০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ভুলটা ছিল পাকিস্তানি শাসকদেরই

ভুলটা ছিল পাকিস্তানি শাসকদেরই - ফাইল ছবি

পাকিস্তানের মিলিটারি শাসক যদি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করত তাহলে পাকিস্তান রাষ্ট্র হয়তো টিকে যেত এবং পাকিস্তান বিশ্বের একটি বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র হতো। ভুলটা ছিল পাকিস্তানের তখনকার শাসকদের। এ কথা পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তার রাজনৈতিক সভায় একাধিকবার বলেছেন। এমনকি সম্প্রতি জেলে বসে এক টুইট বার্তায় তা সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেন। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো- এসব ঘটনার জন্য তিনি পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে দায়ী করেছেন। সেই একই ভুল ১৯৪৭ থেকে ২০২৪, এই ৭৭ বছর ধরে পাকিস্তানে চলমান। একই কারণে পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান গুলিতে নিহত হন। এরপর জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝুলতে হয়। তার মেয়ে বেনজির ভুট্টোও গাড়িবোমা হামলায় নিহত হন। সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হককেও হেলিকপ্টারে পরিকল্পিত টাইমবোমা বিস্ফোরণে প্রাণ দিতে হয়। সেই হেলিকপ্টারে মার্কিন দূতও নিহত হন। নিহত হন সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তা। এরপরও পাকিস্তানে পরবর্তী দিনগুলোতে গণতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের ধারাবাহিকতায় মৃত্যুর সংখ্যা আরো অনেক। সামরিক বাহিনীর কারণেই পাকিস্তানে জাতীয় সংসদ (১৬তম) কখনোই পূর্ণ মেয়াদ পালন করতে পারেনি। ৭৭ বছরের অর্ধেকের বেশি সময় ধরে মিলিটারিরা পাকিস্তানের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সহযোগী পার্টনার ছিল স্বার্থান্বেষী ও উচ্চাভিলাষী কিছু রাজনৈতিক দল। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই ভারত প্রত্যাশা করে আসছিল যাতে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে পাকিস্তান অর্থনৈতিক, রাজনৈতিকভাবে ও ভৌগোলিকভাবে একটি দুর্বল রাষ্ট্রে পরিণত হয়। সেই সুযোগটি পাকিস্তানের আমলাতন্ত্র, মিলিটারি ও সুবিধাবাদি রাজনৈতিক দল, যারা দেশের চেয়ে ক্ষমতাকে বড় করে দেখে, তারাই আজ পাকিস্তানকে দক্ষিণ এশিয়ায় একটি অস্থিতিশীল নাজুক এবং সন্ত্রাসকবলিত রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। আর ভারত তার পছন্দনীয় সেই সুবিধাটি লুফে নিয়েছে। ভারত একান্তভাবেই দক্ষিণ এশিয়ায় তার একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোকে নিজের একক নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়।

অনেকটা ওঠবস করার মতো। যেমন বলব তেমন করবে। এ জন্য ভারত জম্মু-কাশ্মির ও বেলুচিস্তান নিয়ে জটিলতার সমীকরণে দীর্ঘদিন ধরে ছক আঁকছে। আমরা ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ দেখেছি। সেই যুদ্ধে বাঙালি সেনাদের প্রশংসনীয় অবদান ছিল। সেই যুদ্ধে পাকিস্তান জিতে যায়। পরে রাশিয়ার মধ্যস্থতায় যুদ্ধ থামে। এখানেও জাতিসঙ্ঘের নির্দেশে সিজফায়ারে রাজি হয়ে পাকিস্তান ভুল করেছিল। তারপর ১৯৬২ সালে চীনের সাথেও ভারতের যুদ্ধ হয়। এখন পর্যন্ত চীনের সাথে ভারতের শীতল যুদ্ধ লেগেই আছে। ভারত সুকৌশলে প্রতিবেশী ছোট রাষ্ট্রগুলোর উপর নিজের প্রভুত্ব বজায় রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে দেশগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে। ১৯৪৭ সালের ভারত ভাগ মেনে নিতে পারেনি ভারত। আটটি দেশ নিয়ে গঠিত সার্ক ফোরাম বা সংস্থার উদ্যোক্তা ছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। এ জন্য সার্ক সংস্থাটিও ভারতের পছন্দের তালিকায় ছিল না।

আমার কয়েকজন শ্রদ্ধেয় মানুষ বহুদিন ধরে লেখার জগতে বিচরণ করছেন। তারা বলেছিলেন, বাংলাদেশে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনটি হবে না। উত্তরে আমি বলেছিলাম, নির্বাচন হয়ে যাবে এবং একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দ্বাদশ সংসদে শপথও নেবে আওয়ামী লীগ। সেটিই হয়েছে। নির্বাচন পুরোই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল তা একটি শিশুও বোঝে। নির্বাচনের পরদিন ৮ জানুয়ারি কৌতূহলবশে আমি ১৮-২০ বছরের এক ছেলেকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, নির্বাচন কেমন হয়েছে, তুমি কি ভোট দিয়েছ? মাত্র একটি উত্তর দিয়ে স্থান ত্যাগ করল। সে বলল, আওয়ামী লীগের ভোট লাগে না। একটি কিশোরের বক্তব্যে দেশের গণতন্ত্রের চেহারা যখন ফুটে ওঠে তখন আর এর ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। গণতন্ত্রের বিপরীত স্র্রোতের এমন বাস্তবায়ন দেখে এখন আর হতাশ হই না। অতি সত্যি কথা, ভারতের জন্মলগ্ন থেকে অদ্যাবধি দেশটিতে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেনি। এ কারণে ভারত বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মধ্যে শক্ত অবস্থানে আছে। সিকিমসহ ৩০টি রাজ্য নিয়ে ভারত রাষ্ট্র গঠিত। ভারতীয়দের দেশপ্রেম দেখে আমরা প্রায়ই বিস্মিত হই। মাদ্রাজ, বেঙ্গালুরু, মাহিসুর, কলকাতাসহ আটটি রাজ্য দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। ভারতের শিক্ষিত মানুষরাও সাধারণ কাপড় ও সাধারণ মানের খাবারে অভ্যস্ত। বহু ভাষায় কথা বলা বহু জাতির এই দেশ যেভাবে ঐক্যবদ্ধ আছে তা প্রশংসনীয়। এখন পর্যন্ত ভারতের একটি রাজ্যও আলাদা হয়নি; বরং লেন্দুপ দর্জির ‘সিকিম’ ভারতের সাথে সংযুক্ত হয়েছে। ক্ষমতার লোভ একটি রাষ্ট্রের জন্য কত ভয়ঙ্কর এবং দানবীয় হতে পারে সেটি পাকিস্তান ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপটের দিকে তাকালে উপলব্ধি করা যায়। এ দু’টি দেশেই গণতান্ত্রিক কাঠামো অত্যন্ত নাজুক এবং নিজেদের দলেও গণতন্ত্রের চর্চা হয় না, যার কারণে কোনো প্রতিষ্ঠানও গণতান্ত্রিকভাবে গড়ে ওঠেনি দেশ দু’টিতে।

পাকিস্তানে ৯ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে জিতে গেলেও পিটিআই সরকার গঠন করতে পারছে না। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা কোনো দলের না থাকার অর্থই হলো-দেশটির ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি আবারো গুরুতর সঙ্কটের দিকে যাচ্ছে। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে অবস্থান করেও ক্যারিশমাটিক নেতা ইমরান খানের বিজয়কে থামিয়ে দিয়েছে পর্দার আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়া সেনাবাহিনী, সাথে আছে রাজনীতির সুবিধাবাদী চক্র নওয়াজ মুসলিম লীগ ও পিপলস পার্টির বিলওয়াল ভুট্টো। দেশ জাহান্নামে যাক সেটি কোনো বিষয় নয়, বিষয়টি হলো- আমার ক্ষমতা দরকার, সেটি সেনাবাহিনীর আশীর্বাদে হোক বা পশ্চিমা বলয়ের আশীর্বাদে হোক। তবে ইমরান খানের ২০১৮ সালে ক্ষমতায় আসাটা উত্তরাধিকার সূত্রে নয়। নিজের বুদ্ধিমত্তা খাটিয়ে তরুণ ও যুবসমাজের মধ্যে সততার একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে পেরেছিলেন বলেই তিনি ক্ষমতায় আসতে পেরেছিলেন। পাকিস্তানের রাজনীতিতে একটি পরিবর্তন আনার যে ধারা তিনি সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন তা প্রশংসার দাবিদার। তার অতীত ইতিহাস ‘হার না মানার’ ইতিহাস। ১৯৯২ সালে ক্রিকেটে ইংল্যান্ডকে থামিয়ে দিয়ে পাকিস্তানের মাথায় বিশ্বচ্যাম্পিয়নের মুকুট পরিয়ে দিয়ে অতি গর্ভের হাসি তার মতো দলনেতাকেই মানায়। তার অতীত ইতিহাসে মানবহিতৈষী অনেক ঘটনা আছে যা রূপকথার মতো। এটি অস্বীকার করার উপায় নেই। ১৯৯৬ সালে তার রাজনৈতিক অভিযাত্রা শুরু রাজনৈতিক দল পিটিআই গঠনের মাধ্যমে। তারপর ১৯১৮ সালে ক্ষমতার হাল ধরা, আবার চার বছরের মাথায় ১৯২২ সালে বিরোধী দলের অনাস্থা ভোটে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানো এবং তার বিরুদ্ধে ১১৪টি মিথ্যা মামলা দায়ের করা থেকে শুরু করে তার বৈবাহিক জীবন নিয়ে নানা কুরুচিপূর্ণ কাহিনী তৈরি করা- ইত্যাদি হেন কাজ নেই যা তার প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক শক্তি ও সেনাবাহিনী করেনি।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আলজাজিরা ও বিবিসি এবং পশ্চিমা বলয়ের গণমাধ্যমেও এসব কথা এসেছে। ভূ-রাজনীতিতে দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তান আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে দাঁড়াক, এটি দলের মধ্যে অনুপ্রবেশকারী বিশ্বাসঘাতকরা চায় না।

এসব দুষ্টচক্র সবসময় উপমহাদেশে অর্থের বিনিময়ে দেশের স্বার্থের বিপরীতে কাজ করেছে। একটি প্রবাদ বাক্য আছে- মানুষ তখনই পশুর চেয়েও অধম হয়ে যায় যখন তাকে অর্থের নেশায় পেয়ে বসে। সৃষ্টিজগতে একমাত্র মানুষেরই পেট ভরে না, চাহিদারও তার শেষ নেই। তাই মহাপ্রভু আগাম নোটিশ দিয়ে রেখেছেন পবিত্র কুরআনে- একমাত্র মানুষকেই কঠোরভাবে পাকড়াও করা হবে শেষ বিচারের দিনে।

শেষ কথা হলো- বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে গণতন্ত্র এখনো অধরা এবং গণতন্ত্রের পথ পিচ্ছিল কাদায় পরিপূর্ণ। তাই এপথ পাড়ি দিতে হলে আমাদের মতো বুড়ো মানুষ দিয়ে হবে না। এখন দরকার তারুণ্যে উজ্জীবিত তরুণ ও যুবসমাজের। যুগে যুগে তার প্রমাণও আমরা দেখেছি ইতিহাসের পাতায় পাতায়। তরুণরাই পারে পরিবার দেশ ও সমাজ বদলাতে। মানুষ এখন অধীর আগ্রহে একজন ক্যারিশমেটিক নেতার অপেক্ষায় আছে, কখন তার আবির্ভাব ঘটবে।

লেখক : গ্রন্থকার, গবেষক ও রাজনৈতিক-বিশ্লেষক
ই-মেল : harunrashidar@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement