২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`
আজ ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী

একজন অবিস্মরণীয় বিচারপতি

-

উপমহাদেশের স্বনামখ্যাত আইনবিদ, মানবতাবাদী সমাজতিহৈষী, আইনের শাসন ও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা প্রতিষ্ঠার অন্যতম রূপকার এবং ‘সার্ক’-এর অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোরশেদের আজ ৪১তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৭৯ সালের ৩ এপ্রিল তিনি ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। ১৯১১ সালের ১১ জানুয়ারি কলকাতায় এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তার জন্ম। বিচারপতি মোরশেদ ছিলেন একজন যথার্থ সংস্কৃতিবান ব্যক্তিত্ব, যিনি সুযোগ সীমিত থাকা সত্ত্বেও নানা ধরনের রাজনৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালন করে সাধারণ মানুষের ভালোবাসা অর্জন করেন।
অন্যান্য ক্ষেত্রের তুলনায় আইন পেশায় বাঙালি মুসলমানের প্রবেশ ঘটে অনেক বিলম্বে। উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের গোড়ার দিকে পাশ্চাত্য শিক্ষিত মুসলমান আইনজীবীর সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য। অথচ স্বাধীন পেশা হিসেবে তখনো সমাজে আইন পেশার গুরুত্ব ছিল অসামান্য। বিশেষ করে ঔপনিবেশিক আমলে তারা রাজনৈতিক ও অন্যান্য সামাজিক আন্দোলনে অংশ নিতে পারতেন অন্য পেশাজীবীদের তুলনায় অনেক বেশি।
সৈয়দ মাহবুব মোরশেদের পূর্বপুরুষ স্যার সৈয়দ আমীর আলী (৬ এপ্রিল ১৮৪৯-৩ আগস্ট ১৯২৮) কলকাতা হাইকোর্টের প্রথম মুসলমান বিচারপতি ছিলেন। এরপর তার ছেলে সৈয়দ তারেক আমীর আলীসহ আরো অনেক বাঙালি মুসলমান হাইকোর্টের বিচারপতি হন। মোরশেদ হাইকোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর। এর মধ্য দিয়ে তখনকার সমাজে বাঙালি মুসলমানদের জন্য উচ্চ আদালতসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের রুদ্ধ দ্বার উন্মোচিত হতে শুরু করে। বিচারপতি মোরশেদ ছিলেন সত্যিই এক অনন্য ব্যতিক্রম। কারণ কর্মক্ষেত্রে যেমন, তেমনি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও তিনি এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। সামাজিক দায়বদ্ধতার কারণে তার কর্মক্ষেত্র ছিল অনেক প্রসারিত। একপর্যায়ে তিনি প্রধান বিচারপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শামিল হতে দ্বিধা বোধ করেননি। বিচারপতি-জীবনে তিনি অনেক জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ মামলার ঐতিহাসিক ও সময়োপযোগী রায় দিয়ে স্বৈরশাসনের মধ্যেও আইনের শাসন সমুন্নত রাখেন। বাংলা-ইংরেজি ছাড়াও আরবি-ফারসি ভাষায় তার পাণ্ডিত্য ছিল। আইন ছাড়াও তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতির বিষয়ে বহু নিবন্ধ লিখেছেন। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি আসামান্য ভূমিকা রেখে গেছেন। গণতন্ত্রের পক্ষে তিনি ছিলেন একজন অবিচল প্রবক্তা। সর্বোপরি, তার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও বৈদগ্ধ সব প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা ও উজ্জ্বলতাকে অতিক্রম করেছে।
মাহবুব মোরশেদের পিতা সৈয়দ আবদুস সালেকও সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করে তিনি যোগ দেন বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর হিসেবে তিনি বগুড়া, দিনাজপুর প্রভৃতি জেলায় ছিলেন। একজন ধর্মপ্রাণ, সৎ ও দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে তার বেশ খ্যাতি ছিল। মাহবুব মোরশেদের মা আফজালুন্নেসা বেগম শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের বোন। ১৯৩৯ সালের ১ অক্টোবর কলকাতার মেয়র এ কে এম জাকারিয়ার কন্যা লায়লা আরজুমান্দ বানুর সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন মাহবুব মোরশেদ। তাদের চার সন্তানের মধ্যে সর্বজ্যেষ্ঠ কন্যা সাঈদা মোরশেদ। দ্বিতীয় সন্তান (জ্যেষ্ঠ পুত্র) সৈয়দ মার্গুব মোরশেদ সরকারের সংস্থাপন-সচিবসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। তৃতীয় পুত্র মামনুন মোরশেদ লন্ডন কলেজ অব মিডিয়া অ্যান্ড টেকনোলজির অধ্যক্ষ এবং কনিষ্ঠ পুত্র মানসুর মোরশেদ বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটির প্রো-ভিসি।
মাহবুব মোরশেদ স্কুলের প্রতিটি শ্রেণীতে প্রথম হয়েছেন। ১৯২৬ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় তিনি বগুড়া জিলা স্কুল থেকে প্রথম হয়েছিলেন। তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯৩১ সালে অর্থনীতিতে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর কলকাতা বিশ^বিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এমএ এবং প্রথম শ্রেণিতে এলএলবি ডিগ্রি নেন। মেধাবী ছাত্র মোরশেদ ছাত্রজীবনেই বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যের বিখ্যাত লেখকদের উল্লেখযোগ্য বইগুলো পড়া শেষ করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ-ম্যাগাজিনের তিনি সম্পাদক ছিলেন একবার। তিনি তুখোড় বক্তা হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্ক দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। কলেজজীবনে তিনি ক্রীড়াক্ষেত্রেও সুনাম অর্জন করেন। ৩০-এর দশকে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সংগঠকের দায়িত্বও পালন করেন।
মাহবুব মোরশেদ কলকাতা হাইকোর্টে আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন ১৯৩৪ সালে। তিনি নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের অগ্রজ শরৎচন্দ্র বসু (১৮৮৯-১৯৫০) এবং খ্যাতনামা আইনজীবী কে বি খাইতানের জুনিয়র হয়ে কাজ করার সুযোগ লাভ করেন। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই তিনি আইনে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য যুক্তরাজ্য চলে যান। ১৯৩৮ সালে বিখ্যাত লিংকন’স ইন থেকে বার অ্যাট ল’ (ব্যারিস্টার) ডিগ্রি লাভ করেন। দেশে ফিরে তিনি আবার আইন পেশায় আত্মনিয়োগ করেন এবং ১৯৫১ সালে ঢাকা হাইকোর্ট বারে যোগ দেন। ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা বারে প্র্যাকটিস করেছিলেন। নানা ঘটনায় সময়টা ছিল উত্তাল। এসব ঘটনা নিয়ে তিনি সচেতন ছিলেন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন।
১৯৫৫ সালে, যখন সোহরাওয়ার্দী আইনমন্ত্রী, তখন সৈয়দ মাহবুব মোরশেদ পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের বিচারক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংসদীয় গণতন্ত্রের বিধানসংবলিত প্রথম শাসনতন্ত্র প্রণয়নে যারা সোহরাওয়ার্দীকে সাহায্য করেছিলেন, মোরশেদ ছিলেন তাদেরই একজন। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকও কিছু দিন পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের আইনমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ছিলেন আইনের শাসনের অবিচল প্রবক্তা। ১৯৫৮-এর অক্টোবরে সেনাপ্রধান জেনারেল আইয়ুব খান রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। সংসদীয় গণতন্ত্রের শাসনব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে যায়। মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়। তখন দেশের উচ্চ আদালতের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তখন বিচারপতির আসনে থেকে সৈয়দ মাহবুব মোরশেদকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলা নিষ্পত্তি করতে হয়েছে। এর মধ্যে অনেক মামলা ছিল প্রতাপশালী সরকারের বিরুদ্ধে। মরহুম বিচারপতি আবদুর রহমান চৌধুরীর মতে, বিচারপতি মোরশেদের অনেক রায় ছিল ইতিহাসের মাইলফলক, সাংবিধানিক আইনের ম্যাগনাকার্টা স্বরূপ। একবার (১৯৬৪) পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ল পূর্ব পাকিস্তানে। বিচারপতি মোরশেদ হাইকোর্ট থেকে সুয়োমোটো (স্বপ্রণোদিত রুল) জারি করলেন, ফলে এ দেশের সংখ্যালঘুদের ওপর আঘাত আসতে পারেনি। তিনি কিছুকাল পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের (আপিল বিভাগ) অস্থায়ী বিচারক ছিলেন। সেখানেও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। এর আগে, ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষ এবং ’৪৬-এর দাঙ্গার সময় তিনি আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম প্রতিষ্ঠার সাথে যুক্ত থেকে মানবিক ও সমাজসেবামূলক অনেক কাজেও অংশ নিয়েছেন। ’৪৭-এর দেশ ভাগের পর ঐতিহাসিক নেহরু-লিয়াকত চুক্তিতেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন।
বিচারপতি মোরশেদ প্রধান বিচারপতি থাকা অবস্থায় সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছেন। ১৯৬৬তে তিনি ঐতিহাসিক ৬ দফার খসড়া প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। শুধু অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণেই মোরশেদ ৬ দফা প্রণয়নে সম্পৃক্ত হননি, ৬৫-এর যুদ্ধের পরে তিনি উপলব্ধি করেন যে, পূর্ববাংলার প্রতিরক্ষা-ব্যবস্থাও যথেষ্ট মজবুত ছিল না। এই বিষয়টিও গভীরভাবে তার চিন্তার মধ্যে ছিল। ১৯৬৯-এ প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের গোলটেবিল বৈঠকে বিচারপতি মোরশেদ ‘ওয়ান ম্যান ওয়ান ভোট’ দাবি করেছিলেন। তার যুক্তি ছিল, ওয়ান ইউনিট ভেঙে দেয়ার পরে জনসংখ্যার ভিত্তিতে পূর্ব বাংলা ছিল সংখ্য্যাগরিষ্ঠ এবং এই অঞ্চলের ভোটেই ’৪৭ সালে পাকিস্তান গঠিত হয়েছে। এ কারণে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬৯টি আসন পূর্ব বাংলার প্রাপ্য। সেই হিসাবে, এই অঞ্চলে যে দল বেশি আসন পাবে, সেই দলই কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের দাবিদার।
১৯৭১-এর ৮ মার্চ সুপ্রিম কোর্টের একদল আইনজীবী পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে টিক্কা খানের শপথগ্রহণের বিষয়ে বিচারপতি মোরশেদের কাছে পরামর্শ চাইলে তিনি দৃঢ়তার সাথে বলেছিলেন, এই মুহূর্তে দেশে একটা সাংবিধানিক শূন্যতা চলছে, এই পরিস্থিতিতে গভর্নর হিসেবে টিক্কা খানের শপথগ্রহণ সমীচীন নয়।
১৯৭৭ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সাথে এক সাক্ষাতে বিচারপতি মোরশেদ তাকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে একটি আঞ্চলিক ফোরাম গঠনের জন্য পরামর্শ এবং দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার তাগিদ দেন। ১৯৯৮ সালে ঢাকায় বিচারপতি মোরশেদের এক স্মরণসভায় তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব তবারক হোসেন এই তথ্য উল্লেখ করেছিলেন।
সর্বোপরি বিচারপতি মোরশেদ একজন প্রগতিশীল ইসলামী চিন্তাবিদ ছিলেন। কখনো কোনো সাম্প্রদায়িক অপশক্তির সাথে হাত মেলাননি। তিনি ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে সাহসের সাথে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের আন্দোলনে বিচারপতি মোরশেদ ছিলেন অন্যতম প্রধান রূপকার, এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আজকের প্রেক্ষাপটেও বিচারপতি মোরশেদের মতো সাহসী, দেশপ্রেমিক ব্যক্তিত্বের বড্ড অভাব অনুভূত হচ্ছে।হ
লেখক : কবি, শিশুসাহিত্যিক


আরো সংবাদ



premium cement