০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫
`


তারা ফকিরের নয়, আমিরের জাত

তারা ফকিরের নয়, আমিরের জাত - ফাইল ছবি

নির্বাচনকালীন দলীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রীর মনোনয়নের জোরে যারা ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে জনগণের ভোট ছাড়া নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নির্বাচিত ঘোষিত হয়েছিলেন তাদের অনেকেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও মনোনয়ন পেয়েছিলেন। যারা মনোনয়নবঞ্চিত হন তারাও প্রধানমন্ত্রীর অনুমতিক্রমে বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র এবং ডামি প্রার্থী হয়েছিলেন। এরা মনোনয়নপত্রের সাথে দাখিলকৃত হলফনামায় গত পাঁচ থেকে ১৫ বছরে অর্জিত সম্পদের বিবরণী জমা দেন। সেই বিপুল সহায়সম্পত্তি অর্জনের বিবরণ দেখে পাকিস্তানের কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর একটি মন্তব্য মনে পড়ে। কায়েদে আযম সবসময় ট্রেনের প্রথম শ্রেণীর শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কোচে ভ্রমণ করতেন।

পক্ষান্তরে বিশাল ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা মোহনচাঁদ করমচাঁদ গান্ধী রেলের তৃতীয় শ্রেণীর বগিতে ভ্রমণ করতেন। সাংবাদিকরা জিন্নাহর প্রথম শ্রেণীর শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কোচে ভ্রমণ করার উদাহরণ টেনে গান্ধীজি কেন তৃতীয় শ্রেণীর বগিতে ভ্রমণ করেন সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে গান্ধীজি বলেছিলেন, ‘তার দেশের ৯০ শতাংশ জনগণ রেলের যে শ্রেণীর কামরায় চলাচল করেন তিনিও সেই শ্রেণীর কামরায় চলাচল করেন।’ গান্ধীজির তৃতীয় শ্রেণীর বগিতে রেলে ভ্রমণের উদাহরণ টেনে সাংবাদিকরা জিন্নাহ সাহেবের কাছে জানতে চেয়েছিলেন ভারতের চেয়ে ছোট দেশের জাতির পিতা হয়ে তিনি কেন ট্রেনের প্রথম শ্রেণীর শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কোচে যাতায়াত করেন। জবাবে জিন্নাহ সাহেব বলেন, ‘মুসলমান ফকিরের জাত নয়, আমিরের জাত।’

বাংলাদেশের জনগণের ভোট ছাড়া উপর্যুপরি নির্বাচিত মন্ত্রী ও এমপিরা ৭৬ বছর পর জিন্নাহ সাহেবের ওই উক্তি সত্য প্রমাণ করেছেন। টিআইবি, সুজন ও সাংবাদিকদের সমালোচনার জবাবে এক চৌধুরী সাহেব তো বলেই ফেলেছেন, ‘বংশানুক্রমে তার পূর্বপুরুষরা বিপুল ধনরাশির মালিক ছিলেন বিধায় উত্তরাধিকারসূত্রে তিনিও সেই সম্পত্তির মালিকানা পেয়েছেন। প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দাদাদের দাদাগিরিতে ক্ষুব্ধ হয়েই আমাদের পূর্বপুরুষরা ১৯৪৬ সালেই মুসলিম লীগকে ভোট দিয়ে কংগ্রেসকে বিদায় জানিয়ে পূর্ববঙ্গকে ভারতবর্ষ থেকে বিছিন্ন করে পাকিস্তানে যোগ দেন। পাকিস্তানিদের বড়ভাইসুলভ আচরণে নিজ অধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়ার ক্ষোভে আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ ২৩ বছর আন্দোলন-সংগ্রাম করে ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি। জিন্নাহর সাধের পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘তিনি সারা জীবন দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর রাজনীতি করে এসেছেন এবং শোষিতের গণতন্ত্র তিনি এই দেশে প্রতিষ্ঠা করবেন।’

কিন্তু তারপর বঙ্গবন্ধু সাড়ে তিন বছরের বেশি বাঁচতে পারেননি। তার উত্তরাধিকারীরা গত ১৫ বছর ক্ষমতায় যাওয়া ও থাকার জন্য বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শচ্যুত হয়ে শোষকের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। গত ৩০ জুন ২০১১ তারিখে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করে প্রচলিত ধারার নির্বাচনব্যবস্থা প্রবর্তন করে জনগণের ভোটে সরকার পরিবর্তনের রাস্তা সিলগালা করে বন্ধ করে দিয়েছেন। একটানা ক্ষমতায় থাকার সুবাদে তারা নিজেরা শোষকের দলে ভিড়ে সম্পদশালী হওয়ার রাজনীতি বহাল রাখতেই সংবিধান সংশোধন করেছেন। ফলে নির্বাচনে জয়ের জন্য ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত যেমন জনগণের ভোটের ওপর নির্ভর করতে হতো ২০১৪ সাল থেকে নির্বাচনে জয়ের নিশ্চয়তা নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রীর মনোনয়ন প্রাপ্তির উপর। ফলে বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের চাকরিতে যোগদানকালীন তেমন কোনো সহায়-সম্বল না থাকলেও অবসর গ্রহণের প্রাক্কালে সবাই যেমন কোটিপতি বনে যান, তেমনি বিসমিল্লায় এমপি প্রার্থী হওয়াকালীন যাদের উল্লেখযোগ্য সহায়-সম্পত্তি থাকে না নির্বাচিত হওয়ার পরের পাঁচ বছরে সবাই কোটিপতি বনে যান। প্রধানমন্ত্রীর মনোনয়ন পেলেই জয় নিশ্চিত থাকায় পরবর্তী ১০ বছরে সম্পদের পরিমাণ দুই থেকে আড়াই হাজারগুণ বৃদ্ধি পেলেও ভোটের বাক্সে তার কোনো প্রভাব পড়ে না। কারণ ভোটের বাক্সে প্রভাব ফেলার ক্ষমতা জনগণের হাত থেকে গত ৩০ জুন ২০১১ তারিখে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচনকালীন দলীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী যে সীমাহীন সাংবিধানিক ক্ষমতা অধিগ্রহণ করেছেন তা নির্বাচনী ফলাফল থেকে প্রমাণিত।

১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত চারটি নির্বাচন দলীয় সরকারের খবরদারিমুক্ত হওয়ায় ঢাকা শহরের আসনগুলোতে একমাত্র সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা ছাড়া একজন প্রার্থীও পরপর দু’বার নির্বাচিত হতে পারেননি। এমনকি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নিজেও ঢাকার দু’টি আসন থেকে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দু’টিতেই বিএনপি প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। অথচ ২০১৪ ও ২০১৮ এবং সদ্যসমাপ্ত ২০২৪ সালের নির্বাচনেও সেই দাদার আমলে ২০০৮ সালে নির্বাচিতরাই পরপর কেউ চারবার, কেউ তিনবার, কেউ দু’বার নির্বাচিত হয়ে রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর দু’টি আসনে একটিতে রাশেদ খান মেনন হ্যাটট্রিক বিজয়ী ও কাজী ফিরোজ রশীদ ডবল বিজয়ী হয়েছিলেন এবং সর্বশেষ মাদারীপুরের আসন থেকে মাইগ্রেট করে আসা প্রার্থীও ১৩ শতাংশ ভোট পেয়েও নির্বাচিত হয়েছেন।

তাই ২০০৮ সাল থেকে যারা হ্যাটট্রিক বিজয়ী, ২০১৪ সাল থেকে ডাবল বিজয়ী এবং ২০১৮ সালের কুমারী বিজয়ীদের মধ্য থেকে যে ২২৯ জন প্রধানমন্ত্রীর মনোনয়ন পেয়েছিলেন ও মনোনয়নবঞ্চিতদের মধ্যে যারা প্রধানমন্ত্রীর অনুমতিক্রমে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছিলেন সবার সহায়-সম্পত্তি ২০০৯ সাল থেকেই জ্যামিতিক হারে উন্নয়নের জোয়ারের গতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমতিপ্রাপ্ত হয়ে যারা স্বতন্ত্র ও ডামি ক্যাটাগরির প্রার্থী হন তারাও দলের পদ-পদবি ব্যবহার করে গত ১৫ বছরে কামাই রোজগার ভালোই করেছেন। তা না হলে বিপুল বিত্তশালী প্রার্থী মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়ে তাদের ৬২ জনকে পরাজিত করতে পারতেন না। কিন্তু তারা প্রথমবারের মতো প্রার্থী হওয়ায় গত ১৫ বছরে তাদের অর্জিত ধনরাশির তুলনামূলক পরিমাপের কোনো ডিজিটাল নিক্তি টিআইবি ও সুজনের হাতে নেই।

তবে তাদের সহায়-সম্পত্তির পরিমাণ ওই দু’টি সংস্থার অজানা থাকলেও তাদের নির্বাচনী এলাকার ভোটাররা ভালোভাবেই অবহিত ছিলেন, কারণ তারাই ছিলেন এর ভিকটিম। বেয়াড়া ভোটাররা তাদের অর্জিত বিপুল বিত্তবৈভবের কথা জানেন বলেই কেন্দ্রে যাওয়ার রাহা খরচ দিয়েও তাদেরকে ভোটকেন্দ্রমুখী করতে পারেনি। বিরোধী দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও নির্বাচন ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের মতো না করে বুথের ভেতর উত্তর কোরিয়ার মতো ছাপ্পা মারা ব্যালট ভোটারদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হতো। ভোটকেন্দ্রে ভোটারের খরা দেখা দেয়ায় ভোট পড়ার হার বেশি দেখানোর দায়িত্ব স্বাধীন নির্বাচন কমিশনকে নিতে হয়েছিল। এ ব্যাপারে কাজী আউয়াল কমিশন বড়ভাই কাজী রকিব কমিশনের অনুকরণে ভোট পড়ার হার বৃদ্ধি করে দেখিয়েছিলেন সরকারপ্রধানের অভিপ্রায় অনুযায়ী। যেমন সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মইন এক-এগারো ঘটিয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিনকে ইয়েসউদ্দিন রাষ্ট্রপতিতে পরিণত করেছিলেন। যেখানে ২০১৪ সাল থেকে নির্বাচন কমিশনের ভাব উধাও হয়ে শুধু মূর্তিতে পরিণত হয়েছে সেখানে এর চেয়ে জনগণ আর বেশি কী আশা করতে পারে।

সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যা মামলায় সাক্ষীর অভাবে পুলিশ যেমন ১২ বছরেও কোনো অভিযোগপত্র দাখিল করতে পারেনি, তেমনি দুদকও চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগপত্র গঠন করতে পারেনি।

ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করে প্রশাসন, পুলিশ ও পোলিং অফিসারদের ব্যবহার করে জনগণের ভোট ছাড়া যাকে ইচ্ছা তাকে এমপি বানানো যত সহজ, অর্থনীতির পাগলা ঘোড়া সামাল দিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে জনগণকে স্বস্তিদান ততটাই কঠিন। উন্নয়ন করেই যদি নির্বাচনে জয়ী হওয়া যেত তাহলে একযুগ অর্থমন্ত্রী থেকে সিলেটের উন্নয়নের রূপকার সাবেক অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান তার জীবনের শেষ নির্বাচনে নিজের বাড়ির আসনে সৈয়দ মহসীন আলীর মতো প্রার্থীর কাছে অন্তত পরাজিত হতেন না। তার ছেলের অপকর্মের দায় তাকে নিতে হতো না। সাবেক রাষ্ট্রপতি ডা: বি চৌধুরী জীবনের শেষ নির্বাচনে নিজ পৈতৃক আসনে পরাজিত হতেন না, তার পুত্রও ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে জামানত হারাতেন না।

বাংলাদেশ এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র হওয়ায় ভারত, শ্রীলঙ্কা ও নেপালের মতো ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এখানে নেই। ওই সব দেশের মতো নির্বাচন বাংলাদেশে সম্ভব নয়। ওই তিনটি দেশের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের পরাজয়ের রেকর্ড থাকলেও বাংলাদেশে তা কল্পনারও অতীত। শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে যার আমলে ৩০ বছর ধরে তামিলদের সাথে চলা গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটেছিল, তিনিও ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করে তার স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন।


আরো সংবাদ



premium cement