০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫
`


দেশের উন্নয়নে ইসলামী ব্যাংকিং

-

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসির বিশেষ অবদান এই যে, এই ব্যাংকের হাত ধরেই বাংলাদেশে প্রথম এবং বিশ্ব পর্যায়ে দ্বিতীয় ইসলামী ব্যাংকিং ধারণার প্রাতিষ্ঠানিক এবং কাঠামোগত রূপ লাভ করেছে। প্রথমে মিসরে একটি ছোট পরিসরে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের ধারণা বাস্তবে রূপ দেয়ার প্রচেষ্টা নেয়া হয়। তবে সেই প্রথম উদ্যোগ বা সূচনা বেশি দিন বা বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেনি। সেই অর্থে ইসলামী আর্থিক ব্যবস্থার সফল দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উত্তরণের সূতিকাগার হলো ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি, যে প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যেই বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের একমাত্র ব্যাংক হিসেবে ‘দ্য ব্যাংকার’ পত্রিকার বিশ্বের এক হাজার ব্যাংকের অন্যতম ব্যাংক হিসেবে দেশের এক গৌরব হয়ে আপন দৃঢ় অবস্থানে উন্নীত হয়েছে এবং সেই অবস্থান ধরে রেখেছে।
বর্তমানে দেশে ইসলামী ব্যাংকিং ধারণা আর একদমই নীরিক্ষামূলক বা অভিনব স্বাতন্ত্র্য নিয়ে বিদ্যমান নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতি ও জনজীবনে শরিয়াহসম্মত ইসলামী ব্যাংকিং ধারা আজ এক বিশাল প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছে। ইসলামী ব্যাংকিং আজ এ দেশের আর্থ-সামাজিক জীবনের এক অনিবার্য বাস্তবতা। দেশে এখন আর্থিক খাতে ও মানুষের আর্থিক জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম। ১০টি পরিপূর্ণ শরিয়াহসম্মত ইসলামী ব্যাংক, ১৫টি কনভেনশনাল ব্যাংকের ৩০টি ইসলামিক ব্যাংকিং শাখা ও ৬১৫টি ইসলামী ব্যাংকিং ‘উইন্ডো’ সমন্বয়ে পরিচালিত ব্যাংক নিয়ে ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম দেশের ১২ কোটি গ্রাহকের আর্থিক অংশীদার হিসেবে শরিয়াহসম্মত আর্থিক লেনদেন ও কল্যাণের প্রাতিষ্ঠানিক সত্তা নিয়ে সারা দেশে কাজ করছে।

সব ইসলামী ব্যাংক প্রতিষ্ঠানেরই নিজ নিজ শরিয়াহ উপদেষ্টা কমিটি রয়েছে এবং জাতীয় পর্যায়ে ইসলামী ব্যাংকগুলোর শীর্ষ পরিচালনা প্রতিষ্ঠান হলো কেন্দ্রীয় শরিয়াহ বোর্ড (Central Shari'ah Board for Islamic Banks of Bangladesh – CSBIBB) । ২০০২ সালে ইসলামী ব্যাংকিং পরিচালনা ও সমন্বয়ে এই শীর্ষ এবং জাতীয় পর্যায়ের সংগঠন গড়ে তোলা হয়। ইসলামী ব্যাংকগুলোর শরিয়াহ ‘কমপ্লায়েন্স’ সুষমভাবে এবং যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে পরিচালিত হচ্ছে কি না, এটি পর্যবেক্ষণ এবং নিশ্চিত করাই হলো এই শীর্ষ সংস্থা- CSBIBB-এর প্রধান কাজ। ১৯৯৫ সালে IBCF বা ‘ইসলামী ব্যাংকস কনসালটেটিভ ফোরাম’ গঠিত হয়। এই সংস্থার কাজ হলো ইসলামী ব্যাংকগুলোর স্বার্থ এবং সংশ্লিষ্টতাকে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের অন্যান্য নিয়ন্ত্রণকারী (রেগুলেটরি) সংস্থাগুলোর নিয়ম-নীতি, বিধি-বিধান এবং চাহিদার মধ্যে সমন্বয় সাধন নিশ্চিত করা। ইসলামী ব্যাংকিং পদ্ধতি নানা দার্শনিক ও ব্যাংকিং কৌশলগত বিবেচনায় বিশ্বব্যাপী এক নতুন আর্থিক ব্যবস্থাপনার ধারণা এবং সেই অভিনব ধারণার প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত রূপায়ণের একটি অগ্রসরমান, নিত্য-বিবর্তনশীল, বহুমুখী এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক কৌশল।

অর্থনীতিবিদদের অনেকেই বিশ্বাস করেন, পুঁজিবাদের ক্রমবর্ধমান অকার্যকারিতার মুখে কল্যাণমুখী, অংশগ্রহণমূলক ও সামাজিক সুবিচার-অভিমুখী ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক পরিচালিত ইসলামী ব্যাংকিং ধারা আরো নিবিড়ভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠার সব লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এর প্রধান কারণ এবং আনুকূল্যগুলোর মধ্যে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থার সুদমুক্ত মূলভিত্তি, সততা, নৈতিক মূল্যবোধ, শরিয়াহ অনুশাসন এবং সেগুলো কঠোরভাবে প্রতিপালনের জন্য নিজ নিজ ব্যাংকের শরিয়াহ বোর্ড এবং কেন্দ্রীয় শরিয়াহ অ্যাডভাইজরি বোর্ডের নৈতিক প্রহরা এবং অভিভাবকত্ব। যে জনপ্রিয়তা এবং গণ-আস্থা মাত্র চার দশকের মধ্যে একটি অভিনব আর্থিক ব্যবস্থাপনার ধারণাকে প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত রূপ প্রদানে সমর্থ হয়েছে এবং নবীন ব্যাংকারদের দক্ষতা ও প্রবীণ ব্যাংকারদের অভিজ্ঞতার মিশেলে এই সুদমুক্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে এতগুলো বছর অবধি নিয়ে এসেছে, সেই ধারা আর মাত্র একটি দশক চলমান রেখে এর সাথে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটাতে পারলে ইসলামী ব্যাংকগুলো এবং ইসলামী ব্যাংকিং গোটা দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় আমূল রূপান্তর ঘটাতে পারবে বলে আশা করা যায়।

ব্যাংকিং বাজারে প্রবল উপস্থিতি, গ্রাহক আস্থার ফলে বিপুল আমানত, বিনিয়োগ, রেমিট্যান্স এবং সব বিধান মেনে চলার মধ্য দিয়ে অর্জিত ‘রেগুলেটর’ বা নিয়ন্ত্রকদের বিশ^াস এবং আস্থা মাত্র চার দশকের মধ্যে একটি পরীক্ষামূলক ব্যাংকিং ‘টুল’ থেকে আজ ইসলামী ব্যাংকিংকে একটি পরিপূর্ণ আর্থ-সামাজিক তত্ত্ব, বাস্তব ও নৈতিক ধারণায় উত্তীর্ণ করতে সক্ষম হয়েছে। এই ব্যতিক্রমী ব্যাংকিং পদ্ধতির উত্তরোত্তর গতি বৃদ্ধি ও আরো বিকাশ অর্থশাস্ত্রেরই এক গাণিতিক বাস্তবতা। এই বাস্তবতা অকার্যকর করার মতো শ্রেয় বা কার্যকরী বিধান এখন পর্যন্ত উদ্ভাবন হয়নি। ২০০৮ সালের অর্থবাজার সঙ্কটকালে সেই সত্যটি সবারই বিবেচনার মধ্যে এসেছে। আগে নিজেকে টেকসই করে ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থা জাতীয় অর্থনৈতিক কাঠামোকে টেকসই করার ব্রতে অত্যন্ত দ্রুত ও কার্যকরভাবে অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছে। এতে করে ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে আরো অন্তর্ভুুক্তিমূলক করার লক্ষ্য এবং সরকার ও জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করাও সহজ হয়েছে। মাত্র চার দশকের মধ্যেই ইসলামী ব্যাংকিং বিভিন্ন খাতে, বিভিন্ন সূচকে এবং ব্যাংকিংয়ের বিভিন্ন ধারণাগত ভিত্তিতে এর মূলধন শেয়ার বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, দেশের মোট ব্যাংকিং খাতের আমানতের ২৬ শতাংশ, মোট আমদানি বাণিজ্যের ২৬ শতাংশ, রফতানি বাণিজ্যের ২৪ শতাংশ, রেমিট্যান্সের ৩৯ শতাংশ, শিল্প-বিনিয়োগের ২৭ শতাংশ, কৃষি বিনিয়োগের ১৭ শতাংশ এবং ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্পের ৩৮ শতাংশ হিস্যাদার এখন দেশের ইসলামী ব্যাংকগুলো। এই অর্জন সূচকসারি শুধু আশাপ্রদই নয়; রীতিমতো বিস্ময়করও বটে। জনসাধারণের ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি গভীর অঙ্গীকার ও অগ্রাধিকারেরই পরিচয় বহন করে। সেই অর্থে, ইসলামী ব্যাংকগুলোর সম্মিলিত পরিসম্পদ, বৈধ পথে ও ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ, দারিদ্র্য বিমোচন ও আত্ম-কর্মসংস্থান, পল্লী ও কৃষি বিনিয়োগ, ইসলামী মূলধন বাজার, ইসলামী বীমা বা ‘তাকাফুল’, নিরাপত্তা সঞ্চয়, ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিকাশ, নৈতিক ব্যাংকিং, বিনিয়োগ বৈচিত্র্য- প্রভৃতির নিরিখেও বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।

বাংলাদেশের ইসলামী ব্যাংক ব্যবস্থার কল্যাণকর বৈশিষ্ট্যের অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র হলো এর সামাজিক দায়বদ্ধতার উদারনৈতিক বহিঃপ্রকাশ। ইসলামী ব্যাংকিং পণ্যগুলো সাধারণ মানুষের আর্থ-সামাজিক মঙ্গলের নেপথ্যে নিত্যক্রিয়াশীল। এর কল্যাণকর সেবাকার্যক্রমও তেমনি সামাজিক দায় পালনের এক বড় ধরনের দৃষ্টান্ত। শিক্ষার বিকাশ, প্রযুক্তি শিক্ষার ব্যাপকতা এবং আত্ম-কর্মসংস্থানমুখী দক্ষতা অর্জনে ইসলামী ব্যাংকগুলোর ভূমিকা ও অবদান অবিস্মরণীয়। বর্তমানের দারিদ্র্য এবং এর পাশাপাশি ভবিষ্যতের স্বপ্নাভিসারী ‘ডিজিটাল’ থেকে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এ উত্থানপর্বে ইসলামী ব্যাংকগুলো জাতীয় উন্নয়ন প্রবাহে গতি বৃদ্ধির বিরল ভূমিকায় আপন স্বাতন্ত্র্যের স্বাক্ষর রেখে যাবে, এই আশাবাদ মোটেও আবেগপ্রসূত নয়; সূচক-ভিত্তিক অবদানেরই বাস্তব প্রতিবিম্বে উদ্ভাসিত।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক


আরো সংবাদ



premium cement