১৭ মে ২০২৪, ০৩ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৮ জিলকদ ১৪৪৫
`


উৎসের উচ্চারণ

আসছে শয়তানবাদ!

-

বাইবেলে নিন্দিত, ধিকৃত ও অভিশপ্ত লুসিফার, ডেভিল বা স্যাটান শত্রু ও ঘৃণ্য চরিত্র হিসেবেই পশ্চিমা দুনিয়ায় প্রতিষ্ঠিত ছিল। হিব্রু ভাষায় তাকে বলে সতন বা শত্রু, বিরোধী; প্রাচীন গ্রিক ভাষায় সাতানা বা অভিযোগকারী, দানব, আরামীয় ভাষায় শ্যাতানা বা মন্দ আত্মা, পথভ্রষ্ট ইত্যাদি। ইসলামে সে শাইতান বলে অভিহিত। যার মানে বিতাড়িত, সীমালঙ্ঘনকারী, দাম্ভিক ও স্বৈরাচারী।
ইবরাহিমি বলে বিশেষায়িত ধর্মগুলোয় তো বটেই, অন্যান্য ধর্ম ও সংস্কৃতিতেও শয়তান নিন্দিত ও ঘৃণ্য চরিত্র। কিন্তু ইউরোপে ধীরে ধীরে শয়তান মহিমান্বিত হতে শুরু করল রেনেসার কালপর্বে। তখন তাকে এমন এক রূপক হিসেবে দেখানো হলো, যে অবিশ্বাস, ইচ্ছার স্বাধীনতা এবং জ্ঞান ও আলোকিত হবার চেষ্টার প্রতিনিধিত্ব করে। ১৭ শতকের ইংরেজ কবি জন মিল্টনের প্যারাডাইস লস্ট শয়তানকে উপস্থাপন করে এমন এক বিদ্রোহীর ভূমিকায়, যে ঘোষণা করছে- স্বর্গে সেবা করার চেয়ে নরকে স্বাধীন রাজত্ব করা উত্তম। উইলিয়াম ব্লেক, লর্ড বায়রন, পার্সি বি শেলি এবং উইলিয়াম হ্যাজলিট শয়তানকে প্যারাডাইস লস্টের নায়ক হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।

তাদের বিচারে শয়তান এতে নায়কের মতো হাজির হয়েছে। কারণ তার দৃষ্টিভঙ্গি আধুনিক সমাজের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। উইলিয়াম ব্লেকের কবিতায় শয়তানের নরক মহিম আবেদন নিয়ে উপস্থাপিত হয়। নরকের প্রবাদের সন্ধানে ব্লেকের আত্মকথন- ‘আমি যখন নরকের আগুনের ভেতর দিয়ে হাঁটছিলাম, প্রতিভা উপভোগের আনন্দে বিভোর, দেবদূতের কাছে যা যন্ত্রণাদায়ক ও মস্তিষ্কবিকৃতির কারণ, আমি তাদের কিছু প্রবাদ সংগ্রহ করলাম, এই ভেবে যে, নরকের প্রবাদ থেকে একটি রাষ্ট্রের চরিত্র বোঝা যায়, ঠিক তেমনই বাড়িঘর আর পোশাকের বর্ণনার চেয়ে বরং নরকের প্রবাদগুলো থেকে নারকীয় জ্ঞান অর্জন করা যায়।’ নারকীয় জ্ঞানের পথে চলেছেন শেলি, র্যাবো থেকে নিয়ে জন সির্ডি। প্রত্যেকের কাজে শয়তানের নরককে উপভোগ্য করে তোলার ধারা ক্রমপ্রসারমান থেকেছে। ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ, এপিকিউরীয়বাদ, নাস্তিক্যবাদ, অহংবাদ ও আত্ম-দেবত্ববাদ (self-deification) শয়তানবাদের মূল বিশ্বাস ও দর্শনগুলোকে গ্রহণীয় অর্থদানে উদ্দীপনা জুগিয়েছে।
থ্রিষ্টধর্ম বলছে, ঈশ্বরকে জগতের ভার দেয়া উচিত। কারণ তিনি অস্তিত্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সত্তা। কিন্তু আধুনিক মন বলছে ঈশ্বরের হাতে সব তুলে দিয়ে কেন আমরা নিজেদের পথ বেছে নেয়ার অধিকার হারাব? তাই ঈশ্বরের অধীনতার স্বর্গে সেবা করার চেয়ে নরকে রাজত্ব করা সত্যিই ভালো। কেননা এতে অন্তত আপনি স্বাধীন। এই দৃষ্টিভঙ্গির ওপর খাড়া হয়ে শয়তান হতে থাকে স্বাধীন ইচ্ছার প্রতীক। স্রষ্টার একচ্ছত্রতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের প্রতীক। বস্তুবাদ ও ব্যক্তিবাদ তাকে আকাক্সক্ষার বিষয় করে তুলেছে।
এর শ্রেষ্ঠ নজিরগুলোর অন্যতম হলো অ্যালেস্টার ক্রোলির ‘দ্যা বুক অফ দ্যা ল’। বইটি শয়তানবাদকে দেয় প্রবল প্রচার। ক্রোলি শয়তানকে প্রতীকীভাবে দেখেছিলেন। ১৯১৩ সালে প্রকাশিত তার কবিতা ‘অ্যা হাইমেন টু লুসিফার’ শয়তানকে মহাবিশ্বের আত্মা এবং বিদ্রোহের সরবরাহকারী হিসেবে উদযাপন করেছিল। ক্রোলির ধারণাগুলো শয়তানবাদকে পথ দেখায়।
অবশ্য রহস্যময় গ্রন্থ কোডেক্স গিগাস শয়তানের মহিমা রাষ্ট্র করছিল বহু আগ থেকেই। ত্রয়োদশ শতকের প্রথম অংশে হারম্যান রিকুলাস নামক চেকোস্লোভাকিয়ার এক সন্ন্যাসী লিখেন এ বই। ৩৬.২ ইঞ্চি লম্বা, ১৯.৭ ইঞ্চি চওড়া এবং ৮.৬ ইঞ্চি পুরু এই গ্রন্থ আকারের দিক থেকে দানবীয়। মনে করা হতো বইটির প্রকৃত লেখক হলো শয়তান। এতে আছে স্রষ্টার বিরুদ্ধে তীব্র বিষোদগার, বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা পদ্ধতি, ভয়ঙ্কর রোগের অভিশাপ ও মুক্তির তন্ত্র-মন্ত্র। কিভাবে কাউকে বশ মানানো যায়, কিভাবে কালো জাদু করতে হয়, কিভাবে ডাইনি চেনা যায় ইত্যাদির পাশাপাশি চতুর চোর ধরার বুদ্ধিও বাতলে দেয়া হয়েছে ল্যাতিন এই গ্রন্থে।

বইয়ের লেখক হারম্যান ছিলেন বেনেডিক্ট পোডলাজাইসের মঠের এক সন্ন্যাসী। মঠে নিষিদ্ধ কদাচারে লিপ্ত হবার ফলে বদ্ধ কুঠুরিতে তাকে আজীবন নিঃসঙ্গ রাখা হবে, সিদ্ধান্ত হয়। শাস্তি চলাকালে হারম্যান মুক্তির জন্য উদগ্রীব হলেন। মঠাধ্যক্ষ জানালেন কেবল এক শর্তে তাকে মুক্তি দেয়া যেতে পারে। শর্তটি হলো তার অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে এক রাতের মধ্যে একটি বই লিখে দিতে হবে। যাতে থাকবে স্রষ্টার মহিমা ও মানবকল্যাণের দিশা। হারম্যান সব শর্ত মেনে নিয়ে এক সন্ধ্যায় লিখতে বসেন। কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেষ্টা করেও লিখতে পারেননি কিছুই। মধ্যরাতে হতাশ হয়ে চাইলেন শয়তানের সাহায্য। নিজের রক্ত দিয়ে চিঠি লিখলেন শয়তানের সমীপে। যেন সে গ্রন্থ রচনায় হারম্যানকে সাহায্য করে। তাহলে তিনি নিজের আত্মা শয়তানকে সঁপে দেবেন। তার বন্দেগি করবেন বাকি জীবন।
শয়তান এতে সাড়া দিলো। নিজেই হাজির হলো সামনে। ভোরের আগেই লিখে দিলো কোডেক্স গিগাস গ্রন্থ। বইটি যে শয়তানের লেখা, এর প্রমাণ হিসেবে কোডেক্সের ২৯০ পৃষ্ঠায় স্বহস্তে সে অঙ্কন করে আপন ছবি। এই হলো বইটি ঘিরে তৈরি কিংবদন্তি। ষোড়শ শতকের শেষ দিকে বইটির প্রতি পশ্চিমা মনে আগ্রহ বাড়তে থাকে। বিশেষত প্রাগের সম্রাট একে চাইছিলেন যেকোনো মূল্যে। ফলে সন্ন্যাসীরা প্রাগ সম্রাট রুডলফকে বইটি উপহার দেয়। ১৬৪৮ সালে প্রাগের সাথে ৩০ বছরের যুদ্ধ শেষে বিজয়ী সুইডিশ সৈন্যরা এই বই লুট করে। বর্তমানে বইটি আছে স্টকহোমের সুইডিশ রয়াল লাইব্রেরিতে। যাবতীয় অস্পষ্টতা ও রহস্যময়তা নিয়ে বইটি শয়তানের প্রতি মোহ তৈরি করছিল। রেনেসাঁ-পরবর্তী ইউরোপে যার বিকাশ ঘটেছে বিচিত্র পথ ধরে।
শয়তানি মতবাদের যাত্রা পশ্চিমা দুনিয়ায় শুরু হয় নানাভাবে। ১৯৬৫ অবধি তা গোপনীয়তা রক্ষা করত। তাকে অবৈধ মনে করা হতো। প্রকাশ্যে তার উজ্জীবন ঘটে ১৯৬৬ সালে, আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার সানফ্রান্সিসকো শহরে চার্চ অব স্যাটান বা শয়তানের গির্জা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এন্টন স্যান্ডর ল্যাভি। নিজের বাড়িতেই তিনি প্রকাশ্যে তৈরি করেন টেম্পল অব স্যাটান। প্রবর্তন করেন উপাসনার শয়তানি রীতি। কালো পোশাক পরা অনুসারীদের নিয়ে প্রতি সপ্তাহে এর আয়োজন হতো। যাকে বলা হতো ব্ল্যাক হাউজ। এর মহাযাজকও ছিলেন তিনি। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয় ল্যাভি রচিত ‘স্যাটানিক বাইবেল’।
১৯৯৭ সালে ল্যাভির মৃত্যুর পরে চার বছর মহাযাজকের পদটি খালি ছিল। ২০০১ সালে পিটার এইচ গিলমোর হন চার্চ অব স্যাটানের মহাযাজক। তারপর নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটন শহরের ‘হেলস কিচেনে’ স্থানান্তরিত হয় এই চার্চ।
তখনই শয়তানের অনুসারীরা দুই দলে ভাগ হয়ে যায়। একদল আস্তিক; যারা শয়তানকে অহঙ্কার, ব্যক্তিবাদ এবং ইতিবাচকতার মূর্তপ্রতীক মনে করে। আর নাস্তিক শয়তানবাদীরা তাদের উপাস্যকে নেতিবাচকতার মূর্তপ্রতীক মনে করে। গিলমোরের অনুসারীরা পরিচিত হন সংশয়বাদী আস্তিক হিসেবে।

আস্তিক শয়তানবাদ আধ্যাত্মিক শয়তানবাদ বলেও পরিচিত। শয়তানকে দেবতা হিসেবে বিচার করা হয়। এতে কালো জাদুর ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতে হয়। যা কেবল অর্জিত হতে পারে শয়তানের আনুগত্যের মাধ্যমে। এতে পাপ-পুণ্যের সব ধারণা অস্বীকৃত। শয়তানের অনুকারিতার মধ্য দিয়ে আধ্যাত্মিক উন্নয়ন নিশ্চিত হবে।
অপর দিকে, নাস্তিক শয়তানবাদ চূড়ান্ত মাত্রায় আত্মকেন্দ্রিকতাকে উদযাপন করে। স্বভোগের ওপর জোর দেয়। শয়তানি বৈশিষ্ট্যগুলোকে মানুষের আসল প্রবণতা বলে দাবি করে। এর চর্চাকে বিকাশ দিতে চায় এবং চোখের বদলে চোখ নীতিতে তা করতে থাকে। নিজেদের লোকদের প্রতি সদয় আর শত্রুদের প্রতি নিষ্ঠুরতা এখানে আবশ্যকীয় বিষয়। নাস্তিক শয়তানবাদ ‘আধ্যাত্মিক’ বা ‘পবিত্র’ বলতে কোনো কিছুকে স্বীকার করে না। তারা কোনো কিছুর অতিপ্রাকৃতিক ব্যাখ্যা দেয় না। তারা বরং নিরীশ্বরবাদের প্রতি প্রগাঢ় বিশ্বাস লালন করে।
শয়তানবাদের বিশ্বাসের সার কথা হলো ‘Do what thou wilt shall be the whole of the law’ি, যা ইচ্ছে তাই করো, এটাই হলো সম্পূর্ণ বিধান। ঈশ্বর কিংবা শয়তানের উপাসনা এতে মুখ্য নয় মোটেও। যদিও শয়তানের মন্দিরে রয়েছে একটি ৮ ফুট ৬ ইঞ্চি ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য। এর মাথাটি অনেকটা ছাগলের মতো। পিঠে ঈগল পাখির মতো ডানা। নাম ‘ব্যাফোমেট’। কিন্তু এটি কোনো দেবতা নয়; বরং দেবতাকে প্রত্যাখ্যানের প্রতীক এটি।
ধর্ম মানুষকে তার নিজস্ব মানববৃত্তি পালন করতে বাধা দিচ্ছে। এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সব পদ্ধতিই শয়তানের পদ্ধতি। এখানে ঈশ্বর বলতে কিছু নেই। ঈশ্বর আসলে আপনি নিজেই। ফলে আপনার স্বেচ্ছাচারই আপনার সত্য। আপনার ভালোটাই ভালো, আপনার মন্দটাই মন্দ। যৌনাচার, মাদক ব্যবহার, স্বেচ্ছাচার এবং নিজের প্রবৃত্তির যেকোনো ডাকে যেকোনো উপায়ে সাড়া দেয়াটাই আপনার ধর্ম। এখানে ভালো, মন্দ, স্বীকৃত-অস্বীকৃত বলে কোনো কিছু নেই। ন্যায্যতা-অন্যায্যতা বলতেও কোনো কিছুর গ্রহণযোগ্যতা নেই। এর যখন বাস্তবায়ন ঘটবে, তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে ব্যক্তিগত সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা এবং ইচ্ছার স্বাধীনতা। আর এটাই শয়তানবাদী নৈতিকতার মর্ম কথা।
শয়তানবাদ নিজস্ব পরিচয় নিয়ে স্বতন্ত্র ধর্মের মর্যাদায় এখন প্রতিষ্ঠিত হতে চায়। ২০০৪ সালের অক্টোবরে ২৪ বছর বয়সী মার্কিন প্রযুক্তিবিদ ক্রিস ক্রানমার শয়তানি ধর্মে বিশ্বাসী হিসেবে প্রথমবার স্বীকৃতি পান। ২০০৬ সালের ৬ জুন চার্চের ৪০তম বার্ষিকী উপলক্ষে লস অ্যাঞ্জেলেসের সেন্টার ফর ইনকুইয়ের স্টিভ অ্যালেন থিয়েটারে প্রকাশ্যে প্রথম স্যাটানিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমানে ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের সালেমের কেন্দ্রে শয়তানের মন্দিরের সদর দফতর অবস্থিত। এ ছাড়া ইউরোপ, কানাডা, আফ্রিকাসহ নানা অঞ্চলে রয়েছে এর বহু শাখা। যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজস্ব পরিষেবা বিভাগ এই মন্দিরকে ‘কর’ ছাড় দিয়েছে।
২০১৯ সালে মার্কিন সরকার কর্তৃক এটি ধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ফলে শিক্ষাব্যবস্থায় এর বিশ্বাস ও ভাবধারা অন্তর্ভুক্তি অবধারিত। এর প্রভাব ধীরে ধীরে অন্যান্য রাষ্ট্রে ছড়াচ্ছে, ছড়াতে থাকবে। এই বিশ্বাসের অনুসারী তৈরি ও তাদের বিশ্বাসের প্রতি মর্যাদাদানের ব্যাপারটিকে মানবাধিকারের অন্তর্গত বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রয়াসও আমরা লক্ষ করব। যার ধাক্কা আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার প্রতি বিপজ্জনকভাবে চোখ রাঙাবে, এটা বলাই যায়।
লেখক : কবি, গবেষক
71.alhafij@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement