২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

করোনায় হাইব্রিড নেতাদের গাঢাকা

-

করোনাভাইরাসের এ কঠিন সময়ে দেশের প্রায় বেশির ভাগ জনপ্রতিনিধি এখন লাপাত্তা। দু-একবার প্রতীকী ত্রাণ বিতরণের মিডিয়া ট্রায়াল ছাড়া প্রকৃতপক্ষে জনপ্রতিনিধিরা এখন কোথাও কেউ নেই। সারা দেশে অসহায় হয়ে দিন কাটাচ্ছে সাধারণ মানুষ। করোনার কারণে কর্মহীন সবাই। সবকিছু বন্ধ থাকায় নিম্ন আয়ের মানুষ বড় কষ্টে দিন পার করেছে। অথচ এই দুর্যোগের সময় বেশির ভাগ জায়গায় মানুষ তাদের প্রতিনিধিদের কাছে পায়নি। তবে, তাদের অনেকের চুরি-চামারির খবর দেখছে শুনছে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে। আবার দেশে করোনা সঙ্কট থেকে উত্তরণে দিনমজুর ও শ্রমহারা মানুষের জন্য সরকারের প্রণোদনা দেয়া খাদ্য-অর্থ সহায়তা বেশির ভাগ লুটে নিচ্ছেন তারাই।
দেশে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান রয়েছেন ৪৫৭১ জন; মেম্বার ৪১১৩৯ জন এবং মহিলা সদস্য ১৩৭১৩ জন। উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ৪৯২ জন, সদস্য ৯৮৪ জন। জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ৬১ জন, সদস্য ৯১৫ জন এবং সংরক্ষিত আসনের নারী সদস্য ৩০৬ জন। সারা দেশে ১২টি সিটি করপোরেশনে মেয়র, কমিশনার, মহিলা কমিশনার কয়েক হাজার। এর বাইরেও রয়েছে ৩৩০টি পৌরসভা। সেখানে রয়েছেন মেয়র, কমিশনার ও নারী সদস্য। সংরক্ষিত আসনসহ সংসদ সদস্যের সংখ্যা ৩৫০। হিসাব করলে দেখা যায় ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, সদস্য ও সংরক্ষিত আসনে মহিলা সদস্যের সংখ্যা ৬২ হাজার ১৮১। এ ছাড়া ১২টি সিটি করপোরেশন, ৩৩০টি পৌরসভায় জনপ্রতিনিধি কয়েক হাজার। সংসদে ৩৫০ জন এমপিসহ জনপ্রতিনিধির সংখ্যা প্রায় পৌনে এক লাখ।
করোনা পরিস্থিতিতে তাদের ১০ শতাংশকেও দেখেনি এলাকার মানুষ। এমপি-উপজেলা চেয়ারম্যানসহ তাদের অনেকে ঢাকায় আয়েশে সময় কাটাচ্ছেন। স্থানীয় সরকারের কেউ কেউ জেলা সদরে নিরিবিলি ‘নিজে বাঁচলে পরের নাম’ তত্ত্ব অনুযায়ী মাঝে মধ্যে মিডিয়া ট্রায়াল দিয়ে বেশির ভাগ সময় গাঢাকার মতো আছেন। এলাকায় নিয়মিত থাকা ব্যক্তিদের কয়েকজন আছেন ত্রাণ কেলেঙ্কারিতে আর নগদ সহায়তা প্রকল্পে নিজের লোকদের একই মোবাইল নাম্বার বহু জায়গায় ব্যবহার করে টাকা লুফে নেয়ার প্রতিযোগিতায়। গণমাধ্যমে খবর এসেছে, ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয় থেকে প্রায় ৮ লাখ মোবাইল নাম্বার বাতিল করা হয়েছে। নেতারা কেউ কেউ তালিকা তৈরিকে দলীয়করণের অভিযোগে অভিযুক্ত।
২৬ মার্চ থেকে দেশে লকডাউন শুরু হয়েছিল। তখন থেকেই সরকারি ত্রাণ ও খাদ্যসহায়তা কার্যক্রমের চাল আত্মসাৎ ও অনিয়মের খবর আসতে থাকে। করোনার প্রাদুর্ভাবে লকডাউনের কারণে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় চাল, টাকা ও শিশুখাদ্য ত্রাণ হিসেবে দিচ্ছে। সম্প্রতি শুরু হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর নগদ অর্থসহায়তা প্রকল্প। খাদ্য মন্ত্রণালয় টিসিবির মাধ্যমে ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি করেছে। এর বাইরে মহিলা ও শিশুবিষয়ক এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনেও খাদ্যসহায়তা দেয়া হচ্ছে। অনিয়মের কারণে ১০ টাকা দরের চাল বিক্রি বন্ধ রাখা হয়েছিল। পরে চাহিদার কারণে তা আবার চালু হয়েছে। করোনার দুর্যোগের সময় অভাবী মানুষের চাল আত্মসাৎসহ বিভিন্ন অপরাধে এ পর্যন্ত ৫৪ জন ইউপি চেয়ারম্যান ও ৮৭ মেম্বারকে বরখাস্ত করা হয়েছে এবং অর্ধশত জনপ্রতিনিধিকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। তাদের মধ্যে ৩৯ জনই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে পাঁচজন ছাড়া এখন পর্যন্ত অন্যদের বিরুদ্ধে দলীয় কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। লকডাউন শুরুর পর থেকে ৬০ জনের মতো পরিবেশক (ডিলার), চাল ব্যবসায়ী ও তাদের সহযোগী চাল আত্মসাৎ করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়েছেন। তাদেরও বেশির ভাগ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতা, কর্মী ও সমর্থক। আবার কেউবা সহযোগী সংগঠনের নেতা। ত্রাণ আত্মসাৎ ও অনিয়মে বরখাস্ত হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে কয়েকজন বিরোধী দলের নেতা, সমর্থক ও কর্মীও রয়েছেন। ক্ষমতাসীন দল থেকে ত্রাণ আত্মসাতের বিষয়ে কড়া বক্তব্য দিলেও আত্মসাৎকারীদের বিরুদ্ধে দলীয় ব্যবস্থা নেয়ার তথ্য নেই। সারা দেশে অভিযোগ রয়েছে এমন আরো অনেক জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িত থাকার। কিন্তু স্থানীয় জেলা প্রশাসক যাদের নামে সুপারিশ করেন, তাদেরই শুধু বরখাস্ত করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। সংবাদমাধ্যমের সূত্র থেকে জানা যায়, চেয়ারম্যান, মেম্বার, মাঠের দলীয় পদ পেতে অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে তাদের। ‘সেই অর্থ তুলতে’ গিয়ে এখন চুরি আর দুর্নীতি করতে হচ্ছে। তা করোনা বা ভিক্ষার চাল হলেও যেন সমস্যা নেই। ধরা পড়লে কোথাও কোথাও স্থানীয় এমপি ওদের ছাড়াতে আদালতেও যান। দলীয় নেতারা তাদের পাশে দাঁড়ান।
সম্প্রতি সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, ত্রাণ চুরির খবরের পেছনে মতলববাজরা জড়িত। তারা সরকার ও দলের ভাবমূর্তি নষ্টের কাজে জড়িত। আবার সরকারি ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম নিয়ে অপপ্রচার চলছে বলে অভিযোগ করে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারি ত্রাণ নিয়ে অপপ্রচার লাগে না। বড় বড় অঙ্কগুলো একটু হিসাব করলেই বোঝা যায় এই ত্রাণ বিতরণের অবস্থাটা কেমন।
এ দিকে সরকারি দলের ছত্রছায়ায় ব্যবসা বাগানো ধড়িবাজরাও এই দুর্যোগে গাঢাকা দিয়েছে। রাজনীতির ছত্রচ্ছায়ায় ব্যাংক লুট, শেয়ার ব্যবসার নামে জুয়াড়ি, অর্থ পাচারকারীদের কেউ কেউ ভেতরে ভেতরে আবার আলাদা বলয় তৈরি করে ফেলেছেন। এদের কেউ বিদেশে বানাচ্ছেন শপিংমল, পাঁচতারকা হোটেল, বিশাল অফিস ভবন। কেউ অর্থ সরিয়ে নিয়ে গেছেন সিঙ্গাপুর, ব্যাংকক, দুবাই, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায়। এক দিকে ক্ষমতা, অন্য দিকে অর্থের পাহাড়। এই শ্রেণীও বেশ সতর্ক। কঠিন এ সময়ে মানুষের ধারেকাছেও ঘেঁষছেন না তারা। কারো কারো ধারণা হয়েছিল, করোনার বিপর্যয়ে মানবতা ফিরে আসবে; চেতনা ফিরবে; নৈতিকতার সঙ্গে ধর্মীয় ভয় জাগবে এবং মহামারী মানুষকে নতুন পথ দেখাবে। মোটকথা, চুরি-চামারি থেকে কিছুটা হলেও সরিয়ে আনবে। আশা ছিল, এই সময়ে অপরাধে জড়াবে না কেউ। হবে না খুনোখুনি। চুরি-ডাকাতি হবে না। বাস্তবে কি এসব হচ্ছে? বরং সবই চলছে আগের গতিতে। একটুও কমেনি অপকর্ম। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরো বেড়েছে। এমন কঠিন আজাবের মধ্যেও কোনো কোনো অপকর্ম আগামী দিন সম্পর্কে রীতিমতো নতুন করে ভাবনার দাবি রাখে। জনপ্রতিনিধিরা অন্য গ্রহের কেউ নন। তবে দেশের অন্যদের চেয়ে তারা একটু বেশি চালাক। করোনাভাইরাসের এক কঠিনতম সময়ে তারা বিশেষ করে বাংলাদেশের শাসকদলীয় জনপ্রতিনিধিরা সেটা আরেকবার দেখিয়ে দিলেন।
গণমাধ্যমে তাদের কয়েকজনের খবর এসেছে মাত্র। আবার কয়েকজনের ত্রাণ চুরির রকমফেরে এ কষ্টকর সময়েও কিছু অমানবিক ঘটনা ঘটেছে। উদাহরণ হিসেবে এমন কয়েকটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করা যায় যেগুলো মিডিয়ায় এসেছে।
১. চট্টগ্রামের হাটহাজারীর একটি ইউপি চেয়ারম্যান এলাকার মানুষকে ডেকে ২৬টি পরিবারকে তিনি ত্রাণ দেন এবং ত্রাণদানের ছবি তোলেন। পরে সবার থেকে সেই ত্রাণ কেড়ে নিলেন। উপস্থিত মানুষ প্রতিবাদ করলে উল্টো পিটুনি খায়। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে ওই ত্রাণবিতরণের কিছু ফুটেজ। ২. রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আড়া পৌরসভার মেয়র হাটহাজারীর মতো চাতুরীতে না গিয়ে সরাসরি ‘অ্যাকশন’ করেছেন। ‘মারের ওপর ওষুধ নাই’ থিওরি পছন্দ তার। ত্রাণ চাওয়ায় সরাসরি মার দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। ৩. বুদ্ধি না খাটিয়ে দম্ভ দেখাতে গিয়ে ধরা খেয়েছেন নওগাঁর রানীনগর উপজেলার কালিগ্রাম ইউনিয়নের স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা। ডিজিটালের দোষে ফাঁস হয়ে গেছে তার গরিবের চাল নিজের গুদামে রাখার খবর। পরে ঘটনাস্থলে পৌঁছে খাদ্য অধিদফতরের সিল মারা ১৩৮টি চালের বস্তা জব্দ করেন ইউএনও। ৪. কিছুটা ভিন্ন পন্থায় পা বাড়িয়েছিলেন ঝালকাঠি সদর উপজেলার বাসন্ডা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু কৌশলী হলেও শেষ পর্যন্ত ধরা খেতে হয়েছে। ৫. বগুড়ার সারিয়াকান্দি কুতুবপুর বাজারের ডিলার চেয়েছিলেন হতদরিদ্রের চাল নিজের মতো করে ব্যবহার করতে। ওএমএসের ১০ টাকা কেজি দরের ২৮৮ বস্তা চাল আত্মসাতের অভিযোগে তাই তার জেলও হয়েছে এক মাস। এভাবে দিন দিন নানা ঘটনায় বাংলাদেশে জনপ্রতিনিধিত্বের সংজ্ঞা, ব্যাখ্যা, উদাহরণ পাল্টে যেতে বসেছে।
এ দিকে গত দু-তিন মাস ধরে ব্যবসায়ী বা ভিআইপি এমপি রাজনীতিবিদদের কোনো রোগশোকও যেন হচ্ছে না। কারণ তারা বরাবরের মতো এখন কেউ প্রেশার, হাঁচি-কাশি, নাক, কান চুলকানির মতো জটিল উপসর্গ পরীক্ষা বা নিয়মিত চেকআপের অংশ হিসেবে বিদেশ যাচ্ছেন না। এখন সেই সুযোগও নেই। কারণ সারা পৃথিবীই মহামারী করোনায়
আক্রান্ত। দেশে থাকার পরও কেন যেন তাদের পাচ্ছে না মানুষ। কোথায় তারা? কী করেন? জনসম্পৃক্ত জনপ্রতিনিধি না হওয়ায় এ অবস্থা হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। আগে জনপ্রতিনিধি হতে ভোটের জন্য ভোটারের কাছে যেতে হতো। প্রার্থীদের গত কয়েক বছর ধরে জাতীয়-স্থানীয় কোনো নির্বাচনেই জনপ্রতিনিধি হতে মানুষের কাছে যেতে হচ্ছে না। অপকৌশলের কারণে চেয়ারম্যান, মেম্বার, মেয়র, এমপি হতে এখন আর জনগণের ভোট ‘ম্যাটার’ করে না। ফলে জনগণের প্রতি জনপ্রতিনিধিদের দায়বদ্ধতা আগের মতো থাকার তেমন কারণও নেই।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement
চিকিৎসার জন্য ঢাকা ছাড়লেন বিএনপি নেতা আমীর খসরু কুষ্টিয়াতে মসজিদ কমিটি নিয়ে সংঘর্ষে আহত ৫ চেয়ারম্যান তপন ও অজিত মেম্বারকে ধরিয়ে দিতে পারলে পুরস্কার ঘোষণা নারায়ণগঞ্জে ২৪ ঘণ্টায় ১৪ ডাকাত সদস্য গ্রেফতার রাজশাহীতে মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি ছাড়াল যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশী শ্রমিকদের ভিসা সহজ করার আহ্বান প্রবাসী প্রতিমন্ত্রীর চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী না হয়ে অংশীদার হওয়া উচিত : শি জিনপিং ওকাব সভাপতি নজরুল ইসলাম, সম্পাদক জুলহাস আলম পাবনায় ১০ কোটি টাকার অনিয়মে ৩ ব্যাংক কর্মকর্তা কারাগারে চুয়েট ১১ মে পর্যন্ত বন্ধ, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন স্থগিত নরসিংদীতে হিট স্ট্রোকে শিশুর মৃত্যু

সকল