২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শতবর্ষে সলঙ্গা বিদ্রোহ : বিস্মৃত ইতিহাস

-

জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা থেকে সূত্রপাত হয় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের। ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিলে পাঞ্জাবের অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগে ঘটেছিল ইতিহাসের এক নৃশংস গণহত্যা। দিবসটি ছিল শিখদের উৎসবের দিন। ব্রিটিশ সরকার সেই দিন ১৪৪ ধারা জারি করেছিল। তবু বিভিন্ন ধর্মের ২০ সহস্রাধিক মানুষ সেখানে মিলিত হয়েছিল। সেখানে দু’টি সাঁজোয়া যানসহ এক শ’ গুর্খা সৈন্যের আগমন ঘটে। পরক্ষণেই জেনারেল রেজিনাল্ড ডায়ারের নির্দেশে ১৬৫০ রাউন্ড গুলি চালানো হয় সমবেত জনতার ওপর। ঔপনিবেশিকতার পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞে দেয়ালঘেরা সে ময়দান মুহূর্তেই রক্তে লাল হয়ে যায়। নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় দেড় হাজার। নারকীয় এ হত্যাযজ্ঞে মর্মাহত হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিত্যাগ করেন ব্রিটিশের দেয়া ‘নাইট’ উপাধি। দিল্লির হাকিম আজমল খান তার ‘মসিহ-উল-মূলক’ উপাধি এবং প্রথম শ্রেণীর ‘কাইসার-ই-হিন্দ’ স্বর্ণপদক ব্রিটিশ সরকারকে ফিরিয়ে দেন। এ হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে পুরো ভারত ক্ষোভে ফেটে পড়ে। সারা দেশে প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ নগ্ন হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।

জালিয়ানওয়ালাবাগের পথ ধরে ব্রিটিশ বেনিয়াদের নৃশংসতার আরেক রক্তাক্ত অধ্যায় রচিত হয় সিরাজগঞ্জের সলঙ্গায়। দিনটি ছিল ১৯২২ সালের ২৭ জানুয়ারি। এলাকার সবচেয়ে বড় হাটের দিন। এ দিন সেখানে হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে। সমগ্র ভারতবাসীর জন্য রক্তাক্ত বিদ্রোহের ঐতিহাসিক এক দৃষ্টান্ত সৃষ্টি হয়েছিল সে দিন। ব্রিটিশ সৈন্যদের গুলিতে রক্তের বন্যা বয়েছিল সলঙ্গার মাটিতে। অগণিত মানুষের রোনাজারি আর মর্মভেদী আর্তচিৎকারে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল। সলঙ্গার নির্মম এ ঘটনাকে কেউ কেউ জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের চেয়েও ভয়ঙ্কর ও হৃদয়বিদারক বলে উল্লেখ করেছেন। ইতিহাস দিনটিকে ‘রক্তাক্ত সলঙ্গা বিদ্রোহ দিবস’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। সলঙ্গা বিদ্রোহের বয়স এক শ’ বছর পূর্ণ করেছে। এক শ’ বছরে অর্জন বলতে দিবসের স্বীকৃতি মাত্র! কিন্তু সলঙ্গা বিস্মৃতির আড়ালে হারাতে বসেছে।

সলঙ্গা বিদ্রোহের নেপথ্য নায়ক ছিলেন মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ। ১৯২২ সালের ২৭ জানুয়ারি শুক্রবার এলাকার বড় হাট। সলঙ্গায় যুবক আব্দুর রশিদের নেতৃত্বে চলতে থাকে ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের প্রচারাভিযান। ‘বিলেতি পণ্য বর্জন কর, এদেশ থেকে বৃটিশ হটাও’- স্লোগানে স্বেচ্ছাসেবকদের প্রচারাভিযান যখন তুঙ্গে, তখনই ছুটে আসে পাবনার ম্যাজিস্ট্রেট মি. আর. এন দাস। সাথে আসেন সিরাজগঞ্জের মহকুমা প্রশাসক মি. এস. কে সিনহা ও ৪০ জন সশস্ত্র পুলিশ। আসেন পাবনা জেলার পুলিশ সুপারও। এর ক’দিন আগে সলঙ্গার পার্শ্ববর্তী চান্দাইকোনা হাটে ঘটেছিল আরেক ঘটনা। সেখানে স্বেচ্ছাসেবকদের ব্রিটিশ পণ্যবিরোধী প্রচারাভিযানে পুলিশ বাধা দেয়। ক্ষিপ্ত হয়ে পুলিশের রাইফেল কেড়ে নিয়ে তারা ‘ফুলজোড়’ নদীতে ফেলে দেয়। ওই ঘটনার প্রতিশোধ নিতেই তারা সেই দিন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সলঙ্গার হাটে আসে। তাদের সদম্ভ ও মারমুখী উপস্থিতি স্বেচ্ছাসেবক ও জনতার মাঝে ত্রাস সৃষ্টি করে। একটা অশুভ কিছু ঘটার আশঙ্কায় চার দিকে তখন থমথমে অবস্থা। হঠাৎই পুলিশ কংগ্রেস অফিস থেকে প্রচারাভিযানের নেতা আব্দুর রশিদকে গ্রেফতার করে। তাকে নিয়ে আসে গরুহাটে অবস্থানরত পুলিশ সুপারের কাছে। শুরু করে অকথ্য শারীরিক নির্যাতন। নাক, কান ফেটে এবং শরীরের বিভিন্ন স্থান ক্ষত-বিক্ষত হয়ে রক্ত ঝরতে থাকে আব্দুর রশিদের। সব হাটে এ খবর ছড়িয়ে পড়ে ঝড়ের গতিতে। আব্দুর রশিদের পীর পিতার অসংখ্য মুরিদ এবং সাধারণ জনগণ জড়ো হয়ে যায় মুহূর্তেই। সবাই মিলে ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনীকে ঘিরে ধরে। উদ্দেশ্য আব্দুর দকে মুক্ত করা। হঠাৎ করেই উত্তেজিত জনতার মধ্যে থেকে একজন লাঠি (গরু তাড়ানো নড়ি) দিয়ে পুলিশ সুপারের মাথায় আঘাত করে বসে। ফলে ক্রোধোন্মত্ত হয়ে ওঠে সে। আহত ও রক্তাক্ত আব্দুর দকে টেনেহিঁচড়ে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে নিয়ে আসে। জনগণও ইতোমধ্যে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। মারমুখী জনতাকে প্রতিহত করতে ম্যাজিস্ট্রেটের সাথে পরামর্শ করে পুলিশ সুপার নির্দেশ দেয়- ‘ফায়ার’। সাথে সাথে গর্জে ওঠে ৩৯টি রাইফেল। রচিত হয় বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের মর্মান্তিক কাহিনী। পাখির মতো গুলি খেয়ে মরতে থাকে মানুষ। এমনকি মানুষের সাথে হাটে আনা গরু, ছাগল, ভেড়া। কিন্তু কতক্ষণ? হাটে আসা পঞ্চাশ হাজার প্রতিবাদী মানুষের বিরুদ্ধে ৩৯টি রাইফেল শেষতক টিকতে পারেনি। এক সময় শেষ হয়ে যায় পুলিশের বুলেট। হাজার হাজার মানুষ চার দিক থেকে লাঠিসোটা, শ, বল্লম, হলঙ্গা, ফালা ইত্যাদি দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ছুটে আসে। ঘিরে ফেলে লাল টুপিওয়ালা ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনীকে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে তারা আব্দুর দকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এতে জনরোষ কিছুটা স্তিমিত হয়। কিন্তু তারা এগিয়ে যায় নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নিতে। বাইশ বছর বয়সের যুবক আব্দুর দ ছিলেন অত্যন্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। তিনি জানতেন, জনতাকে না থামালে পুলিশসহ ব্রিটিশের কেউ বেঁচে ফিরবে না। কিন্তু পরিণতি হিসেবে পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ বেনিয়াদের জিঘাংসা ও প্রতিশোধের শিকার হতে হবে নিরীহ মানুষদের। আশু ভয়াবহ পরিণতি থেকে এতদঞ্চলের মানুষকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে বিক্ষুব্ধ জনতাকে থামিয়ে দেন আব্দুর দ। সে দিনের সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে সলঙ্গার মাটি নিহত ও আহত মানুষ এবং গৃহপালিত পশুর লাল রক্তে ভেসে গিয়েছিল। ব্রিটিশ পেটোয়াদের নিষ্ঠুরতা সেখানেই শেষ হয়নি। আহতদের চিকিৎসার নাম করে নিয়ে যাওয়া হয় সিরাজগঞ্জে। কিন্তু তাদের চিকিৎসার ন্যূনতম ব্যবস্থাটিও করা হয়নি। আর নিহতদের লাশ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় সিরাজগঞ্জের রহমতগঞ্জে। সেখানে তৈরি করা হয় এ অঞ্চলের প্রথম ‘গণকবর’। আজো সে ‘গণকবর’ সলঙ্গার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। একই সাথে হোসেনপুর, বাসুদেবকোলসহ সলঙ্গার বিভিন্ন জায়গায় নিহতদের কবরস্থ করা হয়। সরকারি হিসাবে এ ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা দেখানো হয় সাড়ে চার হাজার। কিন্তু বেসরকারি তথ্য মতে এ সংখ্যা দশ সহস্রাধিক বলে জানা যায়। এ হলো সলঙ্গার রক্ত ভেজা ইতিহাসের কাগুজে বর্ণনা। যার প্রকৃত চিত্র ছিল আরো নির্মম, ভয়াবহ ও করুণ। প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য অনুযায়ী ‘বর্ণনাতীত’।

জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড ভারতের ইতিহাসের বিশাল জায়গাজুড়ে আছে। জাতীয়ভাবে দিবসটি পালিত হয়। অত্যন্ত মর্যাদা ও গুরুত্বের সাথে স্মরণ করা হয় আত্মাহুতি দেয়া ব্যক্তিদের। এমনকি এক শতাব্দী পর ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ভারতে এসে সে ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে গেছেন। ২০১৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তিনি হত্যাকাণ্ডের স্মৃতিস্তম্ভে গিয়ে নীরবতা পালন করে শোক জানিয়েছেন। তিনি বলে গেছেন, ‘এ ঘটনা ব্রিটেনের ইতিহাসে সবচেয়ে লজ্জাজনক ঘটনা।’

রক্তাক্ত ইতিহাস বুকে নিয়ে সলঙ্গাও সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে। সলঙ্গার রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ডকে জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যার চেয়েও বেশি ভয়াবহ ও হৃদয়বিদারক বলেছেন কোনো কোনো ইতিহাসবিদ। কিন্তু দুর্ভাগ্য, অবহেলিত ও উপেক্ষিত রয়ে গেছে সে ইতিহাস। সেখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ পর্যন্ত নির্মিত হয়নি আজো। হাজার হাজার শহীদকে স্মরণ করার অবসর পর্যন্ত নেই সংশ্লিষ্টদের। শুধু দিবসের তকমা দিয়ে কী হবে? এমনকি সে দিবসটাও জাতীয়ভাবে পালন করার নজির নেই। স্থানীয়ভাবে দায়সারা গোছের কিছু কর্মসূচির মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। আগামী প্রজন্মের কাছে হয়তো অজানাই থেকে যাবে এ রক্তস্নাত ইতিহাস।

সলঙ্গা থানা ঘোষণা হয় ২০০০ সালে। সেই থেকে কর্তাব্যক্তিরা ‘উপজেলা’র মুলো ঝুলিয়ে রেখেছেন। কিন্তু সেটি বাস্তবায়নেও সরকারের আন্তরিকতা বরাবরই অনুপস্থিত। উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয়, ভৌগোলিকভাবেও সলঙ্গা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বটে। রাজধানীর সাথে যোগাযোগে সলঙ্গা হলো গোটা উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গের একাংশের প্রবেশদ্বার। ব্যবসা, কৃষি, শিল্প, সাহিত্য-সংস্কৃতিসহ সব দিক দিয়েই অনেক এগিয়ে। সলঙ্গার অর্থনৈতিক গুরুত্বও এখন অনস্বীকার্য। উপজেলায় রূপান্তরিত হওয়ার ঐতিহাসিক, বাস্তবিক ও আইনগত সব কিছুরই অধিকারী বিদ্রোহী সলঙ্গা। দাবি আদায়ে সোচ্চার হয়ে অপেক্ষমাণ প্রায় তিন লাখ সলঙ্গাবাসী। ছোট্ট দু’টি দাবি, বিদ্রোহের স্মৃতিস্তম্ভ আর উপজেলার স্বীকৃতি। রক্তাক্ত বিদ্রোহের এক শ’ বছর পূর্তিতে এটুকু দাবি বেশি নয় নিশ্চয়ই।

মো: আসাদ উদ্দিন : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
e-mail:asadiuk@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement