনযাপন

করোনায় প্রাইভেট স্কুল শিক্ষকদের মানবেতর জীবনযাপন - ছবি - নয়া দিগন্ত

স্কুল বন্ধ, কবে খুলবে ঠিক নেই। শিক্ষার্থী নেই, তাই বেতনও নেই শিক্ষকদের। এ অবস্থা ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার প্রায় ১৫০ কিন্ডারগার্টেনের ১৪শ শিক্ষক কর্মচারীর। বেঁচে থাকতে সরকারের সহযোগিতা চান তারা।

স্কুল মালিকরা বলছেন, শিক্ষকদের বেতন তো দূরের কথা, স্কুলই বন্ধ করে দিতে হচ্ছে হয়তো। শিক্ষাঙ্গন ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকের আনাগোনায় সদা প্রাণবন্ত থাকতো। বর্তমানে সেই চিরচেনা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিণত হয়েছে বিরানভূমিতে। একদিকে যেমন প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হয়েছে, অন্যদিকে শিক্ষার্থীরাও পড়াশোনা বঞ্চিত হচ্ছে। শিক্ষার অনেক ক্ষতি হচ্ছে। কারণ, কোনো কিছু খুব সহজে যেমন সৃষ্টি করা যায় না, আবার অতি সহজে ধ্বংসও করা যায় না। শিক্ষা তো ইটপাথরে গড়া কোনো ভবন না যে চাইলেই ধ্বংস করা যায়। এটা একটা অদৃশ্যমান জ্ঞান বা ব্যবস্থা, যা অনেক কিছুর বিনিময়ে এবং সময়ের পরিক্রমায় গড়ে উঠেছে। তাই যুগ যুগ ধরে জ্ঞানের সিঁড়ির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা শিক্ষাব্যবস্থা এক বা দুই বছরে শেষ হয়ে যেতে পারে না।

সদরের রুহিয়া ঘনিমহেষপুর গ্রামের রোকসানা হোসেন, কিন্ডারগার্টেন স্কুল পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীর দাদি তিনি। নাতিকে নিয়ে রুহিয়া বাজারে এসেছেন স্কুল ব্যাগ কিনতে। তার নাতি তুরাগ মাহমুদ হিমুর করনোকালীন সময়ে পড়ালেখা কেমন চলছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনা প্রকোপে স্কুল বন্ধ থাকলেও উন্নত দেশের শিক্ষাব্যবস্থা কিন্তু স্থগিত নয়। সেসব দেশ অনলাইনে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম যথাযথভাবে পরিচালনা করে যাচ্ছে। কারণ, তাদের সেই ব্যবস্থা ও সামর্থ্য রয়েছে। আমাদের দেশে অনেকের একটা স্মার্টফোনই নেই, সে ক্ষেত্রে অনলাইনে শিক্ষার কথা তো ভাবাই যায় না। সরকার দেশবাসীকে দেখাচ্ছে যে অনেক দেশেই করোনার কারণে স্কুলকলেজ বন্ধ রেখেছে। সেসব দেশ স্কুলকলেজ বন্ধ রাখছে ঠিকই, কিন্তু বিকল্প একটা ব্যবস্থা তৈরি করে নিয়েছে। সরকারের সে রকম একটা পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণ করার প্রয়োজন ছিল বলে মনে করি।

গেল বছর ১৭ মার্চ থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। কবে থেকে খোলার নির্দেশনা আসবে, তা অনিশ্চিত। দেশের অনেক স্কুল মহামারীর কারণে কঠিন সময় পার করছে। এসব স্কুলের বেশির ভাগ শিক্ষক বাডি়তে ফিরে গেছেন এবং আর্থিক সমস্যায় দিনাতিপাত করছেন। শিক্ষা খাতের সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলো বেসরকারি মালিকানাধীন কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো। দীর্ঘ সময় এই অবস্থা চলতে থাকলে অনেক স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ইতোমধ্যে অনেক স্কুল কিছু মালিক বিক্রিও করতে চাইছেন, কিন্তু বিক্রি করতে পারছেন না। ঠাকুরগাঁও সদরের কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোতে প্রায় ১৪শ শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন। এই শিক্ষক গুলো এখন শতভাগ বেকার। তা ছাড়া স্কুল খোলা থাকলে তাঁদের অনেকেই প্রাইভেট টিউশনি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কেননা এই সব স্কুলের আবার বেতন-ভাতা বেশি নয়। অনেক শিক্ষক করোনাকালীন অতি কষ্টে জীবন যাপন করছেন।
তাদেরই একজন (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) রুহিয়া ব্রাইট স্টার কিন্ডারগার্টেন স্কুলের সহকারী শিক্ষক জানান, অভাবের কারণে তিনি নানান জায়গায় হন্যে হয়ে একটা চাকরি খুঁজেছেন। কিন্তু কোথাও মেলেনি ন্যূনতম বেতনের একটা চাকরি। তিনি অনেক কষ্ট নিয়ে বলেন, ‘আমি রিকশা চালাতে পারি না, যদি পারতাম তবে তা–ই করতাম। শিক্ষক হয়ে তো আর ভিক্ষা করতে পারি না। শিক্ষক হয়েছি বলে কি না খেয়ে মরব?’ অশ্বিনী বর্মন সদরের ব্রাইট স্টার কিন্ডারগার্টেন স্কুলের পরিচালক। তিনি বলেন, আমার এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। করোনা মহামারি এক চ্যালেঞ্জের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একবছর শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে পারিনি। স্কুলের ৪০ জন শিক্ষক নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছি। কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। আমার এখন দিশাহারা অবস্থা। শিক্ষার্থীদের কাছে অনেক বকেয়া বেতন বাকি পড়ে আছে। তারা বাকি বকেয়া পরিশোধ করছে না।

অন্যদিকে মাদ্রাসা খোলা থাকাকালীন আমার স্কুলের ২০ শতাংশ শিক্ষার্থী মাদ্রাসায় চলে যায়। ২০২১ শিক্ষাবর্ষে তো শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে মাত্র ৮০ জন, যেখানে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি হতো কম করে হলেও ২০০ জন। বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন এসোসিয়েশন ঠাকুরগাঁও সদর শাখার সাধারন সম্পাদক অশ্বিনী কুমার বর্মন বলেন, শিক্ষা খাতে ক্ষতিটা প্রকৃতপক্ষে ত্রিমুখী সংকট। শিক্ষার্থী-শিক্ষক-মালিক তিন পক্ষেরই ক্ষতি সাধিত হয়েছে। এই খাতে সরকারের বরাদ্দ থাকলেও প্রাইভেট স্কুলের জন্য কোনো ধরনের সুযোগ সুবিধা নেই। তাদের জন্য না আছে কোনো প্রণোদনা, না আছে কোনো ঋণের ব্যবস্থা। স্কুল বন্ধ রাখার চিঠিতে কিন্ডারগার্টেনের নাম থাকে কিন্তু প্রণোদনার বেলায় নাম নাই।

গতবার সরকার কাওমী মাদ্রাসা গুলোতে প্রণোদনা দিয়েছে। কিন্ডারগার্টেন গুলোকে দেয়া হয়নি এখনো প্রণোদনার বাহিরে আছে। অথচ দেশের সার্বিক উন্নয়নে তাদেরও অংশগ্রহণ রয়েছে। সরকারের উচিত তাদের জন্য বিশেষ কিছু করা। প্রাইভেট স্কুলের শিক্ষকদের সাহায্যে এগিয়ে এলে তাদের অন্তত দুমুঠো অন্নসংস্থান তো হবে! শিক্ষাকে বাদ দিয়ে একটা জাতির সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। অতএব, জাতির উন্নতির জন্য শিক্ষার উন্নয়ন সর্বাগ্রে নিশ্চিত করতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল