৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


রাজশাহীতে এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে ভয়ংকর সুদ কারবারিরা

রাজশাহীতে এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে ভয়ংকর সুদ কারবারিরা - ছবি : নয়া দিগন্ত

রাজশাহীতে এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে সুদ কারবারিরা। সুদ কারবারিদের ভয়ংকর থাবায় প্রায় পথে বসার উপক্রম শতাধিক পরিবার। এ নিয়ে সুর্নির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলেও অভিযুক্তদের কাউকেই এখনো গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। এরই মধ্যে অভিযুক্ত সুদ কারবারিদের বেশ কয়েকজন আদালত থেকে জামিন নিয়ে নিজ এলাকায় ফিরেছে। অথচ এরআগে পুলিশ জানিয়েছিল অভিযুক্ত সুদ কারবারিরা পলাতক থাকায় তাদের গ্রেফতার করা সম্ভব হচ্ছে না।

এদিকে পুলিশের একটি সূত্র দাবি করেছে, অভিযুক্তদের গ্রেফতার না করার জন্য ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় প্রভাবশালী নেতার চাপ রয়েছে। ফলে সুদ কারবারিদের গ্রেফতার করার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পুলিশ ও ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, নগরীর অদূরে কাটাখালী থানার থান্দারপাড়া এলাকার মৃত সমশের আলীর দুই ছেলে ও ছয় মেয়ে মিলে গড়ে তুলেছেন সুদ কারবারি সিন্ডিকেট। এছাড়া স্থানীয় আরো কয়েকজনসহ সব মিলিয়ে অন্তত ১৫ জন এই সিন্ডিকেটের সদস্য। কাটাখালী এলাকাকে টার্গেট করেই মূলত সুদ কারবারিদের অবৈধ কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে।

সুদ কারবারিরা হলেন দুলাল হোসেন (৫৫), নাজমা বেগম (৪৩), ছামেনা বেগম (৩৬), মোসা: নীলা বেগম, মোসা: মনু বেগম (৪৬), শীলা বেগম (৪৫) প্রমুখ।

এদিকে স্থানীয় একটি সূত্র বলছে, অভিযুক্তদের মধ্যে দুলাল হোসেন সুদ কারবারির সাথে জড়িত নয়। তবে তার সুদকারবারি বোনদের তিনি সহযোগিতা করে থাকেন। দুলালের শেল্টারেই মূলত তার সুদ কারবারি বোনদের বেপরোয়া ও বেআইনি কর্মকাণ্ড, অব্যাহত হুমকি ও নানা ষড়যন্ত্রে দিশেহারা হয়ে পড়েছে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো। দুলাল ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হওয়ায় সুদ কারবারি সিন্ডিকেটের লাগাম টেনে ধরতে বেগ পেতে হচ্ছে পুলিশ প্রশাসন ও এলাকাবাসীকে। যতই দিন যাচ্ছে সুদ কারবারিরা হিংস্র ও ভয়ংকর হয়ে উঠছে।

পুলিশ বলছে, সুদ কারবারি সিন্ডিকেটের সদস্যরা মাদক কারবারির সাথেও সম্পৃক্ত। এছাড়া নারী সুদ কারবারিদের কেউ কেউ পতিতাবৃত্তির সাথেও জড়িত বলেও অভিযোগ রয়েছে।

সুদ কারবারিরা যে কত বড় ভয়ংকর, বেপরোয়া ও বেহায়াপনা কাজ করতে পারে সে সম্পর্কে পুলিশ ও ভুক্তভোগীরা চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। তারা জানান, নারী সুদ কারবারিরা নিজে নিজেই বিবস্ত্র হয়ে ভুক্তভোগীদের জিম্মি ও ফাঁসানোর চেষ্টা করেন এমন বহু ঘটনা রয়েছে। ইতোপূর্বে পুলিশকে ফাঁসানোর জন্য পুলিশের সামনেই নিজের গায়ে থাকা ব্লাউজ টেনে ছিঁড়ে ফেলেন এক নারী সুদ কারবারি। একজন মৃত ব্যক্তির নামাজে জানাজা পড়তেও বাধা দেয় নারী সুদ কারবারিরা। একটি পরিবারের কাছে দাবিকৃত সুদের টাকা না পাওয়ায় বিয়ের দিন নববিবাহিতা কনেকে গাড়ি থেকে নামতে বাধা দেয় সুদ কারবারিরা। অনেকেই সুদ ও আসল মিলে সব টাকা পরিশোধ করার পরেও তাদের কাছ থেকে আরো অতিরিক্ত টাকা দাবি করে সুদ কারবারিরা। এতে করে এসব পরিবারে অভাব-অনটনসহ নানা কষ্টে দিনযাপন নিত্যঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সুদ কারবারিদের মিথ্যা মামলা, হয়রানি ও মানসিক চাপ সামলাতে না পেরে মানসম্মানের কথা চিন্তা করে সুদে ঋণ নেয়া পরিবারের অনেকে এলাকা ছেড়ে আত্মগোপনে। তবে পুলিশের আশ্বাসে এরইমধ্যে আত্মগোপনে থাকা অধিকাংশ ভুক্তভোগী বাড়ি ফিরলেও তারা মানসিক স্বস্তিতে নেই। কারণ হিসেবে ভুক্তভোগীরা বলছেন, বেশ কয়েকজন সুদ কারবারি আদালত থেকে জামিন নিয়ে এলাকায় ফিরে এসেছেন। তাই আবারো তাদের রোশানলের শিকার হতে হয় কিনা তা নিয়ে শঙ্কিত ভুক্তভোগীরা।

গত ১৫-১৬ বছর ধরে সুদ কারবারিরা তাদের এসব অবৈধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। এলাকার প্রভাবশালী কতিপয় ব্যক্তির ছত্রছায়ায় থেকে তারা অনেকটা নিরাপদে এসব অবৈধ কর্মকাণ্ড চালানোর সুযোগ পাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

সরেজমিনে কাটাখালী থানার থান্দারপাড়া এলাকায় গিয়ে জানা গেছে, সুদ কারবারিদের নিপীড়নের শিকার শতাধিক পরিবার। এসব বিষয় নিয়ে ‘রাজশাহীতে সুদ কারবারিদের ভয়ংকর থাবায় নিঃস্ব হওয়ার পথে শতাধিক পরিবার’ শিরোনামে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি নয়া দিগন্তসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ফলে নড়েচড়ে বসে স্থানীয় থানা পুলিশ। এরই ধারাবাহিকতায় সুদ কারবারিদের বিরুদ্ধে থানা পুলিশ কঠোর অবস্থান নেয়ায় ভুক্তভোগী পরিবারগুলোতে অনেকটা স্বস্তি ফিরে। আর অভিযুক্ত সুদ কারবারিরা এলাকা ছেলে পালিয়ে যায়। ফলে ভয়ে এলাকা ছাড়া ভুক্তভোগী মানুষগুলোর বেশির ভাগই বর্তমানে নিজ বাড়িঘরে ফিরেছেন।

তবে তারা মিডিয়া বা ক্যামেরার সামনে প্রকাশ্যে কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন। কারণ পরবর্তীতে প্রশাসনের ইতিবাচক সহযোগিতা কতদিন অব্যাহত থাকবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। তবে এরই মধ্যে অভিযুক্তরা আদালত থেকে জামিন নিয়ে এলাকায় ফিরে আসায় শংকিত ভুক্তভোগীরা। নতুন করে কোনো বিপদে পড়তে হয় কিনা তা নিয়ে ভুক্তভোগীদের মধ্যে দুঃশ্চিন্তা কাজ করছে সব সময়।

সুদ কারবারিরা এলাকার নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির পরিবারগুলোকে টার্গেট করেন। প্রতি লাখে ৩০ পার্সেণ্ট হারে সুদে তারা ঋণ দিয়ে থাকেন। সুদে যাদেরকে ঋণ দেয়া হয় তাদের কাছ থেকে ফাঁকা চেক ও স্ট্যাপে স্বাক্ষর করে নেন সুদ কারবারিরা। আসল ও সুদ মিলে পুরো টাকা পরিশোধ করার পরেও অনেককে আরো সুদ গুণতে হয়। অর্থাৎ কেউ ৩০ পার্সেণ্ট হারে সুদে ১ লাখ টাকা ঋণ নিলে তাকে আসল ও সুদ মিলে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু কোনো কারণে ভুক্তভোগীরা এক বা দুই মাস কিস্তি দিতে না পারলে চক্র বৃদ্ধি হারে আরো অনেক টাকা সুদ গুণতে হয়। এতে করে তারা আরো দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে নিপতিত।

ভুক্তভোগী মোসা: তাসলিম ফারিয়া বৃষ্টি জানান, তার স্বামীর অটো গ্যারেজের ব্যবসা রয়েছে। তারা সুদ কারবারি শীলার কাছ থেকে ৩ লাখ ও ছামিনার কাছ থেকে ২ লাখসহ মোট পাঁচ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। পরে জমি ও গহনা বিক্রি করে সুদ ও আসল মিলে সব টাকা পরিশোধ করার পরেও আরো টাকা দাবি করে সুদ কারবারিরা। শুধু তাসলিম ফারিয়া বৃষ্টির পরিবারই নয়, তাদের মত আরো বহু পরিবারকে পথে বসতে হয়েছে।

এদিকে পুলিশ জানায়, একটি এনজিও এবং অভিযুক্ত কয়েকজন সুদ কারবারির কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে মোট পাঁচ লাখ টাকার মত ঋণ নিয়েছিলেন শাহিনা বেগম নামে এক নারী। কিন্তু বিষয়টি তার স্বামী জানতেন না। তার পরেও সেই ঋণের টাকা সুদে আসলে পরিশোধ করা হলেও আরো টাকা দাবি করতো সুদ কারবারিরা। এ নিয়ে স্ত্রী শাহিনার সাথে স্বামী শাহজাহান আলীর দাম্পত্য কলহ চলছিল। এরই জের ধরে ২০২০ সালের আগস্টে নির্মমভাবে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতে স্ত্রী শাহিনাকে হত্যা করেন শাহজাহান সাজু। এ ঘটনায় থানায় দায়ের করা মামলায় অভিযুক্ত সাজু গ্রেফতার হয়ে জেলহাজতে রয়েছেন। একইসাথে হত্যার সাথে নিজের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দেন। মামলাটি বর্তমানে চলমান।

পুলিশ আরো জানায়, ইতোপূর্বে সুদে ঋণ নেয়ার বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্বে দু’জনের আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্থানীয় সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী কাউন্সিলর আয়েশা খাতুন কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, বছরের পর বছর ধরে সুদ কারবারিদের অত্যাচার ও দৌরাত্বে অতিষ্ঠ হলেও এতদিন প্রশাসনের কোনো সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। তবে কাটাখালী থানার বর্তমান ওসি তৌহিদুর রহমান ভুক্তভোগীদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। ওসি সুদ কারবারিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেবেন এমন আশ্বাস দেয়ায় ভুক্তভোগীরা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে অভিযুক্তদের সাথে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো সাড়া মেলেনি। ফলে তাদের বক্তব্য জানা যায়নি।

জানতে চাইলে কাটাখালী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) তৌহিদুর রহমান বলেন, ওই এলাকার একই পরিবারের দুই ভাই ও ছয় বোন এবং পরিবারটির আরো একাধিক সদস্য ও স্থানীয় কয়েকজন মিলে অন্তত ১৫ জন এই সুদ কারবারির সাথে জড়িত। তারা সুদ কারবারি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এলাকার বহু পরিবারকে জিম্মি করে ফেলেছে।

ওসি বলেন, নারী সুদ কারবারি সিন্ডিকেটের সদস্যরা মাদক কারবারির সাথেও সম্পৃক্ত। এছাড়া তাদের কেউ কেউ পতিতাবৃত্তির সাথেও জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।

পুলিশের একটি সূত্র দাবি করেছে, অভিযুক্তদের গ্রেফতার না করার জন্য ক্ষমতাসীন দলের কতিপয় প্রভাবশালী নেতার চাপ রয়েছে। ফলে সুদ কারবারিদের গ্রেফতার করার ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement