২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ক্রাউন প্রিন্স হলে চলবে না

ক্রাউন প্রিন্স হলে চলবে না - ফাইল ছবি

একবার আবুধাবির ক্রাউন প্রিন্স শেখ মুহাম্মদ বিন যায়েদ বিন সুলতান আল-নাহিয়ান পাকিস্তানের একজন বেশ শক্তিধর ব্যক্তিকে বললেন, আপনার স্বদেশী আমাদের দেশে সব অসম্ভবকে সম্ভব করে দেন এবং অবিশ্বাস্য সফলতা অর্জন করেন। কিন্তু এর কি কারণ যে, এই পাকিস্তানিই তার দেশে এমন সফলতা অর্জন করতে পারেন না? এ প্রশ্ন শুনে পাকিস্তানের শক্তিধর ব্যক্তি মুচকি হেসে বললেন, আপনি নিজের দেশে শুধুই একজন ক্রাউন প্রিন্স। আপনার প্রতিটি আদেশ আইনের মর্যাদা রাখে। আর আপনার ন্যায়সঙ্গত নির্দেশ নিয়ে কারো কোনো সংশয়ও নেই। কিন্তু পাকিস্তানে তো প্রত্যেকে নিজেই নিজেকে ক্রাউন প্রিন্স ভাবে। এ কারণে আপনার এখানকার পরিস্থিতি আর আমাদের ওখানকার পরিস্থিতির মাঝে বহু পার্থক্য। অন্য ভাষায়, পাকিস্তানের এই অরাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি আবুধাবির ক্রাউন প্রিন্সকে এটা বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, আপনার দেশে রাজতন্ত্র আছে, আর পাকিস্তানে আছে গণতন্ত্র। এটা সেই পার্থক্য, যা আমাদের রাজনৈতিক শাসকদের এখনো বোধগম্য হয়নি। তাদের রোলমডেল এখনো সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমান। বিন সালমানের শাসনপদ্ধতি সৌদি আরবের জন্য বেশ ভালো হতে পারে, কিন্তু তার শাসনপদ্ধতিকে পাকিস্তানে রোলমডেল বানানো যেতে পারে না। কেননা পাকিস্তানে রয়েছে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র। এখানে কেন্দ্রে তেহরিকে ইনসাফ ও তার জোটের শাসন চলে, আবার সিন্ধুতে পিপলস পার্টিরও শাসন চলে। এখানে প্রধানমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী মিলে সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে মামলা তৈরি করতে চাইলে এফআইএর (ফেডারেল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি) প্রধান তাদের সেই আইন স্মরণ করিয়ে দেন, যার অধীনে পাকিস্তান পরিচালিত হয়।

প্রধানমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী যখন এই বিচারকের বিরুদ্ধে একটি রেফারেন্স তৈরি করে প্রেসিডেন্টের মাধ্যমে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে প্রেরণ করেন, তখন সুপ্রিম কোর্ট ওই রেফারেন্স প্রত্যাখ্যান করে দেন। বিরোধী দল অভিযোগ করে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ন্যাব (ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিবিলিটি ব্যুরো) তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ন্যাব বারবার জাতীয় পরিষদের বিরোধীদলীয় নেতা শাহবাজ শরিফকে গ্রেফতার করেছে এবং আদালত প্রতিবারই তাকে মুক্তি দিয়েছেন। তবুও ক্রাউন প্রিন্স হওয়ার খায়েশ হ্রাস না পেয়ে বরং বেড়েই চলেছে। যত এ খায়েশ বেড়ে চলেছে, পাকিস্তানে রাজনৈতিক উত্তেজনাও ততই বেড়ে চলেছে। যে সময়ে বিশ্ব করোনাভাইরাসের সাথে লড়াই করছে, তখন পাকিস্তানিরা একে অন্যের সাথে লড়াই করছে।

এই চিন্তাধারার ব্যাপারে ভাবুন, যা করোনাভাইরাস মোকাবেলার জন্য সরকার ও বিরোধী দলকে এক করার পরিবর্তে এ নির্দেশ দিয়ে দেবে যে, ‘জাভেদ লতিফকে বিশ্বাসঘাত-কতার অভিযোগে গ্রেফতার করো।’ মিডিয়ায় যেই খোলাখুলি সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা করে, তাকে গ্রেফতার করানোর খায়েশ পাকিস্তানকে সামনে নয়, পেছনে নিয়ে যাবে। পাকিস্তান কোনো ক্রাউন প্রিন্স তৈরি করেনি। বরং একজন রাজনীতিবিদ কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ তৈরি করেছেন। পাকিস্তানকে শুধুই তার চিন্তাধারায় চালানো যেতে পারে। আজ অনেকে পাকিস্তানকে কায়েদে আজম নয়, বরং মুহাম্মদ বিন সালমানের পাকিস্তান বানাতে চাচ্ছে। ইনি আমাদের বন্ধু। আমরা একজন বন্ধু হিসেবে তাকে যথাযথ সম্মান করি; কিন্তু আমরা পাকিস্তানে রাজতন্ত্র মেনে নেবো না।

পাকিস্তানের সমস্যার সমাধান স্বৈরতন্ত্রেও নেই, রাজতন্ত্রেও নেই। সমাধান রয়েছে ব্যাপক গণতন্ত্রে। প্রথমে আমাদের পাকিস্তানের সমস্যার সমাধান করতে হবে। এরপরই আমাদের বিশ্বের সমস্যারও সমাধান করতে হবে। নির্মম উপহাস দেখুন, আমরা পাকিস্তানে একে অন্যের সাথে দা-কুমড়ার মতো আচরণ করি, আমরাই কখনো সৌদি আরব ও ইরানের মাঝে মধ্যস্থতা করতে বেরিয়ে পড়ি এবং কখনো আফগান তালেবান ও আমেরিকার মাঝে আলোচনার জন্য ভূমিকা পালন করি।

আফগানিস্তানে শান্তিপ্রতিষ্ঠার খায়েশ বেশ ভালো বিষয়; কিন্তু পাকিস্তানকে এ ভূমিকাটা নিরপেক্ষভাবে পালন করা উচিত। পাকিস্তান কখনো আফগান তালেবানের জোটভুক্ত হয়ে যায়; কখনো আমেরিকার। আবার আমাদের এ কথাও শুনতে হয় যে, আশরাফ গনির সাথে বিষয়গুলো চূড়ান্ত করা তো বেশ সহজ। কিন্তু তালেবানের সাথে সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন। যখন থেকে তালেবান ইস্তাম্বুল কনফারেন্সে অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছে, তখন থেকে পাকিস্তান ও দোহায় থাকা তালেবান নেতাদের সম্পর্কের মাঝে বেশ প্রভাব পড়েছে। আফগান তালেবানের অভিমত, তারা আমেরিকার সাথে দীর্ঘ আলোচনার পর একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল যার শর্তানুযায়ী পয়লা মে, ২০২১-এর মধ্যে আফগানিস্তান থেকে আমেরিকাকে তার সৈন্য সরিয়ে নেয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাইডেন প্রশাসন পয়লা মের পরিবর্তে এগারো সেপ্টেম্বরের মধ্যে সৈন্য সরিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তালেবানের ধারণামতে, এটা লিখিত চুক্তির বিরোধিতার নামান্তর। এ কারণে তারা ইস্তাম্বুল কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান, যা ২৪ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়ার কথা। ওই কনফারেন্সের উদ্দেশ্য ছিল তালেবানকে একটি মিশ্রিত সরকারে অংশগ্রহণে রাজি করানো। তালেবানের ধারণা, তারা বিগত একুশ বছর ধরে আমেরিকা ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে এ জন্য আন্দোলন করেনি। কারণ এটা তাদের একটি মিশ্র সরকারে শামিল হওয়ার নামান্তর। তারা সবাইকে নিয়ে চলার জন্য প্রস্তুত, কিন্তু তারা নিজস্ব সরকার গঠন করতে চায়। তাদের পক্ষ থেকে স্পর্শকাতরতাহীন মনোভাব সুনিশ্চিত।

পাকিস্তান ‘এক এগারো’র পর যখন তালেবানের ব্যাপারে নীতি পরিবর্তন করেছিল, তখনই আফগান রাষ্ট্রদূত মোল্লা আবদুস সালাম যায়িফকে উলঙ্গ করে আমেরিকার হাতে তুলে দেয়। মোল্লা যায়িফ কয়েক বছর মার্কিন কারাগারে বন্দী ছিলেন। মুক্তির পর তিনি একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। ওই গ্রন্থে তিনি বলেন, পাকিস্তানের ক্ষমতাবান দফতরগুলোর ওপর কখনো ভরসা করা যায় না। ২০১৮ সালে পাকিস্তান তালেবান নেতা মোল্লা আবদুল গনি বারাদারকে আট বছর কারাবন্দী রাখার পর মুক্তি দেয় এবং এ আশা করে যে, এ কয়েদি এখন আমেরিকার সাথে আলোচনা করবে ও আমেরিকার শর্তানুযায়ী, আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করাবে।

পাকিস্তানকে তালেবানের ‘গডফাদার’ হওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত ছিল। পাকিস্তানের ক্ষমতাধররা না তালেবানের গডফাদার হতে পারবেন, না পাকিস্তানিদের ক্রাউন প্রিন্স হতে পারবেন। এখন তালেবানকে বলা হচ্ছে, শান্তি আলোচনায় ফিরে আসো, নতুবা আমাদের থেকে খারাপ কিছু প্রকাশ পাবে। তারা জবাবে বলছে, আমরা সুপার পাওয়ারের ধমককে পাত্তা দিইনি, আপনাদের ধমককেও আমরা কিছুই মনে করি না।’ আমাদের তালেবানকে শাহবাজ শরিফ, আসিফ জারদারি ও জাহাঙ্গীর তারিন ভাবা উচিত নয় যে, দুই-চারটি মামলা দিয়ে দাও। জেলে পাঠাও। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

ক্রাউন প্রিন্স হয়ে আপনি আপনার বিরোধী দলকেই তো সামলাতে পারবেন না, তাহলে তালেবানকে কিভাবে সামলাবেন? সুতরাং হাতজোড় করে অনুরোধ করছি, ক্রাউন প্রিন্স হওয়ার চেষ্টা করবেন না। পাকিস্তানের সমস্যা গণতান্ত্রিকভাবে সমাধান করুন। শুধু তালেবানই নয়, বরং পুরো আফগানিস্তানের জন্য রোলমডেল হওয়ার চেষ্টা করুন।

পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ২৯ এপ্রিল, ২০২১ হতে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট, প্রেসিডেন্ট জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)


আরো সংবাদ



premium cement