২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কিংবদন্তি রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান

-

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জিয়াউর রহমানের সহজ-সরল জীবন ছিল কিংবদন্তিতুল্য। রাষ্ট্রপতি হয়েও তিনি অত্যন্ত সাধারণ জীবন-যাপন করতেন। সততা নিয়ে তার বিরোধী মহলের অনেকে বক্রোক্তি করে থাকেন। অথচ তার মৃত্যুর পর চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে তার ব্যক্তিগত যেসব জিনিসপত্র পাওয়া যায় সে সম্পর্কে শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে তারা লিখেছেন ‘জিয়ার ব্যক্তিগত মালামালের মধ্যে নিম্নলিখিত জিনিসগুলো পাওয়া যায় : একটি পুরাতন চামড়ার সুটকেস। তাহা এত পুরাতন যে, উহার তালাও সঠিক কাজ করে না। একটি পুরাতন অতি সাধারণ টু-ইন-ওয়ান, তালাবদ্ধ একটি পুরাতন ‘ইকোলাক’ জাতীয় ব্রিফকেস, গায়ের আধছেঁড়া গেঞ্জি, ২/৩টি সাফারি শার্ট, একটি প্যান্ট, একটি ফাউন্টেন পেন, একটি সানগ্লাস। মৃতের মাথার কাছে পড়িয়াছিল কয়েকটি ক্যাসেট, তাঁহার বিছানার পার্শ্বেই পড়িয়াছিল জায়নামাজ ও সাদা গোল টুপি।’ (সূত্র : ইত্তেফাক, ৪ জুন ১৯৮১)। একটি প্রশ্ন? দৈনিক ইত্তেফাক কি বিএনপি নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা?

জনপ্রিয় এই রাষ্ট্রনায়ককে নিয়ে তার বিরোধী মহল কিছু কিছু বিরূপ মন্তব্য করেন। কিন্তু জিয়াউর রহমানকে যারা ভালোবাসেন তাদের মধ্যে অনেকেই সেসব নিন্দা মন্দের সঠিক উত্তর দেন না। বিশেষ করে টকশোগুলোতে প্রায়ই দেখা যায় বিএনপিপন্থী বক্তাগণ হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন তাদের প্রতিপক্ষের দিকে। ইতিহাস না জানার কারণে তারা সেসবের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন না। একটি অভিযোগ এরকম- জিয়াউর রহমান একবার সাপ্তাহিক বিচিত্রায় একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন- ‘আই উইল মেক পলিটিকস ডিফিকাল্ট’। তার বিরোধীপক্ষ এই উক্তিটিকে নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার করেন। এই কথাটির পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা পাওয়া যায় হেদায়েত হোসাইন মোরশেদ লিখিত ‘একজন জিয়া’ বইটিতে। সেখানে লেখক লিখেছেন- কথায় কথায় জিয়াউর রহমানকে প্রশ্ন করলাম- যদ্দুর মনে পড়ে সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’র এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছিলেন- ‘আই উইল মেক পলিটিকস ডিফিকাল্ট’। এরপর প্রায়ই আপনি কথাটা বলছেন। আপনার এই কথা নিয়ে নানা মহলে নানা গুঞ্জন ও প্রতিক্রিয়াও হয়েছে।

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকলেন জিয়াউর রহমান। তারপর বললেন- ‘দু’এক কথায় যদি ব্যাখ্যা চান, তাহলে এভাবে মোটামুটি বলা যায় আমি বলেছি গণতন্ত্রকে বাংলাদেশের গ্রামের মানুষের কাছে পৌঁছে দেব। এ দেশে অনেক সাইনবোর্ডসর্বস্ব, বিবৃতিসর্বস্ব, শহরকেন্দ্রিক পেশাদার রাজনীতিবিদ রয়েছেন। এদের চেহারা আর চালচলন কাজকারবার বুঝে ফেলেছি। রাজনীতি করতে অসুবিধা হবে তাদের। তাদের মতো সবার জন্যই-আই হ্যাভ মেড পলিটিকস ডিফিকাল্ট।

তারপর বললেন ‘দুঃখ কী জানেন, নেতারা বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলতে পারেন। আপনাদের ‘বিচিত্রা’-র এক সাংবাদিককে আমি একবার এসব কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম-আমাদের বাংলাদেশের কোনো নেতাই ‘ইন টোটো’ নেতা নন। অর্থাৎ কোনো নেতাই সম্পূর্ণ নন। তারা কথা জানেন, সে সব কথা বলেন এবং সাজিয়েগুছিয়ে বেশি করেই বলেন। কিন্তু লক্ষ করলে দেখবেন, এসব কথা তারা বেশি বলেন ড্রইং রুমে বসে সন্ধ্যার পর। তাদের লোকজন বিবৃতি নিয়ে আপনাদের পত্রিকার অফিসে অফিসে ধাওয়া করেন। এরা আসলে কাজ করেন না। আবার এমন অনেকে আছেন যাদের কাজ করার আগ্রহ আছে। কিন্তু সংগঠন নেই বলে তারা পারেন না। আমি এই কাজ-পাগল অচেনা নেতাদের কাজে লাগাতে চাই।’

তিনি সবসময় চাইতেন জ্ঞানীগুণী, মেধাবী তরুণ ও যোগ্য নেতারা দেশের জন্য কাজ করুন। জিয়াউর রহমান তার উপদেষ্টামণ্ডলীতে যোগ্যতার দিক দিয়ে কিছু তারকাকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মুহাম্মদ শামসুল হক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য সৈয়দ আলী আহসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসন ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ প্রমুখ। অন্যদিকে ডা: বদরুদ্দোজা চৌধুরী, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা প্রমুখ তো ছিলেনই। ব্যারিস্টার হুদাকে তিনি স্থায়ী কমিটির সদস্য করেছিলেন। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৩৫ বছর।

১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান কমনওয়েলথ সরকারপ্রধানদের সম্মেলনে যোগ দিতে লন্ডন গিয়েছিলেন। তিনি লন্ডনে বেশ ক’জন বাংলাদেশী তরুণ পেশাজীবীকেও সাক্ষাৎ দেন। তাদের দেশে ফিরে জাতিগঠনে আত্মনিয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেন। তিনি তাদের কাছে সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনা ও কর্মসূচির কথা এবং তার ভবিষ্যৎ লক্ষ্য তুলে ধরেন। তাদের কয়েকজনকে দেশে ফিরে বিএনপিতে যোগ দিতে রাজি করাতে সক্ষম হন। তাদের মধ্যে ছিলেন ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া ও ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন।

একটি অভিযোগ হচ্ছে জিয়াউর রহমান একবার হিজবুল বাহার নামক একটি জাহাজে করে বাংলাদেশের মেধাবী ছাত্রদের নিয়ে গিয়েছিলেন বঙ্গোপসাগরে নৌবিহারে। সে বিষয়ে অনেকে তির্যক মন্তব্য করেন। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কেন তাদের নৌবিহারে নিয়ে গিয়েছিলেন বিরোধী মহল কিন্তু সেটা বিস্তারিত কখনো বলে না। কারণ সেটা খুলে বললে তাদের থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়বে। সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি আল মাহমুদ। তিনি ‘তৃষিত জলধি’ নামক তার একটি লেখায় তুলে ধরেছেন সেদিনের সেই ঘটনা। রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমানের মূল বক্তব্যটি অনেক বড়; সেজন্য শুধু বক্তব্যের চুম্বক অংশটুকু তুলে ধরা হলো। জিয়াউর রহমান মেধাবী সেসব ছাত্রদের উদ্দেশে বলেছিলেন- ‘শোন ছেলেমেয়েরা, আমি তোমাদের বাংলাদেশের ডাঙ্গা থেকে উত্তাল বে অব্ বেঙ্গলের মধ্যখানে নিয়ে এসেছি। সমুদ্র হলো অন্তহীন পানির বিস্তার ও উদ্দাম বাতাসের লীলাক্ষেত্র। এখানে এলে মানুষের হৃদয় একই সঙ্গে উদার ও উদ্দাম সাহসী হয়ে ওঠো অন্তত উঠতে বাধ্য। তোমার, আমার, বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের সঙ্কীর্ণতা ও কূপমণ্ডূকতাকে পরিহার করে সমুদ্রের মতো উদার ও ঝড়ো হাওয়ার মতো সাহসী হতে হবে। আমি তোমাদের কাছে এখন যে কথা বলব তা আমাদের জাতির জন্য এক ঐতিহাসিক তাগিদ। এই তাগিদকে স্মরণীয় করার জন্য আমি একটা পরিবেশ খুঁজছিলাম। হঠাৎ বঙ্গোপসাগরের কথা মনে পড়ল। এই উপসাগরেই রয়েছে ১০ কোটি মানুষের উদর পূর্তির জন্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত আহার্য ও মূল ভূমি ভেঙে আসা বিপুল পলিমাটির বিশাল দ্বীপদেশ-যা আগামী দু’তিনটি প্রজন্মের মধ্যেই ভেসে উঠবে; যা বাংলাদেশের মানচিত্রে নতুন বিন্দু সংযোজনের তাগিদ দেবে। আমাদের ভিটাভাঙা পলি যেখানেই জমুকতা তালপট্টি কিংবা নিঝুমদ্বীপ, এই মাটি আমাদের। দশ কোটি মানুষ সাহসী হলে আমাদের মাটি ও সমুদ্র-তরঙ্গে কোনো ষড়যন্ত্রকারী নিশান উড়িয়ে পাড়ি জমাতে জাহাজ ভাসাবে না। মনে রেখো, আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলছে। আমরা দশ কোটি মানুষ যথেষ্ট সাহসী নই বলে শত্রুরা, পররাজ্য-লোলুপ রাক্ষসেরা আমাদের পূর্বপুরুষদের এই স্বাধীন জলাধিকারে আনাগোনা শুরু করেছে। তোমরা বাংলাদেশের সবচেয়ে মেধাবী ছেলেমেয়ে, দেশের দরিদ্র পিতা-মাতার সর্বশেষ আশার প্রাণকণা, যাদের ওপর ভরসা করে আছে সারা দেশ, সারা জাতি। তোমরাই হলে বাংলাদেশের হাজার বছরের পরাধীনতার কলঙ্ক মোচনকারী প্রত্যাশার আনন্দ-নিঃশ্বাস।’

একজন প্রখ্যাত লেখক মহিউদ্দিন আহমদ ২০১৬ সালে ‘বিএনপি সময় অসময়’ নামে একটি বই লিখেছেন। বইটি পড়ে আমার কাছে মনে হয়েছে বেশ কিছু ক্ষেত্রে লেখক রাষ্ট্রপতি জিয়ার প্রতি সুবিচার করেননি। আরেকটু সচেতন ও নিষ্ঠাবান হলে বস্তুনিষ্ঠ বিষয়গুলো তুলে আনতে পারতেন। যাদু মিয়ার ভাই মোখলেসুর রহমানের একটি সাক্ষাৎকারকে উদ্ধৃত করে মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন, ‘জিয়া বাংলা লিখতে-পড়তে জানতেন না। প্রথম দিকে তিনি বাংলায় যে বক্তৃতা দিতেন, সেগুলো উর্দুতে লিখতেন। তারপর সেটি দেখে বক্তৃতা দিতেন। তিনি ভালো করে বক্তৃতা দিতে পারতেন না। দিতে গেলে খালি হাত-পা ছুড়তেন।’

মোখলেসুর রহমানের সাক্ষাৎকার তার বইতে এভাবে তুলে ধরেছেন- এসব দেখেটেখে যাদু একদিন আমাকে বলল যে, এ রকম হলে কী করে তাকে আমি চালিয়ে নেব? আমি বললাম- দেখো জিয়া বক্তব্য দিতে পারেন না, ঠিক আছে। তিনি সবচেয়ে ভালোভাবে কী করতে পারেন, সেটা খুঁজে বের করো। জবাবে যাদু বললেন, হাঁটতে পারেন এক নাগাড়ে ২০ থেকে ৩০ মাইল পর্যন্ত। বললাম এইতো পাওয়া গেল সবচেয়ে ভালো একটা উপায়, তুমি তাকে সঙ্গে নিয়ে পাড়াগাঁয়ে হাঁটাও। ... গাঁও গেরামের রাস্তা দিয়ে যাবে আর মানুষজনকে জিজ্ঞেস করবে, কেমন আছেন? প্রেসিডেন্ট দেশের মিলিটারি লিডার, তিনি গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কানাকানচি দিয়ে ঘোরাঘুরি করছেন আর লোকজনের ভালো-মন্দের খোঁজ খবর করছেন, তাতেই তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠবেন।’

লেখকের এই কথাগুলো যে কতটা সত্যের অপলাপ, তা কিন্তু জিয়াউর রহমানকে নিয়ে যে কোনো একটি ভালো বই পড়লেই জানা যায়। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর ডাক্তারি পড়ার ইচ্ছা বাদ দিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। ডাক্তারি পড়ার ইচ্ছা জিয়াউর রহমান ব্যক্ত করেছিলেন তার এক মামীর কাছে ওই সময়ে লেখা একটি চিঠিতে। তার মামা রুহুল আমিনের সৌজন্যে প্রাপ্ত বাংলায় লেখা ওই চিঠির একটি ফটোকপি হুবহু দেয়া আছে হেদায়েত হোসাইন মোরশেদ লিখিত ‘একজন জিয়া’ নামক গ্রন্থটিতে। যে কেউ চাইলে সেটা দেখে নিতে পারেন। চিঠিটি জিয়াউর রহমান তার মামীকে লিখেছিলেন ১/৪৯ জেকব লাইন, করাচি থেকে। জিয়া পাকিস্তানে বসেও কখনো উর্দুতে কথা বলতেন না। কেউ তার সঙ্গে উর্দুতে কথা বললে তিনি ইংরেজিতে জবাব দিতেন। আমরা যে বাঙালি, এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন খুবই সচেতন। (প্রেসিডেন্ট জিয়া, মাহফুজ উল্লাহ, পৃষ্ঠা-২৪) এ সময় ইংরেজিতে বক্তৃতা করতেও পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন তিনি। (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা-২১) আর এই যে হাঁটার অভ্যাস, এটা জিয়া রপ্ত করেছিলেন সেনাবাহিনীতে থাকাকালে। অন্যদিকে মওলানা ভাসানী গ্রামগঞ্জে হেঁটে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান সেই কর্মকাণ্ড দ্বারা প্রাণিত হয়েছিলেন। লেখক মহিউদ্দিন জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনী থেকে এসেছিলেন বলেও খেদোক্তি করেছেন; অথচ লেখক একটু লক্ষ করলেই দেখতে পেতেন বহু দেশের বহু জগদ্বিখ্যাত রাষ্ট্রপ্রধানরা এসেছিলেন সেনাবাহিনী থেকেই। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, উইনেস্টন চার্চিল, চার্লস দ্য গল এরা সবাই আর্মি থেকে আগত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফরাসি দেশের ত্রাণকর্তা দ্য গল একসময় ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এ ছাড়া জর্জ ওয়াশিংটন থেকে শুরু করে থিওডর রুজভেল্ট, আইজেন হাওয়ার এরকম প্রায় আমেরিকার অর্ধেক রাষ্ট্রপতি প্রতিরক্ষা বাহিনী থেকে এসেছিলেন। জিয়াউর রহমানের সবচেয়ে বড় লেগ্যাছি হচ্ছে তিনি বাংলাদেশের সব শ্রেণীর মানুষের মন জয় করে নিয়েছিলেন। অনেকের হয়তো সে কারণে গাত্রদাহ হয়।
জিয়াউর রহমান ছিলেন পত্রিকা ও সাংবাদিক বান্ধব। তিনি ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টকে সবসময় উৎসাহিত করতেন। সে বিষয়টি জানা যায় জিয়ার আমলের টাইমস পত্রিকার সাংবাদিক আলমগীর মহিউদ্দিন যিনি পরবর্তীকালে দৈনিক ‘নয়া দিগন্ত’ পত্রিকার সম্পাদক হয়েছে তার একটি লেখায়। ‘বিশ্ব নেতাদের চোখে জিয়া’ শিরোনামে তিনি লিখেছেন- টাইমসে তখন অনেক ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্ট ছাপা হতো। চাল সিন্ডিকেটসহ নানান খবর। এর মধ্যে একদিন এক ভদ্রলোক একটি বড় ফাইল নিয়ে এসে হাজির। তিনি পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা বলে পরিচয় দিয়ে বললেন, সফদার সাহেবের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু একটি কমিটি করেছিলেন ঢাকা-আরিচা রোডের বিশাল দুর্নীতি তদন্তের জন্য। কিন্তু তার ইন্তেকাল হওয়ায় বোধহয় এ তদন্তের ভাটা পড়েছে। আপনাদের লেখায় দেখি কাজ হচ্ছে। এ রিপোর্টটা যদি করতেন।’ সে কাজের ভার দেয়া হলো আমাদের আর এক রিপোর্টার খন্দকার মনিরুল আলমকে। তিনি বহু পরিশ্রম করে সম্ভবত পাঁচ পার্টে একটি রিপোর্ট তৈরি করলেন। প্রথা অনুযায়ী আমরা সম্পাদকের নেতৃত্বে রিপোর্টটা আলোচনা করার সময় সম্পাদক বললেন, আগামীকাল রাষ্ট্রপতির সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ আছে। দিন, রিপোর্টগুলো নিয়ে তার সঙ্গে আলাপ করব।’

আমরা খুশিই হলাম। প্রায় দুই সপ্তাহ পার হওয়ার পরও সম্পাদক রিপোর্টটা নিয়ে কোনো কথা বলছেন না বলে জিজ্ঞাসা করলাম এর ভাগ্যটা জানতে। তিনি বললেন, রাষ্ট্রপতি জিয়া রিপোর্টটা ছাপতে মানা করে দিয়েছেন।’ কষ্ট লাগল। কারণ এক সাক্ষাতে জিয়া তার ‘চোখ-কান’ হিসেবে সাংবাদিকদের আখ্যায়িত করেছিলেন। ভাগ্যক্রমে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কয়েক সপ্তাহ পর আমার এক পার্টিতে দেখা। সুযোগ নিয়ে বললাম, স্যার, আপনি আমাদের আপনার চোখ-কান বলে আখ্যা দিয়েছেন; অথচ ঢাকা-আরিচা রাস্তার দুর্নীতির খবর ছাপতে নিষেধ করলেন।

তিনি বললেন, হ্যাঁ, আপনাদের সম্পাদক বলেছিলেন এমন একটা রিপোর্টের কথা। তাকে তো ছাপতে বলেছি এবং কথা দিয়েছিলাম, অ্যাকশন নেবো। কই আপনারাই তো ছাপলেন না। ছাপুন না।

রাষ্ট্রপতি জিয়া সেই ডিপার্টমেন্টকে নির্দেশ দেন অনুসন্ধান করতে। আমাদের রিপোর্টের উল্লিখিত নথি দেখে সম্ভবত ১৮ জন সম্পর্কে কাগজপত্র পাওয়া যায়। তাদের সবাইকে চাকরিচ্যুত করেন জিয়া। (রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান, সম্পাদনা শফিক রেহমান, পৃষ্ঠা-৮৬-৮৭)। এই ঘটনা থেকে ধারণা করা যায় জিয়া কী ধরনের মানুষ ছিলেন।

এছাড়া জাতীয় প্রেস ক্লাবও জিয়াউর রহমানেরই অবদান। প্রিন্স করিম আগা খান প্রেস ক্লাব ভবন নির্মাণে ব্যয় বহন করার অঙ্গীকার করেছিলেন। ১৯৭৬ সালে প্রেস ক্লাবের নৈশভোজে যোগ দিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। তিনি বলেছিলেন, নিজেই প্রেস ক্লাব ভবন নির্মাণের ব্যয়ভার বহন করবেন। সে হিসেবে ১৯৭৭ সালে বর্তমান জায়গাটি জাতীয় প্রেস ক্লাবের অনুকূলে বরাদ্দ দেন। সেই সঙ্গে জমির দাম পরিশোধের জন্য ২৭ লাখ ৬৪ হাজার টাকা ক্লাবকে অনুমোদন দেন। জমির দলিলের খরচও মওকুফ করে দেন। ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এই ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং নতুন ভবন নির্মাণের লক্ষ্যে প্রেস ক্লাবকে দেয়া হয় ২৫ লাখ টাকা অনুদান। (প্রাগুক্ত-১৩১)।

এ ধরনের বহু প্রতিষ্ঠান গড়তে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তিনি শিশু হাসপাতালটি তৈরির সময় মরহুম রফিকুল হকের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ৫০ লাখ টাকা। ১৯৭৮ সালে ৫০ লাখ টাকা মানে এ সময়ের কম করে হলেও ১০০ কোটি টাকার সমান। জিয়াউর রহমানের ৫০ লাখ টাকা প্রদানের ঘটনাটি ব্যারিস্টার রফিকুল হকের সামনে বসে শুনেছিলাম বলে সেটা উল্লেখ করছি। সেটা ওয়ান-ইলিভেনের কথা। দু’নেত্রীই তখন জেলে। তাদের পক্ষে লড়বার মতো কোনো আইনজীবী খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অবশেষে এগিয়ে এলেন ব্যারিস্টার রফিকুল হক। তিনি প্রথমে শেখ হাসিনার মামলা হাতে নিলেন। আশার আলো জ্বলে উঠল। একদিন আমার চাচা (আব্বার বন্ধু) অ্যাডভোকেট শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসের নেতৃত্বে ব্যারিস্টার নাসিরুদ্দিন অসীম, ব্যারিস্টার কায়সার কামাল ও আমি সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়ার ফাইলপত্র নিয়ে হাজির হলাম রফিকুল হকের দরবারে। ব্যারিস্টার রফিকুল হক জিয়াউর রহমান ও বেগম জিয়ার ভূয়সী প্রশংসা করলেন এবং বেগম জিয়ার পক্ষে মামলা লড়ার জন্য সম্মতি দিয়ে চলে গেলেন উপরে, দোতলায়। আমরা তো বসেই আছি। তিনি আর নামেন না। কিছু সময় পরে ক্লার্ক মারফত খবর পাঠালেন, টাকা ছাড়া মামলা লড়বেন না। আমরা কেউ-ই সঙ্গে করে টাকা নিয়ে যাইনি। শিমুল বিশ্বাস দ্রুত ছুটে বেরিয়ে গেলেন। আধাঘণ্টা পরে শিমুল বিশ্বাস ফিরে এলেন দু’লক্ষ টাকা নিয়ে। সেই টাকা পাঠানো হলো। তারপর তিনি দোতলা থেকে নামলেন। আমার বন্ধু ও চট্টগ্রামের অন্যতম নেতা ব্যারিস্টার মীর হেলালও তখন জেলে। হেলালের জন্যও আমাকে যেতে হতো ব্যারিস্টার রফিকুল হকের চেম্বারে। ৭/৮ বার গিয়েছিলাম চেম্বারে। তিনি প্রসঙ্গক্রমে একদিন বললেন- অনেক ভালো মানুষ ও রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন জিয়াউর রহমান। শেখ মুজিবুর রহমানের প্রয়াণের পর জিয়া একদিন ডেকে পাঠালেন আমাকে। বললেন- আপনি তো শেখ মুজিবের সঙ্গে কাজ করেছেন। আমার সঙ্গে কি কাজ করবেন? রফিকুল হক বললেন আমি তো আসলে একজন দর্জি। আমাকে যে যা বলবে সেটাই তৈরি করে দেবো। বঙ্গবন্ধু মুজিব কোট চেয়েছিলেন তাকে সেটা বানিয়ে দিয়েছি। আপনি যদি সাফারি চান, আমি সাফারি বানিয়ে দেবো। পকেট যদি দুটোর বদলে চারটা চান, চারটা পকেট বানিয়ে দেবো। জিয়াউর রহমান বললেন- আপনাকে ফি কত দিতে হবে? রফিকুল হক বললেন- দেশের কাজে কোনো ফি নেবো না। জিয়াউর রহমান বললেন- ফি ছাড়া কাউকে দিয়ে আমি কোনো কাজ করাই না। রফিকুল হক বললেন- আচ্ছা দেখা যাবে। ব্যাংকিং খাতের বহুকাজ জিয়াউর রহমান করালেন রফিকুল হককে দিয়ে। কাজ শেষে জিয়া জিজ্ঞেস করলেন, কত দিতে হবে আপনাকে। রফিকুল হক বললেন- আমাকে কিছু দিতে হবে না। তবে সদ্য প্রতিষ্ঠিত, আমার শিশু হাসপাতালের জন্য কিছু অনুদান দিন। জিয়া তাকে ৫০ লাখ টাকা দিলেন। শেখ হাসিনার মামলার জন্য তখন শুধু বর্তমানে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র তাপসকে শুধু উনার চেম্বারে বসে থাকতে দেখেছি। আজ হয়তো সবই আওয়ামী লীগ। কিন্তু তখন শেখ হাসিনার মামলার জন্য তাপস ছাড়া আর কাউকে দেখিনি।

জিয়াউর রহমান হচ্ছেন একটি রাজনৈতিক দর্শন; তিনি একটি বৈপ্লবিক চেতনা। তিনি একটি প্রতিষ্ঠান, সর্বোপরি জিয়াউর রহমান হচ্ছেন একটি ইতিহাস। তিনি যে কতটা জনপ্রিয় ছিলেন তার জাজ্বল্যমান প্রমাণ তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে মানুষের ঢল নেমেছিল ১৯৮১ সালের ২ জুন। ২০ লাখ মানুষ যোগ দিয়েছিলেন তার শবানুগমনে। এটা একটি ইতিহাস। এই উপমহাদেশে কারো মৃত্যুতেই এমন মানুষের ঢল নামেনি। শুধু মহাত্মা গান্ধীর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে হয়েছিল ২০ লাখ মানুষ। মনে রাখতে হবে ভারতের জনসংখ্যা তখন ছিল ৫০ কোটি আর বাংলাদেশে মাত্র ১০ কোটি।

নেহরু যখন মৃত্যুবরণ করেন তার শেষকৃত্যে মানুষ হয়েছিল ১৫ লাখ। আর রবীন্দ্রনাথের পাঁচ লাখ। এতেই বোঝা যায়, মানুষের কী পরিমাণ ভালোবাসা পেয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। শেষ করব ‘নয়া দিগন্ত’ পত্রিকার সম্পাদক আলমগীর মহিউদ্দিনের একটি স্মৃতিচারণ দিয়ে। তিনি লিখেছেন- জিয়াউর রহমান সিকিউরিটির নির্দেশিত পথে না চলে, সোজা গ্রামের মধ্যে চলে যেতেন। সাধারণ মানুষকে তাদের সুখ-দুঃখের কথা জিজ্ঞাসা করতেন। তার কুষ্টিয়ার হাঁটার প্রোগ্রামের বছর দুই পর ওই এলাকায় আমাকে আবার যেতে হয়েছিল। হঠাৎ মনে হলো, যে বাড়িটির ওপর দিয়ে তিনি হেঁটে গিয়েছিলেন, তারা তাকে মনে রেখেছে কি না! সে বিষয়টা একটু জানা দরকার। গিয়ে বিস্মিত না হয়ে পারিনি। সে বাড়ির যতটুকু এলাকার ওপর তিনি হেঁটে গিয়েছিলেন এবং যেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলেছিলেন, তা বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে স্মৃতি হিসেবে। (রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান, সম্পাদনা শফিক রেহমান)। জিয়াউর রহমানের প্রতি মানুষের ভালোবাসা কেউ কোনো দিন কেড়ে নিতে পারবে না।
লেখক : সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট


আরো সংবাদ



premium cement