২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`
স্মরণ

রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতা হাফেজ্জী হুজুর

মোহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর - ফাইল ছবি

বরেণ্য আলেমেদ্বীন মোহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর লক্ষ্মীপুরের রায়পুর থানাধীন লুধুয়া গ্রামে ১৮৯৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মৌলভি মুহাম্মদ ইদ্রিস, দাদার নাম মরহুম মাওলানা মিয়াজী আকরামুদ্দিন। ইসলামী শিক্ষার মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার শিক্ষাজীবন। চাচা মৌলভি মোহাম্মদ ইউনুসের কাছে তিনি বিসমিল্লাহর সবক শুরু করেন। কায়দা-আমপারা থেকে শুরু করে মাসয়ালা-মাসায়েল এবং ফারসি ভাষার প্রাথমিক কিতাবসমূহ চাচার কাছে অধ্যয়ন করেন।

তিনি ফরিদপুর জেলার দুলাইরচর প্রাইমারি স্কুলে এবং রায়পুর থানার ফতেহপুর প্রাইমারি স্কুলে দুই বছরের প্রাইমারি কোর্স মাত্র এক বছরে সমাপ্ত করেন। তারপর তিনি চন্দ্রগঞ্জ মাদরাসা, নোয়াখালীর লাকসাম নবাব ফয়জুন্নেছা মাদরাসা, লক্ষ্মীপুর থানার খিলবাইছা মাদরাসাতে শুরুর কয়েকটি জামাতের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ের কিতাবসমূহ অধ্যয়ন করেন। দেশে কোনো ভালো হেফজখানা না থাকায় তিনি সুদূর পানিপথে যাওয়ার ইচ্ছায় যাত্রা শুরু করেন খুব সামান্য সামানা নিয়ে।

পানিপথে কারি আব্দুস সালামের হেফজখানায় ভর্তি হন। ১৯১৩-১৯১৫ সাল পর্যন্ত ৩ বছরের মধ্যে তিনি পুরো কুরআন মাজিদ মুখস্থ করেন। পরে সাহারানপুর মাজাহিরুল উলুম মাদরাসায় ভর্তি হন। ১৯১৫ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত সেখানে ৭ বছর পড়ালেখা করেন। হাদিস, তাফসির, ফিকাহ, উসুলে ফিকাহ, উসুলে তাফসির, বালাগাত, মানতেক ও হেকমত প্রভৃতি বিষয়ের ওপর বিশেষ শিক্ষা অর্জনসহ ১৯২২ সালে কৃতিত্বের সাথে সাহারানপুর মাদরাসা থেকে দাওরায়ে হাদিসের সর্বোচ্চ সনদ লাভ করেন।

মাজাহিরুল উলুম সাহারানপুরের শিক্ষাজীবনে যেসব মনীষীর কাছে হাফেজ্জী হুজুর বিশেষ শিক্ষা লাভ করেন তারা হলেন- বিখ্যাত মুহাদ্দিস মাওলানা আব্দুর রহমান কামেলপুরী, মাওলানা আব্দুল লতিফ, মাওলানা মুফতি এনায়েত এলাহী, মাওলানা মঞ্জুর আহমদ ও মাওলানা ছাবেত আলী প্রমুখ।

ইসলামী শিক্ষার দুই প্রসিদ্ধ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম দেওবন্দ ও মাজাহিরুল উলুম সাহারানপুর। হাফেজ্জী হুজুর ছিলেন উভয় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী। সাহারানপুরে হাদিসের সনদ নিলেও ফনুনাতে ভর্তি হন দারুল উলুম দেওবন্দে। মাওলানা ইযায আলী, মাওলানা বদরে আলম মিরাঠী, মাওলানা রাসূল খান, আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরি এবং মাওলানা কারি তৈয়ব প্রমুখের মতো তৎকালীন উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ মনীষীর কাছে তিনি ফনুনাতের কিতাবসমূহ অধ্যয়ন করেন। ১৯২৪ সালে দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে উচ্চতর ইসলামী শিক্ষা ফনুনাত কোর্স সমাপ্ত করেন। অতঃপর আশরাফ আলী থানভী রহ:-এর খানকায় কয়েক মাস আধ্যাত্মিক সাধনা করেন।

জন্মভূমিতে প্রত্যাবর্তন করে মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী ও মাওলানা আব্দুল ওয়াহাব পীরজী হুজুরের সাথে একত্রে মিলে দেশের বিভিন্ন স্থানে দেওবন্দের অনুকরণে দ্বীনি মাদরাসা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় লিপ্ত হন। প্রথমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়ায়, তারপর বাগেরহাটের গজালিয়া একটি মাদরাসায় কয়েক বছর শিক্ষকতা করেন।
ঢাকায় এসে চকবাজারে বড়কাটারা আশরাফুল উলুম মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। বড়কাটারা থাকতে লালবাগ শাহি মসজিদের ইমামতির সুবাদে লালবাগ জামিয়া কুরআনিয়া প্রতিষ্ঠা করেন। ফরিদাবাদ জামিয়া ইমদাদুল উলুম মাদরাসাসহ সারা দেশে প্রায় ২০০ মাদরাসা ও মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন।

হাফেজ্জী হুজুর তওবার ডাক দিয়ে সক্রিয় রাজনীতিতে অবতীর্ণ হন। ১৯৮১ সালে ১৫ নভেম্বর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নেন। একই বছর ২৯ নভেম্বর তার নেতাকর্মী ও সমর্থকদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন’ নামে একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম।
ইরাক-ইরান যুদ্ধ বন্ধে ১৯৮২ সালের ২ সেপ্টেম্বর হাফেজ্জী হুজুর ইরান সফরে যান। ইরানের প্রেসিডেন্ট এবং সে দেশের শীর্ষ নেতাদের সাথে যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে মতবিনিময় করেন। ইরান থেকে তিনি পবিত্র মক্কা নগরীতে হজ পালন করতে যান। হজ শেষে ৭ অক্টোবর তিনি ইরাক সফরে যান। ৯ অক্টোবর ইরাকের প্রেসিডেন্টের সাথে যুদ্ধ বন্ধে মতবিনিময় করেন।
১৯৮৩ সালের ২৩ জুলাই হাফেজ্জী হুজুর সব পথ ও মতের দেশের সব দলের জাতীয় নেতাদেরকে মানবতার মুক্তির গ্যারান্টি ইসলামী হুকুমত কায়েমের আন্দোলনে শরিক করার মহান লক্ষ্য নিয়ে এক গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করেন। হাফেজ্জী হুজুরের ওই গোলটেবিল বৈঠক রাজনীতিতে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল।

১৯৮৩ সালে ১৪ ডিসেম্বর রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মহাসম্মেলন। সম্মেলন শেষে এরশাদ সরকারের জরুরি অবস্থা ভেঙে বিশাল মিছিল নিয়ে বায়তুল মোকাররমে সমাবেশে মিলিত হয়। সেখানে হাফেজ্জী হুজুর ঘোষণা করেন, দেশে ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় জনগণ ইসলামী সরকার ক্ষমতায় দেখতে চায়।
১৯৮৪ সালের ২১ অক্টোবর হজরত হাফেজ্জী হুজুরের নেতৃত্বে ১০টি দলের সমন্বয়ে গঠিত হয় সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ। ওই বছর ২১ ডিসেম্বর রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউতে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতির ভাষণে হাফেজ্জী হুজুর বলেন, দুর্নীতির গণতন্ত্রের বদলে আমিরুল মুমিনিন, মজলিসে শূরার পদ্ধতি এবং কুরআন-সুন্নাহর শাসন প্রবর্তনে আমার সংগ্রাম।
১৯৮৫ সালের ২৫ জুলাই হাফেজ্জী হুজুর লন্ডনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইসলামী মহাসম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করেন। সম্মেলনে মুসলিম রাষ্ট্রসমূহে ইসলামী শাসনপ্রতিষ্ঠায় পাঁচ দফা দাবি উত্থাপন করেন।

১৯৮৬ সালে পুনরায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হন হাফেজ্জী হুজুর। এই মহান ব্যক্তিত্ব ১৯৮৭ সালের ৭ মে, ৮ রমজান ১৪০৭ হিজরি বৃহস্পতিবার বেলা পৌনে ২টায় ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এ মানব রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক রাহবার আল্লামা মোহাম্মাদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর ইন্তেকাল করেন।

লেখক : নায়েবে আমির, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন


আরো সংবাদ



premium cement