২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`
সিলেট মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের আলোচনা সভা

গণমাধ্যম ভয়াবহ সঙ্কটকাল পার করছে : রুহুল আমিন গাজী

সিলেট মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত - ছবি : নয়া দিগন্ত

বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি রুহুল আমিন গাজী বলেছেন, বাংলাদেশের গণমাধ্যম ভয়াবহ সঙ্কটকাল পার করছে। গণমাধ্যমের টুঁটি এমনভাবে চেপে ধরা হয়েছে যে এর স্বাধীনতা এখন পুরোপুরি বিপন্ন। দু:শাসন পাকাপোক্ত করতে গণমাধ্যমকে হুমকি, ভয় প্রদর্শন, সাংবাদিক হত্যা, গ্রেফতার, নির্যাতন চলছেই। কথায় কথায় গণমাধ্যম বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। সাংবাদিকদের জেলে ঢোকানো হচ্ছে। নানান কালাকানুন তৈরি করে গণমাধ্যমকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলা হয়েছে। গণমাধ্যম শিল্পে একটা ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করায় গণমাধ্যম এখন সত্য তুলে ধরতে পারছে না। এসব কারণে গণমাধ্যম দিন দিন জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলছে।

শনিবার বিকেলে সিলেট আম্বরখানাস্থ ব্রিটানিয়া হোটেলের সেমিনার কক্ষে সিলেট মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়ন (এসএমইউজে) আয়োজিত বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দের সংবর্ধনা এবং ইফতার ও দোয়া মাহফিলে তিনি এসব কথা বলেন।

এসএমইউজের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোহাম্মদ বদরুদ্দোজা বদরের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক খালেদ আহমদের সঞ্চালনায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মহাসচিব ও বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের সদস্য সচিব কাদের গনি চৌধুরী। আলোচনায় অংশ নেন বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবীদ পরিষদ সিলেটের সভাপতি ডা: শামীমুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক ডা: শাহনেওয়াজ চৌধুরী, প্রফেসর ড. খায়রুল ইসলাম, প্রফেসর ড. মোজাম্মেল হক, প্রফেসর সাহাবুল হক, অ্যাডভোকেট এমরান আহমেদ চৌধুরী, অ্যাডভোকেট আশিকুর রহমান, আলহাজ্ব হাবিবুর রহমান, মাহবুবুল আলম চৌধুরী,
আবদুল আহাদ খান জামাল, সাব্বির আহমেদ, শাহজান সেলিম বুলবুল প্রমুখ।

এ সময় সাংবাদিক নির্যাতনের ভয়াবহতা তুলে ধরে রুহুল আমিন গাজী বলেন, স্মরণকালের ইতিহাসে মিডিয়া এবং মিডিয়া কর্মীদের এমন দুর্দিন আর কখনো দেখা যায়নি। সমাজ-রাষ্ট্রের অনিয়ম-দুর্নীতি, ত্রুটি-বিচ্যুতি, নিপীড়ন-নির্যাতন ও বীভৎসতার স্বরূপ নাগরিক সমাজের সামনে প্রকাশ করার শক্তিশালী ঘটনাধারী এ মহান মাধ্যম এবং মাধ্যমটির কর্মীগণই আজ ভয়ঙ্কর এক পরিস্থিতিতে আবর্তিত হচ্ছে। গত ১৫ বছরে ৬০ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে। জেলে ঢোকানো হয়েছে অনেক সাংবাদিককে। সত্য প্রকাশ করতে কিংবা পেশাগত দায়িত্বপালন করতে গিয়ে হামলা-মামলা ও নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বহু সাংবাদিক। এমনকি কখনো কখনো প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হচ্ছে। এ ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির শিকার হয়ে খোদ রাজধানীতে বহুল আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি, একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক আফতাব আহমেদ, সাংবাদিক দম্পতি ফরহাদ খাঁ-রহিমা বেগম, আবুল হাসান আসিফ, ফতেহ ওসমানি, শফিকুল ইসলাম টুটুল, মাহমুদ হাসান তারেক, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের সাংবাদিক আবদুল হাকিম, পাবনায় ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সাংবাদিক সুবর্ণা আক্তার নদী, কুমিল্লায় আবুল কালাম আজাদ, নারায়নঞ্জে ইলিয়াস হোসেন, চুয়াডাঙ্গায় আবু সায়েম, সিলেটে রুহেল আহমেদ তালুকদার, নোয়াখালীতে বুরহান উদ্দিন মুজাক্কিরসহ বহু সাংবাদিক জীবন দিয়েছেন। কিন্তু দেশে সাংবাদিক হত্যার বিচার হয় না। সাংবাদিক নির্যাতন-নিপীড়নের কোনো বিচার হয় না। ৬০ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হলো অথচ কোনো সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতনের বিচার হওয়ার কোনো দৃষ্টান্ত নেই। সাংবাদিকতা খুব ঝুঁকিপূর্ণ পেশা এটা ঠিক আছে। কিন্তু খুন হয়ে যাবে, নির্যাতিত হবে, বিচার হবে না, এটা কোনো স্বাভাবিক পরিবেশ নয়।

তিনি বলেন, সাংবাদিক সুরক্ষার জন্য আইনি সহায়তাটাই বেশি দরকার। বিচারহীনতার কারণে সাংবাদিক হত্যা নির্যাতন বাড়ছে। প্রতিটি ঘটনা অনুযায়ী দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক বিচার হলে সাংবাদিক হত্যা কিংবা তাদের ওপর হামলা-মামলা ও হুমকি এসব অনেকটাই কমে আসবে। কিন্তু এটা কে করবে? যাদের দায়িত্ব তারাই তো নিপীড়কদের পৃষ্ঠপোষক! দেশে গণতন্ত্র নেই বলে সাংবাদিক নির্যাতন বাড়ছে।

বিএফইউজে মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম গণমাধ্যম হতে পারছে না। সত্য তুলে ধরতে না পারায় সংবাদমাধ্যম দিন দিন মানুষের আস্থা হারিয়ে ফেলছে। যা সংবাদমাধ্যমকে অস্তিত্বের সংকটে ধাবিত করছে। গণমাধ্যম সবসময় জনগণের পক্ষে থাকার কথা। কিন্তু কিভাবে জানি না, জনগণের সাথে গণমাধ্যমের একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। কালে কালে সে দূরত্বটা বাড়ছেই শুধু। আমরা জানি না আমাদের মিডিয়া মালিকরা তা অনুধাবন করছেন কিনা! আমাদের সবচেয়ে বড় সঙ্কট হচ্ছে গণতন্ত্রের সঙ্কট। গণতন্ত্র না থাকলে গণমাধ্যমের যে স্বাধীনতা থাকে না তা আমরা হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাচ্ছি।

ফ্যাসিবাদি শাসনের কারণে সংবাদমাধ্যম গণমুখী সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য প্রধান বাধা হচ্ছে গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি।

তিনি বলেন, সাংবাদিকের ভালোর পক্ষে কল্যাণের পক্ষে থাকতে হবে। সাংবাদিকরা হবে সত্যের পন্থী। সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলবে। বাকস্বাধীনতা, গণতন্ত্র, মানবাধিকারহরণ, ভোটাধিকারহরণ, নির্যাতন, নিপীড়ণ, শোষণ, অবিাচরের বিরুদ্ধে কথা বলবে সাংবাদিকরা। এজন্যই ‘গণমাধ্যম’ ও সাংবাদিকদের ভরসার শেষ ঠিকানা মনে করে সাধারণ মানুষ। কিন্তু স্বাধীনতা না থাকায় সংবাদমাধ্যম আজ গণমুখী সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলছে। সরকার নানা ধরনের কালাকানুন তৈরি করে গণমধ্যমের স্বাধীনতা হরণ করেছে। আজ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ততটুকুই আছে যতটুকু সরকারের পক্ষে যায়।

সাংবাদিকদের এ নেতা বলেন, আমাদের দুর্ভাগ্য যে, অধিকাংশ মিডিয়ার মালিক হয় রাজনীতিক না হয় ব্যবসায়ী। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, মিডিয়াকে ব্যবসায়িকভাবে টিকিয়ে রাখার কৌশলের অংশ হিসেবে বাক্‌স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক অধিকার ও নাগরিক তথ্য অধিকার হরণকারী কালাকানুন মেনে চলার পথ বেছে নিয়েছেন এসব মালিকরা। মোদ্দা কথা- মিডিয়াকে ব্যবসায়ীরা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। এখানে সরকারি দলের নেতা, এমপি-মন্ত্রী, প্রশাসনের বড় কর্মকর্তা কিংবা সচিবদের অপব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি নিয়ে, প্রকল্প বাস্তবায়ন দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে, রাষ্ট্রীয় খরচের মডেল নিয়ে মিডিয়ায় আলোচনা করা যায় না, প্রশ্ন তোলা যায় না। ফলে চুরি, লুণ্ঠন, জালিয়াতি, ঘুষ, তদবির, চাঁদাবাজিকেন্দ্রিক দুর্বৃত্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ‘রাজনৈতিক অর্থনীতি’র মৌলিক দায়বদ্ধতার বিষয় অনুপস্থিত। সমালোচনার সীমা রেখা এতোটা সীমিত করা হয়েছে যে, কিছু কিছু ব্যক্তির নাম মুখেও আনা যায় না। আইন করে কোনো কোনো নেতার সমালোচনা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে! ফলে সংবাদমাধ্যম ‘গণমানুষ’কে প্রতিনিধিত্ব করতে পারছে না বরং প্রশাসনসহ ক্ষমতাসীন সরকার ও সরকারি দলের সার্বিক রাজনৈতিক স্বার্থকে প্রতিনিধিত্ব করছে।

সাংবাদিকদের এ নেতা বলেন, মালিকদের লিপ্সার কারণে সেলফ সেন্সরশিপের সংস্কৃতিতে মিডিয়াকর্মীরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এর ফলে সরকারের বিধিনিষেধের চাইতেও মালিকদের দলদাস প্রবণতা গণমাধ্যমের চরিত্র নষ্ট করে ফেলছে। সম্পাদকরা প্রধানমন্ত্রীর প্রেস কনফারেন্সে গিয়ে প্রশ্ন না করে তৈল মর্দনে ব্যস্ত থাকেন। প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীর প্রেস কনফারেন্স এখন সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

তিনি বলেন, ব্যক্তি, গোষ্ঠী, কিংবা সরকারের স্বার্থ সংরক্ষণের দায়িত্ব সংবাদমাধ্যমের নয়। সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের নাগরিক স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য কাজ করা।

 


আরো সংবাদ



premium cement